কাগজের নৌকা পর্ব – ৯ (অন্তিম পর্ব)

0
1293

# কাগজের নৌকা
# লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
# পর্ব: ০৯ (অন্তিম পর্ব)
.
.
নিমিষেই বাবুল চাচার মাথাটা আলাদা হয়ে গেল। আমি সামনে তাকালাম। মা দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছে। হাতে একটা ধারালো বটি। আমি দ্রুত উঠে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কী করলি এটা মা?’
মা একটা পলকও ফেলে না। চুপচাপ লাশটার দিকে তাকিয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি মাকে হাত দিয়ে নাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
‘মা এটা কী করলি তুই? মেরে ফেললি তোর স্বামীকে?’
মা হুহু করে কেঁদে উঠলো। ধপাস করে বসে পড়লো। হাত থেকে বটিটা পড়ে গেল। একটু পর নিজে চুপ হয়ে বললো,
‘আমার কাছে আমার পোলা আগে। যে মানুষটা ভালোবাসা দেবার নাম করে, ভালো রাখার নাম করে আমাকে অপবিত্র করছে তার এই দুনিয়ায় বাঁইচা থাকার কোনো অধিকার নাই।’
‘তাই বলে মাইরা ফেলবি মা?’
‘তুই কি ভাবছিস যে তোর মা এখানে খুব সুখে আছে?’
আমি মাথা নিচু করলাম। আমার সারা গা ঘেমে গেছে। গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে গেছে। বাইরে বৃষ্টিও কমেছে। রাত কয়টা বাজে আমার জানা নেই। তবে মধ্যরাত্রি যে হবে সেটা আমি বুঝতে পারছি।
‘না মা।’
‘বিয়ার দুই দিন পর্যন্ত ভালা আছিল মানুষটা। তারপর আমাকে জোর করে এ ব্যবসায় নামাইছে। এ কাজ না করলে তোকে আর মালাকে জানে খতম করবে সে হুমকি দিছে। আমি কী করমু বাপ, তুই ক? আমার শরীরটা অপবিত্র হওয়ার কারণে সবাই ভালো আছে সুখে আছে, এর চাইতে আর কী চাওয়ার থাকবার পারে বাপ?’
‘তুই যে ভালো নেই মা সেটা তো আমি জানি। যদি জানতাম এ লোকটা এতবেশি খারাপ আছিল তাইলে তোরে নিয়া এই স্টেশন ছাইড়া বহুদূর চইলা যাইতাম।’
‘সবকিছু এত সহজ না বাপ। প্রথমে এই লোকটা ভালোবাসার কথা বইলা, আমার একাকীত্বের সুযোগ লইয়া আমার মন জিতছে, তারপর আমার পবিত্র শরীরে হাত দিয়া অপবিত্র বানাইছে। আমাকে ব্যবসায় নামানোর জন্যে বিয়ের নাটক সাজাইছে। সব শেষে আমি হাইরা গেছি বাপ। এই দামি শাড়ি, সাজগোজ সব অপবিত্র টাকায় কেনা। আমি মইরা গেছি বাপ, অনেক আগেই মরছি। এই যে আমারে দেখতাছোস, এটা আমার শুধু শরীরটা।’
আমি মায়ের কথা কাঁদতে শুরু করলাম। এতগুলো কথার বিপরীতে আমার কী বলা উচিত আমি ভেবে পাচ্ছি না। তবুও মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
‘আল্লাহ আমাদের কী পরীক্ষা নিচ্ছে মা?’
মা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
‘প্রত্যেকদিন নতুন নতুন কাস্টমার আইসে। কোনো রাইতে চারজন পর্যন্ত। আমি ক্লান্ত হইয়া যাই। কুত্তাটার কাছে হাতজোর করি, আমার কথা শুনে না। কাস্টমারের চাহিদা পূরণ কইরা ওর চাহিদা পূরণ করা লাগে। সারা রাইত অত্যাচার করে। আমি শুধু চুপ থাকি বাপ। নইলে ওয় তোরে মাইরা ফেলত। মানুষটার অনেকদূর পর্যন্ত হাত।’
‘চল মা। আমরা পালাইয়া যাই।’
মা মেকি হাসে। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এ হাসার কারণ আজ আমি বুঝতে পারছি। হয়তো মা ভাবছে এখন আর কিছু বাকি নেই, সব শেষ। খেলা শেষ।
‘চল মা। অনেকদূরে চইলা যাই।’
‘না তা হয় না বাপ। কুত্তাটা কাগজে-কলমে আমার স্বামী আছিল। পুলিশ আইবো, জেরা করব। নইলে তোরেও ধরব বাপ।’
‘আমি সেটা ভয় করি না মা। চল তুই।’
মা আমার হাতটা ছেড়ে দিলো। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাই। রক্তমাখা বটিটা তার হাত থেকে কেড়ে নিতে চাই। মা দেয় না।
‘দে মা, বটিটা আমায় দে। তুই পালাইয়া যা। যা কওনের আমি পুলিশরে কমু।’
মা হাসে এবার। মায়ের হাসি দেখে মনে হয় এই লোকটাকে মেরে সে খুশি হয়েছে, অনেক খুশি।
‘যা বাপ, মালারে নিয়া অনেকদূরে চইলা যা। আমার কথা ভাবিস না।’
‘কিন্তু মা তোরে এইখানে ফালাইয়া আমি যামু না। তুইও চল।’
‘না বাপ, আমার কথা শোন। বেশ্যা হলেও আমি তোর মা।’
‘কিন্তু মা….’
‘আর কোনো কথা কবি না। যা চইলা যা। ভোর হইতাছে। বাইরে বৃষ্টিও নাই। সকালের ট্রেন ধর। যা কইতাছি।’
আমি কাঁদছি। মাকে জড়িয়ে ধরলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
‘তোরে ছাইড়া আমি কই যামু মা। আমারে তাড়াইয়া দিস না। আমিও তোর লগে জেলে যামু।’
‘না, বাপ। মালার কী হইব? আমি বের হয়ে তোরে খুঁইজ্জা নিমু বাপ। দুনিয়াটা এত বড় নয়।’
আমি হাউমাউ করে উঠলাম। মা আমার কপালে চুমু খেয়ে বললো,
‘শুধু তোর মাকে এতটাও খারাপ ভাবিস না বাপ। আমিও ভালা একটা সংসারের স্বপ্ন দেখছিলাম। এই মানুষটা আমায় শেষ কইরা দিছে। তাই আইজ ওরে আমি শেষ করলাম। এই মানুষটার মতো লোকের বাঁইচা থাকার কোনো অধিকার নেই।’
‘না মা।’
‘যা বাপ, তাড়াতাড়ি যা। একটু পর লোকজনের যাতায়াত শুরু হইব।’
আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। মাকে ছাড়তে আমার ইচ্ছে করছে না। আল্লাহ কঠিন বিপদে আমাকে ফেলেছে। বেশ্যা হলেও তো আমার মা। আমার জন্মদাত্রী। আমাকে যে বড় করেছে। আমি চলে যাচ্ছি না দেখে মা আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে আসলো। আসার সময় দেখলাম একটা কুত্তার মাথাহীন রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে আছে। আমি ডাকতে লাগলাম,
‘মা, মা।’
‘আল্লাহর কসম লাগে বাপ। যা চইলা যা।’
আমি কাঁদতে লাগলাম। আমার বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। বাবাকে হারানোর পর মাকেও হারালাম। আমি আস্তে আস্তে ঝুপড়ির দিকে পা বাড়ালাম আর বারবার পেছনে ফিরে তাকালাম। মা দরজা বন্ধ করে রেখেছে।
.
ট্রেন লাইনে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। কী থেকে কী হয়ে গেল। ট্রেন আসছে। এটা ভোরের ট্রেন। সবার আগে আসে। এ ট্রেন আসার কিছুক্ষণ পরই ফজরের আজান দেয়। আমি ট্রেন লাইন থেকে উঠে হাঁটতে লাগলাম। মন ভালো থাকলে স্টেশনে যেতাম। ফজরের দিকে সুটকেস উঠালে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যায়। সেটা আর করার ইচ্ছে নেই। বারবার শুধু কেটে যাওয়া রাতটার কথা ভাবছি। জীবনটা নিমিষেই কীভাবে পাল্টে গেল।
ঝুপড়িতে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর মালা আসলো। আমাকে পাথরের মতো বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘কী রে, এইভাবে বইসা আছোস ক্যান?’
আমি কিছু বলতে পারি না। নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। মালা আমাকে জোরে নাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘কী রে?
আমি উঁহ বলে উঠলাম। তারপর মালার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘মালা চল দূরে কোথাও চইলা যাই। তুই বলেছিলি না একবার? অনেক দূরে চলে যাওয়ার কথা। যেখানে এমন সমাজের মানুষেরা থাকবে না। কারও লাত্থি খাওয়ার ভয় থাকবো না, গালি শোনা যাইবো না। যাবি?’
মালা অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘কী হইছে তোর? কই যাবি?’
‘জানি না রে। ট্রেন যেখানে থামবে সেখানে নামবো। তারপর হাঁটা দেব।’
‘চাচী যাইবো না?’
‘না। মা পরে যাইবো।’
‘চল।’
‘এখনি যাবি?’
‘হ্যাঁ, এখনি যাবো।’
আমি উঠলাম। মালার হাতটা ধরে স্টেশনে গেলাম। ট্রেন আসতে দশ মিনিট বাকি। মালা আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে রে আপন?’
‘কিছু না।’
মালা চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি ট্রেন আসার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ট্রেন আসার শব্দ শুনতে পেলাম। আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। ট্রেন থামতেই একজন ডেকে উঠলো,
‘এই ছোকরা, সুটকেসটা নে তো।’
আমি সেদিকে কর্ণপাত করলাম না। মালাকে নিয়ে ট্রেনে উঠলাম। কিছুক্ষণ পর ট্রেন তার আপন গতিতে চলতে লাগলো। জানি না কোথায় যাব। গন্তব্য অজানা। শুধু জানি এমন এক জায়গায় যেখানে এই কলুষিত সমাজের ঘৃণিত মানুষেরা থাকবে না।
.
পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় হেডলাইন বের হলো,
‘পরকীয়ার জের ধরে স্বামীর মুণ্ডপাত করলো স্ত্রী, অতঃপর বিষপানে স্ত্রীর আত্মহত্যা।’
(সমাপ্ত)

বিঃদ্রঃ গল্পটা যারা প্রতিদিন পড়েছেন আশা করি গল্পটা সম্পর্কে ভালো লাগা মন্দ লাগা জানাবেন। আপনাদের সামান্য একটা মন্তব্য পরের গল্প লেখতে সহায়তা করবে। গল্পে কিছুকিছু বানান রিচেক না দেয়ার কারণে ভুল হয়ে গেছে, সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। সকলের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে