তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১৩+১৪

0
269

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৩.
শাড়িতে নারী! কথাটা আসলেই সত্যি। নারীর সৌন্দর্য শাড়িতেই প্রকাশ পায়। অন্তি চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে আয়নায় নিজেকে দেখছে। কলাপাতা রঙের শাড়িটা তার শ্যাম শরীরে বড্ড মানিয়েছে। তন্নি তা দেখে দাঁত বের করে হাসে। চোখে মুখে দুষ্টুমি খেলে ওঠে। এগিয়ে এসে পেছন থেকে অন্তিকে জড়িয়ে ধরে। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

‘সুন্দর লাগছে তোকে পাখি। আজ তোর গুন্ডা সাহেব তোকে দেখলে নির্ঘাত ফিট খাবে। এ ব্যাপারে একশত পার্সেন্ট না হলেও নব্বই পার্সেন্ট সিওরিটি দিতে পারি আমি। তাকে হসপিটালাইজড্ করার জন্য অগ্রিম একটা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে রাখা দরকার! কি বলিস?’

অন্তি মুখ বাঁকায়। ঐ অসভ্য লোক এসব সৌন্দর্যের কদর করতে জানে না। কেবল পারে চোখ মুখ কুঁচকে ধমক দিতে।
আয়না থেকে চোখ সরিয়ে তন্নির দিকে তাকাতেই তার চোখ কুঁচকে আসে। অবাক গলায় বলে,

‘একি তোর ও না সেম কালারের শাড়ি পড়ার কথা?’

তন্নির মুখটা ছোট হয়ে আসে। তার পরনে হালকা নীল রঙের একটা জামদানী। এটাই সেদিন পার্সেল এসেছিলো। সে তো অন্তির সাথে মিল রেখে কলাপাতা রঙের মায়ের শাড়িটা পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু ঐ খারাপ লোকটা সকাল সকাল টেক্সট করে বললেন,

‘আমার দেওয়া শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বের হবে। ইটস্ আ অর্ডার।’

তন্নির সাহস নেই দ্বিমত করার। আবার কেমন শাস্তি দিবেন তা তো বলা যায় না!

তন্নিকে চুপ থাকতে দেখে অন্তি মুচকি হেসে বললো,

‘তোকে কিন্তু দারুণ লাগছে তনু। একদম পরীর মতো।।’

তন্নি ও উত্তরে লাজুক হাসলো। অন্তির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

‘তোকে কিছু বলার আছে। মানে আবার রাগ করবি কিনা!?’

অন্তি বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,

‘তুই কি আমাকে প্রপোজ করতে চাচ্ছিস? ডোন্ট ডু দ্যাট। আই অলরেডি হ্যাভ সামওয়ান!’

_____________

কলেজ প্রাঙ্গনে আজ রমনীদের মেলা বসেছে। খিলখিল হাসির ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে পরিবেশ। রাস্তায় চলার পথে সকলে আগ্রহভরা দৃষ্টিতে উঁকি দিচ্ছে কলেজ গেটের ভেতরে। অন্তিদের রিকশা এসে থামে কলেজ গেটে। সমস্যা বাঁধে রিকশা থেকে নামতে যেয়ে। শাড়ি পড়ার অভ্যাস নেই দুজনের কারোর। কষ্ট করে একজনের সাহায্যে অন্যজন উঠতে পারলেও নামার সময় এটা চ্যালেন্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তির চোখ মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়েছে। হাত দিয়ে পেটের কাছের শাড়ি চেপে ধরে রেখেছে। এত কষ্ট করে পড়া শাড়ি যদি মাঝরাস্তায় পায়ের নিচে পড়ে খুলে যায় লজ্জার সাথে কষ্টের পরিমানটাও সমানুপাতিক ভাবে বাড়বে। শাড়ি খুলে যাওয়ার চিন্তায় ইতিমধ্যে অন্থির চোখে মুখে বেদনার ছাপ ফুটে উঠেছে। অসহায় দৃষ্টিতে তন্নির দিকে তাকাতে তার দৃষ্টি আরো ঘোলাটে হলো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠ ধরে তন্নি বললো,

‘আমরা কি আজ এভাবেই পিকনিক শেষ করব পাখি? এই মুহূর্তে একটা বফের খুব প্রয়োজন বোধ করছি। পৃথিবীতে এতশত অফারের মাঝে বফ সংক্রান্ত কোনো অফার নেই? আমি দুই মিনিটের অফারটা নিতে চাই।’

অন্তি কিছু বলতে নিবে তার আগেই কোথা থেকে হাওয়ার গতিতে এগিয়ে নুহাশ। পড়নে তার নীল রঙের পাঞ্জাবি। রিকশার কাছে এসে এক গাল হেসে উঠলো।

‘আরে ভাবী যে! কতদিন বাদে দেখা।’

নুহাশ অন্তির সাথে কথা বললেও তার চোখ ব্যস্ত অন্তির পাশে জুবথুব হয়ে বসে থাকা রমনীর দিকে। তাকে দেখতেই মেয়েটা কেমন গুটিয়ে গেছে।

অন্তি গাল ফুলিয়ে বললো,

‘ভাবী ঠেকেছেন যখন একটু হেল্প করুন। রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াতে…..’

অন্তি কথা শেষ করার আগেই নুহাশ এসে তন্নির দিকে হাত বাড়ালো। ছোট করে হেসে বললো,

‘নেমে আসুন বেয়াইন। আপনার সেবায় এই বান্দা হাজির।’

তন্নির দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। ফেঁসে গেছে সে। এই মুহূর্তে এই লোকটার হাত না ধরেও উপায় নেই। তন্নি নেমে গেল। অন্তি সেদিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নুহাশ মুচকি হেসে বললো,

‘বন্ধুর পার্মিশন ছাড়া তো তার বউয়ের হাত ধরতে পারিনা! বন্ধুর থেকে পার্মিশন পেলেই তোমায় নামাবো।’

অন্তির মেজাজ চটে গেলো। রুক্ষ কন্ঠে শুধালো,

‘একদম আমায় ঐ অসভ্য লোকের বউ বলবেন না। তার সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। ইহজনমে সম্ভব ও নয়। আপনার বন্ধু অতিব মাত্রায় অসভ্য একজন মানুষ। আপনার বন্ধুকে বলে দিবেন, রূপন্তি নওয়াজ খান এখন আর আবেগে বশীভূত হয়ে তার মতো অসভ্য মানুষকে পছন্দ করার মতো ভুল করবে না।’

অন্তি এতগুলো কথা বলে শ্বাস ফেলল। বহুদিন পর মনের সব তিক্ততা বের করতে পেরে খুব হালকা লাগছে নিজেকে। সে পারলে এই লোকটার অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে নাই করে দিত। কিন্তু পারছে না বলেই তো চুপ করে আছে।

‘অসভ্য ব্যক্তিত্বের মানুষের জন্য কেঁদে কেটে সাগর মহাসাগর বানানোর পেছনের থিওরিটা জানতে চাই আমি।’

অন্তি চকিত দৃষ্টিতে সামনে থাকায়। দিহান বুকে দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে তার কালো রঙের পাঞ্জাবি। লোকটা সবসময় কালো পড়ে নয়তো সাদা। এছাড়া কি পৃথিবীতে কোনো রং নেই? বুকপকেটে ঝুলে আছে কালো রঙের রোদচশমা। চোখ দুটো কুঁচকে আছে সামান্য। যেন সে সত্যিই উত্তরটা জানতে আগ্রহী। অন্তি চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে আশপাশে তাকালো। এভাবে হাঁটে হাঁড়ি ভাঙার কি দরকার ছিল? শুধুই কি অন্তি তাকে অসভ্য বলে? এর পেছনে যথাযথ কারণ রয়েছে।

অন্তিকে চুপ দেখে দিহান বাঁকা হাসে। এগিয়ে এসে রিকশা ওয়ালার হাতে দুশো টাকার একটা নোট গুঁজে দেয়। অন্তির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ঠোট কামড়ে হাসে। বলে,

‘আপনাকে প্রতি দশ মিনিটের জন্য একশত করে টাকা দেওয়া হবে। আপনার কাজ সামনের চায়ের দোকানে বসে মনের সুখে চা খাওয়া। চাইলে সাথে অন্যকিছু ও খেতে পারেন।’

লোকটার চোখ চকচক করে ওঠে। বিনা বাক্যে সে রাজি হয়ে যায়। দশ মিনিটে রিকশা চালিয়ে একশত টাকা ইনকাম করা অসম্ভব সেখানে বসে বসে চা নাস্তা খেতে খেতে ইনকিম হলে আপত্তি কিসে?
দিহান ঠিক কি করতে চাচ্ছে বোধগম্য হলোনা অন্তির। সে কেবল ড্যাবড্যাব করে দেখতে লাগলো। তবে তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠেছে। এই অসভ্য লোক তার অসভ্য মস্তিষ্ক নিয়ে নিশ্চই কোনো ঝটলা পাকাতে চলেছে। চোখ ঘুরিয়ে তন্নির দিকে তাকালে দেখা গেলো সে মাথা নিচু করে মুর্তির মতো নুহাশের থেকে স্বল্প দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তি রাগে দাঁত চিবিয়ে তন্নিকে ডাকলো। সে বিপদের মাঝে আটকে আছে আর এই মেয়ে দেখো পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

‘হাত ধর। সং সেজে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

অন্তির ধমকে তন্নি ঠোঁট উল্টায়। পা আগাতে গেলেই টান অনুভব করে। নুহাশ তার শাড়ির আঁচল হাতে পেঁচিয়ে রেখেছে। তন্নি চেয়েও পাড়লো না সামনে আগাতে। অন্তির দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই অন্তি চোখ রাঙালো। তন্নি পড়লো বিপাকে। সে কিভাবে অন্তিকে বলবে যে সে নিজেও ফেঁসে আছে!

দিহান একটা ছেলেকে ডাকলো হাতের ইশারায়। কথা বার্তায় জানা গেলো ছেলেটার নাম রাকিব। পেশায় সে দিহানের ভক্ত! অন্তি এটা চট করেই বুঝে ফেলেছে। কারণ ছেলেটা দিহানের কথার আগায় মাথায় ‘জ্বি ভাই’ ‘আচ্ছা ভাই’ এভাবে রিপ্লাই করে যাচ্ছে। অন্তি মুখ বাঁকিয়ে বিরবির করলো,

‘ভাই না ছাই!’

অন্তিকে শেষ বারের মতো চমকে দিয়ে দিহান ছেলেটাকে বললো,

‘চোখে চোখে রাখবি এই যে অতি সুদ্ধ একজন নারী বসে আছে রিকশায়, তাকে যেন কেউ ওখান থেকে নামতে হেল্প না করে। মাইন্ড ইট!’

ছেলেটা অতি উৎসাহে জবাব দিলো,

‘জ্বি ভাই! নো চিন্তা। আমি আছি।’

এটা কি হলো? অন্তি চকিত হয়ে তাকিয়ে রইল। দিহান অন্তির দিকে তাকানোর নূন্যতম প্রয়োজন বোধ করলো না। সে দিব্যি হেলে দুলে উক্ত স্থান থেকে প্রস্থান করলো। ইতিমধ্যে নুহাশ তন্নির আঁচল ছেড়ে হাত আঁকড়ে ধরেছে। তাতে তন্নির প্রাণ যাই যাই অবস্থা। ভূমিকম্পের ন্যায় তার সর্বশরীর কাঁপছে। এত অত্যাচার কেন তার প্রতি? হাতের বাঁধন ছাড়াতে পারবেনা যেনেও সে ব্যর্থ চেষ্টা করেছে দুবার। এতে করে নুহাশ গলার স্বর খাদে নামিয়ে চরম দুটো ধমক দিয়েছে। তন্নি পুনরায় সে কাজ করার সাহস করেনি। নুহাশ এতে মজা পায়। নিরবে হাসে। বোকা মেয়েটা কেবল তাকে ভয় পেয়েই গেলো। একবারো এসব কাজের পেছনের মোটাভ বোঝার চেষ্টা করলো না! করলে হয়তো সেই শুরুতেই নুহাশ নামক ধোঁয়াশা তার নিকট স্বচ্ছ পানির ন্যায় হতো। কিন্তু তার রমনী যে বোকা! বড্ড বোকা! এই অতি সামান্য সমীকরণ মেলানোর মতো পর্যাপ্ত বুদ্ধি‌ তার‌ নেই।

________________

আকাশে রোদ উঠেছে খুব। তীর্যক রোদে শরীর থেকে জল গড়াচ্ছে। অন্তি অতিষ্ঠ ভঙ্গতে কপাল, নাক মুছলো। রাগে তার নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। একটা মানুষ এতটা খারাপ কিভাবে হতে পারে? বিরক্ত দৃষ্টিতে গেটের সামনে চেয়ার পেতে বসে থাকা দিহানকে দেখে সে। লোকটা কেমন নির্লপ্ত ভঙ্গিতে ফোন টিপছে। এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ এমন ঠান্ডা মস্তিষ্কে কিভাবে বসে থাকতে পারে?
অন্তি আশপাশে নজর বুলায়। আশপাশে তাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তন্নি সেই কখন নুহিশের সাথে ভেতরে চলে গেছে। কতবর বেঈমানি করলো মেয়েটা তার সাথে ভাবা যায়? রাকিব নামের ছেলেটা ঘুরে ঘুরে নজরদারি করছে। যেন কোথা থেকে কেউ এসে ছো মেরে অন্তিকে নিয়ে যাবে। এসব কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে অন্তি নিজ থেকেই নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চেষ্টা ছাড়া এ পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কেউ সফল হতে পারেনি। কবি বলেছেন, একবার না পারিলে দেখো শতবার। সে নাহয় একবার চেষ্টা করে দেখলো!
শাড়ির কুচি শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে লাফ দিতে নিলেই দিহান‌ এসে তার সামনে দাঁড়ায়। চাপা কন্ঠে বলে,

‘এনার্জি কেন নষ্ট করছো? সুন্দর ভাবে আমাকে বললেই হয়!’

অন্তি ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায়। দাঁত চেপে বলে,

‘আই ডোন্ট নিড ইয়োর হেল্প।’

‘বেশ! তবে বসে থাকো।’

অন্তি শক্ত জবাব দেয়,

‘আমি একাই নামতে পাড়বো!’

‘আমি সেটা হতে দিব না!’

‘কেন করছেন এমন?’

দিহান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,

‘ইচ্ছা হলো!’

অন্তি শান্ত চোখে তাকায়। দু সেকেন্ডের মাঝে হাত বাড়িয়ে দিহানের কাঁধ ছোঁয়। দিহান চমকে ওঠে। বুকের ভিতর ছলৎ করে ওঠে। অন্তি শক্ত ভাবে তার কাঁধ আঁকড়ে ধরেছে। দিহান আশা করেনি অন্তি এভাবে মেনে যাবে। দিহানকে নির্লপ্ত দেখে অন্তি বলে,

‘কি হলো? নামিয়ে দিন?’

দিহান নিজেকে ধাতস্থ করে। সে ভুলে বসেছিলো যে এটা অন্তি! যাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। কেবল তার নিকট পরাজয় স্বীকার করাই কাম্য!
অন্তির ঠোঁট কোণে হাসি খেলে যায়। ব্যাটা রাগি কুমরা আসছে তাকে হেনস্থ করতে! এত সহজ নাকি? এই রূপন্তি নওয়াজ খানকে হেনস্থা করার জন্য দিহান মির্জাকে দ্বিতীয় বার জন্ম নিতে হবে। এ জীবনে সেটা অ স ম্ভ ব!

চলবে……..

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৪.
সময়ের কাটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটছে। ঢাকা শহরের বুকে দুপুর নেমেছে। ঘড়িতে সময় দুপুর একটা। অন্তি মাঠের এক কোনে জুবথুব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বা হাতে ধরে রাখা তার শাড়ির কুচি। অন্যহাতে মাবাইল সহ পার্স। খোলা চুলগুলো অবাধ্যের ন্যায় উড়ে উড়ে চোখ মুখে পড়ছে। দু হাত ব্লক থাকায় বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা ডানে বায়ে নাড়িয়ে চুল সরানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে সে জায়গা ছেড়ে নড়তেও পারছে না। উঁচু হিলের তলায় শাড়ির কুচি বেঁধে শাড়ি কিছুটা এলোমেলো হয়েছে। এজন্যই মূলত সে এখানে তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটতে গেলে যদি খুলে যায়? এক শাড়ি পরার জন্য এতসব ইতিহাস তৈরি হবে জানলে সে এই ভুল কিছুতেই করতো না। সবাই কেমন হেলেদুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আর সে?
ওদিকে তন্নির কোনো খোঁজ নেই। মেয়েটা ওয়াশরুমের নাম করে সেই গেলো এখনো এলো না। অন্তি যখন আকাশ কুসুম ভাবতে ব্যস্ত তখন সেখানে আগমন ঘটলো দিহান মির্জার। তাকে খুব চিন্তাগ্রস্থ দেখালো। অন্তি চোখ পিটপিট করে চাইলো। এই লোকের মতলব কি? দিহান তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,

‘কোনো সমস্যা?’

অন্তি না বোঝার ভঙ্গিতে ডানে বায়ে মাথা নাড়ল। ছোট করে বললো,

‘কোনো সমস্যা না।’

দিহান আশপাশে তাকিয়ে পুনরায় বললো,

‘এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

অন্তি জবাবে মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে রইলো। আর যাই হোক সে তো এখন বলতে পারবে না তার শাড়ি খুলে যাওয়ার ব্যাপারটা। লজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!

প্রশ্নের সাথে সাথে উত্তর না পেলে মেজাজ তিতো হয়ে আসে দিহানের। সেখানে এই মেয়েটা প্রতিটা জবাবের আগে মৌনতা পালন করে। দু একটা থাপ্পর লাগালে এতদিনে ঠিক ঠাক হয়ে যেত। কিন্তু সেটা পারছে না আপাতত। তেমন করলে এই মেয়ে তার জিনা হারাম করে দিবে।
দিহান দু আঙুল দিয়ে কপাল ঘঁষে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

‘যা পড়তে পারো না তা পরো কেন? দ্বিতীয়দিন যেন তোমায় শাড়িতে না দেখি!’

অন্তি ঠোঁট উল্টে তাকালো। শাড়ির কুচি শক্ত করে ধরে রাখলো। লোকটা বুঝলো কিভাবে? অন্তি আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে দিহানের পানে চাইলো। পরপর পাতলা ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে বলতে নিলো,

‘আপনি বুঝলে কি…..’

তার কথাকে অসম্পূর্ণ রেখে দিহান উল্টো পথে পা বাড়ালো। যেতে যেতে শাসিয়ে বললো,

‘এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। কাউকে পাঠাচ্ছি।’

অন্তি কথা শোনে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে দিহান দুকদম এগিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে অন্তির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,

‘চুমু খেতে চাইতে লজ্জা লাগে না, আর সামান্য শাড়ি খুলে গেছে বলতে এতো লজ্জা? ইমপ্রেসিভ পারফরমেন্স! আ’ম ইমপ্রেসড্!’

কথা শেষ করে ঝড়ের গতিতে প্রস্থান করলো দিহান। তবে অন্তি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোয়াল ঝুলে পড়েছে। লোকটা কি বলে গেলো? পরক্ষণে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে ওঠে। ইশশ! আবেগের বশে কোনো একদিন চুমু খাওয়ার কথা নাহয় সে বলেছিলো, সেটা এতদিন মনে রাখার কি দরকার ছিলো? লোকটা নিশ্চই তাকে লজ্জায় ফেলার জন্য সেসব কথা নোট মার্ক করে রেখেছে! অন্তি চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ালো। এই মানুষটা তো চরম অসভ্যের সাথে নির্লজ্জ ও বের হলো। এতসব খারাপ গুণ কেন তার মাঝেই থাকতে হলো? অন্তি কিভাবে ওভারকাম করবে এসব গুণ?

প্রায় দশ মিনিটের মাথায় একটা আপু এলো। কোলে তার চার কি পাঁচ বছরের একটা মেয়ে। অন্তিকে দেখতেই হেসে বললো,

‘তুমিই রূপন্তি বুঝি?’

অন্তি মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ল। আপুটা অন্তিকে বললো,

‘একটু কষ্ট করে ক্লাসরুমে চলো। এভাবে মাঠে বসে তো শাড়ি ঠিক করা যাবে না। হাঁটতে পারবে?’

অন্তি ছোট করে জবাব দিলো,

‘পারবো।’

‘গুড। আসো তাহলে।’

শাড়া ঠিক করতে করতে আপুটার সাথে অনেক কথা হলো অন্তির। তাদের কথার মেইন টপিক ছিল দিহান। আপুর ভাষ্যমতে দিহান এক কালে তার ও ক্রাশবয় ছিলো। দিহানকে পরপর চারবার প্রেম প্রস্তাব দেওয়ার পর দিহান তার গাল বরাবর ঠাঁটিয়ে এক থাপ্পর মেরেছিল। যদিও এর যথেষ্ট কারণ ছিলো। অতিরিক্ত আবেগের বশে সে হাত পা কেটে বসেছিলো। অনুভূতি স্লোগান ছিল, প্রাণ যায় যাক আমার তুমি হলেই চলবে। কিন্তু তার অনুভুতির দু আনা দাম দিহান দেয়নি। যাই হোক সেই থাপ্পর খেয়েই মূলত তার মাথা থেকে দিহানের ভূত নেমেছিল। তবে তার এই বারাবারি রকম পাগলামির দরুন তার পড়াশোনাটা সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারে জানাজানি হওয়ার ফলে তার বাবা তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেন। এখন সে এক বাচ্চার মা।

এমন হৃদয় ভাঙার গল্প শুনে অন্তির দয়ার মনটা কেঁদে ওঠে। বুক ভার হয়ে আসে প্রেমে ব্যর্থ হৃদয়টার প্রতি। আক্রোশ নিয়ে বলে,

‘পাষাণ মানব একটা!’

অন্তির কথায় হাসে মেয়েটা। কোমরে কুচি গুজে দিতে দিতে বলে,

‘এক দিক থেকে কিন্তু এতে তোমার লাভ হয়েছে।’

অন্তি চোখ পিটপিট করে জানতে চায়,

‘কিভাবে?’

‘দিহান পাষাণ না হলে সে এতোদিনে অন্যকারো হয়ে যেত। ও পাষাণ বলেই ওকে তুমি পাচ্ছ। লাভ হলো না তোমার?’

অন্তির মস্তিষ্ক চট করে ব্যাপারটা ধরতে পারতেই উচ্ছাসিত গলায় বললো,

‘একদম তাই!’

আপুটা শব্দ করে হেসে ফেলে। অন্তি লজ্জ পায়। সে সত্যিই লোকটার প্রেমে পড়ে নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে।

অন্তি শাড়ি ঠিক করে বের হতেই দেখলো দিহান ক্লাসরুমের সামনে পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু একটা দেখছে। পেছন থেকে সেই আপু এসে জোরে বলে ওঠে,

‘প্রেম বিদ্বেষী দিহান দেখছি এখন প্রেমে মাখো মাখো হয়ে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দেওয়া হচ্ছিলো বুঝি?’

দিহান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অন্তিকে এক পলক দেখে নিয়ে আপুকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘অযথা কথা খরচ না করে তোর কাজে যা। এখানে তোর আর কোনো কাজ নেই।’

‘যাচ্ছি যাচ্ছি।’

আপুটা চলে যায়। অন্তি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার কেন জানি খুব লজ্জা লাগছে। এই যে দিহান তার দিকে তাকিয়ে আছে, এতে সে মাথা সোজা করতে পারছে না। যেন চোখে চোখ মিললেই তার মৃ ত্যু ঘটবে। দিহান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবির পকেটে ফোন রেখে শান্ত গলায় বলে,

‘এখন সব ঠিক আছে?’

অন্তি মাথা উপর নিক করে। দু দন্ড সময় পর দিহান পুনরায় বলে,

‘সোজা খাবারের ওখানে চলে যাও। আমি আশপাশেই থাকবো।’

দিহান ব্যস্ত পায়ে চলে যায়। দিহানের বলা কথাগুলো অন্তির ছোট মনে ঝড় তোলে। এলোমেলো করে দেয় অনুভূতিদের। কি ছিলো কথাগুলোতে? এত মাদকতা কেন? তার হৃদয় উষ্ণতায় ভরে ওঠে। এই যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মানুষটার ছোট ছোট যত্ন পাচ্ছে সে, তার লোভ বেড়ে যাচ্ছে। কড়া শাসনে আটকে রাখা হৃদয়টা অস্হির হয়ে ছটফট করছে। ভালোবাসা চাই তাদের। মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখা প্রেমটা যেন নতুন রূপে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। মানুষটার এতটুকু যত্ন পেতে সে মরতেও রাজি।

_____________

‘সোজা হয়ে দাঁড়াও! এভাবে কাচুমাচু করছো কেন? তুমি কি আসামি?’

নুহাশের ধমকে তন্নির চোখে জল আসে। সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু চেয়েও কিছুতেই সে মাথা সোজা করে সরাসরি তাকাতে পারছে না। এদিকে নুহাশ ক্যামেরা হাতে অনর্গল নির্দেশনা দিয়ে চলছে। এভাবে না এভাবে দাঁড়াও, মাথা উঁচু করে তাকাও, অল্প হাসো, আকাশেল দিকে তাকাও ব্লা ব্লা ব্লা। ছবি তোলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আছে তন্নির ও। কিন্তু ক্যামেরা ম্যানটা নুহাশ না হলেই চলতো। এমন দানবীয় মানুষের সামনে সে কিভাবে পোজ নিবে?
তন্নির কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে নুহাশ তপ্ত শ্বাস ফেলে। ক্যামেরা হাতে এগিয়ে আসে। কপালে পড়ে থাকা চুলগুচ্ছো যত্ন নিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দেয়। তন্নি তখনো চোখ নামিয়ে রাখে। নুহাশ ধমক দিতে যেয়েও হেসে ফেলে। চঞ্চল কন্ঠে শুধায়,

‘তুমি বড্ড বোকা সুন্দরী! এত বোকা হলে চলে?’

এবার তন্নি তাকায়। সরাসরি নুহাশের চোখে চোখ রাখে। সে অন্তির মতো চটপটে নয়,শান্ত স্বভাবের, এটা সবাই বলে কিন্তু বোকা? এটা কখনো কেউ বলেনি। বোকা শব্দটা তন্নির কাছে নিতান্তই অপমান সূচক শব্দ বলে মনে হলো। তার আত্মমর্যদা সম্পন্নো মস্তিষ্ক তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়লো। তন্নি প্রথম বারের মতো নুহাশের কথার বিরোধীতা করে প্রতিবাদী কণ্ঠে জানালো,

‘আমি বোকা না। আপনি ভুল বুঝছেন!’

নুহাশের হাসি সেকেন্ডের জন্য থামে। কপাল বরাবর সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। পরক্ষণে হাসি চওড়া হয়। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কৌতুক করে বলে,

‘বোকা বলায় সুন্দরী বিড়াল বাঘ বনে গেলো যে! ইন্টারেস্টিং!’

তন্নি মাথা নিচু রেখেই দু পা পেছনে সরে দাঁড়ায়। চোখ তুলে সম্মুখে তাকানোর দ্বিতীয় চেষ্টা করে না। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে মিনমিন করে বলে,

‘যাচ্ছি।’

আর দাঁড়ায় না মেয়েটা। নুহাশ মুচকি হাসে। ভীতু বাঘিনীকে তার ভালো লেগেছে খুব। এই নতুন রূপটা আনএক্সপেক্টেড ছিলো। নারীর আর কতো রূপ আছে?

চলবে………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে