আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-০৮

0
257

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#৮ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



দরজা খোলা গেল না কিছুতেই।সব চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মাকে দেখলাম জানলার দিকে দৌড়ে যেতে। ভাইয়ার ঘরে যে কাঁচের জানলা আছে তা আমার মোটেও খেয়াল ছিল না ।মা দৌড়ে গিয়ে সেই জানলায় দু’ হাতে একটানা আঘাত করতে লাগলেন।আমি গিয়ে দেখি মার দু’ হাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে ততোক্ষণে।হাতের কনুই বেয়ে সেই রক্ত টপটপ করে জমিনেও গড়িয়ে পড়ছে।জানলার গ্লাস ততোক্ষণে অনেকখানিই ভেঙে ফেলেছে মা। মায়ের ক্ষত বি*ক্ষত দুটি হাতের দিকে তাকিয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো।কষ্ট হচ্ছে আমার ভীষণ! আহারে অভাগী মা! মায়ের এতো দরদ হয় সন্তানের জন্য?
আমি তাড়াহুড়ো করে ভাঙা গ্লাসের ফাঁকা দিয়ে তাকাতে চাইলাম। আমার বুক এমনিতেই ধড়ফড় করছে।আমি ভয়ে চোখ মেলছি না, যদি দেখি ভাইয়া গলায় রশি দিয়ে ফেলেছে! যদি দেখি ভাইয়া আর নাই!
ভয়ে ভয়ে চোখের পাতা খুলতেই দেখি ভাইয়া সিলিং ফ্যানে রশি বেঁধে সেই রশিতেই তৈরি করা গোলকের ভেতর তার গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আর দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে তার শরীর প্রচন্ড রকম ঘামছে। সে থরথর করে কাঁপছে তখনও।আমি মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারছি না। জানালায় শক্ত গ্রীল দেয়া।এই গ্রীল গলে ভেতরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব না।
মা এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।রক্তে লাল টকটকে দুটো হাত এক করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে ভাঁজ করে সাজিয়ে সামনে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মা বললেন,’ আমি তোর মা, আমার কসম লাগে বাজান! তুই যদি ফাঁ*স নিস তবে সঙ্গে সঙ্গে আমিও নিবো। আল্লার কসম, আমিও নিবো।’
বলে মা সঙ্গে সঙ্গে তার শাড়ির আঁচল গলায় পেঁচিয়ে নিতে শুরু করলেন।আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না! আমাদের সুন্দর ঘরটা এভাবে নরক হয়ে উঠলো কিভাবে? এই যে এমন লকলকে দগদগে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন।আমি কিভাবে এই আগুন নিভৃত করবো।কোন তরলে নিভবে এ আগুন?
আমার জানা নাই!
অবশ্য মায়ের গলায় আঁচল পেঁচিয়ে নেওয়ায় ভাইয়া থমকে গেছে। সে তাড়াহুড়ো করে গলা থেকে রশি ছাড়িয়ে নিচে নেমে এলো। জানলার কাছে দৌড়ে এসে জানলার ভাঙা অংশ দিয়ে তার হাত দুটো বের করে দিয়ে মায়ের হাত দুটো টেনে ধরলো। তারপর কাঁদতে কাঁদতে সে বললো,’ না মা না। তুমি এটা করো না। আমি এটা মরে গিয়েও সহ্য করতে পারবো না!’
ভাইয়া এরপর দৌড়ে এসে দরজা খুললো।নিজেই বেরিয়ে এলো বাইরে।মা তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। আদর করলেন।চুমু খেলেন কপালে।গালে।যেমন করে ছোট্ট শিশুদের চুমু খায়, আদর করে মায়েরা।আর তার গালে চড়, থাপ্পর বসিয়ে দিতে দিতে বললেন,’ এতো বড় সাহস কে দিয়েছে তোকে? তুই মরতে চাস তাই না? কেন মরবি তুই বল।আমায় বল তুই? কার জন্য? কিসের জন্য?’
ভাইয়া বললো,’ অপি যা করলো এতো সবের পর এই জীবন রেখে কি লাভ মা? আমি মানুষকে কিভাবে এই মুখ দেখাবো?’
আমার মা অসম্ভব রকমের জ্ঞানী মহিলা।বাবা আমাদের দুই ভাইকে ছোট্ট ছোট্ট রেখে মারা গিয়েছিলেন। আমার দাদি ছিলেন অনেক বেশি বদমেজাজি মহিলা। মায়ের উপর তিনি নানাভাবে অ*ত্যাচার, অ*নাচার করতেন।সব সময়ই। মাকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। মায়ের তখন রূপ ছিল, বয়স ছিল। বিয়ে করার মতো অবস্থা ছিল।নানা তখনও বেঁচে আছেন। তাদের অর্থ বিত্ত কিংবা প্রভাব প্রতিপত্তি কোন কিছুর বিন্দুমাত্র অভাব ছিল না।নানা এবং মামারা চেয়েছিলেন মা বিয়ে করুন আবার। অনেক জায়গা থেকেই আলাপ এসেছিল।মা কিন্তু আমাদের দুই ভাইকে রেখে অন্য কোথাও বিয়ে করে ফেলেননি। তিনি তার সব শ্রম দিয়ে,মায়া মমতা আদর শাসন দিয়ে আমাদের বড় করে তুলেছেন। পড়াশোনা করিয়েছেন। একজন মা জ্ঞানী বলেই এতো সব কিছু সামলাতে পেরেছেন। কোনদিন পিতৃ হারাবার কষ্ট কি, যাতনা কি তা আমাদের বিন্দু পরিমাণ বুঝতে দেননি,!
মা ভাইয়ার একটা হাত ধরলেন। তারপর বললেন,’ তুই কি কোন অপরাধ করেছিস? এখানে কি তোর হাত আছে? এই ভিডিওতে, ছবিতে তুই আছিস?’
ভাইয়া বললো,’ না।নাই।’
মা বললেন,’ তাহলে? তাহলে তুই মানুষকে মুখ দেখাতে পারবি না কেন? তুই তো কোন অপরাধ করিসনি। অপরাধ করলে কথা ছিল। অপরাধ না করেও নিজেকেই নিজে এতো বড় শাস্তি তুই দিবি কেন?’
ভাইয়া বললো,’ অপি এটা কিভাবে করলো মা? তাকে কি আমি কম ভালোবেসে ছিলাম? তাকে কি আমি কম বিশ্বাস করেছিলাম? তুমি কম স্নেহ করতে তাকে? তপু কম শ্রদ্ধা করতো? তার জন্য আমরা কি না করেছি মা? এরপরেও কিভাবে সে এমন প্রতারণা করতে পারলো?’
মা ভাইয়ার কাছে বসলেন। তারপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’ আরে বোকা ছেলে, এটা নিয়ে এখন পড়ে থাকলে চলবে না। কিছুতেই থেমে যাওয়া যাবে না। মানুষ কিছু বলুক গিয়ে। লোকের কথায় কিচ্ছু যায় আসে না অপু! লোক আমাদের খাওয়ায় না, পরায় না।তো তাদের কথা কেন আমরা আমলে নিবো অপু? তোকে কি আরো কিছু বোঝাতে হবে আমার? তুই কি বোকা ছেলে নাকি বল?’
ভাইয়া এবার কিছুটা ধাতস্থ হলো বলে মনে হলো। সে বললো,’ অপিকে ঠিকই খুঁজে বের করবো।আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো কেন এমন করলো সে আমার সাথে। কি দোষ ছিল আমার? কেন এমন করলো সে?’
মা বললেন,’ বাদ দেও এসব অপু।যা হবার তা হয়ে গেছে। ভাগ্য বদলাবার ক্ষমতা তোমার আমার নাই।এটা আল্লার হাতে।এসব নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করার দরকার নাই।আর আজ যা করতে চেয়েছিলে ভবিষ্যতে যেন এরকম কিছু করা তো দূরের কথা , কল্পনায়ও যেন এসব না আনো! সাবধান! ‘
ভাইয়া মায়ের পা ধরে ক্ষমা চাইলো।বললো, তার বাকী জীবনে এমন কিছু ভুলেও সে করবে না!
মা তাকে ক্ষমা করলেন শেষ বারের মতোই।

এরপর সবকিছু ঠিক ভাবেই চলতে লাগলো। ভাইয়া আবার নিয়মিত অফিসে যাচ্ছে। সবকিছু সুন্দর ভাবে চলছে। শুধুমাত্র অপি ভাবী নাই।তার অনুপস্থিতি বড় কষ্ট দেয় আমায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে তার কথা মনে পড়লে ভীষণ ঘেন্নাও কাজ করে।কি নোংরা কাজগুলো করে গেল সে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
শুধুমাত্র তার জন্যই আমাদের সম্মান ধুলোয় মিশে গেল। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী এখন অনেকেই মিটিমিটি হাসে। কোনো ঘরে দুই জাঁ কিংবা ননদেরা একসঙ্গে শাকপাতা বাছতে গিয়ে কিংবা একে অপরের মাথায় নারিকেল তেল ঘষে দিতে গিয়েও তাদের গল্পের খোরাক হয় আমাদের ঘরের গল্প।অপি ভাবীর গল্প। চায়ের স্টল গুলোতে আগে সিনেমা চলতো। এখন অপি ভাবীর গল্প চলে। এসব গল্প বাড়িয়ে বলিয়ে বলা হয়। আমার নিজের কানেই এসেছে অনেক কিছু। তারা এটাকে এই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যে, অপি ভাবী কদিন পর পর তার পুরুষ বদলাতো।আর মাঝরাতে আমরা ঘুমিয়ে গেলে সেই পুরুষদের ঘরে নিয়ে আসতো।আরো কতো নোংরা নোংরা কথা যে তারা বলে!
শুধুমাত্র তার জন্যই এখন রাস্তায় বেরুলেও পরিচিত কেউ পেলে সহানুভূতি দেয়ার নাম করে চারটে কথা শুনিয়ে ছাড়ে! তখন আমারও ইচ্ছে করে, সত্যিই মরে যাই। ভাইয়া যে সেদিন মরতে চাইলো, তা এমনি এমনি না। নিজের স্ত্রী এমন করলে তখন কি মাথার ঠিক থাকে! ভাগ্যিস যে সে অপি ভাবীকে এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছে।অন্য কেউ হলে তো খু*ন করে ফেলতো!
নদীর একপাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসব ভাবছিলাম। আমার যখন ভীষণ মন খারাপ হয়। তখন এই নদীর কাছে আমি চলে আসি। এই নদীর নাম ব্রক্ষ্মপুত্র। কিন্তু আমি এর নাম দিয়েছি মায়াবী নদী।এর প্রতি আমার অনন্ত- অসীম মায়া। এখানে এসে নদীর পাড় ধরে একটু হাঁটাহাঁটি করি। নদীতে জল এখন একেবারেই কম। যেটুকু জল আছে তার সাথে যেন আকাশের রং এসে মিশে একাকার হয়ে থাকে সব সময়।কে বলবে জলের কোন রং হয় না! এই নদীর জলের রং এখন নীল।ঘন নীল। সেই নীল জলের বুকেই ভেসে বেড়াচ্ছে একদল পাতি হাঁস। মাঝেমধ্যে এক দুটো পানকৌড়ি ডুবছে, ভাসছে।এসব দেখে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু আজ মন কিছুতেই ভালো হচ্ছে না। নিজেকে কেমন অসহায় মনে হয় আমার। কেন জানি মনে হয় কারোর প্রতি আমি বা আমরা অবিচার করছি!
অপি ভাবীর কথা খুব মনে পড়ছে আমার। আমাদের মিষ্টি আর হাসিখুশি অপি ভাবী। আচ্ছা সে কেন এমন করলো হঠাৎ? কেন?
একটা মানুষ সম্পর্কে কোনদিন কিছুই জানি না। তার কোন খারাপ গুণ কোনদিন চোখে পড়েনি।আর হঠাৎ করেই কি না সে এতো কিছু ঘটিয়ে ফেললো! এও কি সম্ভব!

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বিকেল ফুরিয়ে গেছে মুহূর্তে। নদীর ওপারে যে মস্ত শিরিষ গাছ।সেই গাছের ডালপালার ফোঁকড় দিয়ে দেখা যাচ্ছে সিঁদূরের মতো লাল টকটকে সূর্যের হঠাৎ করেই মিলিয়ে যাওয়া।দূরের মসজিদ থেকে তখন ভেসে আসছে মাগরিবের আজান।আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এর ঠিক দখিনে হিন্দু পল্লী। ওখান থেকে কাঁসার আওয়াজ আসছে। ঘরের নারীরা নিশ্চয় এখন তুলসী তলায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে দিচ্ছে। এই যে এক সন্ধ্যা, দিন আর রাতের মিলন।এ এক অপার্থিব সময়।এ এক মধুর মোহন আর পবিত্র সময়।মিলনের চেয়ে কি পবিত্র কিছু আর আছে? আচ্ছা মিলনের সব দৃশ্যই কি এমন সুন্দর হয়?
পুরুষ- নারীরও?
আচ্ছা ভাইয়া আর অপি ভাবীরও কি এমন ছিল না? তারা কি তাদের ফুলশয্যায় শপথ করেনি কেউ কাউকে ছেড়ে না যাবার? আমৃত্যু একসঙ্গে থাকার? একে অপরের সঙ্গে প্রতারণা না করার? সুখে দুঃখে সব সময়ই একে অপরের পাশে থাকার?
কিন্তু এমন কেন করলো তারা? কেন?

খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম আমি।ভেজা ঘাসের উপর বসেই আবছা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য কাউকে এমন সব প্রশ্ন করে করে কোন উত্তর না পেয়ে চোখ ভেজাচ্ছিলাম নিজের।আর তখনই পকেটে থাকা ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। প্রথমবার ফোনে হাত নিলাম না। ভীষণ মন মরা আমার।ইচ্ছেই করছে না ফোন ধরতে এখন। কিন্তু দ্বিতীয় বারের মতো যখন ফোনে রিংটোন বাজতে লাগলো। তখন মনে হলো, কেউ জরুরি কল করেছে।পকেট থেকে ফোন হাতে নিয়ে অবাক হলাম। দীর্ঘদিন পর ফৌজিয়ার ফোন। ফৌজিয়া আবার হঠাৎ ফোন করলো কেন?
ফোন রিসিভ করতেই ফৌজিয়া বললো,’ তপু, তুমি কোথায় আছো? ‘
আমি বললাম,’ আছি এক জায়গায়।’
ফৌজিয়া এবার বললো,’ তুমি কি এক্ষুনি একটু আসতে পারবে? খুব ইমার্জেন্সি!’
আমি অবাক হলাম। আমার সঙ্গে এখন তার ইমার্জেন্সি কি আছে!
আমি বললাম,’ কোথায় আসবো?’
সে বললো,’ আমার বাসায় আসো।’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে