অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
305

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পঞ্চবিংশ পর্ব

বিকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আহনাফ ও সারাহ্। মায়ের সাথে একপ্রকার রাগ করেই চলে এসেছে সারাহ্। বাসে উঠে খেয়াল হলো ওর মা ওইসব কথা উঠলেই রেগে যাচ্ছিল, মানে উনি নিশ্চয়ই কিছু তো জানে। তাহলে এখন ঢাকা থেকে চলে গেলে যদি মায়ের কোনো বি°পদ হয়।

“আহনাফ, আমি বাসায় যাবো।”

সারাহ্-র অতিউৎসাহী কথায় আহনাফ সাধারণ হবাব দেয়,
“তাই তো যাচ্ছি।”
“আম্মুর বাসায় যাবো।”
“কাল না চলে আসার জে°দ করলে?”
“এখন তো যেতে চাচ্ছি, চলেন।”

আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে চোখমুখ কুঁচকে বলল,
“মাইয়া মাইনসের য°ন্ত্র°ণা আর স°হ্য হয় না।”

সারাহ্ ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“কয়টা মেয়ের য°ন্ত্র°ণা স°হ্য করছেন, মিস্টার?”

আহনাফ মুখ টিপে হেসে ওর কাছে গিয়ে বলে,
“আমি যাই করি, এখন তুমি কিছু সহ্য করো।”
“এটা বাস, তোমার বাসা না।”
“তুমি বললে বাসরও বানাতে পারি।”
“ছি।”

সারাহ্ ওকে একটু ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আহনাফ হাসতে থাকে।

তারপর সিরিয়াস একটা চেহারা করে বলে,
“কেন বাসায় যেতে চাচ্ছো?”
“মনে হচ্ছে আম্মু কিছু জানে বাট লুকাচ্ছে।”
“অফিসারকে বললে না কেন?”

সারাহ্ একটু চুপ থেকে বলল,
“অফিসার নাইমাকে জানিয়েছি, উনি বলেছেন আম্মুকে নজরে রাখবেন।”
“তবে তো হলোই।”
“যদি আম্মুর কোনো সমস্যা হয়।”

আহনাফ সিটে হেলান দিয়ে সারাহ্-র দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেয়েগুলো যা এক°রো°খা, মা নিশ্চয়ই আরো বেশি হবে। নো টেনশন।”
“আমার মা আপনার শাশুড়ী হয়।”
সারাহ্ কি°ড়মি°ড়িয়ে কথাটা বলে।

আহনাফ চোখ বন্ধ করে হাসতে থাকে। সময়ে অসময়ে, কারণে অকারণে সারাহ্-কে রাগাতে তার ভালোই লাগে।
______________________________________

ইমতিয়াজ পুরো রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। জানলা দরজা বেশ ভালো মতো সিল করা। খোলার কোনো উপায় নেই আর ওর তো একহাত ভা°ঙা, চেষ্টাও করতে পারছে না। ওয়াশরুমে কোনো জানলা নেই। এক কথায় বাইরের পরিবেশ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে ওদের।

নীলুফার দুপুরে এসে খাবার দিয়ে গেছে। ইমতিয়াজ একটু চুপচাপ থাকার চেষ্টা করছে, ঠান্ডা মাথায় ভাবছে সবকিছু। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে এতো এতো ঘটনা ঘটেছে যে তা একমুহূর্তে বোঝা সহজ নয়।

নীলুফার দরজায় নক করে বলে,
“আসবো।”

ইমতিয়াজের উত্তরের অপেক্ষা না করে সে ভিতরে আসে। ইমতিয়াজ তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার ফোন কোথায়?”

মৃত্তিকার স্যালাইন খুলতে খুলতে স্বাভাবিক সুরে বলে,
“আমি জানি না, আপনি নিজেকে যে খুঁজে পেয়েছেন এটাই বেশি।”

ইমতিয়াজ কিছু বলে না, শুধু চোখ কুঁচকায়। নীলুফার আবার বলে,
“কবরে পড়ে ছিলেন তাই উপরে একটা লা°শ নিয়ে। জ°ব্ব°র লোক আপনি।”

ইমতিয়াজ একটু চুপ থেকে বলে,
“কার লা°শ ছিলো? (একটু থেমে) আই মিন, পুরুষ নাকি নারী?”

নীলুফার হেসে বলল,
“নারী নিয়ে কবরে যাবেন?”

তারপর হো হো করে কিছুক্ষণ হেসে বলে,
“পুরুষ ছিল। একজন নারী পাশে পড়ে ছিল।”

ইমতিয়াজ বুঝতে পারে এরাই সেই দুজন যারা ওকে মা°রা°র চেষ্টা করেছে। আবারো প্রশ্ন করে,
“ওরা কিভাবে মা°রা গেছে?”

নীলুফার মৃত্তিকার সব ইলেকট্রোড খুলছে। কাজ থামিয়ে বলল,
“একেকজনকে তিনটা করে গু°লি করা..”

নীলুফার কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে পল্লবী বলল,
“একদম বুকে দুইটা, হৃদ°পিণ্ড ছি°ন্নভি°ন্ন হয়েছে ওদের।”

ইমতিয়াজ চমকে উঠে পিছন ফিরে। পল্লবী আলতো করে হেসে নীলুফারকে বলে,
“ওকে নিয়ে আসো।”

মৃত্তিকার বেডটা নিয়ে যেতে চাইলে ইমতিয়াজ বাধা দেয়।
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?”
“এম আর আই করাতে হবে।”

পল্লবীর উত্তরটা ইমতিয়াজের পছন্দ হলো না। অপরিচিত দুজন নারী, যতই ওদের বাঁচাক না কেন বিশ্বাস করা সমীচীন নয়। নিরীহ সেজে ধোঁকা দেয়ার লোকের অভাব নেই।

“আমি সাথে যাবো।”

ইমতিয়াজের কথার জবাব দেয়ার আগে সে আবারো বলে,
“যাবো মানে যাবো, কোনো প্রশ্ন নয়।”

পল্লবী মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”

মৃত্তিকাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ইমতিয়াজও সাথে যাচ্ছে। সাদা রঙের দেয়ালগুলো দেখছে সে, পাশে থাকা চেয়ারগুলো সাদা, জানলা-দরজার গ্রিল ও পর্দাও সাদা। নীলুফার আর পল্লবীর পোশাকও সাদা।

এম আর আই রুমে গিয়ে নীলুফার সব ঠিক করছে। ইমতিয়াজ পল্লবীকে বলে,
“এসব মেশিন চালাতে তো এক্সপার্ট লোক লাগে। এখানে তো আপনারা ছাড়া আর কেউ নেই।”
“এখানেই অনেক মানুষ আছে, তোমার নজরে তুমি দেখতে পাচ্ছো না।”

ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকায়। এই মহিলা যথেষ্ট হেয়ালি করে কথা বলে। কোথায় মানুষ? থাকলে সে দেখবে না কেন?

এখানেও সব সাদা। প্রত্যেকটা জিনিস সাদা। এক অদ্ভুত শুভ্রতা সবকিছুতে।

“এখানে সবকিছুই এমন সাদা কেন?”

ইমতিয়াজের প্রশ্নে পল্লবী একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল,
“কা°ফ°নের রঙ তো শুভ্রই হয়। অন্য কোনো রঙ দেখেছো নাকি?”
______________________________________

লুৎফর রহমান ও তানজিম এসেছে রমনা থানায়। ইমতিয়াজ আর মৃত্তিকা নি°খোঁজ, কিন্তু বাসায় ওদের নিয়ে কোনো কথাই হচ্ছে না। সবাই চিন্তিত কিন্তু কেইসের কথা বললেই কেমন যেন গু°ম°রে যায়। অবশেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে দুজনে থানায় আসে।

ইন্সপেক্টর রাব্বি উনাদের সব কথা শুনে, উনাদেরকে সাথে নিয়ে ইমতিয়াজের বাসায় আসেন। দরজা খুলেই সবাই অবাক।

বাসা গোছানো, পারফিউম পাওয়া যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই যেন সবকিছু গোছানো হয়েছে। মিউ মিউ করে বিড়ালটা আসলো, সেও একদম ফুরফুরে মেজাজে আছে। তিনচারদিন ধরে ইমতিয়াজ নেই, তার তো না খেয়ে থাকার কথা৷ অথচ সে আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার বাটিতে খাবার-পানি সব আছে।

ইমতিয়াজের শোবার ঘরে গিয়ে আরেকদফা অবাক হতে হলো তাদের। এই রুমটা আরো গোছানো, পরিপাটি। বিছানা একদম টানটান অবস্থায় আছে। রান্নাঘরে গিয়ে বুঝলো চুলা গরম, অর্থাৎ এখানে রান্না হয়েছে। সিংকের পাশে খুয়ে রাখা থালা-কাপ, তারমানে কেউ খেয়েছে।

রাব্বি সব ঘুরে ঘুরে দেখে বলল,
“আপনারা বললেন আজকে নিয়ে চারদিন উনি নি°খোঁজ, অথচ ঘর দেখে মনে হচ্ছে উনি আজকেও বাসায় ছিল। কেন?”

তানজিম কি বলবে বুঝতে পারছে না। ইমতিয়াজ কি তাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখতে চাইছে না? এতো লুকোচুরি কেন?

“যা হোক, আপনারা শুধু শুধুই আমাদের সময় নষ্ট করেছেন।”

এবারে তানজিম মুখ খুলে,
“কিন্তু ওই ম্যাসেজ।”
“হয়তো গিয়েছিল আর ফিরেও এসেছে।”
“তবে মিউকো আপু কোথায়?”

তানজিমের কথায় রাব্বি আবারো রান্নাঘরের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“চলে আসবে।”

একজন কন্সটেবল সাথে এসেছিল। তাকে নিয়ে নিরবে বেরিয়ে যায় রাব্বি। ওদের কথার কোনো গুরুত্বই রাব্বি দেয়নি। কোনো কে°ইস নেয়নি। তার ভাবসাবে মনে হয়েছে ইমতিয়াজ একটু আগে উনার সাথেই চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে গেছে।
______________________________________

পরদিন সকালে,

বাসায় কোনো এক অতিথি আসবে৷ তাই বেস ভালো করেই যোগাড় করা শুরু করেছেন নার্গিস পারভিন। বাসার কাজের খালাকেও সকাল থেকে ব্যস্ত করে রেখেছেন।

সামিহা নিজকক্ষে আরামে ঘুমাচ্ছিল। শনিবার, ভার্সিটিতে ক্লাস নেই, এই কারণে বেশ আরামেই ঘুমাচ্ছে সে।

নার্গিস পারভিন এসে লাইট জ্বালিয়ে বলেন,
“ঘুম ছাড়াও জীবনে অনেক কিছু থাকে। তোমার তো আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। উঠে ফ্রেশ হও, মেহমান আসবে।”

সামিহা মাথাটা একটু তুলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,
“কে আসবে?”
“তোমার এক আন্টি।”

সামিহা আবারো শুয়ে বলল,
“আমাকে দেখতে তো আর আসছে না। তবে আমি কেন উঠবো।”

ওর গায়ের কাঁথা সরিয়ে নিয়ে বলেন,
“উঠো, উঠে পড়ো।”

সামিহা চোখ কচলে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। মায়ের মেজাজের এমন চৌদ্দটা বেজে আছে কেন তা ওর জানা নেই। কোন দেশি মেহমান আসবে তা ও দেখতে চায়।
______________________________________

“মিউকো চেয়েছিল শেয়ার কিনতে, অথচ এখন হুট করে লা°পাত্তা। ফোন ধরছে না, কোনো ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে না। ঘটনা কি?”

ইসরাত আপন মনে বকবক করছে আর মৃত্তিকাকে ম্যাসেজ করছে। মৃত্তিকা ম্যাসেজ সিন করছে কিন্তু রিপ্লাই দিচ্ছে না। ইসরাত কল দেয়, রিসিভ হয় না।

রাগে ফোন রেখে ইসরাত বসে থাকে। এ কেমন ব্যবহার ওর। শেয়ার কেনার কথা বলে এখন নিজেই চুপ, ও কি সারাবছর দেশে বসে থাকবে।

এদিকে মৃত্তিকা আর ইমতিয়াজের ফোন আছে শরীফের কাছে। টেবিলে থাকা দুজনের ফোন ক্রমাগত হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছে উনি। মৃত্তিকা শেয়ার কেনার জন্য দেশে ছিল, এই কথাটা মাত্রই জেনেছে।

“মিউকো, আমার মেয়ে আমার দিকেই গেছে। কলবরকে নিশ্চয়ই সে চিনেছে। ওই ফ্যামিলিটা ভালোই থাকতো যদি আমাকে ভালো থাকতে দিতো।”

টেবিলের উপর থেকে পেপারওয়েটটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে বলল,
“রিপা, শুধু তুমি বুঝোনি। তোমার মেয়েও সত্যটা ধরেছে আর তুমি..”

রাগে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে শরীফ। বয়সের ভারে এখন চেঁচামেচি তার জন্য বেশ ভারি হয়। কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“তুমি যদি আগে বুঝতে তবে অকালে তোমাকে ম°র°তে হতো না।”
______________________________________

বিকাল চারটা ত্রিশ,
মৃত্তিকার বিছানাটার পাশে ফ্লোরে বসে পেছনের ছোট টেবিলটায় হেলান দিয়ে বসে আছে ইমতিয়াজ। শরীর তারও বেশ খারাপ করছে। এই শুভ্র রঙ আর এতো এতো চিন্তায় মস্তিষ্ক কাজ করা থামিয়ে দিচ্ছে বোধহয়।

হাতের আঙ্গুলে এক দুই করে গুণছে আর ভাবছে ইমতিয়াজ।

মৃত্তিকা বলেছিল তিনটা মৃ°ত্যু°র পেছনে তার বাবার হাত থাকতে পারে। ওর বাবার ওর পিছনে স্পা°ই দিয়েছে।

ওর বাবার কাছে পি°স্ত°ল আছে। আবার গো°রস্থানে ওই দুজনকে গু°লি করা হয়েছিল।

মৃত্তিকাকে মারার আগে ওর কাছে চিঠি এসেছিল। “ওই বাসা” মানে ওর মামার বাসা থেকে বের করতে হতো। শাফিন সাহেবের বাসায় কি ভয়?

খুঁড়ে রাখা কবরের সাথে লাগানো পাথরে মৃত্তিকার নাম ছিল। আগেভাগেই কেউ তা তৈরি করে। তবে কি এটা পূর্বপরিকল্পিত খু°ন?

গো°র°স্থানে লোকটা বলেছিল “তাহমিনার হাসবেন্ডই পরবর্তী লোক।” তারমানে কেউ ওকে আগে থেকে পয়েন্টে রেখেছে।

ইমতিয়াজ নিচুস্বরে বলে উঠে,
“তবে কি সত্যিই তিনজনকে খু°ন করা হয়েছিল?”

ইমতিয়াজ লাফিয়ে উঠে বসে। এতদিন পর এমন একটা চরম সত্য উপলব্ধি করে সে স্তম্ভিত। সবকিছুই পূর্বপরিকল্পনায় হয়েছে। ঠান্ডা মাথার কোনো ব্যক্তি এই পরিকল্পনার মূলে আছে।

কে সে? মৃত্তিকার বাবা? ডি°ভো°র্সের এতো বছর পর উনি কেন রিপা বেগমকে খু°ন করবে? তাও দেশে এনে।

দরজা ঠেলে ভিতরে আসে পল্লবী। ইমতিয়াজকে দেখে মুখ টি°পে হেসে বলে,
“মৃত্তিকার রিপোর্ট দেখলাম।”

ইমতিয়াজ হাতে থাকা কাঁ°চি°টা শক্ত করে ধরে বলে,
“কি এসেছে রিপোর্টে?”

রিপোর্টগুলো অপরপাশের টেবিলে রেখে বলে,
“মোটামুটি ভালো। ওর কো°মা নিয়ে ভ°য় পেয়েছিলাম, তবে এমন কোনো সম্ভাবনা আর নেই।”

ইমতিয়াজ উঠে পল্লবীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাদের এখানে আটকে রাখা হয়েছে কেন?”

পল্লবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আটকে তো রাখিনি। তবে যেতে দেবো না।”

ইমতিয়াজ কাঁ°চিটা উঁচু করতেই পল্লবী ওর হাতে ও কোমড়ে বেশ জোরে ঘু°ষি দেয়। ইমতিয়াজের কোন কোন স্থানে ক্ষ°ত আছে তা সে ভালো করেই জানে।

ইমতিয়াজ সরে যায়, কোমড়ের ক্ষ°তে আর হাতে প্রচন্ড ব্য°থা হচ্ছে। পল্লবী রাগি কন্ঠে বলে,
“গাধা নাকি তুমি? আমাকে কেন আ°ক্র°ম°ণ করেছো?”
“এই জায়গায় আটকে কেন রেখেছেন?”
কি°ড়মি°ড় করে বলে ইমতিয়াজ।

“কাঁ°চি ফেলো, (ধম°কে উঠে) ফেলো।”

ইমতিয়াজ কাঁ°চিটা ফেলে দেয়। পল্লবী কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে মৃত্তিকার কপালে চুমো দিয়ে বলে,
“জলদি ভালো হয়ে উঠো, মা। পৃথিবী তোমার অপেক্ষায়।”

ইমতিয়াজের দিকে রাগি দৃষ্টি দিয়ে পল্লবী বেরিয়ে যায়। সাথে বন্ধ হয় দরজাটা। ইমতিয়াজ ডানহাতে ধরে এসে নিজের বিছানায় বসে।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষট্ বিংশ পর্ব (২৬ পর্ব)

“বাসায় কে এসেছিল, এশা?”

বাবার প্রশ্নে সামিহা ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে,
“কোনো এক রোমি আন্টি।”

জাহাঙ্গীর সাহেব ঠোঁট উল্টালেন। স্ত্রীর কোনো বান্ধুবীকে উনি চিনেন না। শব্দহীন হয়ে নিজকক্ষে প্রবেশের সময় নার্গিস পারভিনকে কারো সাথে কথা বলতে শুনেন,
“আমি ভুল না উনি ঢাকায় থাকার কথা না।”

ফোনের অপরপাশ থেকে রোমি বলেন,
“সিআইডির সাহায্য নেয়া উচিত। তোমার জামাই ঠিক কথা বলছে।”

“কি বলবো? আমার জন্মের আগের ঘটনা এটা, তারপর আমার শৈশব কালেও কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমার বাড়ি এক জায়গায় আর এটা ঘটেছে আরেক জায়গায়। মানুষ আমাকে সুস্থ ভাববে?”

রোমি খন্দকার নিরব থাকেন। জাহাঙ্গীর সাহেব অপরপাশের কথা না শুনলেও নার্গিস পারভিনের কথা সবই শুনেছে। উনি দরজা ঠেলে ভিতরে আসেন। নার্গিস পারভিন “রাখছি” বলে কল কে°টে দেন।

“কিসব হচ্ছে? কি ঘটনা ঘটেছে?”

নার্গিস পারভিন শান্ত গলায় হেসে বলেন,
“তেমন কিছু না। আমার এক ফ্রেন্ড এসেছিল, ওর কিছু সমস্যা নিয়েই কথা হয়েছে, কিন্তু সমাধান হয়নি।”

জাহাঙ্গীর সাহেব বিষয়টা নিয়ে আর নাড়াচাড়া করেন না। আলতোভাবে মাথা নাড়েন।
______________________________________

পরদিন ভোরে,
স্বাভাবিকভাবেই গতরাতে ঘুমিয়েছিল ইমতিয়াজ। কিন্তু ঘুমটা ভাঙে তার অস্বাভাবিক ভাবে।

ভোর ভোর তানজিম ডাকছে,
“ভাইয়া, এই ভাইয়া।”

ইমতিয়াজ চোখ খুলে আশেপাশে তাকায়। সাধারণ একটা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে সে। কোথায় গেল ওই শুভ্র রহস্য?

লুৎফর রহমান পাশ থেকে বলল,
“তুমি ঢাকার বাইরে গেলে, ফিরেও এলে, এ°ক্সি°ডে°ন্ট করলে অথচ একবারও আমরা জানলাম না। চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।”

ইমতিয়াজ উঠে বসে বলল,
“তেমন কিছু হয়নি আমার, ঠিক আছি।”
“ঠিক নেই তুমি ভাইয়া। আমরা তো পুলিশ কে°ইসও করতে গেছিলাম, ভাগ্যিস করিনি।”

তানজিমের কথায় ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে। বলে,
“মৃত্তিকা?”
“আপু বিশেষ কেবিনে, জ্ঞান ফেরেনি।”

ইমতিয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর উঠে বেরিয়ে আসে। ভোররাত এখনো হয়তো ফজরের আযান দেয়নি। তবুও এখানে কত মানুষ। ওই শুভ্র দিনগুলোকে স্বপ্ন ভাবছে ইমতিয়াজ, হয়তো সে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু তা তো বাস্তব, এক অচেনা বাস্তবে ছিল সে।

পাশ দিয়ে ডা. পল্লবী যায়। ইমতিয়াজকে দেখে আলতো হেসে চুপ থাকতে ইশারা করে চলে যায়।

মৃত্তিকার কেবিনের সামনে মমতাজ বেগম আর শাফিন সাহেব বসে আছে। ইমতিয়াজকে দেখেই মমতাজ বেগম উঠে এসে ওকে ধরে কান্না করে দেয়। শাফিন সাহেব বললেন,
“কেমন আছো?”

ইমতিয়াজ কাঁচের জানলা ছাড়িয়ে ভিতরে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“মৃত্তিকার চেয়ে অনেক ভালো আছি।”
“এই কয়দিন কোথায় ছিলে?”

ইমতিয়াজ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে পল্লবীকে দেখে বলে,
“এখানেই ছিলাম।”
“তোমার বাসায় কে ছিল ভাইয়া?”

পাশ থেকে কথাটা বলে তানজিম। ইমতিয়াজ তাকালে তানজিম আবারো বলে,
“আমি তোমার বাসায় গিয়েছিলাম, বাসা একদম সাজানো গোছানো ছিল।”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মি°থ্যা একটা কথা বলে দেয়,
“আমার বন্ধু ছিল।”

পুরো সত্য সে নিজেও জানে না৷ এখন সবাইকে বলা মানে মৃত্তিকার জীবনে আরো দুঃখ টে°নে আনা আর রহস্যটা অধরা থেকে যাওয়া। ওই জীবন্ত স°মা°ধী আর শুভ্রতার রহস্য যে তাকে খুঁজতেই হবে।

তানজিম ওকে টে°নে একটু দূরে এনে ম্যাসেজটা দেখিয়ে বলে,
“এটা কে দিয়েছে?”

ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে বলল,
“আমি না, আমার ফোনই তো আমার কাছে নেই।”

তানজিম মামা, মা আর বাবার দিকে তাকায়। এই পরিবারের উপর কার এমন নজর পড়লো।

তানজিম চলে যেতে নিলে ইমতিয়াজ ওকে বলল,
“এখন একটু চুপ থাকো, বিষয়টা কাউকে জানিও না।”
“কোনো সমস্যা ভাইয়া?”

ইমতিয়াজ তানজিমের কানের কাছে গিয়ে বলে,
“চুপ থাকতে বলেছি, চুপ থাকো। সবকিছুর সময় আসছে।”

ইমতিয়াজ চলে যায়। পল্লবীর কেবিনে গিয়ে দরজায় নক করে। পল্লবী বলে,
“আসো, ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ ভিতরে গিয়ে বেশ শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমাদের ফোন থেকে আপনি সবাইকে ম্যাসেজ করেছেন?”

পল্লবী ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে,
“আপনা থেকে চলে গেছে।”
“হেয়ালি করবেন না।”
“ওকে, আমি দিয়েছি।”

পল্লবী নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল,
“ডা. পল্লবী মহৎ মানুষ, এটা সবাই জানে।”

ফজরের আযান শুনে ইমতিয়াজ আর কিছু না বলে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে চলে যায়। এই মহিলা একটা রহস্যের কু°ন্ড°লী, এমনভাবে পাঁ°ক লেগেছে যে খুলে আসা কঠিন।
______________________________________

আজ বেশ তাড়াতাড়ি কলেজে চলে এসেছে আহনাফ ও সারাহ্। প্রায় সাড়ে সাতটায় কলেজে এসে হাজির, কিন্তু ক্লাস শুরু নয়টায়।

কলেজ গেইট ছাড়িয়ে ভিতরে আসতে আসতে সারাহ্ বলে,
“এতো তাড়াতাড়ি আসলে কেন?”

সারাহ্-র প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আহনাফ পালটা প্রশ্ন করে,
“ব্যাটমিন্টন খেলতে পারো?”

সারাহ্ মাঠের দিকে তাকায়, কতগুলো ছেলে মেয়ে ওখানে ব্যাটমিন্টন খেলছে। সে মাথা নাড়ে,
“হ্যাঁ, পারি।”

আহনাফ ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলে,
“ওকে, ব্যাগ রেখে মাঠে আসো।”

সারাহ্ চোখ কুঁচকে বলল,
“কলেজ মাঠে আমি এখন ব্যাটমিন্টন খেলবো?”
“আমি না আমরা, তাড়াতাড়ি যাও।”

আহনাফ নিজের ব্যাগটা এক ছাত্রের হাত দিয়ে টিচার্স রুমে পাঠিয়ে দেয়। শার্টের হাতা গু°টাতে গু°টাতে গিয়ে ব্যাট নিয়ে খেলতে শুরু করে।

সারাহ্ ব্যাগ রেখে এসে কলেজের বারান্দায় দাঁড়ালো। আহনাফ ওর দিকে কর্ক ছুঁড়ে বলে,
“আসো, দেখি তুমি কেমন খেলতে পারো।”

সারাহ্ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। আহনাফ সবাইকে বলে,
“ম্যাডামকে একটু জায়গা দাও, দেখি শুধু বিক্রিয়াই লিখতে জানে নাকি খেলতেও পারে।”

পাশ থেকে এক ছেলে বলে,
“স্যার, আপনার সাথে পারবে না।”

আহনাফ কলার টে°নেটু°নে বলল,
“সেটা আমি জানি।”
“ভাব কম নেন ফয়েজ স্যার।”
সারাহ্ একটু জোরে কথাটা বলে গিয়ে ব্যাট হাতে নেয়।

দুজনে খেলা শুরু করে। আহনাফ সারাহ্-র থেকে বেশ লম্বা হওয়ায় ওর একেকটা শট ছোটখাটো সারাহ্-র মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।

সারাহ্ রাগ করে তাকায় ওর দিকে। আহনাফ বাম চোখ টিপে বলে,
“ম্যাডাম, বেশি উঁচু হচ্ছে।”
“এসব ঠিক না, ফয়েজ স্যার।”

আহনাফ হাঁটু গেড়ে দুহাত মেলে বসে বলল,
“এবারে চলবে।”

সারাহ্ লজ্জা পেয়ে যায়। এতোগুলো স্টুডেন্টের সামনে এমন এক ব্যবহার আহনাফ করছে যে কোনো স্ত্রীই লজ্জায় পড়বে। ছেলে মেয়েগুলো বেশ হাসাহাসি করছে। সারাহ্ ব্যাট রেখে চলে গেল। এই লোকই তো বোর্ডের সামান্য কথা লেখায় ওকে বকেছিল।

আহনাফ সবাইকে বলে,
“ম্যাডামের সমস্যা আছে নাকি মাথায়?”

ছাত্রছাত্রীরা আবারো হাসছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আহনাফেরও আর খেলা হলো না। সারাহ্-র পর সেও চলে যায়।
______________________________________

দুইদিন পেরিয়ে যায়৷ মৃত্তিকার জ্ঞান ফিরেছে গতরাতে। মমতাজ বেগম কথা বলতে চাইলেও মৃত্তিকা কথা বলেনি, বরং চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল।

দুপুরের পর ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে দেখতে এসেছে। তার ডানহাত এখনো গলায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। চেয়ার টে°নে পাশে বসে সে। মমতাজ বেগম বাইরে গেছেন অনেকক্ষণ হলো।

মৃত্তিকা চোখ খুলে ইমতিয়াজকে দেখে, সে আপন মনে ফোন দেখছে। মৃত্তিকা নিচুস্বরে বলল,
“কেমন আছেন?”

ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকায়।
“ভালো।”

হাঁটুতে বামহাতের কনুই দিয়ে ভর রেখে সামনে ঝুঁ°কে ইমতিয়াজ বলে,
“আপনার এই অবস্থা কে করেছে জানেন কিছু?”

মৃত্তিকা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলে,
“শ°ত্রুদের যদি চিনতে পারতাম, তবে আজকে ভালোই থাকতাম।”

ইমতিয়াজ সোজা হয়ে বসে। মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“মৃ°ত্যু সহজ নয়, এরচেয়েও বেশি কষ্ট আমার মাম পেয়েছে।”

ইমতিয়াজের হৃদপিণ্ডের কাঁ°পুনি বাড়ে। মৃত্তিকার মাম তো একা ছিল না সেদিন। তাহমিনা যে সাথে ছিল।

মৃত্তিকা ক্যা°নো°লা লাগানো হাতটা ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ওটা দু°র্ঘ°টনা ছিল না, মামকে ইচ্ছা করে মে°রেছে ওরা। ভালো মানুষ থাকায় তাহসিনা আর তাহমিনাকে একই পথের যাত্রী হতে হয়েছে।”

ইমতিয়াজ উঠে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওর হাতের উপর হাত রাখে। ইমতিয়াজ থেমে যায়। মৃত্তিকার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।

“আমি এতোটা ভালো মানুষ নই, (একটু থামে) আর ভালো হতেও পারবো না।”

ইমতিয়াজ ওর হাতের দিকে চেয়ে থেকে বলল,
“হয়তো আপনিও ভালো মানুষ, নাহলে এভাবে কেউ মা°রতে চাইতো না।”

মৃত্তিকা হাতটা সরিয়ে নেয়। ঘাড় না°ড়াতে এখনো কষ্ট হয় তার। তবে নিজের ব্য°থাগুলো থেকে বেশি ব্য°থা মামের জন্য পাচ্ছে সে।

ইমতিয়াজ একটু বসে থেকে উঠে যায়। মৃত্তিকা আবারো চোখ বন্ধ করে। দরজার বাইরে এসে কান্না করে দেয় ইমতিয়াজ। জীবন ওর সাথে এই খেলাটা কেন খেললো?
______________________________________

সাড়ে তিনটায় ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়েছে তানজিম ও সামিহা। শেষ কয়েকদিন তানজিম খুবই চুপচাপ আছে, জরুরি কথা ছাড়া বাড়তি কোনো কথা নেই। ইমতিয়াজ-মৃত্তিকার হারিয়ে যাওয়ার গল্প সামিহাকে শুনিয়েছে, অসুস্থতার কথাও বলেছে। কিন্তু তার এমন নিরবতায় সামিহা কষ্ট পাচ্ছে।

তানজিম বাসায় যাওয়ার পথ ধরলে সামিহা এসে ওর একহাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“তানজিম, চল আজকে মিউকোপুকে দেখতে যাই।”
“আজ না অন্য দিন।”
নির্বিকার হয়ে জবাব দেয় তানজিম।

তানজিমের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“রেগে আছিস?”
“না।”
“তবে চুপ কেন?”

তানজিম থেমে গিয়ে বলল,
“নিজের পরিবারের মানুষগুলোকে বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। দুজন মানুষ হুট করে নিখোঁজ আর আমার ফ্যামিলি হাত পা গু°টিয়ে ছিল। (একটু থেমে) বাবা একটু খুঁজেছে তবে মামা তো চেষ্টাও করেনি।”

সামিহা কপাল কুঁচকায়। পারিবারিক অশান্তিতে আছে বেচারা। তানজিম হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“মিউকোপু মামার বাসা থেকে গা°য়েব হয়েছিল, কিন্তু মামা বিষয়টা গায়ে মাখেনি।”
“তানজিম, এতো চিন্তা করিস না প্লিজ।”
“চিন্তাই করতে পারছি না আমি।”

উঁচু ফুটপাতের ধারে বসে পড়ে তানজিম। হাত দিয়ে মুখে ঢেকে বসে থাকে। সামিহা পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“তানজিম, বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করিস না। মানুষ দেখছে।”

তানজিম কিছুক্ষণ এভাবে বসে থেকেই বলে,
“তুই চলে যা সামি। আমার সাথে আর মিশবি না।”
“কেন?”

তানজিম ধ°ম°কে উঠে বলে,
“চলে যা বলছি।”

তানজিমের এলোমেলো কথা গুছাতে পারলো না সামিহা। বরং ওর কথার ঢংয়ে কষ্ট পেল। নিরবে চলে গেল সে। তানজিমকে শান্ত করার পরিবর্তে আরো অশান্ত করে দেয় ছোট মেয়েটা।
______________________________________

“ঐশী, আজকে একটু পাস্তা করো তো।”
“যাচ্ছি যাচ্ছি।”

মাগরিবের নামাজ পড়ে বাসায় এসেই কথাটা বলে আহনাফ। সারাহ্ সবে নামাজ সেরেছে। জায়নামাজ রেখে চুল আঁচড়াতে নিলে আহনাফ বলল,
“অনেক সুন্দর লাগছে, এখন তাড়াতাড়ি যাও। আমার ক্ষুধা লাগছে।”
“আহা, ফয়েজ।”

সারাহ্ কোনোমতে চুলগুলো খোঁপা করে রান্নাঘরে এলো। পাস্তা সিদ্ধ বসিয়ে অন্য চুলায় হোয়াইট সস বানাতে শুরু করলো।

আব্বাস সাহেব এসে রান্নাঘরের দরজা দাঁড়ায়। সারাহ্-র কাজের ক্ষি°প্র°তা কিছুটা আহনাফের মায়ের মতো। রান্নাঘর নিজের মতো করে গুছিয়েছে।

সারাহ্ দরজার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“ফয়েজ, রান্না চলছে। তুমি একটু ওয়েট কর। সবকিছুতে অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো।”

আহনাফ মাত্র ডাইনিং এ এসেছে। আব্বাস সাহেব হেসে বলেন,
“আমি ফয়েজ, তবে আব্বাস ফয়েজ।”

সারাহ্ জিভ কা°ম°ড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। আহনাফ শব্দ করে হেসে দেয়। আব্বাস সাহেব ড্রইংরুমে গিয়ে টিভি ছেড়ে বসেন।

সারাহ্ কপাল চা°প°ড়ে বলে,
“দেখা তো লাগে।”

আহনাফ এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আহারে, বাসার নিরীহ বউটার শশুড়ের সামনে উলটা কথা বেরিয়েছে।”
“সরুন।”

আহনাফ সরে না। সারাহ্-র ঘাড়ের চুলগুলো সরিয়ে চুমো দিয়ে বলে,
“জলদি খাবার দাও।”

সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,
“আমাকে খেয়ে ফেলেন, রান্না করতে দিচ্ছে না আবার বলে জলদি খাবার দেও।”

আহনাফ হো হো করে হেসে বলল,
“তোমাকে খেলে আমি সারাদিন কাকে বি°র°ক্ত করবো।”

আহনাফ ড্রইংরুমে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর নাস্তা সাজিয়ে নিয়ে সারাহ্ও এখানে আসে। আব্বাস সাহেবের হাতে বাটি দিয়ে বলল,
“বাবা, নিন।”

তিনজনে একসাথে খেতে বসে। আব্বাস সাহেব একচামচ খাবার মুখে নিয়ে বলল,
“রোজার রান্নার হাত অনেক ভালো ছিল।”

সারাহ্ উনার দিকে তাকিয়ে বলে,
“রোজা কে?”

আব্বাস সাহেব আলতো হেসে বলেন,
“তোমার শাশুড়ী আম্মা, রোজার নামের সাথে মিলিয়ে আফরোজার নাম রাখা হয়েছে। মেয়েটা পুরো মায়ের মতো। আর তুমিও রোজার মতোই সংসার গুছাতে পেরেছো।”

সারাহ্ মুচকি হাসে। আহনাফ বলে,
“গুছাতে গিয়ে তোমার ছেলেকে পাজেল করে নাজেল বানিয়ে ছেড়েছে।”

সারাহ্ চোখ পাকিয়ে তাকায় ওর দিকে। আহনাফ মনের সুখে খাচ্ছে। আব্বাস সাহেব ওদের অবস্থা দেখে হাসেন।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তবিংশ পর্ব (২৭ পর্ব)

আজ বেশ কয়েকদিন পর গো°র°স্থানে এসেছে ইমতিয়াজ। ফজরের পর মসজিদ থেকে বেরিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছে। রিপা বেগমের কবরের পাশের দুটো কবরের দিকে তাকায় সে।

“এগুলোই কি ওইদিন খু°ন হওয়া দুজনের কবর?”
কথাটা ভেবে এগিয়ে যায় তাহমিনার কবরের কাছে।

আজ সে নিরব, অনুভূতিহীন। কোনো কথা সে বলছে না, বলে চাচ্ছেও না। মেয়েটার কি এমন দোষ ছিলো আর ওই বেবিটার কি দোষ ছিল, যে পৃথিবীর আলোই দেখেনি। কি দোষ থাকতে পারে ওদের? শত্রুতা যদি রিপা বেগম আর তার মেয়ের সাথে থাকে, তবে তাহমিনা আর তাহসিনার এ অবস্থা কেন?

লোহার দরজায় গড়গড় শব্দ করে ভিতরে আসে শরীফ। ইমতিয়াজ একবার তার দিকে তাকায়।

রিপা বেগমের কবরের সামনে এসে দুহাত মেলে দোয়া করে। তারপর ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অবাক হচ্ছো কেন? তুমি যেমন তোমার স্ত্রীর কবরে এসেছো, তেমন আমিও এসেছি।”

ইমতিয়াজ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
“যখন বেঁচে ছিল, তখন স্ত্রীর দাম দেননি। এখন এসব করে কি লাভ?”

শরীফ এসে ওর পাশে বসে বলল,
“মানুষ একটা সময় নিজের ভুল বুঝতে পারে। (একটু থেমে) মিউকো আর তোমাকে কিন্তু আমি সেদিন উ°দ্ধা°র করেছি।”

ইমতিয়াজ বুঝতে পারে লোকটা কথা ঘুরাতে চাচ্ছে। মুখ বাঁ°কিয়ে হেসে বলল,
“আমার সন্দেহ হয়েছিল। (একটু থেমে) পল্লবী কে?”
“আমার বোন, মিউকোর ফুফু।”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে। শরীফ বলে,
“তোমার হাত ঠিক হতে সময় লাগবে। এই কয়েকদিন অফিসে যাবে?”

ইমতিয়াজ কিছুই বলে না। মুখ ঘুরিয়ে তাহমিনার কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। শরীফের সব কথার উত্তর দেয়ার ইচ্ছা তার নেই।

শরীফ বলে,
“তুমি মিউকোকে বিয়ে করবে? বিষয়টা কি সত্য?”

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি একবারও বলেছি আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করবো?”

ইমতিয়াজ চলে যেতে নিলে শরীফ পেছন থেকে বলল,
“আমার মেয়ে বলো না, ও রিপার মেয়ে।”

থমকে দাঁড়িয়ে ইমতিয়াজ বলল,
“তবে তার পিছনে স্পা°ই লাগিয়েছেন কেন?”
“না হলে আর এসব খবর আসতো না। আর না তোমাকে চিঠি দিতে পারতাম।”

ইমতিয়াজ আর ফিরে তাকায় না। হনহনিয়ে হেঁটে চলে যায়। শরীফ কিছুক্ষণ একই জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু শুধুই রাগ হচ্ছে তার। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে তার, আবার নিজের রাগের প্রতিও রাগ হচ্ছে। বাইরে এসে সি°গা°রেট জ্বা°লায় সে। নাকমুখ দিয়ে অনবরত ধোঁ°য়া নির্গত করতে থাকে।
______________________________________

দুইমাস পর,
ক্লাসে এসে সামিহা পুরো রুমে চোখ বুলায়। তানজিম কোথাও নেই, তার অর্থ সে এখনো আসেনি বা আসবে না। আজকাল ক্লাসে খুব একটা তাকে দেখা যায় না, আসলেও পিছনের সারির কোনো একটা বেঞ্চে বসে থাকে।

সামিহা বেঞ্চে বসে এখনো চেয়ে আছে দরজার দিকে। কিন্তু তানজিম আসেনা।

ক্লাস শুরুর দশমিনিট পর তানজিম দৌড়ে এসে ক্লাসে ঢুকে।
“মে আই কাম ইন স্যার?”
“কাম ফাস্ট।”
স্যার ধ°ম°ক দিয়ে কথাটা বলে।

তানজিম এসে সামিহার পাশেই বসে পড়ে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে আর মুখ দিয়ে “হু, হু” বলে অদ্ভুত একটা শব্দ করছে। সামিহা ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

তানজিম ফিসফিস করে বলল,
“ক্লাস শেষে বাইরে আসিস, কথা আছে।”

হুট করে যেন তার কথায় বিশাল পরিবর্তন এসেছে। সামিহা খুশি হয়ে যায়। তার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। তানজিম ওর হাতটা ধরে, সামিহা বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলেও পড়া আর তার মাথায় ঢুকছে না।

সামিহার আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে ওর হাত ধরেছে তানজিম। শতশত পারিবারিক অশান্তি আসবে, সহস্র সমস্যা থাকবে, জীবনে হাজারো ঝ°ড় আসবে যাবে, তাই বলে কি প্রিয় মানুষের হাতটা এতো সহজে ছাড়া যাবে।

সামিহাকে নিজের মনের কথা জানিয়ে সারাজীবন সাথে থাকার প্রস্তাব দিবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তানজিম। বহুবার যা বলতে গিয়েও আটকে গেছে তা আজ বলেই দিবে সে।
______________________________________

শারিরীকভাবে বেশ সুস্থ হয়েছে মৃত্তিকা, তবে মানসিক অবস্থা এখনো ভালো নয়। কলরবের বাবার হঠাৎ ব্যবসা ম°ন্দা ও নানান কারণে কোম্পানির তিনটা শেয়ার বিক্রি করতেই হয়েছে। মৃত্তিকা একটা শেয়ার কিনেছে, বাকি দুটো কে কিনেছে তা ওর জানা নেই। আপাতত তা জানান দরকারও তার নেই।

হঠাৎ করে এমন ব্যবসা ম°ন্দা হওয়া ও মৃত্তিকার শেয়ার কেনা কলরবের কাছে একটা ষ°ড়°যন্ত্র মনে হলেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে সে কিছুই করতে পারেনি।

ইসরাতের বাবার কোম্পানি আছে, বাবার সাথে সে নিজেও প্রায় আড়াই বছর কোম্পানির অনেক কাজ শিখছে। এসব কু°ট কা°চা°লি সম্পর্কে ইসরাতের জ্ঞান ভালো। সেই ব্যবসা ম°ন্দা করার মূল নেতা ছিল। না না, নেতা নয় নেত্রী।

সারাদিন মিরপুরের অফিসে কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় আসে সে। এখনো সে উত্তরা মামার বাসায় থাকে। এতো বড় ঘটনার পরও সে মামার বাসায়ই থাকার সিদ্ধান্তে অটল।

বাসায় আসতেই দেলোয়ারাকে ব্যস্ত দেখে মৃত্তিকা বলল,
“মামানী, কোনো সমস্যা?”

সুরভি নিজের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চকলেট খেতে খেতে বলল,
“ভাবখানা দেখো যেন আমার ডেলিভারি পে°ই°ন উঠেছে।”

মৃত্তিকা জোরে হেসে দেয়। দেলোয়ারা রাগ করে বলল,
“ইমতিয়াজ আসবে, শুনোনি?”

মৃত্তিকা সুরভির দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে,
“উনি আবার কেন আসবে?”
“তোমাকে দেখতে।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকায়।
“দেখতে? আগে দেখে নাই নাকি?”

মৃত্তিকা রুমে চলে যায়। স্কার্ফ খুলে বাচ্চা ছেলেদের মতো সদ্য গজানো চুল আঁচড়াতে শুরু করে। সুরভি বিছানায় বসে বলে,
“সত্যি, বাবার সাথে বিয়ের কথা বলেছে। আজকে তোমার মত নিতে আসবে।”

মৃত্তিকা ঠোঁট উলটে বলল,
“মত নিতে আসবে, ওকে ফাইন। তো মামানী এমন করছে কেন?”
“জামাই আসবে এজন্য।”

মৃত্তিকা চিরুনি রেখে ওয়াশরুমে চলে যায়। এতো ধরনের সমস্যার মাঝে এরকম ঘটনা অ°প্রত্যাশিত।

সন্ধ্যার পর সময়মতো ইমতিয়াজ আসে। শাফিন সাহেব আর দেলোয়ারার সাথে কথা হয়, তাদের অনুমতি নিয়ে মৃত্তিকার সাথে আলাদা কথা বলার সুযোগ পায় ইমতিয়াজ।

ড্রইংরুমেই কথা বলছে ওরা, বাকিরা নিজেদের রুমে চলে গেছে।

সবাই চলে যেতেই মৃত্তিকা সরাসরি প্রশ্ন করলো,
“হঠাৎ বিয়ের পি°নি°ক উঠছে কেন আপনার?”

ইমতিয়াজ চোখ কুঁচকে বলল,
“ভদ্রভাবে কথা বলুন। এটা কোনো পি°নি°ক না, জাস্ট কাউকে বাঁচাতে চাচ্ছি।”
“আহা, উ°দ্ধা°র করছেন।”
ব্য°ঙ্গ করে কথাটা বলে মৃত্তিকা।

ওইযে বলেছিল মৃত্তিকা, সে চাইলে আবেগ অনুভূতি কবেই মে°রে ফেলতে পারতো। সেটাই করেছে সে। মে°রে ফেলেছে, ইমতিয়াজকে ভুলে যাওয়ার জন্য যা যা করার সব করেছে। ভুলতে না পারলেও অন্তত ওর অবস্থা কেউ বুঝতে পারে না।

“বিয়ে করবো মানে বিয়ে হচ্ছে। আপনি রাজি নন কেন?”

মৃত্তিকা আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
“কারণ আমার কারণে একবার জীবিত কবরে গিয়েছেন, নেক্সট হয়তো ম°রে কবরে যাবেন।”

ইমতিয়াজ হেসে বলল,
“আপনি আমাকে মৃ°ত্যুর ভয় দেখাচ্ছেন?”
“ধরে নিতে পারেন।”

দরজার ওপাশে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইমতিয়াজ। সে সোফা থেকে উঠে এসে মৃত্তিকার পাশে বসলো। মৃত্তিকার হাত ধরতেই চমকে উঠে সে। ইমতিয়াজ শুধু হাত ধরেনি, মৃত্তিকার হাতের মুষ্টিতে কোনো একটা কাগজ দিয়েছে।

“মৃ°ত্যু যেখানে চরম সত্য, সেখানে তা স্মরণে রাখাই ভালো আর আপনি তা স্মরণ করাতে পারলে আপনাকে সাথে রাখাও ভালো।”
ইমতিয়াজ হাত ছাড়লে মৃত্তিকা কাগজটা ওড়নার নিচে লুকিয়ে ফেলে।

রাতে খাবার একসাথে করে সবাই, এখানেই বিয়ের জন্য বৃহস্পতিবার রাতের সময়টা নির্ধারিত হয়ে যায়। ইমতিয়াজের বাসায় যেহেতু কেউই নেই তাই মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমানই আসবেন অভিভাবক হয়ে। যদিও এসব শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।

রাত সাড়ে নয়টায় ইমতিয়াজ বিদায় নেয়। যাওয়ার আগে মৃত্তিকার কানের কাছে বলে যায়,
“কাগজটা দেখার পর এনিহাউ নষ্ট করে দিয়েন। আর কারো হাতে যেন না পড়ে।”

ড্রেস পালটানোর নাম করে ঘরের দরজা লাগিয়ে কাগজ খুলে মৃত্তিকা। দুইটা কাগজ, একটা বড় আর একটা ছোট। ছোট কাগজে লেখা,
“মৃত্তিকাকে বিয়ে করো বা না করো, ওই বাসা থেকে বের করে আনো। হয়তো আজ রাতটাই হয়তো ওর জীবনের শেষ রাত।”

মৃত্তিকা চমকে উঠে। বড় কাগজের হাতের লেখাগুলো ইমতিয়াজের।

“আমি জানি না বিষয়টা আপনি কিভাবে নিবেন। তবে ছোট কাগজটা আপনাকে যেদিন খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল সে রাতে অচেনা কেউ পাঠিয়েছিল। পরে বুঝতে পারি চিঠির মালিক আপনার বাবা, আপনার বাবা আমাকেও বাঁচিয়েছে। বিয়ের বিষয়ে আপনি চিন্তিত আছেন জানি। তবে অমত করবেন না। আপনার বাবা আমাকে জানিয়েছে শুক্রবারে হয়তো আপনাকে গুম করা হবে, তবে তার আগে কোম্পানির শেয়ার নিবে আপনার কাছ থেকে। তো আমার কথাটা মেনে নিন আর কিছু অন্যরকম হোক।”

কাগজটা দু°মড়ে মু°চড়ে ফেলে মৃত্তিকা। বাবা নামক ওই লোকটা আবারো ওর জীবনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আর ইমতিয়াজ তাকে বিশ্বাস করছে। একটা ভ°য় জেগে উঠে মৃত্তিকার মনে, ইমতিয়াজ আবার শরীফের মতো হবে না তো?
______________________________________

পরদিন সকালে,
প্রথম পিরিয়ডে কোনো ক্লাস না থাকায় কলেজের সামনের রাস্তায় হাঁটছে আহনাফ। বেশ আরামে সকালের রোদে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।

আহনাফের ফোন বেজে উঠে। পকেট থেকে ফোন বের করে আননোন নাম্বার দেখেও রিসিভ করে।

“আসসালামু আলাইকুম।”

অপরপাশ থেকে তানজিম বলল,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ভাইয়া। আমি তানজিম।”

আহনাফ রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটু ইতস্তত করে বলল,
“আরে তানজিম, কেমন আছো?”
“ভালো আছি ভাইয়া। তুমি ঢাকায় আসো না?”
“মাস দুয়েক হয়েছে গিয়েছিলাম।”
“ওহ, (একটু থেমে) আসলে ইমতিয়াজ ভাইয়ার বিয়ে, তুমি আসলে ভালো লাগতো।”

আহনাফ কলেজের দিকে যেতে যেতে বলল,
“ইমতিয়াজ ভাইয়া বিয়ে করছে?”
“হুম, মিউকো আপুকে।”

মিউকো নামটার সাথে আহনাফের পরিচিতি নেই। তবুও এ ব্যাপারে প্রশ্ন না করে বলল,
“ভালো সিদ্ধান্ত। বিয়ের তারিখ কবে?”
“এইতো বৃহস্পতিবার। তুমি আসতে পারবে?”
“ওহ, তবে তো পরশুদিন। আমি চেষ্টা করবো, কিন্তু কথা দিতে পারলাম না।”

তানজিমের ক্লাসের সময় হয়ে যাওয়ায় তাড়াহুড়ো করে বলল,
“আচ্ছা ভাইয়া, আমার ক্লাস আছে। পড়ে কথা হবে।”
“ওকে, ভালো থেকো।”

তানজিম ফোন রেখে দৌড়ে ডিপার্টমেন্টে যায়। কাল বলবো বলবো করেও সামিহাকে কিছুই বলা হয়নি, আর এই মেয়েটাও হয়েছে একটা বোকা। কিছুই যেন বুঝে না। তানজিম তো আর জানে না সামিহা সব বুঝেও শুনতে চাচ্ছে।

দিনটুকু পেরিয়ে এখন শেষ দুপুর, কলেজের ক্লাস শেষে আহনাফ বের হয়৷ সারাহ্ এখনো টিচার্স রুমে আছে। হয়তো কোনো ম্যাডামের সাথে গল্পে মজেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দৌড়ে দৌড়ে এসে আহনাফকে বলে,
“তাড়াতাড়ি চলেন।”
“এতো তাড়া এখন। এতোক্ষণ তো নিজেই ঘুমাচ্ছিলে।”

দুজনে হাঁটতে শুরু করে। সারাহ্ বলল,
“ঘুমাইনি তো, একটা গল্প শুনছিলাম। অনেক রোমাঞ্চকর।”

আহনাফ একটা হাই তুলে বলে,
“মেয়েদের গল্প স্বামী, সন্তান ছাড়া আর কি?
“আরে না, ওসব কিছু না। (একটু থেমে) আমাকে শুক্রবারে গোমতী পাড়ে নিয়ে যাবেন?”
“আমি ঢাকায় যাবো।”

সারাহ্ অবাক হয়ে আহনাফের দিকে তাকায়। অনেকদিন হয়েছে ওই কথোপকথন ছাড়া আর কোনো সমস্যা হয়নি, সিআইডি থেকেও কিছুই জানায়নি। বুকের ভেতর অজানা ভ°য় জেগে উঠে সারাহ্।

“ঢাকায় কেন যাবেন?”
“চিন্তা করো না, তেমন কিছু না।”

সারাহ্-র সামনে তাহসিনা বা তার পরিবারের কথা বলা যে অনুচিত তা আহনাফ বুঝে। তানজিমকে না করলে বিষয়টা যেমন খারাপ দেখাবে, তেমনি সারাহ্-কে বলাও হয়তো ঠিক হবে না। অদৃশ্য টা°না°পো°ড়েনের মাঝে পড়ে থাকে আহনাফ।
______________________________________

মৃত্তিকা অফিসে আছে। নিজের কেবিনে পায়চারি করছিল এতোক্ষণ। এখন সে চেয়ার টেনে বসে। ইমতিয়াজকে বিয়ে করা না করা নিয়ে বেশ সুন্দর একটা সংশয় তার।

চোখ বুঝলে একদিকে যেমন একটা গোছানো সুন্দর সংসার দেখে, তেমনি অন্যদিকে নিজের মায়ের সংসারের কথা মনে পড়ে। সেখানে তো শুধু অ°শান্তিই ছিল।

চেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ইমতিয়াজকে কল দেয়।

“আপনি কাল ওসব কি লি…”

মৃত্তিকার কথার মাঝেই ইমতিয়াজ বলে,
“কিছুই বলিনি আপনাকে, শুধু বিয়ে করতে বলেছি। আর কিছু না।”

মৃত্তিকা আশেপাশে তাকায়। ইমতিয়াজ কাগজে সব লিখে দিয়েছে, আবার এখন ওকে বলতে দিচ্ছে না। এর অর্থ একটাই এমন কেউ আছে যে ওদের কথা শুনছে।

মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার মত ছাড়াই তো বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেল।”

ইমতিয়াজ একটু চুপ করে থেকে বলে,
“লাল শাড়ি পড়বেন না, এই অনুরোধ রইলো।”

মৃত্তিকা সোজা হয়ে বসে। ইমতিয়াজ কল কেটে দিলো। মৃত্তিকার ঠোঁট কাঁ°পছে, চেহারা একটা লাবন্যতা এসেছে, একটু লাজুকতা ভর করেছে। সামনের গ্লাস থেকে ঢ°কঢ°ক করে পানি পান করে নেয় সে, তারপর নিরবে চোখ বুজে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে