তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১১+১২

0
257

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১১.
কলেজ শেষে আজ দু বান্ধবী ফুচকা খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে। এখানের ফুচকাটা দারুন। বিশেষ করে তিন ধরনের আলাদা স্বাদের টকের জন্যই এই মামার ফুচকার এত কদর। প্রতি প্লেট পঞ্চাশ টাকা। আজ বিলটা অন্তির পক্ষ থেকে। লম্বা সিরিয়াল পরেছে। কম করে হলেও বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অন্তি ভীর ঠেলে দু প্লেট ফুচকার অর্ডার দিলো। অদ্ভূত ভাবে দোকানদার তাকে দেখতেই এক গাল হেসে বললো,

‘একটু দাঁড়ান আপা, এহনি দিতাছি।’

অন্তি একটু অবাক হলো। সচরাচর অর্ডার দিলে লোকটা ভিষণ ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে,

‘দেরী হইবে আপা। লাইনে দাঁড়ান।’

সেখানে আজ এত মধু মিশিয়ে কথা বলছে? নিশ্চই ব্যাটা ভালো মুডে আছে। অন্তি আর পাত্তা দিলো না। ব্যস্ত হলো খোশগল্পে। কিন্তু তাদেরকে দ্বিতীয় বারের মতো চমকে দিয়ে এক মিনিটের মাথায় দু প্লেট ফুচকা হাতে হাজির হলো লোকটা। অন্তির সাথে সাথে তন্নির চোখেও রাজ্যের বিষ্ময়। বিস্ময় কে আরো একধাপ এগিয়ে দিতেই লোকটা বিনয়ী স্বরে বললো,

‘আপা চেয়ার দেই? রোদ্দুরে খারাই আছেন, ছায়ায় আইসা বহেন?’

তন্নির মুখ এক ইঞ্চি পরিমান ফাঁকা হয়ে আ হয়ে আছে। অন্তি ফিসফিস করে বললো,

‘দোস্ত কোনোভাবে কি আমরা সেলিব্রিটি হয়ে গেছি?’

‘নো ওয়ে! আমরা তো টিকটক করি না!’

দুজনের মাঝের কৌতুহল এখানেই চাপা পড়লো। কিন্তু তাদের দমে যাওয়া কৌতুহল পুনরায় আবির্ভাব হলো বিল পে করার সময়। একশত টাকার নোট এগিয়ে দিতেই লোকটা চমকে বলে ওঠেন,

‘আপা টাকা লাগবে না। আপনেরা যান। আবার আসবেন। যখন মন চাইবে চইলা আসবেন।’

এ পর্যায়ে অন্তি আর তার মুখ বন্ধ রাখতে পারলো না।

‘বিল কেন লাগবে না মামা?’

লোকটার মুখের হাসিভাবটা ভোতা হয়ে এলো। কিছুটা আমতা করে বললো,

‘আপনাগো আমি মনে মনে সৎ বোন ভাবি তাই লাগবে না আপা। আপনারা এখন যান আপা। বাইরে রোদ্দুর খুব।’

লোকটা তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অন্তির ব্যাপারটা মোটেও সুবিধার লাগলো না। চেনেনা জানেনা কেউ তাকে মনে মনে বোন ভাবলেই কে হলো নাকি? অন্তি টাকাটা লোকটার পাশে রেখে বললো,

‘পরেরবার বিশ্বাসযোগ্য কোনো অযুহাত দিবেন। তখন ভেবে দেখবো।’

অন্তি আর তন্নি চলে গেল। তারা যেতেই লোকটা কাউকে কল করলো। খুব অস্বস্তি নিয়ে মিনমিন করে বললো,

‘ভাই ভাবী আসছিলো। আমি টাকা নিতে চাই নাই। জোর কইরা দিয়া গেল। যাওয়ার সময় বলছে, পরেরবার বিশ্বাসযোগ্য অযুহাত দিতে।’

দিহান সবটা শুনে ছোট করে বললো,

‘আচ্ছা।’

কল কেটে বিরবির করে বললো,

‘গোবরে তবে পদ্ম ফুটেছে! মাথায় বুদ্ধি তবে অল্প স্বল্প আছে! নট ব্যাড।’

দিহানের ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। তা দেখে নুহাশ কাতর স্বরে বললো,

‘দোস্ত যা খুশি কর কিন্তু ব্যাপারটা প্লিজ আমার জন্য জটিল করিস না। তোর প্রেমের উপর আমারটা ডিপেন্ড করছে। দোহাই লাগে তোর!’

____________

অন্তিদের বাড়িতে আজ তার মায়ের দুঃসম্পর্কের এক বোন এসেছে। সাথে এসেছে তার মেয়ে। নাহার তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভালো মন্দ রান্না হয়েছে। অন্তি সেই দুপুর থেকে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। সেই দূর আত্মীয়ের মেয়েটা তার রুমে আস্তানা গেঁথে বসে আছে। এতেই চরম বিরক্ত সে। শুধু বসে থাকলেও হতো কিন্তু এই মেয়ে রিতিমত তার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘আচ্ছা আপু তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?’

মেয়েটার কথায় দারুন বিরক্ত হয়ে অন্তি বললো,

‘থাকলেও বা কি?’

‘তেমন কিছু না। আমার বয়ফ্রেন্ড ছাত্রলিগের সাথে জড়িত। তোমার কোনো সাহায্য লাগলে আমি ওকে বললেই হয়ে যাবে তাই আর কি।’

অন্তির মুখ আ হয়ে গেছে। অবাক হয়ে বললো,

‘তুমি কোন ক্লাসে পড়ো যেন?’

এ কথায় মেয়েটা কিছুটা বিরক্ত হলো। বললো,

‘এই নিয়ে তিনবার বলছি, ক্লাস স্যাভেন।’

অন্তি ভেবে পায়না এটুকু একটা মেয়ের ও বয়ফ্রেন্ড আছে! পরক্ষণে মনে হয় এতদিনে তার প্রেমটাও হয়ে যেত যদি দিহান মানুষ হিসেবে আর পাঁচটা স্বাভাবিক পুরুষের মতো হতো। কিন্তু লোকটাতো একটা পাষাণ। হৃদয়হীন মানুষ।

‘বলোনা তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?’

‘না।’

‘আমি খুঁজে দিব একটা?’

এ পর্যায়ে অন্তি মেয়েটাকে ধমক দিলো। মেয়েটা তৎক্ষণাৎ সুর সুর রুম থেকে বের হয়ে গেল। সে যাওয়া মাত্র অন্তি বড় করে শ্বাস ফেলল। এমন বিচ্যু মেয়ে কিভাবে সামলায় আন্টি আল্লাহ জানেন।

বাহিরে মুষোল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কাঁচের জানালায় ফোটা ফোটা বৃষ্টিকণা জমে আছে। বেশ কিছুদিন ধরেই রাতের দিকে এমন বর্ষণ হয়। অন্তির চোখে ঘুম নেই। রুম অন্ধকার করে বসে আছে। মনের মধ্যে অদ্ভুত অশান্তি হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে। দিহানকে ছাড়া তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় আজকাল। মানুষটা কেমন মনের সাথে রক্তেও মিশে গেছে। বিছানা হাতড়ে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দিহানের নম্বর ডায়াল করলো। এটা তার নতুন নম্বর। দিহান রিসিভ করলো একটু সময় নিয়ে। রিসিভ করেই তার চিরচেনা গম্ভীর স্বরে শুধালো,

‘কি চাই?’

অন্তি কিছু বললো না। চুপ করে ওপাশের মানুষটাকে অনুভব করতে চাইলো। দিহান তখন ল্যাপটপে কিছু একটা করতে ব্যস্ত। কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে থাই দেওয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এক হাতে সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে তাতে আগুন লাগালো। তখনো ওপাশের মানুষটা নিরব। দিহান তপ্ত শ্বাস ফেলল। ধীর গলায় শুধালো,

‘কতদিন এভাবে লুকোচুরি করবে? কাল মিট করো।’

ঐভাবে ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পারেনি অন্তি। সোজা হয়ে বসে শক্ত করে ফোন কানে চেপে রাখলো। মিনমিন করে বললো,

‘কিভাবে বুঝলেন?’

দিহান ঠোঁট কামড়ে হাসে।

‘দিহান মির্জাকে কল করে চুপ করে থাকার মতো সাহস একটা পিচ্চি মেয়ে ছাড়া কেউই করে না।’

অন্তি নাক ফুলায়। গলার স্বর চড়াও করে বলে,

‘আমি পিচ্চি না। যথেষ্ট বড়।’

কথাটা বলে খানিক থেমে আবার বলে,

‘আপনিকি একজন্যই আমায় ইগনোর করছেন?’

কথাটা বলার সময় তার গলা কাঁপে অল্প। দিহান ছোট করে উত্তর দেয়,

‘না।’

‘তাহলে? প্রেমিকা আছে আপনার?’

চঞ্চল স্বর বলে উঠে অন্তি। দিহান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে,

‘প্রেমিকা নেই তবে বউ আছে। তুমি জানতে না?’

অন্তি জবাব দিলো না। খট করে কেটে দিলো কল। দিহান থতমত খেয়ে গেল। আবার কি হলো? খানিক সময় মোবাইলে দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। এসব পিচ্চি পাচ্চা মেয়ের সাথে কি আদেও প্রেম করা যায়? জাস্ট ইমপসিবল! এই প্রেম তাকে দিয়ে হবে না।

অন্তি কল কেটে রাগে ফুঁসছে। লোকটা আবারো তাকে মিথ্যা বলছে। পাষাণ লোক! আর কখনো সে কল করবে না অসভ্য লোকটাকে। অন্তির মাঝে মধ্যে মনে হয় এই মানুষটা পৃথিবীর সবচাইতে বিরক্তিকর একজন মানুষ। রস-কষ হীন তেতো একটা মানব। যার প্রতিটা কথায় মুক্তর বদলে নিমের ফল ঝরে। কখনো তো তার ইচ্ছা হয় লোকটার কান টেনে ধরে বলতে,

‘আজ থেকে ফ্রিতে টিউশন দিবো আপনায়। তিন বেলা নিয়ম করে সুন্দর করে কথা বলতে শিখবেন। নয়তো নর্দমার মাঝে কান ধরিয়ে দাড় করিয়ে রাখবো।’

মানে একটা মানুষ কতটা অসহ্য হলে এমন কাঠ কাঠ কথা বলতে পারে! অন্তি হাতের ফোন বেডে ছুঁড়ে মারলো। বিরবির করে বললো,

‘তোর আর তোর বউয়ের একটা একটা করে চুল ছিঁড়বো আমি। যাস্ট ওয়েট। অসভ্য লোক!’
___________

দিনটা শুক্রবার। আকাশে আজ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। বৃষ্টি শেষে এমন ঝলমলে দিন যেন সকল ক্লান্তি দূর করতে যথেষ্ট। কি সুন্দর রূপ প্রকৃতির! চায়ের দোকানে আড্ডা বসেছে। নাহিদ নামের ছেলেটা দারুন গান গায়। ভার্সিটিতে থাকা কালিন এভাবে গোল হয়ে বসে কতো গান গেয়েছে! আজ সে দিনগুলোর কথা ভিষণ মনে পড়ে। জীবন কিভাবে কোন দিকে মোড় নিলো খুঁজে পায়না নুহাশ। দিহান ছিলো ডিপার্টমেন্টের টপ স্টুডেন্ট। ওর ব্রাইট ফিউচার নিয়ে সকলেই আশাবাদী ছিলো। কিন্তু শেষে এসে কি হলো? টেনেটুনে পাশ করা নুহাশ আর সে একই চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন। যেখানে তাদের মহৎ কোনো কাজের জন্য পোষ্টারে, খবরের কাগজে তাদের নাম ওঠার কথা,‌সেখানে তাদের নাম হয়েছে গুন্ডা! এমনটা না হলেও তো পারত!
নুহাশের চোখ ঘোলাটে হয়ে আসে। পাশ থেকে সুমন হাত দিয়ে তাকে ঠেলা দেয়। মজা করে বলে,

‘কি মামা! মোন কই গেছে? আমাদের বলো, খুঁইজা আইনা দেই।’’

নুহাশ শ্বাস ছেড়ে বলে,

‘তিন রাস্তার মোড় থেকে বা হাতে নাক বরাবর চলে গেলে নীল রঙের তিনতলা একটা বাড়ি আছে। ঐ বাড়ির মালিকের ছোট মেয়ের কাছেই আছে। যা নিয়া আয়।’

সুমন দাঁত বের করে হাসে। চোখ টিপে বলে,

‘শুধু মোন আনলেই হবে? নাকি মাইয়াও লাগবে!’

নুহাশের মেজাজ খারপ হয়। দাঁত খিচে দিহানের দিকে তাকায়। দিহান অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোয়াচ্ছে। নুহাশ পুনরায় সুমনের দিকে তাকিয়ে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সাবধানি কন্ঠে বলে,

‘এসব বাজে ইঙ্গিত দ্বিতীয়বার আমায় দিবি না। ভুলেও না।’

চলবে…………

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১২.
পাঁচতলা ভবনের গেটের সম্মুখে দাঁড়িয়ে এক মাঝ বয়সী লোক। পড়নে সাদা রঙের ফতুয়া সাথে ঢোলা প্যান্ট। হাতে চামড়ার ব্যাগ। মাথার অর্ধেকাংশেই চুলের অস্তিত্ব নেই। অনেকক্ষণ ধরেই গেটের সামনে চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করে চলছেন ভদ্রলোক। গেটের ভেতরে যাবেন কি যাবেন না তা নিয়ে সংশয়ে ভুগছেন তিনি। গেটের দাড়োয়ান হাসি হাসি মুখ করে বললেন,

‘আর কতক্ষণ দাঁড়াই থাকবেন মজনু ভাই? স্যারে সেই কখন আপনারে ডাকছেন। বেশি দেরি করলে আবার চাকরি নট! জানেন-ই তো!’

মজনু বিরক্ত চোখে তাকায়। ধমক দিয়ে বলে,

‘কথা কম বলতে পারেন না? চাকরি নট হলে হোক। আপনার স্যারের হাতে মান সম্মান খুয়ানোর থেকে চাকরি নট হওয়া ভালো।’

দারোয়ান লোকটার চোয়াল ঝুলে পড়লো যেন। গলার স্বরে বিস্ময় ঢেলে বললো,

‘কি বলেন ভাই! আপনের চাকরি‌ নট হওয়ার ভয় নাই? আপনের তো ভাই মেলা বড়ো কলিজা!’

মজনু মিয়া কথা বললো না। তবে তার কলিজা বড়ো বটে! নয়তো এই অসভ্য বাপ ছেলের চক্করে নিজের জীবন জরায় কখনো? চিন্তায় চিন্তায় তার বিপি লো হয়ে পড়েছে। এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।

মজনু মিয়া পায়চারি বন্ধ করে শান্ত ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ কিছু একটা ভাবলেন পরপর উল্টো পায়ে চলতে শুরু করলেন। রেজওয়ান মির্জার কোনো কল সে আর রিসিভ করবে না, আর না করবে দিহান মির্জার কল। এই বাপ ছেলে দুটোই অতিব মাত্রায় অসভ্য। এই অসভ্য পরিবারের অসুস্থ চাকরি সে আর করবে না।

মজনু মিয়ার ফোন বাজছে। ফতুয়ার পকেটে রাখা ফোনটা কেঁপে উঠছে থেকে থেকে। মজনু জানেন কে কল করেছে। রিসিভ করলেই কথার দু চারটা মার পরবে তার উপর সেটাও তার জানা। মজনু মিয়া দাঁড়ালেন, পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনটার লাল বাটন চেপে ধরে অফ করে দিলেন সংযোগ। এতেও তার হৃদতুষ্ঠি হলো না। সিমটা খুলে পাশের নর্দমায় ফেলে দিলেন। অতিষ্ট ভঙ্গিতে দাঁত চেপে বিরবির করলেন,

‘মির্জা গুষ্ঠির ষষ্ঠী…!’

____________

কলেজে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবছর পিকনিকে কলেজ থেকে বাহিরে নিয়ে গেলেও এবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ক্যাম্পাসেই পিকনিক আয়োজন করা হবে। মেয়েরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাড়ি পড়বে সকলে। শাড়ি পড়ার এ ব্যাপারটায় সবথেকে বেশি আগ্রহী অন্তি। ইচ্ছা থাকলেও তার কখনো শাড়ি পড়া হয়ে ওঠেনি। এই শাড়ি পড়া নিয়ে তার মায়ের ঢের আপত্তি রয়েছে। তার মায়ের অকারণে আপত্তি থাকা ব্যাপারগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। শাড়ি পড়ার কথা শুনলেই চোখ নাক কুঁচকে বলবেন,

‘ওসব পড়তে হবে না। ভালো একটা জামা পড়েনে।’

স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে সবাই শাড়ি পড়েছিল। সে নিজেও খুব শখ করে মায়ের কাছে শাড়ি পড়ার আবদার নিয়ে হাজির হতেই নাহার কাটকাট গলায় বললেন,

‘ছোট মেয়ে মানুষের শাড়ি পড়ে কি কাজ? ভালো কোনো জামা পড়ে যাও। বড়ো হওয়ার দরকার নেই এত।’

ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় উজ্জ্বল মুখটা। গলা খাদে নামিয়ে মায়ের কথায় বিস্ময় নিয়ে অন্তি বলেছিল,

‘শাড়ি পড়লেই মেয়েরা বড়ো হয়ে যায় বুঝি?’

নাহার তাখন মেয়ের কথার জবাব না দিয়ে কেবল বলেছিলেন,

‘আজ শপিং এ যাবো। সুন্দর দেখে একটা কুর্তি কিনে নিও।’

অন্তির আর সেবার শাড়ি পড়া হলো না। অনুষ্ঠানে সবাই লাল রঙের শাড়ি পড়লেও সে পড়েছিল গাঢ় নীল রঙের লং কুর্তি। কি বেমানান ই না লাগছিলো! মনে হচ্ছিলো ঝাঁক ঝাঁক পাখির মধ্যে সে একমার কাক! কি অস্বস্তিকর একটা অবস্থা। পুরোটা সময় অন্তির হাঁসফাঁস করেই কাটলো। কিছুটা লজ্জাও পেয়েছিলো সে। এত বড় বড় কথা বলে শেষে কিনা সে নিজেই ড্রেসকোড ফলো করেনি!

অনুষ্ঠানের মাঝ পথেই সে বাসায় চলে এসেছিলো। টানা দুদিন সে মায়ের সাথে কথা বলেনি।

সেসব পুরোনো দিনের কথা ভেবেই অন্তি শাড়ি পড়ার কথাটা সাবধানে লুকিয়ে গেলো। এবার সে কোনোভাবেই এটা মিস করতে চায় না। নাহার জানতে পারলে কখোনোই তাকে শাড়ি পড়তে দিবে না।

তন্নিকে সাথে নিয়ে কোচিং শেষে শপিংয়ে চলেছে অন্তি। যাওয়ার পথে দিহানের সাথে দেখা হয়েছে। লোকটার গম্ভীর চোখজোড়ার বন্ধী হয়েছে সাথেই। অন্তি খুব সাবলীল ভাবেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। যেন দিহান নামক মানুষটার কোনো অস্তিত্ব নেই এ জগতে। অন্তির এহেন কান্ডে দিহানের সাথে সাথে বাদবাকি সকলেই অবাক। তারা যা দেখলো তা কি সত্যি!

দিহানের দুই ভ্রুর মাঝে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। এই মেয়ের মতিগতি সে বুঝতে পারে না। এই কেঁদে কেটে বন্যা বইয়ে দেয় তো এই মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। মেয়ে মানুষ এতো ঘোলাটে কেন? দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিহান। তার এত শক্ত ব্যক্তিত্বকে নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা যে মেয়ে রাখে সে মেয়ে নিশ্চই সাধারণ কেউ নয়। বিশেষ কেউ একজন! আর এই বিশেষতাই দিহানকে খুব করে টানে। মস্তিষ্ক চায় একবার মনকে প্রশ্রয় দিতে। কিন্তু প্রশ্রয় দিলেই যে তার ধ্বংস নিশ্চিত!

দিহানের ভাবনার সুতো ছেড়ে নুহাশের কথায়।

‘মেয়েগুলো উল্টোপথে কোথায় যাচ্ছে? হাত পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখা দরকার। এত টো টো করে ঘোরার কি আছে বুঝিনা!’

দিহানের ভাবনার কাঠি আরো একবার নড়ে উঠলো। এতো হেলেদুলে কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা? চোখের চাহনি দৃঢ় হলো। জিপের উপর থেকে সটান নেমে দাঁড়িয়ে নুহাশকে বললো,

‘বাইকের চাবি দে।’

নুহাশ তৎক্ষণাৎ মানা করে দিলো।

‘মামা বাড়ির আবদার নাকি? তোর গাড়ি নিয়ে যেখানে খুশি যা। বাইক দিতাম না।’

দিহান অবশ্য নুহাশের কথায় কান দিলো না। ছো মেরে চাবি নিয়ে নিলো। বাইক স্টার্ট দিতেই নুহাশ লাফ দিয়ে পেছনে উঠে বসলো। দিহান ধমকে বললো,

‘নেমে দাঁড়া! তোর সাথে রাইড করার ইচ্ছা‌ নেই আমার।’

‘আমারো নেই। বাধ্য হয়ে উঠেছি।’

দিহান আর কথা বাড়ালো না। এখন ফালতু আলাপ করার মুড নেই তার। কিন্তু তাদের এ যাত্রা বৃথা হলো। অন্তি এবং তন্নির টিকিটাও তারা কোথাও খুঁজে পেল না। মুহূর্তের মাঝে কোথায় গায়েব হলো মেয়ে দুটো? দিহানের মেজাজ খারাপ হয়। সাদা মুখটা রাগে লাল হয়ে আসে। নুহাশ মুখ দিয়ে চ শব্দ করে নেমে যায়। আজ সে তন্নিকে হারে হারে বোঝাবে টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর শাস্তি ঠিক কেমন হতে পারে!

অন্তি ঘুরে ঘুরে কাবার্ড খুলে সদ্য কিনে আনা কলাপাতা রঙের শাড়িটা দেখছে। তার কাবার্ড ভরা জামাকাপড়ের মাঝে শাড়িটা জাগা পেয়েছে সবার উপরে। এটাই তার একমাত্র শাড়ি। সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজ পেটিকোট ও কিনে এনেছে সে। কিন্তু তার এই রঙের চুড়ি নেই। বাজারে কোথাও খুঁজে পায়নি ম্যাচিং চুড়ি। এজন্য অল্প স্বল্প মন খারাপ। কিন্তু ওটা আপাতত কোনো ব্যাপার না। অন্তি উৎফুল্ল মনে হেলেদুলে রুম থেকে বের হয়। ড্রয়িংরুমে তার মায়ের সাথে খোশ গল্পে মগ্ন মিলাকে দেখে মুখ বাঁকায়। মিলাকে রাগাতে নাহারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘বড় কাকি কি তোমার আদরের মেয়েকে ঘর ছাড়া করেছে মা? আজকাল এ বাসায় যে ঘাটি গেড়ে বসেছে!’

আশ্চর্য জনক ভাবে মিলা এ কথার কোনো জবাব দেয় না। উল্টো নাহার রেগে কিছু বলতে গেলে বলে,

‘ওর কথায় কান দিওনা তো মেজ মা। তারপর বলো, কোথায় যেন ছিলাম আমরা? ও হ্যাঁ শোনো…’

অন্তি চোখ কপালে তুলে তাকায়। এই ন্যাকা এতো ভালো হলো কবে থেকে? নাকি এটাও নতুন ন্যাকামির ট্রেইলার!

_____________

গভীর রাত। ব্যস্ত রাস্তা এখন পুরোপুরি নিরব হয়ে উঠেছে। দূর থেকে কুকুরের ডাকের শব্দ ভেসে আসছে। এই গভীর রাতেও রাস্তার দিকে মুখ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে লাগাতর কান ধরে উঠবস করছে তন্নি। চোখ ছলছল করছে মেয়েটার। যখন তখন টুপ করে জল গড়িয়ে পড়বে। কান্না চেপে রেখে ছোট ছোট করে উচ্চারণ করছে,

‘সাতান্ন, আটান্ন, ঊনষাট…….’

বারান্দা বরাবর রাস্তায় বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুহাশ। রাস্তার ধারের হলদে রঙের আলোতে তার মুখ জ্বলজ্বল করছে। চঞ্চল লোখজোড়া নিবদ্ধ সম্মুখে দোতলায় শাস্তিপ্রাপ্ত মেয়েটার দিকে। মেয়েটা সেই কখন থেকে মাথা নিচু করে আছে। মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। এই ভুলের জন্য কি শাস্তিটা আর একটু বাড়ানো উচিত? ননুহাশের আবার দয়ার হৃদয়। প্রেয়সীর এতো কষ্ট সে ঠিক সহ্য করতে পারবে না। নুহাশ ফোন হাতে কল করলো। রিং বাজলো দোতালার বারান্দায়।‌ সময় কল রিসিভ করলো মেয়েটা।

‘কাছে এগিয়ে আসো। সোজা হয়ে দাঁড়াবে। একদম সোজা আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। বিন্দু নড়চড় চাই না!’

‘আচ্ছা।’

মেয়েটা সত্যি এগিয়ে আসে। রোবটের মতো করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এই অল্প আলোতেও সে লক্ষ্য করে মেয়েটার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। কেঁদেছে খুব‌। নাকের ডগা ও ডালিমের মতো লাল টুকটুকে হয়ে আছে। নুহাশ আবিষ্কার করলো মেয়েটাকে কাঁদলে একটু বেশিই সুন্দর লাগে। মেয়েটার এই ডালিম রাঙা রূপটাই তার বেশি পছন্দ হয়েছে। নুহাশ খুব আফসোস করে বলে,

‘দুঃখিত সুন্দরী। তোমাকে যে এখন থেকে একটু বেশিই কাঁদতে হবে!’

তন্নি বুঝতে পারে না তার কথার অর্থ। চোখ ঝাপটায় কেবল। প্রশ্ন করার সাহস হয়ে ওঠে না। নুহাশ হাত ঘড়ির দিকে চোখ বূলায় একবার। রাত দুইটা বেজে পাঁচ মিনিট। ফের দৃষ্টি ফেলে তন্নির দিকে। মেয়েটার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে।

‘ঘুম পায়?’

তন্নি তৎক্ষণাৎ দু পাশে মাথা নাড়িয়ে না জানায়। নুহাশ ঠোঁট কামড়ে হাসে। মেয়েটা তাকে বাঘের থেকেও বেশি ভয় পায়। এটা নুহাশের ভালো লাগে। মেয়েটার ভয় পেয়ে আড় চোখে তাকানোটা দারুন।

‘রুমে যাও। ঘুমিয়ে পড়ো।’

নুহাশের কথাটা বলতে দেরী হলেও তন্নির বারান্দা থেকে গায়েব হতে দেরী হলো না। রুমে ঢুকেই চট করে দরজা আটকে দিলো। যেন সে এতক্ষন ধরে এই অপেক্ষাতেই ছিল। নুহাশ হেসে ফেলে। বুকের মাঝে শান্তি অনুভব হয়। এই মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য সে বরবাদ হতেও দুবার ভাববে না।

বারান্দার বদ্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে নুহাশ। বলে,

‘এখন না হয় একটু ভিলেন হলাম! ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিব পড়ে। তখন তোমার যা শাস্তি মন চায় দিও! আমি নুহাশ হাসতে হাসতে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকবো।’

চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে