কাগজের নৌকা পর্ব-৭

0
801

# কাগজের নৌকা
# লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
# পর্ব: ০৭
.
.
লোকটার মাথা ফাটিয়ে দৌড়ে অনেক দূর চলে আসছি। হাঁপাতে হাঁপাতে রেললাইনের ওপর বসে পড়লাম। আমার সাথে মালাও হাঁপাতে লাগলো। আমি ঢোক গিলে বললাম,
‘মনের জ্বালা মিটছে। শুয়ারদের এমনে টাইট না দিলে শিক্ষা হইব না।’
‘ঠিক কইছোস। তয় যদি পুলিশের কাছে নালিশ করে?’
‘করুক। আমিও কমু, আমারে লাত্থি দিছে, ধাক্কা মারছে।’
‘দুই তিন ঘন্টা স্টেশনের দিকে ফিরাও তাকাবি না। চল ঝুপড়িতে যাই।’
‘হ্যাঁ চল।’
দুজন মিলে ঝুপড়িতে চলে আসলাম। এদিকে আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। মায়ের কাছে খেয়ে এসেছি সেই দুপুরবেলা। এখন পেটে অনেক ক্ষুধা। মালাকে বললাম,
‘খিদা লাগছে?’
আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তা তো লাগছেই।’
‘চল খিচুরি পাকাই।’
‘তুই খিচুরি পাকাতে জানিস?’
‘তুই শুধু চুলাটা জ্বালা, আমি চাল আর ডাল নিয়া আসি।’
‘ঠিক আছে।’
আমি মুদির দোকানে চাল ডাল নিতে গেলাম। পকেটে চল্লিশ টাকা। খিচুরি খেলে এখনি শেষ। যেহেতু মালাকে খিচুরির কথা বলেছি সেহেতু চাল ডাল নিতেই হবে। খলিল চাচার কাছ থেকে চাল ডাল চাইলাম। চাচা বললেন,
‘চাল ডাল কী করবি রে? তোর মা আসছে নাকি?’
‘না চাচা। রাইতে খিচুরি পাকামু।’
‘তোর মা আসে না দেখতে?’
‘না চাচা। আসে নাই। আমি গেছিলাম দেখতে।’
‘তুই গেছিলি?’
‘হ্যাঁ চাচা। মন যে মানে না। মা ছাড়া ক্যামনে থাকি বলো?’
‘তা ঠিক। তা ভালাই আছে তোর মা?’
‘দেখে তো ভালাই মনে হইল।’
‘ভালো থাকলেই ভালো।’
চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি চাল ডাল আর বাকিতে কিছু সবজি নিয়ে ঝুপড়িতে আসলাম। মালা ততক্ষণে চুলোয় আগুন ধরানোর কাজ জোর কদমে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রচুর ধোঁয়া উঠছে কিন্তু আগুন জ্বলে না। মালা কখনও রাঁধে না। চুলো ধরানোটাই তার কাছে ঢের বেশি মনে হয়েছে। ফুঁ দিতে দিতে করুণ অবস্থা। আমি হেসে বললাম,
‘হয়েছে, তোকে আর চুলা জ্বালাতে হবে না। তুই এগুলা ধুয়ে আন।’
‘আচ্ছা।’
আমি চুলা ধরাতে লাগলাম। মালা চাল ডাল ধুতে শুরু করলো। ধোয়া শেষ হলে মালা বললো,
‘তুই কি সত্যি খিচুরি রান্না করতে জানোস?’
‘আরে না, কোনোদিন করি নাই। আজ করতেছি। মাকে রান্না করতে দেখছিলাম। সেরকম করি চেষ্টা করি। মা তো আর আমাগো লগে থাকব না। এখন নিজেকে সব শেখা লাগব না?’
‘তা ঠিক।’
মালা আমার কথায় তাল মিলালো। আমি আবার বললাম,
‘শুনছি খিচুরিতে নাকি খাটনি কম। সব ধুয়ে চুলোয় চড়ালেই হয়, সেই জন্যে।
‘ওহ।’
খিচুরি চুলোয়। এদিকে ফুঁ দিতে দিতে আমারও অবস্থা বেশ খারাপ। কাশতেও লাগলাম। তারপরও চেষ্টা থামালাম না। একসময় খুব জোরে আগুন জ্বলে উঠলো। মালা খুশি হয়ে তালি দিয়ে বললো,
‘ইয়ে, জ্বলেছে।’
অনেক সাধনার পর রান্না শেষ। কিছু চাল হয়তো ফোটেনি। খুব বেশি সুগন্ধ না বের হলেও যা হয়েছে মন্দ হয়নি। প্লেটে করে নিয়ে দুজনে বসলাম। মুখে প্রথম গ্রাস নিয়ে চাবাতে চাবাতে বললাম,
‘খারাপ হয়নি রে মালা। খেয়ে নে।’
‘আচ্ছা।’
‘তয় কিছু চাল পুরা ফোটে নাই।’
‘সমস্যা কই, পেটের ভেতর গিয়া ফুটবে।’
বলেই মালা হোহো করে হাসতে লাগলো। আমিও তার সাথে যোগ দিলাম।
‘প্রথমবার রান্না করলাম, সে হিসেবে অনেক ভালা হইছে।’
‘ঠিক কইছিস।’
‘শোন, একটু রাইখা দেই। কাল সকালে খাইয়া ভাংড়ি কুড়াতে বাইর হবো।’
‘আচ্ছা।’
পেট পুরে খেয়ে একটা ঢেকুর তুললাম। মালাকে পেটটা দেখিয়ে বললাম,
‘দ্যাখ, কতগুলা খাইছি।’
‘আমিও।’
মালার এ কথা শুনে দুজনে হাসতে লাগলাম। মালার হাসি আমার খুব ভালো।লাগে। ওর খুশি দেখলে মনটা ভালো হয় আমার। এখন তো আর মা নাই। মালাকে নিয়েই যতটুকু পথ চলা যায় ততটুকু চলতে হবে। দুজনেই আমরা এতিম।
.
দিন যাচ্ছিল, মন্দ না। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই যাচ্ছিল। মাঝেমাঝে খিচুরি রান্না করে খেতাম দুজনই, কখনও সস্তার কোনো হোটেলে ভাত খেতাম। সপ্তাহে দুতিনদিন মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসতাম। এই তো জীবন!
সেদিন হঠাৎ আমার মনটা খারাপ ছিল। মায়ের কাছে যেতে মন চাচ্ছিল। বিকেলবেলা চলে গেলাম মায়ের কাছে। মা তখন আঙিনায় চাল বাছে। আমাকে দেখে খুশি হলো।
‘কী রে বাপ, এসময়?’
‘হ্যাঁ মা। তোকে দেখতে মন চাচ্ছিল, তাই।’
আমাকে কাছে বসিয়ে আদর করে বললো,
‘আমাকে খুব ভালোবাসিস না?’
‘খুব।’
‘কখনও যদি আমার বিষয়ে খারাপ কিছু শুনিস তাহলে বিশ্বাস করিস না বাপ। মায়েরে আগে জিজ্ঞেস করবি, ক্যামন?’
‘আচ্ছা মা।’
মা আগের থেকে সুন্দরী হয়েছে। সবসময় সেজেগুজে থাকে। আমার বেশ ভালোই লাগে। আমি সবসময় মাকে এমনই দেখতে চেয়েছিলাম। কখনও যেন তার মুখটা অন্ধকারে ঢেকে না যায়।
‘আচ্ছা মা তুই কি সত্যি ভালা আছোস?’
মা হাসে আর চাল বাছে। আমি জানি মা হয়তো কোনো কারণে সুখে নেই। কী সে কারণ সেটা আমার আজও অজানা। মাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পরও সেটা নিয়ে কখনও মুখ খুলেনি। আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু বলেনি। হয়তো আমাকে বলার মতো না, তাই বলেনি।
মা বলে,
‘ভালো আছি বাপ। কিন্তু…..?
এমন সময় মোটরবাইকের শব্দ। বাবুল চাচা। মায়ের হাসিটা নিমিষেই উবে গেল। চাচা আমাকে দেখে বিদঘুটে এক হাসি দিয়ে বললো,
‘কী খবর? সব ভালো তো?’
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
‘হুম, সব ভালা।’
‘আইজ অসময়ে, না মানে বলতেছি আসলে তো দুপুরে আসিস। আজ বিকেলে, তাই।’
‘মারে দেখতে মন চাইল তাই।’
‘ওহ। জমিলা ওরে নাস্তা দেও। আর আমাকে এক গ্লাস পানি দেও।’
‘আচ্ছা ঘরে যান আমি আনতেছি। ‘
একথা বলে মা আমাকে বারান্দায় টুলে বসিয়ে চালের পাতিল নিয়ে রান্নাঘরে গেল। রান্নাঘর থেকে গ্লাসে করে পানি নিয়ে ঘরের দিকে গেল। যাওয়ার সময় আমাকে বললো,
‘একটু দাঁড়া বাপ। উনারে পানি দিয়ে আসতেছি।’
‘আচ্ছা মা।’
মা ঘরে গেল। আমি বাইরে বসে আছি। এই লোকটার আসল মতলব আমি এখনও ধরতে পারিনি। মায়ের বিয়ের চার পাঁচ মাস হয়ে গেল, তাও। যখন আসি তখন আমাকে দেখলে হাসে। খুব বেশি কথা বলে না। আগে যেমন লজেন্স দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিতো এখন সেটা দেয় না। একদিন আমি মানা করার পর আর সেটা কখনও দেয়নি।
ঘর থেকে মা আর বাবুল চাচার কথার অস্পষ্ট শব্দ আসছে। আমি প্রথমে না শোনার ভান করেও পরে একটু এগিয়ে গেলাম। তাতে যা শুনলাম। চাচা বলছে,
‘এখন আসছে ক্যান আপন?’
‘ছোট মানুষ, দেখতে মন চাইছে তাই আসছে।’
‘দুপুরবেলা আসতে পারে না? তোমার পোলারে কও বিকেলে যেন না আসে কোনোদিন। আসলে দুপুরে আসে যেন।’
‘আপনকে কিছু কইয়েন না। আমি ওরে বুঝাই কমু।’
‘আচ্ছা। এখন তারে যত তাড়াতাড়ি পারিস বিদেয় কর। লোক চইলা আসবো।’
‘আপনি একটু নাহয় পরে আসতে বলেন, ততক্ষণ খাওয়াই বিদেয় করবো।’
‘আমার কথায় অবাধ্য হোস না জমিলা। নাহলে তোর আর তোর পোলা রে….!’
‘আর কইতে হইব না।’
মা ঘর থেকে বের হচ্ছিল। আমি টুলে গিয়ে বসে পড়লাম। আমাকে দেখে মা হাসলো। ওদের কথাবার্তার কিছুটা আমি এখনও বুঝিনি। কে আসবে? কোন লোক? আমি থাকলে দোষ কী? নাকি টোকাই বলে তাদের মাথাকাটা যাবে, সেজন্য।
মা আমাকে ভাত দিয়ে বললো,
‘হ্যাঁ রে, মালাকে আনলি না?’
‘ওরে আজ ডাকি নাই।’
‘ক্যান?’
‘এমনে।’
‘খেয়ে নে। সন্ধ্যা হচ্ছে, তাড়াতাড়ি ঝুপড়িতে যা। কুপি জ্বালাও গিয়ে। নাহলে দেরি হবে।’
আমি জানি মা আমাকে তাড়াতাড়ি পাঠানোর জন্যই এমন করতেছে। আমিও তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম। আমি বুঝতে পারছি বাবুল মিয়া বারবার আমার দিকে দেখছে। আমি খেয়ে বললাম,
‘মা, আসি তাহলে?’
‘আচ্ছা বাপ।’
বাবুল মিয়া দরজা থেকে বললো,
‘আপন, আসিস আবার।’
আমি কোনো জবাব দিলাম না। চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। পেছনে ফিরে দেখি মা আনমনে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুরুতে মা আমাকে নিজের কাছে রাখতে চাইলেও এখন এ বিষয়ে তেমন কিছু বলে না। হয়তো আমাকে ছাড়া থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে। হবেই তো, কতবড় বাড়ি! এজন্য বাবুল চাচা বাহ বাহ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আমার মাকে কেড়ে নেয়ার জন্য আমি তাকে বাহ বাহ দেই না।
.
রাতে বিছানায় শুয়ে শুধু এটাই ভাবতে লাগলাম যে বিকেলে ওখানে গেলে কী সমস্যা? আমাকে ঝুপড়িতে পাঠানোর এত তাড়া কেন তাদের? কারা আসবে? কোন লোকজন? প্রশ্নগুলে আমার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে। ফের পরে ভাবছি, হয়তো আত্মীয় হবে কোনো, যার কারণে এমনটা বলেছে। শুধু শুধু একটা সহজ বিষয়কে জটিল করে তুলছি।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে