আড়ালে কে নাড়ে কলকাঠি পর্ব-০৭

0
264

#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#৭ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মহসিন ভাই আমার মেসেজ এখনও সিন করেননি। তার সঙ্গে যে ফোন করে কথা বলবো এই শক্তি আমার শরীরে নাই। আমি ক্লান্ত শ্রান্ত আর বিধ্বস্ত হয়ে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রইলাম।
অবশ্য মহসিন ভাইয়ের সাথে যখন কথা হলো তখন কোন তথ্য তার কাছ থেকে পাওয়া গেল না। তিনি বললেন, এটা ফেসবুক, টেলিগ্রাম সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই পোস্ট করেছে। অনেক গুলো গ্রুপে, পেজে।এটা আসলে কে প্রথমে পোস্ট করেছে তা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।

আমার সবচেয়ে বেশি অবাক লাগছে একটা বিষয়ে, অপি ভাবী এই এতো দিন চুপচাপ কিভাবে রইলো? কোন কথাই বললো না সে এই বিষয় নিয়ে। ভাইয়াকে নিয়ে।আর আজ হঠাৎ করেই একেবারে বিদ্রোহ করে বাসা ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।আর তার চলে যাবার কয়েক ঘণ্টা পরেই তার এসব ছবি,ভিডিওর লিংক সব বের হয়ে গেল।এটা কিভাবে সম্ভব? এর মানে কি আমি ধরেই নিবো যে অপি ভাবী জানতো আগে থেকেই, আজ তার ছবিগুলো, এবং ভিডিও গুলো ছড়িয়ে পড়বে। তাহলে কি ভাবী যাদের অনুরোধ করেছিলো ছবিগুলো এবং ভিডিও গুলো পোস্ট না করতে তবে তারাই আজ এটি করেছে।তারা ভাবীর অনুরোধ রাখেনি। তবে যে ভাবী ওদের সঙ্গে কালো রঙের গাড়িতে করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। ভাবীর গহনা ঘাঁটি যা ছিল সব দিয়ে এলো,অথবা ওরা কেড়ে নিলো। এরপরেও কিভাবে ওরা ভাবীর সঙ্গে এমন করলো? বিনিময় নিয়েও কেন ওরা প্রতারণা করলো?
সে যায়হোক, আমার প্রশ্ন হলো ভাবীর সঙ্গে ভিডিওতে যে পুরুষ লোকটি এই লোকটি কে?যেই থাকুক না কেন পুরুষটি, সে ভয়াবহ রকমের চতুর। তাকে কোন ভাবেই চেনা যাচ্ছে না। কাউকে সন্দেহও করা যাচ্ছে না। এমনকি লোকটি কতোটা উঁচু, কতোটা সাস্থ্যবান, চেহারার অবয়ব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।ভাবী যে কোথাও ভয়ংকর রকম ভাবে ফেঁসে গিয়েছে এটা স্পষ্ট।

মজার বিষয় হলো এর পরদিন ভোর বেলায় ভাইয়া বাসায় ফিরলো। বাসায় ফিরে সে মায়ের পায়ের কাছে বসে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো।
মা বললেন,’ কোথায় ছিলি তুই?’
ভাইয়া সত্যি কথাই বললো।বললো,’ সিলেটে।’
‘সিলেটে কেন গিয়েছিলি?’
ভাইয়া আর মিথ্যে করে অফিসের কথা বললো না। সে বললো,’ ঘুরতে।’
‘ তাহলে বাসায় মিথ্যে বলে গেলি কেন? অফিসের কথা বললি কেন?’
ভাইয়া এবার মায়ের পা জড়িয়ে ধরে মায়ের কোলে মাথা গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো।আর কান্নাভেজা গলায় বলতে লাগলো,’ মা, আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে! আমার সব শেষ হয়ে গেছে।একটা সোনার সংসার, পুড়ে ছাই করে দিয়েছে অপি।দিনের পর দিন আমি এসব যন্ত্রণা, কষ্ট সব সহ্য করেছি। ঘরের কাউকে কিছুই বলিনি। ভেবেছিলাম একাই সব সমাধান করবো। কিন্তু আমি পারিনি মা।যে পতিতা, নষ্টা, তাকে ধর্মের জ্ঞান আর সামাজিকতার ভয় দেখিয়ে লাভ হয় না মা!’
ভাইয়া তখনও কাঁদছে। তার চোখ লাল হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে।
মা অপু ভাইয়ার মুখটা তার দু হাত দিয়ে উপরে তুললেন। তারপর বললেন,’ কি হয়েছিল বল তো আমায়!’
ভাইয়া বললো,’ অপি কারোর সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল মা।যার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তার কাছে অপির ভিডিও ছিল।এসব ভিডিও দিয়ে দিনের পর দিন ওই লোক আমায় হুমকি ধামকি দিতো।টাকা চাইতো।টাকা না দিলে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হু*মকি দিতো।আমি টাকা দিয়েছি।এটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন আমি জানলাম যার সঙ্গে অপির অবৈধ সম্পর্ক, তার সন্তানই অপির গর্ভে। তখনই আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে তখন গোপন এক কলহ শুরু হয়। তাকে আমি মারধোরও করি। সবার আড়ালে।আমি চাইনি তা কেউ জানুক।আর কেউ কষ্ট পাক এসব শুনে।আমি নিজে নিজেই সব কিছুর সমাধান করতে চেয়েছি। অপি শেষ পর্যন্ত হসপিটালে গিয়ে তার গর্ভের সন্তান অ্যাবোরেশোন করে এলো। এইসব কিছু আমি কিভাবে মেনে নিতাম বলো মা? কিভাবে? এর পরপরই আমি নিজেকে শান্ত করতে,একটু চিন্তামুক্ত থাকতে সিলেটে চলে যায়। ভাবলাম, ওখানে কদিন থেকে এলেই আমি শান্ত থাকতে পারবো।একটু ভালো থাকতে পারবো। কিন্তু ওখানে গিয়েও আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না।ওই লোক আমায় আবার ফোন করতে শুরু করে। আবার টাকা চাইতে শুরু করে। আবার হু*মকি দেয়।
বলে, টাকা না দিলে এসব ছবি,ভিডিও ছড়িয়ে দিবে। এরপরই আমি ফোন অফ করে ফেলি। আমি আর এসব নিতে পারছিলাম না।আমি বোঝে গিয়েছিলাম, সে কদিন পর পরই এভাবে আমার কাছে টাকা চাইবে।আর হু*মকি দিয়েই যাবে।অপিকে ওই লোক ইউজ করেছে শুধুমাত্র টাকা ইনকাম করতে।অপি বুঝতে পারেনি।অপি তার নিজের জীবন ধ্বং*স করলো, সাথে আমার জীবনটাও! ‘
ভাইয়া কেঁদেই যাচ্ছে।মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কোন কথা বলছেন না।
ভাইয়াই আবার কথা বললো। বললো,’ আমার ভাগ্যটা এতো খারাপ কেন মা ? বলো, আমার ভাগ্যটা এতো খারাপ কেন? এই যে সবাই আমার স্ত্রীর এসব ছবি দেখবে, ভিডিও দেখবে।আমি কিভাবে সমাজে মুখ দেখাবো মা? আমি মানুষদের কিভাবে এই মুখ দেখাবো? এরকম জীবন রাখার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো মা। এরকম জীবন রাখার কোন মানেই হয় না!’
মা ভাইয়াকে বার বার সান্তনা দিলেন।মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।আদর করে দিলেন। কিন্তু আমার কেন জানি এসব দেখে মনে মায়া জন্মের পরিবর্তে কেমন একটা ক্ষোভ জন্ম নিলো।

এই যে ভাইয়া এভাবে কাঁদলো। দুঃখ করলো।এসব দেখে, ভাইয়ার কথা শোনে মোটেও আমার মন গলেনি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে হয়তো কোন একটা কিন্তু আছে। নয়তো ভাবী অতো সব কিছু করলো, আর ভাইয়া এর সবকিছুই শুধু গোপনে সহ্য করেই গেল।এটা কি বিশ্বাস যোগ্য কথা?
আর ভাবী যে আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাবার সময় এভাবে কাঁদলো , গেট ডিঙিয়ে যাবার সময়ও চোখ মুছলো, এসব কি শুধু শুধু?
একটা ঘরের জন্য, ঘরের মানুষ গুলোর জন্য ভালোবাসা না থাকলে কি কেউ এমন করবে?

সন্ধ্যা সময় ভাইয়া বাজারে গেলো।ফেরার সময় দেখলাম তার হাতে একটা প্যাকেট।আমি বললাম,’ কি এনেছো ভাইয়া?’
ভাইয়া বললো,’ সুঁতো।’
আমি অবাক হলাম। বললাম,’ সুঁতো কেন? সুঁতো দিয়ে কি করবে?’
ভাইয়া বললো,’ কাল অফিস আছে। অফিসের কাজে লাগবে।’
আমি আর কিছু বললাম না। ভাইয়ার সঙ্গে এখন আর অতো কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কেন জানি ভাইয়াকে আর আমার সুবিধার লোক মনে হয় না। তাকে আমার অতোটা বিশ্বাসও হয় না। কেন জানি সব সময় তাকে আমার সন্দেহ হয়। কেন জানি মনে হয়, অপি ভাবীর কোন দোষ ছিল না।সব দোষ ভাইয়ার। এসবের জন্য একমাত্র ভাইয়াই দায়ী।

কিন্তু সে রাতেই আমার এই ভুল ধারণা বদলে গেল। তখন মাঝরাত। ফেসবুকে স্ক্রল করছি। তখনই দেখলাম নিউজফিডে ভাইয়ার স্ট্যাটাস।দুই মিনিট আগেই পোস্ট করেছে সে।লিখেছে ‘ এই জীবনের উপর আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। এমন কলঙ্কে অঙ্কিত কুৎসিত একটা জীবন রাখার কোন মানেই হয় না।আমি নিজের ইচ্ছায় আত্মহ*ত্যা করছি। এতে কেউ দায়ী নয়।’
ভাইয়ার পোস্ট দেখার পর দু’ চোখ অন্ধকার হয়ে এলো আমার। সন্ধ্যা সময় যে ভাইয়া মোটা সুঁতো কিনে এনেছিল প্যাকেটে করে তাহলে তা অফিসের কাজের জন্য আনেনি।এটা দিয়ে আত্মহ*ত্যা করতেই কিনে এনেছিল। আমার কাছে মিথ্যে বলেছিল। আমিও তখন বুঝতে পারিনি।ভাবতেও পারিনি ভাইয়া এমন একটা কাজ করে ফেলবে!
আমি কি করবো না করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। নিজের উপর নিজেরই ভীষণ রাগ লাগছে এখন। আমার আপন ভাই, রক্তের ভাই। তাকে কিভাবে আমি অবিশ্বাস করে ফেলেছিলাম!
কিভাবে ভাইয়ার চেয়ে অপি ভাবী আমার কাছে বিশ্বাসের পাত্রী হয়ে পড়েছিল! অথচ ভাইয়াকে অবিশ্বাস করার মতো প্রমাণ নাই বললেই চলে। কিন্তু অপি ভাবীকে অবিশ্বাস করার মতো অনেক গুলোই প্রমাণ আছে। এবং সবগুলো প্রমাণই অতি জ*ঘন্য!
আমি তাড়াহুড়ো করে মাকে ডেকে তুললাম।মা আর আমি দৌড়ে গেলাম ভাইয়ার দরজার কাছে। কিন্তু ভেতর থেকে ভাইয়ার দরজা আটকে রাখা।আমি আর মা চিৎকার করে ভাইয়াকে ডাকছি।মা কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতে ভাইয়াকে অনুরোধ করে বলছেন,’ বাবা, তুমি দরজাটা খুলো। লক্ষ্মী বাবা আমার! সোনা মানিক আমার! তুমি বেঁচে না থাকলে আমি বাঁচবো কিভাবে? কাকে নিয়ে বাঁচবো! ‘
কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ভাইয়া ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ করছে না।
আমি ভাইয়াকে ফোন দিচ্ছি। ফোন বন্ধ করে ফেলেছে। এরপর নিরুপায় হয়ে দরজায় আমার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছি। মাও আমার সঙ্গে দরজায় আঘাত করছেন তার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে।কিন্তু কোন ভাবেই আর দরজা খুলতে পারছি না আমরা। এখন কি হবে? আচ্ছা ভাইয়া কি তাহলে গ*লায় দড়ি দিয়ে ঝু*লে পড়েছে এতোক্ষণে ?

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে