তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-৩২+৩৩

0
302

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩২.
দিহানের আজকাল ভিষণ মন খারাপ হয়। যদিও মন খারাপ হওয়াটা অত্যন্ত সাধারণ একটা ব্যাপার। মন খারাপের জন্য পর্যাপ্ত কারণের প্রয়োজন হয় না। তবে দিহানের মন খারাপের পেছনে শক্তপোক্ত কারণ রয়েছে। তার মনে হয় সে হয়তো খুব বেশিদিন বাঁচবে না। কেন বাঁচবেনা তা অজানা। এই যে তার সামনে কোমরে ওড়না গুঁজে, চুল হাত ক্ষোপা করে দাঁড়িয়ে কাপড় ভাঁজ করতে থাকা রমনীটাকে দেখলেই তার বুক ভারী হয়ে আসে। এই মেয়েটাকে নিজের করে পাওয়ার নিদারুণ লোভ তাকে কষ্ট দিচ্ছে খুব। কিন্তু তার কেন যেন মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে বউ রূপে দেখা হবেনা তার। তার আগেই ওপাড়ে ডাক পড়বে।
দিহান নিজের ভাবনার উপর বিরক্ত প্রকাশ করে। নাক চোখ কুঁচকে মাথা ঝাঁকায়। ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এসব কল্পনা তাকে মানায় না। এসবের পেছনের দোষটা দিহান নির্দ্বিধায় অন্তিকে চাপিয়ে দেয়। যবে থেকে এই মেয়েটা তার জীবনে এসেছে সে ক্রমশ দুর্বল হয়ে চলছে। শুনেছে নারীর হাতে পুরষকে ধ্বংস করার ক্ষমতা থাকে। এতদিন বিশ্বাস না করলেও দিহান এখন এ কথায়
পুরোপুরি বিশ্বাসী। দিহান গভীর চোখে অন্তির পানে তাকায়। বাহির থেকে আসা মৃদু বাতাসে অন্তির কপালের সামনের চুলগুলো উড়ছে। পেছনে হাত খোঁপা করা চুলগুলো আলগা হয়ে আছে। যখন তখন খুলে পড়বে। দিহানের মন চাইলো অন্তিকে বলতে,’ এদিকে এসে বসো।’ অন্তি লক্ষি মেয়ের মতো পাশে বসলে সে আলতো হাতে খোঁপা শক্ত করে বেঁধে দিবে। তার বাগানে ফোটা টকটকে গোটাকয়েক ডায়ান্থাস ফুল এনে গেঁথে দিবে খোঁপায়। মেয়েটা কি তখন লজ্জা পেয়ে দুহাতে মুখ লুকাবে? নাকি ছলছল চোখে চেয়ে বলবে,’এত কেন ভালোবাসেন?’
কিন্তু বাস্তবে দিহান খোঁপা করতে পারে না। তার পক্ষে বাগান থেকে ফুল আনাও সম্ভব না। হাঁটতে মানা তার। বাথরুমেও তাকে অন্যের সাহায্যে যেতে হয়। ব্যাপারটা ভিষণ লজ্জাজনক। দিহান বড় করে শ্বাস ফেলে। বলে,

‘বাসায় কি বলে বের হয়েছ?’

অন্তি ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। তার হাতে কালো রঙের একটা টি শার্ট। এই টিশার্টটা প্রায়ই দিহানকে পড়তে দেখা যায়। অন্তি দিহানের কথার জবাব না দিয়ে বলে,

‘আপনি সবসময় সাদাকালো ড্রেস আপ করেন কেন?’

‘হয়তো আমার জীবনটা ওমন ছিলো তাই।’

‘এখন কেমন?’

অন্তির চোখে ভরপুর কৌতুহল। মেয়েটা এভাবে তার প্রতি দিহানের মনোভাব জানতে চাচ্ছে। দিহান অন্তির চোখে তাকিয়েই চট করে ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। মনে আসা সুন্দর উত্তরটা দিতে মন চাইলো না আর। মেয়েটাকে একটু রাগালে কেমন হয়? ভাবনা মতোই দিহান মুচকি হেসে বললো,

‘আই থিংক এখন আমার কালো রংটাই পছন্দ। সাদাটাও মুছে গেছে।’

অন্তির মুখের রং বদলে গেল। চোখের চাহনি গাঢ় হলো। মনে মনে ভিষণ কয়েক গালি ছুঁড়ে গটগট পায়ে রুম ছাড়লো। এই চরম অসভ্য লোককে দেখতে কিনা সে বাড়ি থেকে চুরি করে এখানে এসেছে! ভাবা যায়? সে আসলেই প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছে। নয়তো এমন অসভ্য লোককে দেখার জন্য এত কষ্ট কেন করবে?

অন্তি বাড়ি ফিরে গেছে। যাওয়ার আগে দিহানের সাথে দেখা করেনি। রেহানা অনেক করে দুপুরে খেয়ে যাওয়ার জন্য বলেছে। অন্তির জন্য এই অল্প সময়েই চার ধরণের রান্না করে ফেলেছে। কিন্তু মেয়েটা খেয়ে যেতে রাজি হয়নি। দেরী হয়ে গেছে, বাসায় ঝামেলা হবে এই ভয়ে বেশি জোর করতে পারেনি। অল্প সময়েই মেয়েটা কেমন বাড়িটাকে ভরপুর করে ফেলেছিলো। এখন আবারো পূর্বের ন্যায় শান্ত হয়ে পড়েছে। অন্তি যাওয়ার পরপরই রেহানা দিহানের রুমে যায়। দিহান তখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে। রেহানা এসে সরাসরি দিহানকে প্রশ্ন করে,

‘মেয়েটার ঠিকানা দে। ওর বাড়িতে যাব। যত দ্রুত সম্ভব ওকে এবাড়িতে নিয়ে আসব।’

দিহান সহজ উত্তর দেয়,

‘আচ্ছা।’

দেহানা তাজ্জব বনে যায়। ছেলে এত সহজে রাজি হয়ে যাবে সে ভাবেনি। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে দিহান ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘আর কি?’

‘তোর কোনো মতামত নেই।’

‘বললাম আচ্ছা। এটাই মতামত।’

‘আচ্ছা। তোর বাবার সাথে কথা বলে দেখি।’

‘হুম। ও কোথায়?’

রেহানা স্বাভাবিক উত্তর দেয়,

‘চলে গেছে।’

দিহানের কপাল কুঁচকে আসে। চলে গেছে মানে? তাকে না বলেই চলে গেছে? এই মেয়ের সাহস দিনদিন বেড়ে চলেছে। অতটুকু মেয়ের এত জেদ থাকে কোথায়? তার ধৈর্যের বাহিরে চলে যাচ্ছে অন্তির কাজকর্ম।
কিন্তু মায়ের সামনে সে কোনোরূপ কথা বলে না। অত্যন্ত স্বাভাবিক উত্তর দেয়,

‘ও।’
______________

তন্নি আজকাল নুহাশকে ভয় পাচ্ছেনা। ব্যাপারটা নুহাশকে খুব হতাশ করছে। মেয়েটাকে ধমক দিলে আগের মতো কেঁদে ফেলেনা এখন। উল্টো খট করে কল কেটে দেয়। যখন তখন কল করে বারান্দায় ডাকলে আসে না। তার মন চাইলে তবেই আসে। নুহাশের মন বলছে আজকাল উল্টো সে ভয় পাচ্ছে বোকা মেয়েটাকে। এই বুঝি রেগে যায়! নুহাশ বিতৃষ্ণা চিত্তে হাতের সিগারেটটা ফেলে দেয়। যখন মন মেজাজ খারাপ থাকে তখন সিগারেট ও অসহ্য লাগে। নুহাশ তার খিটখিটে মেজাজ নিয়েই তামিমকে বললো,

‘কড়া করে এক কাপ চা দে তো। একদম কড়া‌। মুখে দিলে যেন নিমের মতো তিতা লাগে। বুঝছোস?’

‘দিতাছি ভাই।’

দু মিনিটের মধ্যে তার কড়া চা চলে আসে। সত্যিই ভয়ংকর তিতা চা বানাইছে তামিম। জিভে লাগা মাত্র পেট থেকে সব বের হয়ে আসার উপক্রম। ভয়ংকর দুটো গালি দিয়ে চা ফেলে রেখে দোকান থেকে বের হয়ে পড়ে সে। তামিম বোকা চোখে চেয়ে থাকে। তার কি দোষ? আশ্চর্য!

দোকান থেকে বের হয়ে নুহাশ তন্নিকে কল করে। এতদিনে এই প্রথম কল ঢোকা মাত্রই কল রিসিভ হয়। নুহাশ বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বলে,

‘তোমার কি আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা আছে? থাকলে বলো নয়তো এখানেই সব শেষ করো। প্রতিদিন ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান ভালো লাগে না।’

‘আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?’

‘কেন বলছি জানো না তুমি?’

‘জানলে আপনাকে বলতে বলতাম?’

‘আসবা কি না তাই বলো।’

তন্নি খানিক থেমে বলে,

‘আপনি কাল সারাদিন কল করেননি কেন?

‘তুমি কথা শোনো‌ না। খুব বেশি অবাধ্যতা করো তাই।’

‘আপনি রাগ করেছেন আমার উপর?’

‘খানিকটা।’

‘আচ্ছা। রাগ করিয়েন না। সুন্দর করে কথা বলেন।’

নুহাশের মুখ রাগে লাল হয়ে আসে। কিন্তু সে নিজেকে থামায়। যথাসম্ভয় রাগ কন্ট্রোল করে বলে,

‘দেখা করতে আসো প্লিজ।’

ওপাশ থেক তন্নির খিলখিল হাসি শুনতে পাওয়া যায়। সাথে রিনরিনে গলায় বলে ওঠে,

‘অপেক্ষা করুন। আসছি।’

নুহাশ বড় করে শ্বাস ফেলে। তার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। আজ এই মেয়ে না করলে নিঃসন্দেহে সে এই মেয়েকে খু*ন করে ফেলতো। তাকে কষ্টে রেখে তার বোকা সুন্দরী শান্তিতে থাকবে তা কিভাবে হয়?
_____________

এতদিন বাদে আরাভকে নিজের বাসায় দেখে অবাক হয় অন্তি। সোফায় বসে ফোনে কথা বলছে। টেবিলে বিভিন্ন রকম নাস্তা রাখা। নাহার অন্তিকে দেখতেই ব্যস্ত গলায় বলে,

‘দ্রুত গোসল করে তৈরি হয়ে নে। ছেলেটা অতদূর থেকে তোকে নিতে এসেছে। সেই কখন থেকে বসে আছে। দ্রুত যা।’

ততক্ষণে আরাভ ও কথা শেষ করে কান থেকে ফোন নামিছে। অন্তিকে দেখে সরল হেসে বলে,

‘অনেকদিন পর দেখা হলো। কেমন আছেন?’

অন্তি খুব স্বাভাবিক ভাবে হেসে বলে,

‘ভালো। হঠাৎ আসলেন যে?’

অন্তির কথায় আরাভ উত্তর দেওয়ার পূর্বেই নাহার ধমক দিলো।

‘এ কেমন কথা? হাতে পায়ে বড় হয়েছে শুধু। বুদ্ধি বলতে কিচ্ছু নেই। যা রুমে যা। ফ্রেশ হয়ে নে। ওর কথা ধরো না তো তুমি।’

‘ইট’স ওকে আন্টি।’

অন্তি মুখ বাঁকিয়ে রুমে যায়। গোসলে যাওয়ার পূর্বে দিহানকে ছোট একটা ম্যাসেজ পাঠায়।

‘এই যে প্রেমিক! আমি হবু বরের সাথে লাঞ্চ ডেটে যাচ্ছি।’

ম্যাসেজটা সেন্ড হতেই অন্তি খুব আনন্দের সাথে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ঠোঁট নেড়ে বিরবির করে দু একলাইন গান গেয়ে চলছে। মন তার তৃপ্তিতে ভরপুর। বদ লোকটা এবার বুঝুক কেমন লাগে।

দিহানের উপর আক্রমণকারীদের মধ্য থেকে‌ দুটো ছেলেকে দিহানের ছেলেরা ধরে ফেলেছে। ওদের বর্তমানে গুদামঘরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এই গুদামঘরটা অনেক পুরোনো। রেজওয়ান মির্জা তার ব্যাবসার প্রথমদিকে এটাকে ব্যাবহার করতো। পরবর্তীতে এটা বন্ধ করে ফেলে রাখা হয়। সেটাকেই দিহান তার ডেরা বানিয়েছে। ছেলেদুটোর হাত পেছন করে বাঁধা। মাথা সহ মুখ কালো কাপড়ে মোড়ানো। বুলু নামের কালো করে মোটা ছেলেটা দিহানকে ভিডিও কল করে। অন্যজনকে ইশারায় ছেলেদুটোর মুখের কাপড় সরাতে ইশারা করে। মুখের কাপড় সরালে দিহান বাঁকা হাসে। বলে,

‘ওদের সাথে যারা ছিলো তাদের সবার ইনফরমেশন বের কর ওদের মুখ থেকে। সর্বোচ্চ যন্ত্রণা দিয়ে হলেও ইনফরমেশন চাই। শুধু ওদের বাঁচিয়ে রাখলেই চলবে।’

বুলু নামের ছেলেটা সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,

‘কাজ হয়ে যাবে ভাই। চিন্তা করবেন না।’

কল কাটার পরপরই দিহানের সামনে অন্তির ম্যাসেজটা আসে। ম্যাসেজটা দেখতেই দিহানের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে নেয়। চিৎকার করে রেহানাকে ডাকে। দিহানের চিল্লাপাল।লায় রেহানা সমেত রেওয়াজ ও এসে পৌঁছায়। তিনি মাত্রই ফিরেছেন। রেহানা এসে ছেলের পাশে বসে ব্যস্ত গলায় বলে,

‘কি হয়েছে? এভাবে চিৎকার করলি কেন?’

‘আজই রূপের বাসায় যাও। যেভাবে সম্ভব সেভাবে ওর পরিবারকে মানিয়ে আসবে।’

রেহানা কিছুটা শান্তচিত্তে জবাব দিলো,

‘আজ তোর বাবা ব্যস্ত থাকবে। এত তাড়াহুড়ো করার কিছু দেখছি না আমি। সময় সুযোগ বুঝে যাব।’

‘তেমনটা হলে নিশ্চয়ই আমি তোমাকে আজ যেতে বলতাম না। আবেগে ভেসে যাওয়ার বয়স নেই আমার। যেটা বলছি প্রয়োজন আছে বলেই বলছি।’

রেজওয়ান মির্জা ছেলের কথায় অধৈর্য হয়েছে বলেন,

‘তোমার প্রয়োজনটা আমাদের ও বলো। নয়তো বুঝব কিভাবে?’

দিহান ওর বাবার বিপরীতে শক্ত গলায় বলে,

‘সেসব আপনাদের না জানলেও চলবে। আপনারা কেবল আপনাদের দায়িত্ব টুকুই সঠিক ভাবে পালন করেন। আমার কাজ আমি বুঝে নিব।’

বাপ ছেলের মাঝে বাকযুদ্ধের আভাস পেয়ে রেহানা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বলে,

‘আচ্ছা দেখছি ব্যাপারটা। আজই যাব। তোর বাবা যেতে না পারুক আমি তোর মামাকে কল করে ডেকে নিব।’

চলবে………

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩৩.
গ্রাম থেকে অন্তির ফুপি সাবিনা এসেছেন। একা মানুষ এলেও বিশাল দুটো ব্যাগ বয়ে এনেছে। যেন এখানেই ঘাঁটি স্থাপনের আশায় আছে। তিন ভাইয়ের বাড়িতে এক মাস করে না থাকলে বেরানোর মজা হয় নাকি? এসে সরাসরি বড় ভাইয়ের ঘরে উঠছে সে। সিরিয়াল অনুযায়ী বড় ভাইয়ের বাসায় কিছুদিন থাকার পর মেজভাই এর বাসায় তারপর ছোটভাই। সাবিনার আসার খবর পেতেই অন্তির ছোট চাচী দৌড়ে এসেছেন। তিনি প্রয়োজন ব্যাতীত খুব একটা অন্তিদের ঘরে আসেন না।

‘মেজভাবী শুনছেন আপা আসছে নাকি।’

নাহার খুব সাবলীল জবাব দিলো,

‘শুনলাম তো।’

‘এবার মনেহয় মাসছয়েক থাকার প্লান করে আসছে। ব্যাগ দুটো দেখছেন!’

‘থাকুক সমস্যা কোথায়? তুমি তো আপাকে ছাড়া কিছু বোঝো না। সারাদিন আপা আপা করে মাথা খেয়ে ফেল এখন সমস্যা কোথায়? করলা নাহয় আপার একটু সেবা যত্ন।’

রিপা চাচীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। চোর ধরা পড়ার মতো মুখ করে বেরিয়ে যেতে নিলেই সেখানে আগমন ঘটে সাবিনার। পান খেয়ে ঠোঁট জোড়া লাল টুকটুকে করে ফেলেছে। গায়ে টকটকে লাল রঙের একটা চাদর। হেলেদুলে এসে সোফায় বসে পান চিবুতে চিবুতে বলে,

‘আসলাম ঘন্টা পার হইছে একবার তো খোঁজ নিলা না। আমারই নামতে হইলো। এতদিন বাদে আসলাম তোমাদের আদর যত্ন কোই? আজকালকার মানুষেরা আদর যত্ন করার কথা ভুলছে। মানুষ আর মানুষ নাই।’

সাবিনার কন্ঠ হতাশা আর কষ্টে জর্জরিত। নাহার হাতের কাজ রেখে এগিয়ে আসে। ননদের কথা তার গায়ে লাগলেও আপাতত সে গায়ে লাগাতে চাচ্ছে না। ননদ জাতটাই এমন। যতদিন থাকবে উঠতে বসতে এমন কথা শুনতে হবে। উত্তর দিতে গেলে স্বামীর কাছে খারাপ হতে হবে। কি দরকার? ওসব গায়ে না নেওয়া ভালো। রিপা চাচী তার রূপ বদলে ফেলেছে। সাবিনার পাশে বসে একগাল হেসে বলে,

‘কি যে বলেন আপা! আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। মেজভাবীকে সাথে নিয়ে যেতে আসলাম। এর মাঝেই তো আপনি চলে এলেন। তা শরীর কেমন? শুকাইছেন মনে হচ্ছে!’

নাহার ভেবে পায়না এমন হাতির মতো শরীরের কোন অংশ শুকাইছে। এসব লো ক্লাস তেল তার ছোট জা-কে দিয়েই সম্ভব।

বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে অন্তি। এসে কারো সাথে কথা না বলেই নিজ রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। নাহার চিন্তিত চিত্তে মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকায়। গলা উঁচিয়ে দু একবার প্রশ্ন করে,

‘কি হয়েছে? এত দ্রুত ফিরলি কেন?’

অন্তি জবাব দেয়নি। নাহারের মোন কেমন খচখচ করছে। এভাবে একটা ছেলের সাথে মেয়েকে পাঠানো কি ঠিক হলো? ঝোঁকের বশে বিবেগ হারিয়েছে একদম সে। নিজের বিবেগের উপর ভিষণ রাগ হলো সাথে মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা ও। এদিকে সাবিনাকে দেখেও এড়িয়ে যাওয়ায় দারুন ক্ষেপেছে সাবিনা। তার এতবড় বেইজ্জতি সে কিভাবে মেনে নিবে!

‘ভাইয়ের বাসায় আসলাম ভাইয়ের বউ মুখ ফিরায় নিলো এখন কিনা ভাইঝি ও! এই দিন দেখা লাগলো আমার।’

নাহার নরম গলায় বলে,

‘আপা আপনি ভুল বুঝছেন। ও হয়তো কোনো ব্যাপারে রেগে আছে। আপনি খেতে আসুনতো। ও ছোট মানুষ, ওর কাজ ধরার মতো কিছুনা। আপনার জন্য বড় রুইমাছ রান্না করেছি।’

______________

সাহেদ বাড়ি ফেরার পর বেশ বড়সড় আকারে বৈঠক বসেছে। বৈঠকটা মূলত অন্তি আর আরাভকে নিয়ে। আজ অন্তিকে নিয়ে আরাভ জমকালো কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলো। সেখানে তার গোটাকয়েক বন্ধুরাও ছিল। কিন্তু আরাভ সহ তার বন্ধুরা যেমন পরিবেশ গড়ে তুলেছিল তেমন পরিবেশে কোনো সভ্য পরিবারের মেয়ের পক্ষে থাকা সম্ভব না। অন্তির বড় চাচা সবটা জানির পর ভাইয়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন। অন্য কোনো ছেলের ভরসায় কিভাবে সে বাড়ির মেয়েকে ছাড়তে পারে। সাবিনাও ভাইয়ের উপর হতাশা প্রকাশ করলেন। কড়া গলায় বললেন,

‘দরকার হলে মেয়ের বিয়ে দেব না তাও ঐ ছেলেকে জামাই হিসেবে চাইনা। কথাটা মাথায় ঢুকা সাহেদ। এই নিয়ে ফের যেন দুটো কথা আমার বলতে না হয়।’

সাহেদ মাথা নিচু করে বসে থাকেন। নিজের বিবেগের উপর ঘৃণা হচ্ছে তার। আজ যদি খারাপ কোনো কিছু ঘটে যেত? কি করতেন তিনি? কিভাবে মুখ দেখাতেন মেয়েকে? ভয়ে বুকটা মুচরে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে।
নাহারের চোখ ভরা পানি। মেয়েটা তার যেতে চায়নি। সে জোর করে পাঠিয়েছে। এর সবটা দ্বায় তার। মেয়ের ভালো চাইতে চাইতে যে খারাপ করে ফেলছিলো সেটাই বুঝতে পারেনি সে।

শাহিন সাহেব আলোচনার ইতি টানতে বলেন,

‘যা হয়েছে সেটাতো বদলানো যাবে না। কিন্তু তোমরা সচেতন হও। তাছারা আমাদের মেয়ে এখনো ছোট। বিয়ে দেওয়ার সময় যথেষ্ট রয়েছে। ওকে ওর মতো করে সময় দাও। নিজ পায়ে দাঁড়াক।’

শাহিন কথা শেষ করে উঠে যাওয়ার পরপর সবাই সবার জায়গা থেকে উঠে যায়। এই বৈঠকে অন্তি অনুপস্থিত ছিলো। সে রুমের দরজা আটকে বসে আছে। বাবা মায়ের উপর তার অনেক অভিমান জমেছে। আরাভের মতো খারাপ একটা ছেলেকেই কেন তাদের এতো পছন্দ হতে হবে। দিহানকে কেন তাদের চোখে পড়ে না? দিহান তো ওমন না। সে আলাদা। অন্যসব গুন্ডা মাস্তানদের মতো না। তবুও মায়ের ভিষণ অপছন্দ। এখানেই অন্তির অভিমান আটকে আছে।

রাতে খেতে ডাকা হয়েছে অন্তিকে। কিন্তু সে দরজা খোলেনি। নাহার সাহেদের প্লেটে খাবার বেড়ে দিলে সাহেদ না খেয়েই উঠে যায়। নাহারের চোখ ভরে আসে। তার ও খাওয়া হয়না। খাবার গুছিয়ে ফ্রিজে তুলে রাখে। পারুকে ডেকে খেয়ে নিতে বলে। তার খাবার বেড়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির এমন অবস্থায় পারুর মনটাও খারাপ। সে ও ভিষণ মন খারাপ নিয়ে বলে,

‘খাইবার মন চায়না খালা। আপারে ভাত না খাওয়াইয়া আমি কোনোদিন খাইছি বলেন? আপা খায়নায় আমি কেমনে খাই?’

নাহার ওর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে,

‘ভাত খেয়ে প্লেট ধুয়ে রাখিস। তরকারিটা বাইরে আছে ফ্রিজে রেখে দিবি মনে করে।’

_______________

দুদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও রেজওয়ান মির্জা সময় বের করতে পারছেন না ছেলের জন্য অন্তির হাত চাইতে যাওয়ার। এদিকে রেহানা আতঙ্কিত হয়ে আছে। দিহান না ঝামেলা করে। ছেলের উপর তার বিশ্বাস নেই যেমনটা ছেলের বাপের উপর নেই তার। দুজনের কেউই সোজা কথার মানুষ না।
রেজওয়ান মির্জা পেপার পড়া শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক বসান। রেহানা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেন,

‘আপনার ভাবজ্ঞান কি? কি করতে চাচ্ছেন?’

রেজওয়ান মির্জা স্ত্রীর কথার মর্ম বুঝতে না পেরে বলেন,

‘কোন ব্যাপারে বলছো?’

রেহানা স্বামীর কথায় আশ্চর্য না হয়ে পারেন না। দুদিন যেতে না যেতে এত বড় একটা ব্যাপার ভুলে বসেছে মানুষটা। ছেলেকে সে চেনেনা? এ ব্যাপারে দিহান জানতে পারলে বাড়ি মাথায় তুলবে। নিজের রাগ চেপে রেহানা বলে,

‘আপনার আজ যত কাজ আছে ক্যান্সেল করুন। আমরা রূপন্তিদের ভাসায় যাচ্ছি আজ। এটাই ফাইনাল।’

রেজওয়ান চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বিতৃষ্ণ গলায় বলেন,

‘ছেলের সাথে সাথে তোমার মাথাও খারাপ হয়েছে রেহানা। ওর শরীরের অবস্থা কি? এই অবস্থায় বিয়ের ভূত চেপেছে মাথায়। তুমিও সেই ভুতকে দুধ কলা দিয়ে আপ্পায়ন করছো।’

রেহানা গলায় দ্বিগুণ তেজ নিয়ে জবাব দেন,

‘গেলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। তাদের ও তো মতামত থাকবে। কথা বলতে সমস্যা কোথায়? কোনো কারণ ছাড়া তো ছেলে এত ব্যস্ত হয়নি। আপনি না চিনলেও আমার ছেলেকে আমি চিনি। সংসারের কোনো ব্যাপারে আপনি সিরিয়াস না। সব কিছুই আপনার কাছে ফালতু মনে হয়।’

‘এখানে সংসারের ব্যাপার কেন আসছে? আশ্চর্য!’

‘আশ্চর্যর কি দেখলে? আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই বলিনি আমি। যা বলেছি সবটা সত্যি।’

এ পর্যায়ে রেজওয়ান মির্জা হার মেনে নেন। ক্লান্ত গলায় বলেন,

‘আচ্ছা আজ যাচ্ছি আমরা। সময় মতো তৈরি হয়ে নিও।’

চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে