কাগজের নৌকা পর্ব-২

0
959

# কাগজের নৌকা
# লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
# পর্ব: দুই
.
.
সারারাত আমার চোখে ঘুম নেই। শুধু বাবুল চাচা আর মায়ের লেপ্টে থাকার দৃশ্য বারবার মনে পড়ছিল। এতবার এ দৃশ্যটাকে সরাতে চাইলাম, কিন্তু ব্যর্থই হলাম।
.
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্টেশনের দিকে হাঁটা দিলাম। এখনও স্টেশনের মানুষ সেভাবে জাগেনি। ট্রেন আসতেও দেরি হবে হয়ত। আমি অস্পষ্ট আলোতে ট্রেন লাইনে বসে পড়লাম। পেটটা ক্ষুধায় চোঁচোঁ করছে। রাতে ঘুম হয়নি, জেগে ছিলাম বেশিরভাগ সময়। শরীরটা ক্লান্তও লাগছে। মনের মধ্যে রাগ যেন ফুসলে উঠছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হচ্ছে।
আস্তে আস্তে রোদ উঠছে। দুএকজন করে লোকের আনাগোনা চলছে। রোদের ঝিলিক গায়ে লাগতেই অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করছে। গতকাল ওই ঘটনার পর এই প্রথম ভালো লাগছে। হঠাৎ কার যেন স্পর্শ অনুভব করলাম। পেছনে ফিরে তাকালাম। মা!
‘কী রে বাপ, সকাল সকাল এইহানে কী করস?’
এ কথা বলে মা আমার পাশে বসে পড়লো। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। যাতে মা কিছু বুঝতে না পারে। কে যেন বলেছিল, মা বেশ্যা হলেও সে মা। মায়েদের কাছে তাদের সন্তানরা রাজপুত্র। আমি জানি মা আমাকে কতটা কষ্ট করে মানুষ করছেন। হঠাৎ বাবার মৃত্যুটা আমাদের ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। মাকে আমি ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।
আমি মায়ের দিকে তাকালাম,
‘সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো তাই এইহানে বইসা আছি। তুই এইহানে কী করিস মা?’
মা মেকি হেসে বললো,
‘তোকে বিছানায় পাইলাম না। ভাবলাম কই গেল পোলাটা।’
‘কই আর যামু মা। আমার তো যাওনের যায়গা নাই।’
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠলো। বললো,
‘এমন কথা কইস বা বাপ। তুই যে আমার বাপ। আমার বাপ মরার পর তুই আমার সব, আমার দুনিয়া।’
‘মা তুই বাড়িত যা। ট্রেন আইতাছে। দেখি কেউ কাম দেয় কী না।’
মা আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
‘তাড়াতাড়ি বাড়ি আয় বাপ। চাল ভেজে চা করি।’
‘আচ্ছা মা।’
মা চলে গেল। আমার মনটাও নরম হয়ে গেল। মা তো মায়েই হয়, মায়ের কাছে দুনিয়ার সব কিছু মিথ্যা। মা এমনই একজন যার মুখের দিকে তাকালে সব কষ্ট যন্ত্রণা ভোলা যায়। শুধু এটা বলতে পারি না যে,
‘আমি তোকে ভালোবাসি মা। ভীষণ ভালোবাসি।’
.
ট্রেন আসলো। আমি দৌড়ে গেলাম। যাত্রী আছে কিছু। কয়েকজন ভদ্রলোক নামছে। আমি এগিয়ে গেলাম।
‘স্যার সুটকেস, ব্যাগ ধরতে হইব?’
কালো কোর্ট-প্যান্ট পরা লোকটা বলে উঠলো,
‘পারবি তুই? অনেক ওজন কিন্তু।’
আমি হেসে বললাম,
‘পারমু স্যার। এটাই তো আমার কাম।’
আমার কথা শুনে সুটকেসটা মাথায় তুলে দিলো। আরেক হাতে আরেকটা ব্যাগ। আমি ওনাদের সাথে সাথে যাচ্ছি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখলাম একটা গাড়ি, চার চাকার গাড়ি। খুব সম্ভবত সাহেবদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে।
‘এখানে রাখ।’
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার মাথা থেকে সুটকেসটা নামিয়ে নিয়ে বললো,
‘নাম কী তোর?’
‘আপন।’
‘দারুণ তো। কয়টাকা দেয়া লাগবে?
‘বিসমিল্লাহতে আপনি আইছেন, যা দেবেন তাই নিমু।’
লোকটা হাসলো। হেসে বললো,
‘যা দিব তাই?
‘জ্বি স্যার।’
একটা পাঁচ টাকার কয়েন দিয়ে বললো,
‘চলবে তো?’
আমি মনে মনে লজ্জা পেলাম। লোকটা হয়ত বুঝতে পারলো। আমার হাত থেকে কয়েনটা নিয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে বললো,
‘নে, এটা রাখ।’
‘স্যার আমার কাছে তো ভাংতি নাই।’
‘পুরোটাই রাখ। আর কখনও বলবি না যা দেবেন তাই নেব। নাহলে ঠকবি। বুঝলি?’
আমার মাথা নাড়ালাম। লোকটা তার ফ্যামিলিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল। আমি পঞ্চাশ টাকার কড়কড়ে নোটটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম।
স্টেশনে আসতেই আরেক সাহেবের ডাক আসলো। আমি দৌড়ে গেলাম।
‘স্যার কিছু ধরতে হইব?’
‘হ্যাঁ, এ সুটকেস দুটা নে।’
সুটকেস দুটা আমার মাথায় চাপিয়ে দিলো। বেশ ওজন ছিল। আমি লোকটাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। ওনার সাথে একজন মহিলা। সম্ভবত উনার স্ত্রী। রাস্তার দিকে আসার পর লোকটা একটা ট্যাক্সি ঠিক করলো। ততক্ষণ আমি সুটকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে। মনে মনে ভাবলাম কতক্ষণ নামাব। নামাতে পারলেই বাঁচি। সুটকেস দুটো নামিয়ে উনি আমাকে দশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
‘নে।’
আমি টাকাটা হাতে নিয়ে বললাম,
‘আর দশ টাকা দ্যান স্যার। কম হয়ে যায় তো।’
‘আর দশ টাকা মানে?’
‘একটা সুটকেট দশ টাকা। দুইটা সুটকেট ২০টাকা।’
‘ দশ টাকা দিছি এটাই বেশি দিছি। যা ভাগ।’
লোকটা কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো।
আমি নরমস্বরে বললাম,
‘স্যার ঠকানো হয়ে যায়।’
এ কথা শুনে আমাকে লাত্থি দিয়ে বললো,
‘পাজি ছেলে। মুখে মুখে তর্ক করিস। দশ টাকা দিছি এটাই বেশি।’
এ কথা বলেই উনারা ট্যাক্সি করে চলে গেল। আমি মাটিতে পড়ে চেয়েই থাকলাম। গা ঝাড়তে ঝাড়তে ভাবলাম। দুজনের মাঝে কত ফারাক। একজন কত বিনয়ী, আরেকজন কত বাজে লোক। অথচ দুজনই কোর্ট-টাই পরা।
আল্লাহর এ দুনিয়ার কত খেলা যে চলে, তার ইয়ত্তা নেই।
.
ঝুঁপড়িতে ফিরে দেখলাম মালা মায়ের পাশে বসে আছে। মা চাল ভাজে। আমি তাদের পাশে বসে পড়লাম। মালাকে বললাম,
‘সকাল সকাল তুই?
মালার মুখটা কালো হয়ে গেল। মনমরা হয়ে বললো,
‘দাদীর জ্বরটা বাড়ছে। বিছানা থাকি উঠবার পারে নাই। ক্ষুধাও লাগছে।’
মালার কথায় মা বললো,
‘দুপুরবেলা এখানে ভাত খাইস মালা। জেঠাইমার জন্যে নিয়াও যাইস।’
মালা এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বা ফেলল।
‘আচ্ছা চাচী।’
চা আর চাল ভাজা খেয়ে মালাসহ স্টেশনের দিকে ছুটলাম। কিছুক্ষণ পর মালা বলে উঠলো,
‘তোর পেছনে ধূলা ক্যান?’
আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। দেখলাম সত্যি সত্যি অনেক ধূলো। ঝাড়তে ঝাড়তে বললাম,
‘এক সাহেব ব্যাটায় লাত্থি দিছে।’
‘লাত্থি মারছে ক্যান?’
‘দুইটা সুটকেস জন্যে ১০টাকা দিচ্ছিল। ২০টাকা চাইতে লাত্থি মারলো হারামজাদা।’
মালার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি জানি আমার জন্য ওর অনেক মায়া, অনেক টান। অনেক ভালোবাসে ও আমায়।
আমি পঞ্চাশ টাকার নোটটা বের করে ওর হাতে দিয়ে বললাম,
‘নে ধর।’
পঞ্চাশ টাকার নোট দেখে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো।
‘এত সকাল সকাল পঞ্চাশ টাকা কই পাইলি।’
আমি সহাস্যমুখে বললাম,
‘আরেক সাহেব ব্যাটায় খুশি হয়ে দিছে। নে ধর। দাদীর জন্যে ওষুধ কিনিস।’
মুহূর্তেই মালার মনটা ভালো হয়ে গেল। হাসিমুখে বললো,
‘পুকুরপাড়ের পাশের বড়ই গাছটাতে বড়ই পাকছে। চল পেড়ে খাই।’
‘চল।’
দুজনে পুকুরপাড়ের দিকে ছুটলাম।
.
বিকেলে ঝুঁপড়িতে ফিরে দেখলাম চুলোর পাশে বাবুল চাচা বসে আছে। মা চুলো ধরিয়েছে। আমি আসার আগে ঝুঁপড়ির আড়াল থেকে এতটুকু শুনলাম যে, মা বাবুল চাচাকে বলছে,
‘সবসময় দিনের বেলা আসবেন না। মাইনষে খারাপ কয়।’
‘মাইনষে কি তোরে ভাত দেয় জমিলা?’
জমিলা আমার মায়ের নাম।
‘তাও। আপন যে কোনো সময় চইলা আসে। যদি দেখে?’
‘সেজন্যেই কই চল কাজী অফিসে। পার্মানেন্ট করি তোকে। রানী করে রাখব তোকে। আমার মনের রানী।’
‘আমার বিয়ের ইচ্ছা নাই।’
‘তাইলে কি বেশ্যা হয়া থাকবি? কাজের পর টাকা? এতটুকু তোর চাওয়া?’
এ কথা শুনে মা চমকিত হয়ে গেল। বাবুল চাচার দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মায়ের এ চাহনি দেখে আমার মায়া হলো, বড্ড মায়া।
বাবুল চাচা বলে উঠলো,
‘বিয়া করতে চাইতাছি, তাও তোর হয় না। নাকি আমার বাড়িত আমার আরও বউ আছে যে তোরে সুখে রাখব না?’
‘আমার আপন!’
‘আপনকে নিয়া ভাবিস না। ওয় তো আমার পোলার মতো। এখন রান্না রাখ। ঘরে চল। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, সান্ত্।’
‘এখন না, পরে।’
আমার মেজাজটা খারাপ হতে লাগল। ঝুঁপড়িতে কীভাবে যাব সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। যাব কী যাব না সেটা নিয়ে দোটানায় পড়ে গেছি। শেষ পর্যন্ত গেলাম। আমাকে দেখে বাবুল চাচা বলে উঠলো,
‘আরে ব্যাটা, কী খবর? কাম কাজ সব ভালা তো?’
‘ভালা।’
মিছেমিছি ঝুঁপড়িতে ঢুকে কিছুক্ষণ পর বের হয়ে আসলাম। বাইরে লোকটা মায়ের সাথে তার ব্যবসা নিয়ে কথা বলছিল। আমি জানি, আমি না থাকলে ভালোবাসার কথা বলতো। এখন বাজে লোক মনে হয় তাকে। আমাকে দেখে বললো,
‘নে, লজেন্স খা।’
আমি বললাম,
‘আমি লজেন্স খাওয়া ছাইড়া দিছি।’
‘তাহলে তোর লাইগা কী আনুম?’
‘কিচ্ছু না।’
একথা বলে আমি হাঁটা দিলাম। মা পেছন থেকে তাকে,
‘বাপ খাইয়া যা।’
আমি পেছনে না ফিরে বললাম,
‘পরে খামু।’
মনে মনে ভাবলাম,
‘আমি তোমাদের সুযোগ দিলাম। ভালোবাসার সুযোগ।’
গতকাল রাতে ভাবছিলাম আমি। অনেকরাত পর্যন্ত ভেবেছি। একজন নারী একজন পুরুষ ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমার মাও আব্বাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিলো। আব্বা নাই তাই হয়তো মা বাবুল চাচাকে খুঁজে নিয়েছে। আমাকে হয়তো তাদের এ অবৈধ সম্পর্ক মেনে নিতে হবে।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে