তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-৩৪

0
296

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩৪.
পড়ন্ত বিকেল। আকাশে রোদের সোনালী আলো লুটোপুটি খাচ্ছে। ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝ বয়সী মেহগনি গাছটার সকল পাতা ঝড়ে পড়েছে। কয়েকটা লাল রঙের মুর্ষে পড়া পাতার অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। হয়তো দিন দুয়েক যেতেই পতন ঘটবে তাদের। গাছের চিকন একটা ডালে বসে ভিষণ করুন সুরে কা কা করে ডেকে চলেছে একটা কাক। হয়তো হারিয়ে যাওয়া সঙ্গিকে খুঁজছে সে। আশপাশে থাকা জীবগুলো তার ডাকে অস্থির হচ্ছে তাতে তার মাথা ব্যাথা নেই। নিজের জীবন যেখানে ডুবিডুবি অন্যের কথা চিন্তা করে কি হবে? নুহাশ অবশ্য বিরক্ত হচ্ছে না। তার মায়ার শরীর। কাকটার জন্য তার হৃদয় হাহাকার করছে। সঙ্গীহীন জীবন সত্যিই ভয়ংকর। এই ভয়ংকর জীবন থেকে এই বোবা প্রাণিটাকে উদ্ধার করো মাবুত!

‘এভাবেই বসে থাকবেন? কিছু না বলার থাকলে আমি উঠি?’

নুহাশ এতক্ষণে কাকের চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলো। তার পাশে বসা পরীর মতো মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়েছে। চলে যেতে প্রস্তুত সে। হয়তো খানিক রেগেছেও। ফর্সা মুখটা কেমন লাল হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে নাক। সুন্দরী মেয়েদের রাগলে বেশি সুন্দর লাগে। কৃত্রিম ব্লাসের প্রয়োজন হয় না। কোথাও যেতে হলে রাগ করে সৌন্দর্য বাড়ালেই হয়। অযথা টাকা খরচ করে মেকআপ করার কি দরকার?
নুহাশের এখন মেকআপ নিয়ে চিন্তা করার সময় না। তার উচিত সুন্দরীর রাগ ভাঙানো। ভাগ্য করে এমন সুন্দরী একটা প্রমিকা পেয়েছে সে, রাগ ভাঙাতে না পারলে প্রেমিক হিসেবে জাতি তাকে তীব্র নিন্দা জানাবে যে!

‘আর কিছুক্ষণ বসো? বাদাম খাবে?’

তন্নি দাঁত চেপে উত্তর দেয়,

‘অলরেডি বাদাম, ঝালমুড়ি, ফুচকা সব খেয়ে ফেলেছি। আপনার মাথাটা বাকি কেবল।’

‘আমার আপত্তি নেই তুমি এটাও খেতে পারো।’

নুহাশের নিঃস্বার্থ এই ভালোবাসা তার প্রেমিকার হৃদয় ছুঁতে পারলো না। রমনী ভয়ংকর দৃষ্টি ছুঁড়ে হেঁটে চলে যেতে লাগলো। নুহাশ ঠাঁয় বসে রইল। আজকাল কোনো কিছুই তার মত অনুযায়ী চলেনা। তার এক ধমকে একশো হৃদয় কাপলেও এই রমনীর হৃদয়ে সামান্য দোল খেলে না। নুহাশ আরো একটা ভয়ংকর সত্য আবিস্কার করেছে। এই রমনীর সামনে সে খুব নার্ভাস হয়ে পড়ে। বাঘের মতো গর্জে উঠলেও মুখ থেকে আওয়াজ আসে ‘ম্যাও’।

_____________

দিহানের পরিবার থেকে লোক এসেছে অন্তির বাসায়। এই কথা শোনার পর থেকে অন্তি রুমের দরজা বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে আছে। রুমের বাতি সব বন্ধ। আনন্দ আর ভয় দুটো গাঢ় অনুভূতির দরুন চোখ থেকে টুপটাপ করে জল গড়াচ্ছে। বুকের ভেতরটা অস্বভাবিক হারে কাঁপছে। যেন তোলপাড় চলছে সেখানে। সমস্ত শরীর মৃদু কাঁপছে। হাত দুটো মুঠো করে রেখে একাধারে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করে চলছে। একবারের জন্য হলেও যেন তিনি তার দোয়া কবুল করেন।

নাহার বিরস মুখে আপ্যায়নের বন্দোবস্ত করছে। তার চেহারা‌ দেখে বোঝা যাচ্ছে দিহানের পরিবার আসায় সে মোটেও খুশি না। সাহেদের আচরণে তেমন কোনো কিছু প্রকাশ পাচ্ছে না। সে হাসি মুখে কথা বলছে রেজওয়ান মির্জার সাথে। কখনো হা হা হাসির ধ্বনিতে কেঁপে উঠছে ঘর। শাহিনকে খবর দেওয়া হয়েছে। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলেও দিহানের পরিবার এসেছে শুনতেই জানালেন কিছুক্ষণের মাঝেই তিনি আসছেন। একবার যে ভুল হয়েছে দ্বিতীয়বার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাননা তিনি। পরিবারের মেয়েদের নিয়ে তিনি ভিষণ সিরিয়াস।

রেহানা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই নাহারের সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলো। ছেলের থেকে যতদূর শুনেছেন তিনি আর যা দেখছেন তাতে তিনি বেশ বুঝতে পারছেন তাদের আসায় নাহার খুশি হয়নি। এড়িয়ে চলছে খুব। নাহার মিষ্টির ট্রে হাতে বসার ঘরে আসতেই নাহার হেসে তার হাত ধরেন। হেসে বলেন,

‘বসুন না! আপনার সাথে একটু কথা বলি।’

নাহার অস্বস্তিতে পড়ে যায়। হাত ছাড়িয়ে চলে যাওয়ার মতো অভদ্র আচরণ তাকে মানায় না। আবার পাশে বসে আলাপ জুড়ে দেওয়ার মতো কাজেও মন টানছে না। সাহেদ চোখের ইশারায় স্ত্রীকে বসতে আদেশ করে। সাহেদের ইশারা পেতে নাহার বসে পড়ে। মুচকি হেসে বলে,

‘হ্যা বলুন। কেমন আছেন?’

স্ত্রীকে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে সাহেদ কিছুটা স্বস্তি পায়। টুকটাক কথার মাঝেই শাহিন চলে আসে। শাহিন আসতেই রেজওয়ান মির্জা কৌশলে বলেন,

‘এবার তাহলে মূল আলোচনায় আসি, কি বলেন?’

শাহিন সম্মতি জানিয়ে বলে,

‘হ্যা হ্যা অবশ্যই।’

রেজওয়ান মির্জা আলতো হেসে বলেন,

‘সাহেদ সাহেব আপনার মেয়েটাকে আমি দেখিনি কিন্তু দিহানের মায়ের থেকে যতটুকু শুনেছি ভিষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার মেয়ে নেই। কেবল দুটো ছেলে। বড় ছেলেটাকে ঠিকঠাক মানুষ করতে পারলেও ছোটটার সাথে পেরে উঠিনি। কিন্তু আমার আশা ভরসা ওর উপর ছিলো সবথেকে বেশি। ছেলেটা আমার হুট করেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লো। বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী হওয়া সত্ত্বেও তা ছেড়ে এর পেছনে পড়ে রইলো। সত্যি বলতে আমি বাবা হিসেবে যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। কিন্তু ছেলের মত বদলাতে পারিনি। তবে আমি আমার ছেলের উপর অসন্তুষ্ট না। কারণ বাবা হিসেবে আমি এতটুকু গর্ব করে বলতে পারবো আমার ছেলেটা বেষ্ট। সেটা সে যে পর্যায়েই থাকুক না কেন।’

এ পর্যন্ত বলে থামেন রেজওয়ান মির্জা। বড় করে শ্বাস ফেলে স্ত্রীর দিকে তাকান। যেন চোখের ইশারায় বলছেন,’ শেষটা নাহয় তুমি করো।’

রেহানা স্বামীর চোখের ভাষা বুঝে আলতো হাতে নাহারের হাত আঁকড়ে ধরেন। বলেন,

‘আপা আপনারা আমার ছেলে সম্পর্কে কতটুকু জানেন তা আমি জানি না। তবে আপনার মেয়ের চোখে আমি আমার ছেলের প্রতি যে টান দেখেছি তাতে আমি বলতে পারি মেয়েটা ভেতর থেকে আমার ছেলেটাকে বুঝতে পেরেছে। খুব কি অন্যায় হয় যদি আপনারাও একটু ছেলেটাকে মেনে নেন? আমি ছেলের মা হয়ে অনুরোধ করছি তার মানে এমন না আমার ছেলে দুর্বল। আমি অনুরোধ করছি কারণ আপনার মেয়েটাকেই আমার চাই নিজের মেয়ের মতো করে।’

নাহার কি জবাব দিবে খুঁজে পেল না। শাহিন যেসব কথা গুছিয়ে রেখেছিলো তা প্রয়োগ করার মতো জায়গা খুঁজে পেল না। রেজওয়ান মির্জা আর রেহানার কথায় অত্যন্দ নম্রতা ছিলো যা সাহেদ কিংবা শাহিনকে কঠিন হতে রোধ করেছে।

অন্তি গাঢ়ো নীল রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। শাড়িটা নাহার নিজ হাতেই পড়িয়ে দিয়েছে। শাড়ি পড়ার পুরো সময়টুকু অন্তি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মুখ পড়ার সামান্য চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু নাহারে মুখোভাব দেখে সে কিছুই বুঝতে পারেনি। শাড়ি পড়া শেষে নাহার তার রুম থেকে একটা সাদা পাথরের নেকলেস এনে দেন। সাথে ম্যাচিং দুল।

‘এটা পড়ে নে। ভালো লাগবে। অল্প একটু সাজিস।’

‘আচ্ছা।’

‘তৈরি হয়ে আমায় ডাক দিস।’

নাহার চলে যেতে নিলে অন্তি পেছন থেকে ডাক দেয়।

‘মা?’

‘হুম।’

‘রেগে আছো আমার উপর?’

‘না।’

‘সত্যি?’

‘জানিনা।’

‘আমি স্যরি মা।’

‘ঠিক আছে।’

‘দিহান সত্যিই ভিষণ ভালো মা। আরাভের থেকে অনেক ভালো। তুমি নিজ চোখেই দেখে নিও। আমি সত্যি বলছি মা।’

‘আচ্ছা।’

‘তুমি রাগ কোরো না প্লিজ। আমি কষ্ট পাচ্ছি।’

‘তৈরি হয়ে নে। আমি মিলাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

অন্তির চোখ ভরে আসে। নাহার তার উপর রাগ করেছে। সে ঠিক বুঝেছে। সে তো মা কে কষ্ট দিতে চায়নি। সে ইচ্ছা করে কিচ্ছু করেনি। সে তো দিহানকে সহ সবাইকে চেয়েছে। এজন্য একটু অবাধ্য হয়েছে। খুব বেশি ভুল করেছে কি? মা কি তাকে একটু মাফ করে দিতে পারে না?

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে