কাগজের নৌকা পর্ব-১

0
1762

# কাগজের নৌকা
# লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
#পর্ব: ১ম

.
আব্বা মারা যাবার ৬মাস না যেতেই বাবুল চাচার আমাদের বাড়িতে রোজ যাতায়াত শুরু হয়েছে। চাচা আসলেই মা ভাত বসাতেন বা চায়ের পানি চড়াত। চাচা আসার সময় হাতে করে বাজার নিয়ে আসত, ব্যাগ ভর্তি বাজার। মা উনার হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বিমর্ষ চাহনিতে নরম কণ্ঠে বলে উঠতেন,
‘ঘরে গিয়া বসেন। আমি চায়ের পানি চড়াই।’
মায়ের নরম কথায় বাবুল চাচা হাসি দিতো। এ হাসির অর্থ আমার তখনও জানা ছিল না। বয়সটা কম আমার, ১০ বছর হবে। সব জিনিস এতটা না বুঝলেও শুধু এতটুকু বুঝতাম বাবুল চাচা আমাদের সাহায্য করছেন। নাহলে প্রতিদিন আমার জন্য লজেন্স আনবেই বা কেন?
আমি বস্তির ওই ঝুঁপড়ির ঘরটাতে থাকলে উনি আমার হাতে লজেন্স হাতে দিয়ে বলতেন,
‘নে আপন, লজেন্স খা।’
আমিও হাসিমুখে লজেন্স নিয়ে বাইরে ছুটতাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। দুটো লজেন্স পেলে একটা মালাকে দিতাম, আরেকটা আমি খেতাম। একটা থাকলে সমান সমান ভাগ করে খেতাম। মালা আমার ছোটবেলার বন্ধু। অনেক ভালো বন্ধু। দিনের অনেকটা সময় আমরা স্টেশনে কাটাই। ভাঙরি জমাই, ট্রেন আসলে কুলির কাজ করি, কখনও কখনও বাদাম-বুটও বেঁচি। এই স্টেশনে অনেকের সাথেই সখ্যতা কিন্তু মালার সাথে সখ্যতা আমার ছোট থেকেই। মালার বাবা-মা নেই, আমাদের বস্তিতে ওর বুড়ি নানীর সাথে থাকে। আপন বলতে শুধু ওই বুড়ি নানীই সব।
স্টেশনের পাশেই বস্তি। এ জীবন কেমন তা সভ্য জগতের মানুষের উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সভ্য সমাজ যা জানে তার ছিটেফোঁটাও আমাদের সাথে মেলে কিনা সন্দেহ। হ্যাঁ, আমরা টোকাই, আমরা কুলি, আমরা ফেরিওয়ালা। আমরা সভ্য সমাজের মানুষের মতো ওত শিক্ষিত নই। আমরা দুবেলা পেট পুরে খেতে পেলেই খুশি হই।
.
আজকে ভাঙরি বেশি পাইনি। যা পেয়েছিলাম তা খুব কম। মহাজন টাকাও বেশি দেয়নি। ১০টাকা দিয়েছে। মালার সাদা মুখটা আজ কালো হয়ে গেছে। সেও বেশি কিছু পায়নি। বাড়িতে কী নিয়ে ফিরবে এটা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। কুলির কাজ করেও শান্তি পাই না। আমাদের দিয়ে কেউ কেউ কাজ করায় না, আমরা নাকি ছোট। আবার কেউ বড়বড় সুটকেস মাথায় চাপিয়ে দুটাকা তিন টাকা দিয়ে লাত্থি মারে। এরাই তো সভ্য সমাজের মানুষ। কষ্ট লাগে খুব, ঢের কষ্ট।
‘নে, তুই এ দশটাকা নে।’
মালা আমার দিকে একবার তাকায়, আরেকবার টাকার দিকে তাকায়।
‘কী ভাবছিস? নে, ধর।’
‘চাচী তোকে বকবে রে।’
আমি হাসি। হেসে বলি,
‘মা আমাকে এখন আর বকে না রে। ওই বাবুল চাচা আছে না? উনি আমাদের ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করে দেয়।’
‘আচ্ছা উনি ক্যান ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করে দেয়?
‘আমাদের সাহায্য করে তাই।’
‘তাহলে আমাদের সাহায্য করে না ক্যান? আমরাও তো দুই বেলা খাইতে পারি না।’
আমি আবার হাসি। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাই। তারপর বলি,
‘আচ্ছা বাবুল চাচাকে বলব, তোরেও যেন সাহায্য করে। ক্যামন? এবার টাকাটা ধর। চল, বাড়ি যাই।’
মালা টাকাটা হাতে নেয়। তারপর দুজনে ট্রেন লাইন ধরে বস্তির দিকে হাঁটা দেই।
.
বস্তিতে ফিরেই দেখলাম ঝুঁপড়ির দরজা দেয়া। ঝুপড়িই বললাম। ঘরটাতো ছোট। আর একটাই ঘর। মা আর আমি মেঝেতে বিছানা করে ঘুমাই। আমাদের খাট নেই তাই। মা আমাকে কোলের কাছে নিয়ে এখনও ঘুমায়। আব্বা থাকতেও আমাদের কষ্ট হতো, কিন্তু এতটা না। আব্বা আর মা দুপাশে ঘুমাতো আর আমি মাঝখানে। কী শান্তির ঘুম। এখনও আমি মায়ের কোলে শান্তিতে ঘুমাই। তবে আমি বুঝতে পারি মা অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমায় না। চোখের জল ফেলে। মায়ের চোখের জল মাঝেমাঝে আমার মাথা স্পর্শ করে। আমি ঘুমের ভান করে থাকি। আব্বাকে হারানোর পর মা কেমন যেন হয়ে গেছে। তবে ইদানীং মাকে একটু ফুরফুরে মনে হয়। যবে থেকে বাবুল চাচা আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করে তবে থেকে। আব্বা মারা যাওয়ার পর মা তেমন সাজগোছও করত না। এখন একটু সাজগোছও করে। ভালোই লাগে আমার। সবকিছু এত ভালো চলতেছে!
বাবুল চাচার মতো মানুষ যদি আরও অনেক থাকত তাহলে বস্তিবাসীদের এত কষ্ট থাকত না।
ঝুঁপড়ির সামনে গিয়ে বুঝলাম মা ভেতরে আছে। আরও কেউ থাকতে পারে। কেন জানি আজ ডাকলাম না। চুপিচুপি উঁকি দিলাম।
যা দেখলাম তা নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চোখে হাত দিয়ে ঘষা দিয়ে আবার দেখার চেষ্টা করলাম। যা দেখছি তাই সত্যি।
মায়ের সাথে বাবুল চাচা লেপ্টে আছে। দুজন সুখের সাগরে হয়ত হাবুডুবু খাচ্ছে। আমি ধরাৎ করে বসে পড়লাম। যা দেখছি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি এতকিছু বুঝি না। শুধু এতটুকু জানি মা আর বাবুল চাচা যা করছেন তা ভালো নয়। খারাপ কাজ, খুব বাজে কাজ। কতক্ষণ বাইরে বসে ছিলাম আমার মনে নেই। তখনও বাবুল চাচা ঝুঁপড়ি থেকে বের হয়নি। মালার ডাকে আমি তার দিকে তাকালাম। অস্ফুটভাবে বললাম,
‘অ্যাহ।’
‘যাবি না?’
‘কোথায়?
‘ট্রেন আইতাছে।’
আমি উঠলাম। বললাম,
‘তুই সামনে যা, আমি আইতাছি।’
‘আচ্ছা।’
মালা এগিয়ে গেল। আমি আরেকবার ঘরে উঁকি দিলাম। শুয়ে থেকে দুজন যেন কী শলাপরামর্শ করছে। চুপচাপ আমি মালাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। কয়েকটা ব্যাগ ধরতে পারলে মালার আজকের খাওয়াটা হয়তো হয়ে যাবে। আমার না খেলেও চলবে। যা দেখলাম তাতে পেটের ক্ষুধা মিটে গেছে। নিজের প্রতি প্রচণ্ড রাগ হতে শুরু হলো। কেন উঁকি দিলাম। না দেয়াই তো ভালো ছিল। কেন এত তাড়াতাড়ি ফিরলাম ঝুঁপড়িতে। এত তাড়াতাড়ি না আসাই তো ভালো ছিল। মনে মনে কপাল চাপড়াতে থাকলাম। সুখের পৃথিবীতে মেঘের ঘনঘটা।
.
রাতে ঝুঁপড়িতে ফিরে দেখলাম গোস্তের সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। আজকের ঘটনার পর আমি বুঝতে পারলাম এ সুগন্ধ নয়, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আমার ভীষণ বমি পাচ্ছিল। নিজেকে ঠিক রেখে ঝুঁপড়িতে ঢুকলাম। বাবুল চাচা চলে গেছে। মায়ের সাথে যে জায়গাটায় খারাপ কাজ করছিল সে জায়গাটা দেখতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। মা পেছন থেকে ডাকে,
‘আপন, কী রে বাপ। কী হইছে তোর?’
আমি কোনো কথা না বলে চুপ থাকি। মা আবার আমাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কথা কস না ক্যান আপন? কী হইছে?
আমি এবার বললাম,
‘গোস্ত পাইলা কই মা?’
মা হাসে উত্তর দেয়,
‘তোর বাবুল চাচা দিয়ে গেছে।’
‘বাবুল চাচা শুধু আমাগোরে কেন দেয়? বস্তিতে আরও ম্যালা মানুষ আছে তো তাগো রে দেয় না, খালি আমাগো দেয়। ক্যান মা?
আমার এ প্রশ্ন শুনে মা হতভম্ব হয়ে যায়। হয়তো মনে মনে ভাবে এ কোন আপনকে দেখছি।
‘কও মা, চুপ থাকিস না।’
মা বলে,
‘তোর এত কথার উত্তর দিবার পামু না। যা গায়ে পানি দিয়া আয়।’
আমি দাঁড়িয়ে থাকি। নড়াচড়া করি না। আব্বা মারা যাবার পর আমরা হয়তো খারাপ অবস্থায় ছিলাম, কিন্তু না খেয়ে ছিলাম না। মানুষের লাত্থি উষ্ঠা একবার খেলেও আরেকবার ঠিকই পেটের অর্ধেকটা পূরণ হতো।
‘কী হলো, যা। দাঁড়াই আছিস যে।’
মায়ের কথায় আমি কলের দিকে হাঁটা দিলাম।
.
খেতে বসলাম। মুখটা ভার হয়ে আছে। সামনে গরুর গোস্ত, ডাল আর ভর্তা। আমি শুধু ডাল আর ভর্তা নিলাম। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘গোস্ত নিলি না বাপ?’
আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম,
‘না মা।’
‘ক্যান? তোর না গরুর গোস্ত ম্যালা পছন্দের। সেই জন্যে তোর বাবুল চাচাকে গোস্ত আনতে কইছিলাম। নে, খা, আমি দিতেছি।’
মা গোস্ত দেয়ার জন্য চামুচে গোস্ত তুলে আমার পাতের দিকে ধরলো। আমি প্লেটটা সরালাম।
‘কী হইল বাপ? নে।’
‘না মা, খামু না। আইজ ভাল্লাগতাছে না।’
‘কী হইছে তোর? আইজ এমন করতাছোস ক্যান? জ্বর আসছে নাকি? দেখি।’
মা আমার দিকে হাত বাড়ায়, আমি হাত সরিয়ে দেই। এ হাতে পাপ লেগে আছে যে।
‘মা, বাবুল চাচারে আর গোস্ত আনতে কইয়ো না। আমার ভাল্লাগে না গোস্ত।’
আমার আজকের কথাবার্তা শুনে মা কিছুটা অবাকই হয়েছে। আমি তার দিকে তাকাইনি। শুধু ডাল আর ভর্তা দিয়ে চুপচাপ ভাত খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আমি গোস্ত খেলাম না বলে মাও খেল না। আমার পাশে শুয়ে পড়ল। আজকে আমাকে আর কাছে টেনে নিলো না। টানলেও হাত সরিয়ে দিতাম। ওই হাত আর শরীরে পাপ লেগে আছে যে।
সারারাত আমার চোখে ঘুম নেই। শুধু বাবুল চাচা আর মায়ের লেপ্টে থাকার দৃশ্য বারবার মনে পড়ছিল। এতবার এ দৃশ্যটাকে সরাতে চাইলাম, কিন্তু ব্যর্থই হলাম।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে