আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-০৯

0
245

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#৯ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ফৌজিয়ার বাসায় যেতে আধঘন্টা সময় লাগলো আমার। আমি গিয়ে দেখি সে বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। বসে থেকে গান শুনছে। রবীন্দ্রনাথের গান।

“আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে
যাব না
”যাব না গো, যাব না যে
থাকব পড়ে ঘরের মাঝে
যাব না গো, যাব না যে
থাকব পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায়
এই নিরালায় রব আপন কোণে
যাব না এই মাতাল সমীরণে।”

আমায় দেখে সে হাসলো।বললো,’ তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম তপু। অতো তাড়াতাড়ি এসে পড়বে ভাবিনি।
আসো।ঘরে যাই চলো।’
আমি ঘরে গিয়ে বসলাম। সোফায়।
তারপর বললাম,’ ফৌজিয়া, হঠাৎ কেন ডাকলে আমায়? ‘
ফৌজিয়া বললো,’ চা খাবে নাকি কফি? আচ্ছা থাক কিছুই খেতে হবে না।আমি জানি এখন কিচ্ছু খেতে পারবে না তুমি। এসব খেতে গেলে সেদিনের মতোই বমি করে সব ভাসিয়ে দিবে।’
এটা বলে ফৌজিয়া দুষ্টুমি ভরা হাসি হাসলো আমার দিকে তাকিয়ে।
আমি বললাম,’ আচ্ছা কিছু খেতে টেতে হবে না, আর বমিও করতে হবে না আমার। এখন তুমি বলো, কেন ডেকেছো আমায়। আমার সঙ্গে তোমার কি এমন ইমার্জেন্সি কাজ!’
ফৌজিয়ার চুল খোলা ছিল। সে পেছনে হাত দিয়ে চুল গুলো খোঁপা করে বেঁধে নিলো মুহূর্তে। তারপর বললো,’তোমাকে তো বলাই হয়নি অপি ভাবী তার বরের জায়গায় কার নাম লিখেছিলো। তাই না?’আসলে আমার নানান ব্যস্ততা ছিল।বিপদ-আপদ ছিল।তাই আর বলা হয়ে উঠেনি।এর জন্য আমি সরি!’
আমি উদগ্রীব হয়ে গেলাম সেই নাম শুনতে।আমি জানি, ফৌজিয়া এখন যে নাম বলবে সে-ই এখানকার মূল হোতা। সবকিছুর পেছনেই কলকাঠি সেই নাড়ছে।কি নাম তার? কি নাম?
আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,’ ফৌজিয়া, দোহাই লাগে আল্লার! তাড়াতাড়ি সেই নাম তুমি বলো আমায়।ওই কালপ্রিটটা আমাদের সুন্দর ফ্যামিলিটারে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে! ওরে খুঁজে বের করে আমি এমন শাস্তি দিবো ফৌজিয়া যে ও আর জীবনে কোনদিন কারোর ক্ষতি করার মতো কল্পনাও করতে পারবে না!’
ফৌজিয়া কথা বললো না। সে ছন্দের মতো পা ফেলে তার ঘরে রাখা আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। তারপর আলমারি খুলে ওখান থেকে একটা নীল রঙের ডায়েরি নামিয়ে আনলো। তারপর আমার সামনে এনে এর চারটে পাতা উল্টে দেখালো ওই নাম।আমি নাম দেখে অবাক হলাম।এটা আবার কোন ধরনের নাম?
ওখানে লিখা – ” A dog in the form of a human ”
আমি কিছুই বুঝতে না পেরে ফৌজিয়াকে বললাম,’ এটা কি দেখাচ্ছো? এরকম নাম কিভাবে হয় মানুষের? ‘
ফৌজিয়া হাসলো।বললো,’ হয়। কিছু মানুষের হাত পা সবই থাকে।এরা কথা বলে। বিয়ে করে।অফিস করে। মানুষের সঙ্গে চলে।খায়-দায় আর ঘুমায়ও। কিন্তু এরা সত্যিকারে কোন মানুষই না ।এবং এই ” A dog in the form of a human ” টা কে তুমি জানো?’
আমি বললাম,’ কে?’
ফৌজিয়া বললো,’ আমি এখনই বলবো না এই মানুষ নামের অমানুষটি কে।কি তার পরিচয়।এটা বলার আগে আরো কিছু জিনিস তোমায় দেখাতে চাই আমি।আর কিছু জিনিস শুনাতেও চাই।’
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। আমার সবটা শরীর থরথর করে কাঁপছে।আমি বললাম,’ ফৌজিয়া, তুমি কি আমায় নিয়ে খেলা খেলছো নাকি? তুমি আমায় বোকা পেয়েছো তাই না? তুমি জানো, তোমার এই গোপন গোপন খেলার জন্য,নামটা না বলার জন্য আমাদের কতো কতো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। গতকাল ভাইয়া মরতে বসেছিলো। মায়ের জন্য শুধু সে এখনো বেঁচে আছে। ‘
ফৌজিয়া হাসলো। শব্দ করে। এই প্রথম তার দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরে ভয় ধরে গেল। রাগে তার চোখ দুটো জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে আছে। চেহারার দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে, এ যেন অশূর বধ করতে আসা স্বর্গীয় কোন দেবী!
আমি কিছু বলার আগেই ফৌজিয়া বললো,’ আমি খেলছি? হা হা হা। তাহলে ঠিকই ধরেছো তুমি। এইসব কিছু খেলা আমিই খেলেছি। এখনও খেলছি।আমি। শুধু আমি।একা আমি। আমিই সেই আড়ালের শিকারী।আড়ালে লুকিয়ে থেকে কলকাঠি আমিই নাড়িয়েছি এতো দিন। কিন্তু খেলাটা এখনও শেষ হয়নি তপু।তপু, তুমি সিনেমা দেখো না? বাংলা সিনেমা? হিন্দি সিনেমা? ওসব সিনেমায় শেষের একটা সিন থাকে তাই না? ওখানে সব রহস্যের উন্মোচন হয়।সত্যের পক্ষে যে থাকে সে জিতে যায়।আর মিথ্যের পক্ষে যে থাকে সে পরাজিত হয়। তাই না? ‘
আমি কথা বললাম না। কথা বলতে পারছি না। আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে।
কথা বললো আবার ফৌজিয়াই। সে বললো,’ আড়ালে এতো দিন যে খেলা আমি খেলেছি এর শেষ আজকেই হবে।আজ রাতের মধ্যেই।’
আমি কিছু বলতে যাবো কিন্তু ফৌজিয়া কিছুই বলতে দিলো না আমায়।আমায় থামিয়ে দিয়ে সে বললো,’ আজ তুমি কোন কথাই বলবে না তপু।সব কথা আমি বলবো।আমি। শুধু আমি। একা আমি। ‘
বলে সে আলমারির কাছে গেল আবার। তারপর একটা সাদা ছোট্ট বাক্স নিয়ে এলো। আমার কাছে এসে সেই বাক্স খুলে একটা রূপার চেইন বের করলো ওখান থেকে।চেইনের নিচে একটা ইংরেজি অক্ষর। “A” । কিন্তু চেইনটা একদিকে ছেঁড়া।চেইনটা দেখে আমি চমকে উঠলাম।এটা আমি স্পষ্ট চিনতে পেরেছি।এটা আর কারোর না।এটা অপু ভাইয়ার। ভাইয়া তার ছাত্র জীবনে সব সময় গলায় চেইন পরতো। তারপর হঠাৎ করে একদিন সেই চেইন নাই।একরাতে আমরা খেতে বসেছি।আমি আর ভাইয়া।মা আমাদের পাতে ভাত -শালুন বেড়ে দিচ্ছেন। তখনই মা খেয়াল করলেন, ভাইয়ার গলায় চেইন নাই। কিন্তু তার গলায় কেটে যাওয়া লম্বা সরু একটা দাগ ভেসে আছে। তাকালে লাল টকটকে মাংস দেখা যায়।
মা বললেন,’ তোমার চেইন কোথায় অপু? ‘
ভাইয়া আমতা আমতা করে বললো,’ আছে।’
‘ কোথায় আছে?’
ভাইয়া বললো,’ ঘরে।’
মা বললেন,’ যাও নিয়ে আসো গিয়ে এখানে।’
ভাইয়া বিরক্ত হলো।বললো,’ এখন তো খাচ্ছি, এখনই কেন আনতে হবে? খাওয়ার পর আনলে হবে না তোমার?’
মা বললেন,’ না হবে না। এক্ষুনি আনতে হবে।’
ভাইয়া খানিক সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো,’ চেইনটা নাই!’
মা অবাক হলেন। বললেন,’ নাই মানে? চেইন কোথায় গেল? আর তোমার গলায় এই দাগ কিসের?’
ভাইয়া কিছু বলে না।চুপ করে আছে।’
মা ধমক দিলেন। বললেন,’ কিছু বলছো না কেন তুমি? চুপ হয়ে আছো কেন? ‘
ভাইয়া থতমত খেয়ে গেল যেন। তারপর বললো,’ চুরি হয়ে গেছে এটা। ওইদিন যে মেলা হলো।ভীড় ছিল খুব। ওখান থেকে কেউ একজন টেনে নিয়ে গেছে। আমি দেখতেই পাইনি কে নিলো।আর তখনই গলা কেটেছে।দাগ হয়েছে।’
মা সেদিন বলেছিলেন,’ দেশের চোর গুলোও এতো খারাপ হয়ে গেছে যে, একটা সামান্য রূপার চেইনের লোভও এরা সামলাতে পারে না! ‘

এবার আমি ভাবছি , সেদিন ভাইয়ার চেইন যদি মেলা থেকে চুরি হয়ে থাকে তবে তা ফৌজিয়ার কাছে এলো কি করে? নাকি ফৌজিয়াকেই ভাইয়া উপহার দিয়েছিলো এটা। তারপর মিথ্যে করে বললো চুরি হয়ে গেছে। আমাদের কাছে গোপন করেছিল। কিন্তু এখানে একটা বিরাট প্রশ্ন থেকেই যায়। আচ্ছা ভাইয়া যদি ফৌজিয়াকে এই চেইন নিজের থেকেই উপহার দেয় তবে তার গলায় এই দাগটা হয়েছিল কিভাবে?

ফৌজিয়া চেইনটা আমার হাতে দিয়ে বললো,’ এটা চিনতে পেরেছো তপু?’
আমি চিনতে পারলেও সত্যটা বললাম না। কেন বললাম না জানি না। আমি বললাম,’ না, চিনতে পারছি না তো।’
ফৌজিয়া হাসলো। আগের মতোই সেই ভয়ংকর এক হাসি হেসে সে বললো,’ তুমি অবশ্যই চিনতে পেরেছো তপু। কিন্তু মিথ্যে বলছো তুমি। এই চেইন তোমার অপু ভাইয়ার।ঠিক বলিনি আমি?’
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,’ হু।ঠিক বলেছো।’
কিন্তু হঠাৎ করেই ফৌজিয়াকে কেন আমার ভয় করছে আমি তা বুঝতে পারছি না। ভয়ে ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছি না তার সাথে। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, ফৌজিয়া সাধারণ কোনো মেয়ে নয়।যাকে আমি এই এতো দিন অতি সাধারণ, সাদামাটা একজন ডাক্তার ভাবতাম, ফৌজিয়া শুধু এইটুকু না। সে এরচেয়েও বেশি কিছু। এবং ভয়ংকর।আর অনেক বেশি চতুর।
ফৌজিয়া এবার আমার কাছে এলো। একেবারে কাছে।নাকের ডগায়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’তোমাকে একটা প্রশ্ন করি তপু? একটা ছোট্ট প্রশ্ন? ‘
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,’ হু।করো।’
এবার ফৌজিয়া আমার সামনে একটা চেয়ার টেনে আনলো। তারপর এক পায়ের উপর তার অন্য পা তুলে নিয়ে আরাম করে ওখানে বসলো। তারপর গলার আওয়াজ কমিয়ে অথচ ধারালো গলায় বললো,’ যেহেতু এই চেইনটা তোমার ভাইয়ের তাহলে এই চেইন আমার কাছে এলো কি করে তপু? ‘


#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে