আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-১০

0
257

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#১০ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



আমি এর উত্তর কি দিবো? আমি কিভাবে জানবো ভাইয়ার চেইন কিভাবে তার কাছে এলো ? সে বলে দিলেই তো হয়।
আমি বললাম,’ ফৌজিয়া, এটা আমি কিভাবে বলবো বলো।এটা তো তোমার নিজের জানার কথা। তোমার কাছে যেহেতু চেইন তাহলে তুমিই জানো এটা কিভাবে তোমার হাতে এসেছে। তাহলে আমায় জিজ্ঞেস করছো কেন?’
ফৌজিয়া হাসলো।বললো,’ এমনিই জিজ্ঞেস করেছি। বাজিয়ে দেখলাম একটু তোমায়।’
আমি বললাম,’ এখন তুমিই বলো তোমার হাতে কিভাবে এটা এলো? আমি যতদূর জানি মেলা থেকে ভাইয়ার এই চেইন চুরি হয়ে গিয়েছিল।’
ফৌজিয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো এই কথা শোনার পর। সে খানিক হাসিহাসি মুখ নিয়ে বললো,’ কবেকার ঘটনা এটা? কতো বছর আগের বল তো? ‘
আমি বললাম,’ অতো কিছু কি আর মনে আছে নাকি!’
ফৌজিয়া বললো,’ তখন তুমি কোন ক্লাসে পড়তে এটা মনে আছে তোমার?’
আমি খানিক সময় ভাবলাম। তারপর বললাম,’ তখন তো ছুটির সময় ছিল। আমাদের এসএসসির রেজাল্ট পাবলিশের এক- দুদিন পরেই সম্ভবত ভাইয়ার চেইন চুরি হয়।’
ফৌজিয়া বললো,’ বাহ্। তুমি এখনও অসম্ভব রকমের মেধাবী। তোমার মেমোরাইজিং পাওয়ার অনেক বেশি স্ট্রং। এই জন্যই তোমার সঙ্গে কোনদিন আমি পড়াশোনায় কুলিয়ে উঠতে পারিনি তপু!’
বলে হাসলো ফৌজিয়া।
আমি বললাম,’ আচ্ছা ওসব বাদ দাও এখন।এর আগে তুমি এটা বলো কিভাবে তোমার কাছে ভাইয়ার চেইন এলো।’
ফৌজিয়া বললো,’ অবশ্যই বলবো।আজ সবকিছুই জানবে তুমি। কিন্তু তার আগে আরো কিছু কথা আছে তোমার সঙ্গে। আর কিছু জিনিস দেখাবারও আছে তোমায়।’
বলে চোখ টিপলো ফৌজিয়া।
আমি আজ ওকে একেবারেই নতুন করে আবিষ্কার করছি। তাকে আর মোটেও আমার চিরচেনা ফৌজিয়া মনে হচ্ছে না!
এরপর ফৌজিয়া হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা টেনে নিলো। তারপর চেয়ার থেকে উঠে এসে সোফায় সে আমার সঙ্গে মিশে বসলো। তারপর মোবাইলের গ্যালারিতে গিয়ে একটা ছবি বের করে আমায় দেখালো।ছবিটি সিলেটের লাক্কাতুরা চা- বাগানে তোলা।চা- বাগানে গিয়ে সে ছবি তুলেছে এটা আমি জানি। কিন্তু এই ছবি দেখে আমি চমকে উঠবো নাকি দম বন্ধ করে মরে যাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না!
ছবিতে ভাইয়া ফৌজিয়াকে জড়িয়ে ধরে আছে।ওই চা বাগানেই। একটা আকাশমণি গাছের নিচে তারা দাঁড়ানো।
আমি বললাম,’ এসব কি ফৌজিয়া?’
কথাটা রাগেই বলতে গেলাম। কিন্তু এর অর্ধেক বলতে পারলাম। বাকিটা বলার আগেই সে এক হাতে আমার মুখ চেপে ধরলো। তারপর বললো,’ এখন কোন প্রশ্ন করবে না আমায় তপু।আরো অনেক কিছুই দেখার বাকি আছে এখনও তোমার। শুধু দেখে যাও আপাতত।’
বলে সে গ্যালারি থেকে বের করে আরো একটি ছবি দেখালো। সেই ছবি দেখে আমার জিভ একেবারে তালুতে লেগে গেল। ফৌজিয়া আর অপু ভাইয়া শুয়ে আছে বিছানায়।তারা যে ঘরে শুয়ে আছে সেই ঘরের সব জিনিস পত্র, দেয়ালের কারুকাজ,লাইট,জানলা সবকিছুই দেখা যাচ্ছে ছবিতে।
এই ছবির ঘর আর বিছানার সঙ্গে আমার দেখা আরো কিছু ছবির ঘর আর বিছানার হুবহু মিল আছে। একটুও কম- বেশি নাই।
ফৌজিয়া বললো,’ ওয়েট।ছবি টবি ইডিট করা যায়।ছবি দেখিয়ে লাভ নাই তোমায়। এবার তোমায় একটা ভিডিও দেখাই।’
সে তার ফোনের ফাইলে ঢুকে একটা ভিডিও বের করলো। সেই ভিডিওতে অপু ভাইয়া ফৌজিয়ার পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। জড়িয়ে ধরে কি যেন বলছে। ফৌজিয়া আর ভাইয়া হাসাহাসিও করছে আবার। ভিডিওতে যে ঘর,ঘরের দেয়ালের রং, কারুকাজ , বিছানা, ঘরের অন্য সব আসবাবপত্র কিংবা লাইট, এর সবকিছুর সাথে অপি ভাবীর যে ভিডিও ছড়িয়েছে।ছবি ছড়িয়েছে। সেই ভিডিওর, ছবির ঘরের সঙ্গে হুবহু মিল। সোজা কথায় বলতে গেলে, একই ঘর, একই মানুষ। কিন্তু ভিন্ন দুটি নারী।
ততোক্ষণে আমার কাছে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।আমি বুঝতে পেরেছি অপু ভাইয়ার সঙ্গে ফৌজিয়ার গোপন এক সম্পর্ক ছিল ‌। এখনও আছে। এবং ভাবীর যে ভিডিও, ছবি ছড়িয়ে পড়লো অনলাইনে, ওখানে ভাবীর সঙ্গে থাকা অস্পষ্ট পুরুষটিও আর কেউ নয়।সে‌ অপু ভাইয়াই।
তবে কি অপু ভাইয়া নিজেই এই ভিডিও ছড়িয়েছে? নাকি অন্য কেউ?
ভাইয়া কেন তার নিজের আত্মসম্মান নিজেই নষ্ট করবে! কোন পুরুষ কি তার নিজের স্ত্রীর নগ্ন ছবি, ভিডিও এভাবে ভাইরাল করে দেয়?
এটা কি আদৌও সম্ভব!
আচ্ছা ধরলাম ভাইয়াই এইসব কিছু ছড়িয়েছে। কিন্তু এখানে আরো একটা বিরাট প্রশ্ন আছে। ধাঁধা আছে।এটা হলো ভাবী যে পর পর দুদিন ফোন করলো কাউকে। অনুরোধ করলো তার ছবি বা ভিডিও গুলো যেন এভাবে না ছড়িয়ে দেয়।প্রয়োজনে যা চায় তাই দিবে। এমনকি একদিন ভাবী নিজেই ওদের কালো গাড়ি করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। রাতে ফিরলো।ফেরার পর দেখা গেলো তার হাতে,কানে, গলায় কোথাও কোন গহনা নেই। এর মানে কি?
এই এতো এতো প্রশ্ন, রহস্য যখন মাথায় এসে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখন ফৌজিয়া আরেকটি ছবি দেখিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিলো। ছবিতে সেই একই ঘর,একই দেয়াল, দেয়ালের কারুকার্য। ভাইয়াও ওখানে। কিন্তু এখানে তৃতীয় একজন নারীও আছে । ওই নারীর সঙ্গেও ভাইয়া খুব অন্তরঙ্গ অবস্থায় আছে। এই নারীটি আর কেউ নয়। মহসিন ভাইয়ের বউ তরু ভাবী।
আমি স্থবির হয়ে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই এতো দিন, এতোটা সময় ভাইয়াকে যা দেখে এসেছি, যা ভেবে এসেছি এর সবই তবে ভুল? ভ্রান্তি?
মহসিন ভাই, যে নাকি ভাইয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু।বিশ্বস্ত বন্ধু। অবশেষে তার সবচেয়ে দূর্বল জায়গায়ও আঘাত করেছে ভাইয়া!
এইসব কিছু বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। কিন্তু অবিশ্বাস করার মতোও তো কিছু না এসব।
ফৌজিয়া মিটিমিটি হাসছে। এবার এরকম মিটিমিটি হেসেই সে বললো,’ কি হলো তপু? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাই না? হা হা হা। তোমার ভাইয়ার নাম কি যেন? মোহতাসিম বিল্লাহ অপু। তোমার ভাবী মানে অপি ভাবী তাকে মানুষ মনে করতো না। তাকে মনে করতো কুকুর। দেখতে মানুষের মতোই কিন্তু আদতে সে এক কুকুর।ওই যে নীল রঙের ডায়েরিতে ইংরেজি সেন্টেন্সটা পড়োনি? অপি ভাবীর গর্ভে এই কুকুরের সন্তানই এসেছিল। অপি ভাবী যখন কনসিভ করলো এবং দু মাস পর সে পুরোপুরি কনফার্ম হলো যে সে কনসিভ করেছে, সেই দিনটি তার ভীষণ আনন্দ করবার দিন ছিল।আনন্দে চিৎকার করে, হৈ হুল্লোড় করে এই সংবাদ তোমার অপু ভাইয়াকে, তোমাকে, তোমার মাকে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে এই সংবাদ দিতে পারেনি।কারণ, এর ছ’ ঘন্টা আগেই তার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনটি ঘটে। সে আবিষ্কার করে তার বিশ্বস্ত স্বামী সে ছাড়াও অন্য নারীর কাছে যায়।অন্য নারীর সঙ্গেও মিশে। অন্য নারীর সঙ্গে শু’ই। সেদিন সকালে তোমার ভাইয়া ফোন লক না করেই তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে গিয়েছিল।আর অপি ভাবী কি মনে করে যেন তোমার ভাইয়ার ফোনের ফাইলে ঢুকে পড়লো।আর তখনই তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।সে দেখলো, যাকে সে এতো দিন নিজের ওমে রেখেছে, আদরে রেখেছে, সে এক কাল সাপ! সে ফাইল খুলেই দেখলো মহসিন ভাইয়ের বউ অর্থাৎ তরু ভাবীর সঙ্গে তোমার ভাইয়ার অন্তরঙ্গ ছবি, ভিডিও সবকিছু। ভাবী যখন এসব দেখছিলো, বাথরুম থেকে এসে তোমার ভাইয়া তা দেখে ফেলে। দেখে ফেলে যে ভাবী তার মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছে। এবং গোপন সবকিছুই দেখে ফেলেছে ততোক্ষণে।সেদিনই ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া হয় তোমার ভাইয়ার।ভাবীর সঙ্গে কথার কাটাকাটির এক পর্যায়ে তোমার ভাইয়া ভাবীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।ভাবী গিয়ে পড়ে খাটের কোনায়। তার চোখের উপর কপালের নিচ দিকে যে লম্বা দাগ। সেই দাগটা তখনই হয়েছিল। এরপর থেকেই তাদের সংসারে গোপন যু*দ্ধের শুরু হয়।
অপি ভাবী অনেক চেষ্টা করেছে এই যু*দ্ধের অবসান ঘটাতে।ঘরে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। সবকিছু স্বাভাবিক করতে। কিন্তু তোমার অপু ভাইয়া এই সন্ধি চায়নি। সে বরং অপি ভাবীকে ভয় দেখায়। সেই যে কবে অপি ভাবীকে নিয়ে রিসোর্টে গিয়েছিল তোমার ভাইয়া। বিয়ের কদিন পর। তখনই সে বুদ্ধি করে তোমার ভাবীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ভিডিও করে রেখেছিল। ছবি তুলেছিল। এটা করে রেখেছিল সুযোগ বুঝে যেন সে নিজেকে বাঁচাতে পারে। এরপর তার সেই দিন এলো।অপি ভাবী নিজে নিজে এই সমস্যা সমাধান করতে না পেরে যখন তোমার মায়ের কাছে সবকিছু খুলে বলতে চাইলো, তখনই তোমার ভাইয়া অপি ভাবীর
এইসব ছবি আর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার ভয় দেখাতে শুরু করলো। আর তখনই অপি ভাবী সিদ্ধান্ত নেয়, এই বাচ্চা সে কিছুতেই তার পেটে রাখবে না। সে ভাবলো, কুকুরের বাচ্চা তো কুকুরই হয়। মানুষ হয় না।আর বাচ্চা যে তার গর্ভে এসেছে এই কথাও কাউকে আর সে জানায়নি । এমনকি তোমার ভাইয়াকেও না। সে সরাসরি আসে আমার কাছে।এবরোশন করাবার কথা বলে।আমি তো আগে থেকেই অপি ভাবীকে চিনতাম। কিন্তু সে তো আমায় আর চেনে না। আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না। তার কাছে আমি বলি, গর্ভপাত করাতে হলে কজ বলতে হবে।হিস্টোরি না শুনে নিষ্পাপ একটা ভ্রুণকে কিছুতেই আমি হ*ত্যা করতে পারবো না! সে তখনই সবকিছু খুলে বলে। কিছুই গোপন করেনি।সব শুনে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠি।
জানো তপু, এমন একটা সুযোগের জন্য আমি তেরোটা বছর ধরে অপেক্ষা করছিলাম।তেরোটা বছর, কতো দীর্ঘ সময় তুমি বুঝো? অবশেষে অপি ভাবী আমার কাছে আসলো।আর আমার সেই চির আকাঙ্ক্ষিত অপেক্ষার অবসান ঘটালো।আর আমার জেতার সময় এলো। বিজয়ের সময় এলো! ‘
হা হা হা করে আবারও হাসলো ফৌজিয়া। তারপর তার বাঁ পাশের টেবিলের ড্রয়ারটা একটানে খুলে চকচকে কালো রঙের ছোট্ট পি*স্তলটি বের করে আনলো।আর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চটজলদি আমার দিকে পি*স্তলটি তাক করে ফেললো।
আমি মুহুর্তে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।আমি জানি আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। এরপরেই আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে দিবে প্রাণনাশী একটি বুলেট। কিন্তু আমায় মা*রতে চায় কেন ফৌজিয়া? ভাইয়ার পাপের শাস্তি সে আমায় দিবে কেন?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে