অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৬৩+৬৪

0
305

(সতর্কতা- নৃ°শং°স খু°নের বর্ণনা আছে, নিজ দায়িত্বে পড়বেন।)

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পর্ব ৬৩

নিয়াজী এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে৷ শরীফের চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়েছে। এখন সে বাসায় যাওয়ার জন্য একদম ঠিকঠাক আছে। আর কোনোভাবে সে আহনাফ কিংবা ইমতিয়াজের হাতে পড়তে চায় না।

ঘড়ি দেখাচ্ছে সকাল সাতটা বেজেছে, নিয়াজী হাসপাতালের ছোট বিছানা থেকে উঠে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু একটা খুঁজতে, খুব স্বভাবতই তা ফোন। তবে পায় না।

“কিছু খুঁজছো নাকি?”

শরীফ এসে রুমে প্রবেশ করে। নিয়াজী ওকে দেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, আমি আসলে বাসায় যেতে চাই।”

“আসল ঠিকানায় যাবে? চলো, পৌঁছে দেই।”

নিয়াজী সরতে পারে না, শরীফ ওকে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলে,
“রিপাকে মা°রধর করেছি এটাই পৃথিবী দেখেছে, কিন্তু ওকে যে আমি ভালোবেসেছি সেটা কেউ দেখেনি। ওকে মা°রা তোমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।”

নিয়াজী শরীফকে ধা°ক্কা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়, কিন্তু এবারে সে চির ব্যর্থ হলো। ব্যর্থতাকে আর টপকাতে পারে না।

পি°স্তলে সাইল্যান্সার লাগানো থাকায় শব্দ হয় না, তবে গু°লি চলে। কপাল ভেদ করে চলে যায় গু°লিটি। সাদা বিছানা, সাদা টাইলসের মেঝেতে যেন কেউ আলপনা এঁকেছে। র°ক্তের আলপনা। শেষ নিশ্বাস বের হয়েছে নিয়াজীর।

নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা সেও করেছে। তাহসিনা, তাহমিনা বা রিপা বেগমের মতো সেও বেঁচে থাকার আকুতি ছিল তার চোখেমুখে, কিন্তু বাঁচতে পারেনা।

কপালে একটা গোলাকার গু°লির চিহ্ন, র°ক্তে মাখোমাখো হয়ে আছে। সেই ছিদ্র দিয়ে এখনো বের হচ্ছে টাটকা র°ক্ত।

শরীফ বাইরে এসে ইশারা করলে চারজন লোক নিয়াজীর দেহ নিয়ে ম°র্গে চলে যায়। শরীফ শান্তভাবে হেঁটে নিজের চেম্বারে চলে আসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে পুরোনো কথা।

“আমাদের মেয়ের নাম হবে মৃত্তিকা। সুন্দর না নামটা? আমি আগে থেকেই এটা ভেবে রেখেছিলাম।”
মেয়েকে কোলে নিয়ে কথাটা বলে রিপা।

“কি করে বুঝেছিলে মেয়ে হবে?”

“মায়েরা বুঝতে পারে।”

রিপার কথা মনে করে কান্না পায় শরীফের। চোখের পানি বাঁধনহারা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে৷ বয়সের এই প্রান্তে এসে ডি°ভোর্স হয়ে যাওয়া স্ত্রীর জন্য কান্না করাটা বেমানান। কিন্তু ভালোবাসা যে বাধা মানে না।
______________________________________

এলার্জি হয়ে মৃত্তিকার হাত-মুখ-গলা লাল হয়ে আছে। আয়নার সামনে নিজের এ অবস্থা দেখে বলে,
“কি হয়েছে দেখেছেন?”

ইমতিয়াজ অফিসে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর কথায় ভালো করে দেখে বলল,
“আজকে বিকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। হঠাৎ এমন হলো কেন?”

“জানি না।”

মৃত্তিকা ছোট করে জবাব দিয়ে নাস্তা তৈরি করতে চলে যায়। টেবিলে নাস্তা রেখে অপরূপার দিকে আড়চোখে কয়েকবার তাকালো।

অপরূপা মৃদু হেসে বলল,
“সকালে অন্য মেয়েদের গায়ে লাভ বাইট থাকে আর তোমার এলার্জি? বাহ, বাহ।”

ঘর থেকে ইমতিয়াজ কথাটা শুনে। সে বেরিয়ে এসে বলল,
“আমার স্ত্রীর লাভ বাইট দেখার শখ তোমার জাগে কেন? এধরনের ফালতু কথা আরেকবার শুনলে খুব খারাপ হবে।”

মৃত্তিকা নাস্তা নিয়ে রুমে চলে যায়। বিছানায় খাবার রেখে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। ইমতিয়াজ ওর মুখোমুখি বসে ওর মুখের সামনে খাবার তুলে বলল,
“খাবে না?”

মৃত্তিকা খাবার মুখে নিয়ে বলে,
“কি করবেন ওকে দিয়ে?”

“অফিসারদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করবো।”

“যদি শাফিনের আরো লোক থাকে? আর ওকে আর শাফিনকে বাঁচিয়ে নেয়।”

“সম্ভাবনা কম, শাফিনের অবস্থা এমনিতেই খুব খারাপ। ওর লোকেরা ওর সাহায্য আর করবে বলে মনে হয় না।”

“আপনি যে বলেছিলেন এবারে শাফিনকে অন্য ফাঁ°দে ফেলবেন। ওর এ অবস্থায় কিভাবে সম্ভব?”

ইমতিয়াজ মাথানেড়ে খেতে থাকে। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে বলল,
“চাইলে এ অবস্থায়ও সম্ভব। অফিসার গালিব চেষ্টা করছে, অফিসার রিজভি চেষ্টা চালাচ্ছে। সবাই তো আর শাফিনের পক্ষে না। তবে ফাঁ°দে তাকে পড়তেই হবে।”

“ফাঁ°দটা কি?”

ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“যদি শাফিন এবারেও বেঁচে ফিরে, তবে বুঝতে পারবে।”

মৃত্তিকা উঠে এসে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সব ভালো থাকুক। ফে°তনা দূর হোক।”

ইমতিয়াজ ওর গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,
“অফিস যেতে হবে তো।”

মৃত্তিকা সরে যায়। গত পরশুদিন তানজিম আর সুরভি বাসায় এসে ইমতিয়াজকে দেখে যে ভয়টা পেয়েছে, সেটা ভেবে এখন আবারো মৃত্তিকার হাসি পায়।

“নিজে নিজে হাসছো কেন?”

“এমনিতেই, রেডি হয়ে নিন।”
______________________________________

সুরভি শাফিনের কাছেই আছে। মমতাজের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। মমতাজ বেগম উঠতে পারে না, নিজে নিজে খেতে পারে না। সামান্য পানিটুকু চাইলেও সুরভি তা দেয় না। ঘৃ°ণার পরিমান এতো বেশি হয়েছে যে সে ওদেরকে মে°রে ফেলতে পারলে বাঁচে।

অপরূপার উপরেও তার রাগ আছে। অপরূপার সত্যটা জানতে পেরে সুরভি বাবাকে আরো বেশি ঘৃ°ণা করছে। পরশু যখন অপরূপাকে মৃত্তিকার বাসায় দেখেছে, তখন থেকে সে আরো চুপ আছে।

ঝড় আসার আগে প্রকৃতি যেমন শান্তরূপে নিজেকে পরিবেশন করে, সুরভিও তেমনি আছে।

“সুরভি, মা আমার, একটু পানি দাও।”

মমতাজ বেগমের কথা উপেক্ষা করে নিজেকে শান্ত রেখে সে বেরিয়ে আসে। মৃত্তিকার বাসায় চলে এসেছে সে।

সকাল সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। মৃত্তিকা মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে আর মিউকোর গায়ে হাত বুলাচ্ছে। বেল বাজায় চমকে উঠে।

মৃত্তিকা ধীরপায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সুরভি ভিতরে এসে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইমতিয়াজ বাসায়?”
“না, অফিসে গেছে।”

সুরভি মাথানেড়ে অপরূপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃত্তিকাকে বলে,
“বাবা তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে, মিউকো। দেখা করবে?”

নিজের থেকে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে দেয় সুরভি। মৃত্তিকা একটু চমকে উঠে। আবার শাফিনের কুৎসিত অবস্থা নিজের চোখে দেখার ইচ্ছাও জাগে। ইমতিয়াজ জানলে ওকে যেতে দিবে না, তাই না জানিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।

“আমি যাবো, আপু।”

“ঠিক আছে, তুমি তৈরি হয়ে বের হও। আমি ওকে পাহারা দিচ্ছি।”

মৃত্তিকা অপরূপার দিকে ইশারা করে বলল,
“ও কিন্তু অনেক বিপজ্জনক।”

“ও কতটা খাতারনাক, আমি তার চেয়ে বেশি খাতারনাক।”

মৃত্তিকা মৃদু হাসে। দ্রুত তৈরি হয়ে সে বেরিয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। ও চলে গেছে সুরভি অপরূপার কাছে এসে বলে,
“এখন যদি তোমাকে ছেড়ে দিই, কোথায় যাবে?”

অপরূপা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“আগে তোমাকে মা°রবো আর তারপর মৃত্তিকাকে। ইমতিয়াজকে একা করবো আমি।”

“তোমার কি সমস্যা ইমতিয়াজের সাথে?”

“মৃত্তিকাকে এতো ভালোবাসে কেন? এতো আদর কিসের জন্য?”

হিং°সার অনলে জ্ব°লছে অপরূপা। সুরভি সোজা হয়ে বসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“চলো তবে, মা°রবে মৃত্তিকাকে।”

প্রায় আধঘন্টা পর সুরভি অপরূপাকে নিয়ে বের হয়। কোনো জোরাজুরি না করেই অপরূপা ওর সাথে আসছে। সিএনজি করে হাসপাতালে পৌঁছায় ওরা।

এদিকে মৃত্তিকা শাফিনের সাথে দেখার করার অনুমতি পেয়ে ভিতরে এসে শাফিনের অবস্থা দেখে।

পঁ°চা অংশ থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে। সময়মতো পরিষ্কার করা হয়নি বলে এ অবস্থা হয়েছে। মৃত্তিকার গা গু°লিয়ে আসে।

মমতাজ বেগমের কাছে গিয়ে বলল,
“বড়মণি?”

দুবারের ডাকে মমতাজ বেগম চোখ খুলেন। হাত উঠিয়ে বলে,
“এসেছো মা? একটু পানি দিবে।”

দুর্ঘটনায় উনার বুকে ব্য°থা পেয়েছিল। থেকে থেকে সে ব্যথায় কাতরে ওঠে। মৃত্তিকা উনাকে ধরে উঠিয়ে পানি পান করিয়ে দেয়।

মমতাজ বেগম আবারো শুয়ে বলে,
“আমি তোমাকে মা°রার জন্য শাফিনের ঠিকানা বলিনি, তোমাকে আমি এখন আর মা°রতে চাই না মা।”

মৃত্তিকা অপলক তাকিয়ে বলল,
“মাম একটা কথা বলতো, খালা নাকি মায়ের চেয়ে ভালা। আর আমার খালা আমার মাকেই মে°রেছে।”

মৃত্তিকা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখের পানি লুকাতে ব্যস্ত হয় সে।

শাফিনের কাছে গিয়ে বলে,
“তোমার মনের মতো তোমার শরীরটাও পঁচতে শুরু করেছে। এই হাত দিয়ে মেয়েগুলোকে স্পর্শ করেছিলে, তাই না? মজলুমের অভিশাপ বিফলে যায় না মামা।”

কঠিন প্রশ্নে চেয়ে থাকে শাফিন। মৃত্তিকা আবারো বলে,
“কেন ডেকেছো তাই বলো? কেন দেখা করতে চেয়েছো?”

শাফিন নিচুস্বরে বলল,
“তোমাকে আমি আসতে বলিনি।”

শাফিনের বামহাতে হাতকড়া লাগানো আছে। লোহার ভারি কড়াটা শব্দ করে নাড়িয়ে বলে,
“এই হাত খোলা থাকলে এখনই তোমাকে মে°রে দিতাম। তোমার জন্য আমি মৃ°ত্যু য°ন্ত্রণা সহ্য করছি।”

“এগুলো কর্মফল।”

শাফিন আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলে। ডানহাতের আঙ্গুলগুলো তার নড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে, যেন সে হাত নাড়াতে চাচ্ছে। মৃত্তিকা সেদিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর অপরূপাকে টে°নে ভিতরে এনে ফেলে সুরভি। মৃত্তিকা চমকে উঠে বাইরে তাকায়। দুজন পুলিশ তাদের জায়গায় নেই। আইসিইউর সামনে পুরো স্থান ফাঁকা।

“আপু?”

মৃত্তিকার ডাকে সুরভি উত্তর দেয়,
“চুপ করো, বাধা দিও না।”

সুরভি শাফিনকে ডেকে বলে,
“বাবা, তোমার সুন্দরী, যুবতী, সুনয়না স্ত্রী দেখা করতে এসেছে। যার রূপে পাগল হয়ে তুমি আমার মায়ের সাথে প্র°তা°রণা করেছো, সেই অপরূপা এসেছে। দেখো তুমি।”

শাফিন ধীরে ধীরে চোখ খুলে। সুরভি অপরূপার চুলের মুঠি ধরে ওকে শাফিনের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,
“সবাই সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, শুধু আমার বাবা আর আমি ছাড়া।”

অপরূপার মাথাটা বিছানায় চেপে ধরে ওড়নার নিচ থেকে বড় ছু°ড়িটা বের করে অপরূপার গলায় গভীর করে চালিয়ে দেয় সুরভি। চিৎকার দেয়ার সময়টুকু অপরূপা পায় না। ছু°ড়ি দিয়ে খুঁচিয়ে র°ক্ত আরো বের করে সুরভি।

মৃত্তিকা ধরতে আসতে নিলে সুরভি ধমক দেয়,
“খবরদার কাছে আসবে না। এখানে তোমার কিছু নেই। চলে যাও।”

সে নিজেও কান্না করে দিয়েছে। র°ক্তে মাখোমাখো হয়েছে তার শরীরের পোশাক। ছটফট করতে থাকা অপরূপাকে ধরে রাখতে রাখতে মুখে-গলায়-হাতে র°ক্ত মেখে ভ°য়ং°কর রূপ এসেছে সুরভির।

“সন্তানের হাতের মৃ°ত্যুর চেয়ে তোমার জন্য কোনো বড় শাস্তি নেই বাবা।”

মমতাজ বেগম এসব দেখে চিৎকারে করে উঠে। শব্দ শুনে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ভিতরে চলে আসে।

সুরভি শাফিনের উপর ছু°ড়ি চালাতে নিলে দুজন মহিলা কন্সটেবল জোরপূর্বক সুরভিকে ধরে ফেলে। সরিয়ে আনে শাফিনের কাছ থেকে। তবুও শাফিনের হাতে ছুড়ির আঁ°চড় পড়ে, কে°টে র°ক্ত ঝরা শুরু হয়েছে।

সুরভি এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাফিনের দিকে। বাবার প্রতি তার চরম ঘৃ°ণা, এতোটাই ঘৃ°ণা যে বাবাকে মে°রে ফেলতেও সে দ্বিধা করবে না।

মৃত্তিকা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আকস্মিক ঘটনায় মানসিকভাবে বিপ°র্য°স্ত হয়ে পড়েছে সে। এই পরিবারের কেউ আবারো খু°ন করলো। তানজিম ঠিক বলেছিল এ র°ক্তে খু°ন ঘুরছে।
______________________________________

দশদিন পেরিয়ে যায়। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সারাহ্ নিজের রুমে শুয়ে আছে। আহনাফ গতকাল আসেনি, সেই যে শুক্রবারে গেল তারপর যেন বাসার পথই ভুলে গেছে। সারাহ্ও অভিমান করেছে, কোনো কল দেয়নি।

কলিং বেল বাজলে সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে অপরিচিত কয়েকজন মেয়ে এসেছে, হাতে একটা দানবাক্স।

“আসসালামু আলাইকুম।”

এক মেয়ের সালামের জবাব দেয় সারাহ্।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। জি বলুন।”

“আমরা একটা বৃদ্ধাশ্রমের জন্য টাকা সংগ্রহ করছি।”

মেয়েগুলোর পিছন থেকে “টুকি” বলে বেরিয়ে আসে সামিহা। তাড়াহুড়ো করে বলে,
“আমি ওদেরকে নিয়ে এসেছি, জলদি জলদি টাকা বের করো।”

সারাহ্ পুরো দরজা আগলিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এ টাকা কোথায় যাবে?”
“বৃদ্ধাশ্রমে, সত্যি বলছি। আমরা মিথ্যা বলি না, আমি তো না-ই।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে গিয়ে পার্স থেকে দুইশ টাকার নোট দিয়ে বলে,
“যাবো একদিন ওই বৃদ্ধাশ্রমে, দেখবো টাকার কি হচ্ছে।”

মেয়েগুলো চলে যায়। সামিহা ভিতরে এসে হেলেদুলে হেঁটে হেঁটে বলছে,
“আপু, তুমি সোজা হবা কবে?”

“কেন? আমি কি বাঁকা?”

“না, কোমড়ে হাত দিয়ে এমন সাপের মতো হাঁটা থামাবা কবে তাই বলো।”

“তবে রে।”

সারাহ্ ওর দিকে কুশন ছুঁড়ে দিলে সামিহা দৌড়ে পালায়। তারপর আবার রুম থেকে উঁকি দিয়ে বলে,
“আমিও ইমতিয়াজ ভাইয়ার মতো একদিন ম°রার ভাণ ধরে থাকবো। তখন দেখবো তুমি কেমনে কা°ন্দো।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে ফেলে। সামিহা রুমে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। তানজিমের কাছ থেকে ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুর অভিনয়ের কথা শুনেছে সামিহা।

সারাহ্ রুমে চলে এসেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলল,
“কোলে কবে আসবি, সোনা? আমার যে আর ধৈর্য থাকছে না।”
______________________________________

সুরভিকে জে°লে নেয়া হয়েছে আজ দশদিন। রাইদ মাকে ছাড়া খুবই কান্নাকাটি করে। সুরভি ছেলেকে দেখে না, দেখা করতে আসলেও কাছে যায় না।

অপরূপার দা°ফনের কাজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে৷ নিয়াজীর খু°নের কথাও এখন ওপেন সিক্রেট বলা যায়, তবে শরীফকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

দেলোয়ারা তো আগে থেকেই নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। স্বামীর এ অবস্থার পর মেয়ের জেল, উনি যে বেঁচে আছেন সেটাই বেশি।

রাইদকে মৃত্তিকা কোলে নিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করছে। দেলোয়ারা এখন মৃত্তিকার বাসায়, ওর সাথেই আছে।

“বাবা আমার, সোনা আমার, আর কাঁদে না। একটু খাও।”

ফিডার দিয়ে অল্প অল্প করে দুধ খাওয়াচ্ছে ওকে মৃত্তিকা। ছোট মানুষ, মা ছাড়া বুঝেটা কি? বাবা তো মাকে ছেড়েই দিয়েছে।

সমস্তটা দিন মৃত্তিকা ওকে নিয়েই কা°টিয়েছে। রাতে ইমতিয়াজ বাসায় এসে দেখে ক্লান্ত মৃত্তিকা রাইদের পাশে আরামে ঘুমাচ্ছে। ওকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে কপালে চুম্বন করে দেয়।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখে রাতের খাবার প্রস্তুত।

ইমতিয়াজ নিজে নিজেই বলে,
“গিন্নি তবে পারফেক্ট হচ্ছে।”

পেছন থেকে দেলোয়ারার কন্ঠ পাওয়া যায়।
“আরে ইমতিয়াজ, এসে গেছো। ফ্রেশ হয়ে নাও, আজ আমি রান্না করেছি।”

ইমতিয়াজের মুখটা শুকিয়ে যায়। তবে এসব রান্না দেলোয়ারা করেছে। পরক্ষণেই হাসে সে, সবসময় স্ত্রীরা রান্না করবে কেন? মাঝে মাঝে স্বামী তাকে রেঁধে খাওয়াতে নিষেধ নেই। ওদের সম্পর্ক না হয় উল্টোই হোক।
______________________________________

মধ্যরাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্ব°র এসেছে শাফিনের। জ্ব°রে কাঁপছে, ব্য°থায় চিৎকার করছে আর মনে মনে আফসোস করছে সে।

যদি জামিল, দুলাল বেঁচে থাকতো, তবে সে ঠিকই বেঁচে যেতো। আজ তার খারাপ সময়ে বিশ্বস্ত লোকগুলোও যেন পালিয়েছে। কারো কোনো খোঁজখবর নেই।

মমতাজ বেগম অনেকটাই সুস্থ, তবে বয়সের তুলনায় দুর্ঘটনার ভারটা সে নিতে পারছে না। শাফিন জানে মমতাজ পালাবে না, তবে তাকেও যে পালাতে দিবে না।

পা তার সম্পূর্ণ অবশ, হাত একটু নাড়াতে পারে। নাড়ালেই পঁ°চা-গলা মাংস খুলে পড়তে শুরু করেছে। শাফিন চিৎকার করে। একজন কর্তব্যরত ডাক্তার ভিতরে আসলে মমতাজ বলে,

“ওকে দূরে সরাও, না হয় আমাকে সরাও। ওর চিৎকার আমার ভালো লাগে না।”

ডাক্তার শাফিনকে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করে। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। ক্ষ°ত সারানোর ওষুধ ওর উপর কেন যেন কাজ করছে না। ক্ষ°ত শুকাচ্ছে না, বরং আরো বাড়ছে। ভ°য়ং°কর রকম দূ°র্গন্ধ আসছে তার থেকে।

“আমাকে সুস্থ করো, নাহয় মে°রে ফেলো। সহ্য হচ্ছে না আমার। মিউকো, ছাড়বো না আমি তোমাকে।”

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুঃষষ্টি পর্ব (৬৪ পর্ব)

“হাত-পা কে°টে ফেললে বেঁচে যাবে তুমি।”

ভোর ভোর ডা: মাহিনের কথায় শাফিনের খারাপ মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। খিঁ°চিয়ে উঠে বলল,
“কা°টতে হবে কেন? অনেক মানুষের এরকম হয়েছিল, ওরা কি সুস্থ হয়নি?”

মাহিন হেসে স্যালাইন ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“ওরা তো বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করেছে, তুমি তো তা পারবে না।”

শাফিন যেন আশার আলো দেখে।
“আমাকেও বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন প্লিজ। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”

মাহিন স্টেথোস্কোপ হাতে নিয়ে বলল,
“সহ্য তো করতে হবে আর না হয় ম°রতে হবে। (একটু থেমে) মেয়েগুলো যেমন সহ্য করতে না পেরে ম°রে গেছে, ঠিক তেমন।”

মাহিন চলে যেতে নিলে শাফিন বলে,
“ওই ডাক্তার, আমি দোষী হলে মিউকোও দোষী। সে আমার এ হাল করেছে।”

মাহিন ফিরে দাঁড়িয়ে বলে,
“ঠিক করেছে। দেশের আইন যা পারেনি, সে পেরেছে। স্যালুট করা উচিত তাকে।”

মাহিন দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়। সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় যারা আছে তারাই আজ অ°ন্যায়-অবিচারকে প্রশ্রয় দিচ্ছে ক্রমাগত। ফে°ত°নার সৃষ্টি করছে, নিরীহদের হ°ত্যা করছে। এমন মানুষদের সাথে কথা বলার ইচ্ছা মাহিনের নেই, না তাদের চিকিৎসা করার ইচ্ছা আছে।
______________________________________

ফজরের নামাজের পর মৃত্তিকা রাইদের জন্য খাবার বানাতে গেল। সাতমাসের বাচ্চাটা মায়ের দুধ ছাড়া আর কিছু খেতেও তো শিখেনি এখনো।

পানি মিশিয়ে পাতলা করা দুধ গরম করে মৃত্তিকা। ইউটিউব দেখে দেখে সে এ পদ্ধতি ব্যবহার করছে। আবার আজ থেকে একটু একটু সুজি দিবে ভাবছে, তবে তারজন্য ইমতিয়াজের সাহায্য লাগবে।

মসজিদ থেকে বাসায় এসেই ইমতিয়াজ রাইদের কান্না শুনে দ্রুত গিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয় সে। মৃত্তিকা ফিডার নিয়ে এসে ওকে খাওয়াতে চেষ্টা করে। গলা ফা°টিয়ে চিৎকার করছে রাইদ।

মৃত্তিকা নরম কন্ঠে বলল,
“বাবা আমার, একটুখানি খেয়ে নাও। জান না আমার।”

দেলোয়ারা কান্না শুনে উঠে এসে দরজায় নক করে। মৃত্তিকা বলে,
“দরজা খোলা মামানী।”

দেলোয়ারা ভিতরে আসে। গত কয়েকদিন রাইদকে নিয়ে মৃত্তিকার বিশ্রামহীন, নিদ্রাহীন রাতগুলোর কথা উনি জানেন।

দেলোয়ারা বি°র°ক্তি নিয়ে বলে,
“বাপ-বেটি খু°ন করে পড়ে আছে, জ্বা°লা সব আমার।”

ইমতিয়াজ উনার দিকে তাকিয়ে বলল,
“মামানী, যে দোষ করেছে সে দোষী, তার পরবর্তী প্রজন্ম না। উত্তর কোরিয়ার নিয়ম এখানে মানলে তো আর হবে না।”

“সে তুমি যাই বলো, এই গুষ্ঠির কেউই ভালো হবে না। এই র°ক্ত যেখানে গেছে, সেখানেই লা°শ পড়েছে।”

মৃত্তিকা ধ°মক দিয়ে উঠে,
“থামো তো মামানী, এই বাচ্চা কি করছে? শুধু শুধু ও কেন কষ্ট পাচ্ছে? সহ্য না হলে তুমি ঘরে যাও।”

দেলোয়ারা কথা বাড়ালেন না, নিজের রুমে চলে গেলেন উনি। উনার কষ্ট উনি জানেন আর জানেন আল্লাহ্।

মৃত্তিকা মিউকোকে এনে রাইদের সামনে বসিয়ে দেয়। মিউকোকে দেখিয়ে দেখিয়ে মৃত্তিকা বলে,
“ওটা কি? ওটা ক্যাট, মোটা বিড়াল। বিড়াল খায়, রাইদও খায়।”

মিউকোর লেজ ধরে বলে,
“এটা লেজ, বিড়ালের লেজ। রাইদ লেজ দেখে খায়।”

মিউকোর নড়াচড়া আর খেলাধুলা দেখিয়ে রাইদের খাওয়া চলতে থাকে। একটুখানি খেয়ে শান্ত হয় সে। একপর্যায়ে মৃত্তিকার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে।

মৃত্তিকা ওকে বুকের উপর নিয়ে বিছানায় বসে থাকে। পুরো সময় ইমতিয়াজের দৃষ্টি মৃত্তিকার দিকে ছিল। মাতৃত্ব যেন তার মধ্যে হঠাৎ করে চলে এসেছে। একটা আলাদা চাহনী, আলাদা স্নেহময় কন্ঠ।

ইমতিয়াজ ওর পাশে বসে কিছু বলতে নিলে মৃত্তিকা ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে না বোধক মাথা নাড়ে। ইমতিয়াজ মুচকি হেসে রাইদের কপালে চুমো দেয়।

মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিজের গাল ইশারা করে। ইমতিয়াজ ওর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ধীরে ধীরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“লজ্জা বি°স°র্জন দিয়েছো?”

মৃত্তিকা মুচকি হাসে, কিছুই বলে না। রাইদকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে, ইমতিয়াজও মিউকোকে নিয়ে ওর পাশে শোয়। দৃষ্টি দুজনের চোখে দুজনের আবদ্ধ, কিছু বলতে চেয়েও নিশ্চুপ ওরা।
______________________________________

আরেকটা দিন আহনাফের অপেক্ষায় কাটিয়ে দেয় সারাহ্। ওর আর এসব ভালো লাগে না। আহনাফ কেন আসছে না? ফোনে ওইটুকু সময় কথা বলে কি হয়? না ঠিকমতো শোনা হয় আর না দেখা হয়।

অবশেষে আজ সন্ধ্যায় আহনাফ আসে। সারাহ্ অভিমান ধরে রেখেছে, রাখবেই। এতো সহজে ছেড়ে দিলে লোকটা পার পেয়ে যাবে।

নার্গিস পারভিনের সাথে কথা শেষে আহনাফ রুমে আসে। সারাহ্ ওকে দেখেই বারান্দায় চলে গেল। আহনাফ মুচকি হেসে ব্লেজারের গুপ্ত পকেট থেকে গোলাপ বের করে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

“গোলাপ লাগবে কারো?”

সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি এটা গরুর মতো চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন।”

আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে ঠোঁট উলটে বলল,
“ফাইন, এখানে কার মায়ের নাম নার্গিস?”

“এই একদম আম্মুকে নিয়ে কিছু বলবেন না।”

আহনাফ হেসে বলল,
“নার্গিস হলো একটা ঘূ°র্ণিঝ°ড়ের নাম, তাই তুমি ঝ°ড়ের মেয়ে আরেক ঝ°ড়। না ঝ°ড় না, তুমি সাহারা মরুভূমি।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে তাকালে আহনাফ আবারো বলে,
“হ্যাঁ, তোমাকেই বলেছি, এভাবে তাকানোর কিছু নেই তো।”

“আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। এতোদিন পর এসেছেন, আবার ঠিকমতো কথাও বলছেন না।”

আহনাফ ওর কাছে এসে গোলাপ ওর বেনীতে গুঁজে দিয়ে বলল,
“এখন একদম পাক্কা লম্বা লেজের লাফানো প্রাণী লাগছে।”

সারাহ্ তেঁতিয়ে উঠে,
“আপনি আবার আমাকে বানর বললেন?”

“বলেছি বুঝি? কই, এমনকিছু তো মনে পড়ছে না। তো সাহারা মরুভূমি, বলছিলাম কি..”

আহনাফের কথার মাঝেই সারাহ্ বলে,
“কে সাহারা মরুভূমি, আমি সারাহ্, কোনো এক ন্যাকার ঐশী।”

আহনাফ ওকে জড়িয়ে ধরে ন্যাকাসুরে বলল,
“সাইদার আম্মু রাগ করে না। আদর, আদর, অনেক আদর।”

সারাহ্-র কপালে, গালে, থুতনিতে চুম্বন করতে থাকে আহনাফ। সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে,
“আর ন্যাকামি লাগবে না।”

“এগুলো তো আমার সাইদা আর সাদাবের জন্য। তোমাকে দিচ্ছি নাকি? এমন ভান যেন উনাকে আমি আদর করছি। ঠে°কা আমার।”

সারাহ্ চলে যেতে নিলে আহনাফ ওকে কাছে এনে ওর ঠোঁটে স্পর্শ করে বলল,
“এখানেরটুকুই আপনার, বাকিটা আমার বেবিদের।”

সারাহ্ মুচকি হেসে মাথা নুইয়ে ফেললে আহনাফ ফিসফিস করে বলে,
“সিংহভাগ তো এখানেই থাকে।”

সারাহ্ এবারে নিজের মুখ আহনাফের বুকেই লুকায়। নিজে নিজেই হাসছে সে।

স্ত্রীর রাগের পাহাড় ডিঙিয়ে প্রেমের প্রান্তে পৌঁছে গেছে আহনাফ। সারাহ্-র মিষ্টি লাজুক হাসি দেখে আহনাফও হাসে।

এই কয়েকদিন ধরে আহনাফ ব্যস্ত ছিল অন্যকাজে। সারাদিন ক্লাস করে রাতে সে জামিলের সাথে সম্পৃক্ত নানা তথ্য খুঁজেছে।

ফুফু আম্বিয়ার কাছ থেকে জানতে পেরেছে ছয়তলায় একটা হলরুম করার উদ্দেশ্যে সেখানে কাজ চলছিলো, কিন্তু মাঝপথে অর্থ সংকটে কাজ থেমে গেছে।

বোঝা যায়, তবে এই সুযোগে অপরূপা সেখানে ঘা°টি বেঁধেছিল।। এছাড়া আর তেমন কিছুই সে পায়নি। নতুন কোনো মানুষের সম্পৃক্ততাও এখানে নেই।
______________________________________

ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট, শাফিনের কাছে এএসপি নাহিদ এসেছে। মমতাজ বেগম ঘুমাচ্ছে, শাফিনের ঘুম নেই। য°ন্ত্র°ণায় সে নির্ঘুম রাত্রিযাপন করে।

নাহিদকে দেখে সে অবাক হয়। শাফিন বলে,
“আটকে রেখে কেন দেখতে এসেছো?”

“তোমার ক্রস°ফা°য়ার আমি থামিয়েছি, নাহলে ওইদিনই তুমি শেষ হয়ে যেতে।”

“কারণ? এমন পদে থেকে আমাকে কেন বাঁচিয়েছো?”

নাহিদ একটু হেসে বলে,
“এখনও তোমাকে বাঁচাতে পারি। ইন্ডিয়া নিয়ে যাবো, মুম্বাই না হলে তামিলনাড়ু। অস্ট্রেলিয়া বা সিংগাপুরেও নিয়ে যেতে পারি। যাবে?”

“কেন সাহায্য করছো তাই বলো। উদ্দেশ্য কি?”

নাহিদ ভণিতা করে বলে,
“আহা, উত্তেজিত হয় না। (একটু থেমে) তোমার যতপ্রকার বিজনেস আছে, সব আমার আন্ডারে দিয়ে দাও। ব্যস, তুমি বেঁচে যাবে।”

শাফিন মুখ ভেংচিয়ে বলল,
“ওসব নিয়ে আর কি করবে? লোকজন নেই তো।”

“ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। তুমি শুধু আমার আন্ডারে করবে, সব ঠিক কোথায় কোথায়, কি কি আছে তা বলবে। তবেই হবে।”

শাফিন কিছুক্ষণ ভাবে, এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। বলে,
“ঠিক আছে, দিবো। তবে এখন অর্ধেক দিবো, বাকি অর্ধেক সুস্থ হওয়ার পর।”

“মেন্টালি রেডি হও, তুমি শেষরাতে বের হয়ে যাবে। সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করা আছে।”
শক্তকন্ঠে কথাটা বলে নাহিদ।

শাফিন আবারো একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করে,
“ইমতিয়াজ কেমন আছে? সত্যিই সে মা°রা গেছে।?”

হুট করে শাফিনের এমন প্রশ্নে নাহিদ অবাক হয়। তারপর বলে,
“সত্য সত্যই মা°রা গেছে।”

শাফিন সত্যটা জানে না। ওকে কেউ জানায়নি, কি করে জানবে। সে মুচকি হাসে, তারপর শব্দ করে হাসে। বলল,
“সে আমাকে মা°রতে চেয়েছিল, নিজেই ম°রে গেছে। মিউকো, একা তুমি, চির একা। আমিই তোমাকে একা করেছি।”

নাহিদ বেরিয়ে আসে। ইমতিয়াজ বাইরে বসে আছে। নাহিদ ওর কাছে এসে বলল,
“কাজ শেষ, যতটুকু দরকার ছিল বলেছি। আশা করি এবারে তাকে শক্তপোক্ত করেই ধরা যাবে।”

ইমতিয়াজ মাথানেড়ে বলল,
“ধন্যবাদ, আপনার মতো মানুষের জন্য আইনের উপর এখনো বিশ্বাস রাখা যায়। (একটু থেমে) ডিআইজি দিলদারের খবর কি? উনিই তো শাফিনের মৃ°ত্যু°দ°ন্ডের আদেশ থামিয়েছে।”

“উনি আমার সিনিয়র, তবে আইন সিনিয়র-জুনিয়র মানে না। জে°লে আছে।”

ইমতিয়াজ আইসিইউর দিকে তাকিয়ে বলল,
“শাফিন কিন্তু ভ°য়ং°কর লোক, সামলাতে পারবেন?”

“ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ্ আমাকে সেই শক্তি দান করুক।”

ইমতিয়াজ মাথানেড়ে বলল,
“আমিন।”

দুজনে বাইরে আসতে আসতে ইমতিয়াজ জিজ্ঞাসা করে,
“সুরভি আপুর খবর কি? উনাকে কি রি°মান্ডে নিবে নাকি?”

“না, উনি সব স্বীকার করেছে। বাকিটা কোর্ট যা বলে। শুনানি হবে, মৃত্তিকা ম্যাডামকে আসা লাগতে পারে, যেহেতু উনি প্রত্যক্ষদর্শী।”

ইমতিয়াজ উত্তর দিলো না। রাইদের অবস্থা চোখের সামনে দেখছে সে। মাকে ছাড়া ইমতিয়াজ নিজেও বড় হয়েছে, কষ্ট সে জানে।

মায়ের মৃ°ত্যু হয়েছিল ওর জন্মের কিছুক্ষণ পরই। তারপর ইমতিয়াজের কথা ভেবেই ওর বাবা ওরই খালাকে বিয়ে করে। বয়স যখন তিনবছর তখন তিনিও মা°রা যান। বাবার কাছেই মা ছাড়া বড় হয়েছে সে। ওর তো বাবা ছিল, রাইদের তো কেউ নেই।

পরক্ষণেই ইমতিয়াজ ভাবে,
“না আছে, রাইদের মা যদি মৃত্তিকা হয়, তবে সে বাবা। রাইদের বাবা-মা দুই-ই আছে। তবুও কাউসারের সাথে একবার কথা বলা উচিত।”
______________________________________

নাহিদ কথা রাখে। শেষরাতে কয়েকজন লোক এসে হাজির হয় শাফিনের কাছে। শাফিনের বেডসহ তাকে নিয়ে যেতে নিলে শব্দ শুনে মমতাজ বেগমের ঘুম ভা°ঙে।

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে? আপনারা কারা?”

একজন লোক এসে মমতাজ বেগমকে বলে,
“আপনি ঘুমান, এসব আপনার জানার বিষয় না।”

শাফিন পেছন থেকে জোরে জোরে বলতে থাকে,
“আমি সুস্থ হবো, মিউকোকে মে°রে ফেলবো আমি। তাহমিনার কাছে ইমতিয়াজ গেছে আর ইমতিয়াজের কাছে মৃত্তিকা যাবে।”

মমতাজ বেগম আকুতি করে উঠে,
“মে°রো না ওকে, ওই শিশুগুলোর অভিশাপে তুমি পঁচে যাচ্ছো, আর অভিশাপ নিয়ে যেও না।”

শাফিন হেসে জোর গলায় বলল,
“তুমি মিউকোকে বাঁচাতে চাচ্ছো? সে তোমাকে মা°রবে। বাবা কি বলেছিল মনে নেই? সবসময় নিজের কথা ভাববে, কাউকে নিয়ে ভাবার দরকার নেই।”

মমতাজ বেগম কাঁদতে শুরু করলো। এছাড়া আর করবেনই বা কি। শাফিনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল লোকগুলো। সাদা চাদরে ঢেকে লা°শের মতো বের করে নিয়ে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হলো।

নাহিদ এম্বুলেন্সে বসে আছে, ড্রাইভারের পাশের সিটে ইমতিয়াজ এমনভাবে বসে রইলো যেন শাফিনের চোখে না পড়ে।
______________________________________

দেড়মাস পর, সময়টা হিসাবের ক্ষেত্রে অনেকটা বেশি মনে হলেও আসলে বেশি নয়।

সারাহ্-কে আজকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আগামীকাল ওর ডেলিভারির তারিখ দিয়েছে। এজন্যই তো আজকে সন্ধ্যায়ই ওকে চেকআপের জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল, বাচ্চার পজিশন ঠিকঠাক না থাকায় ভর্তি করাতে বলা হয়েছে।

ভর্তি হওয়ার পর থেকে ভয়ে মেয়েটা কুঁচকে আছে, বারবার দুরুদ পড়ছে। সাহায্য চাচ্ছে আল্লাহ্-র কাছে।

আহনাফ, সামিহা তার পাশেই আছে। নার্গিস পারভিন আজকে ওর সাথে থাকবে। মহিলা ওয়ার্ডে রাতে পুরুষ থাকা নিষেধ। আহনাফকে তাই চলে যেতে হবে।

রাত নয়টা বেজে গেছে, সারাহ্ আহনাফের যাওয়ার কথা শুনে ওর হাত ধরে কান্না করে দেয়,
“থেকে যান আমার কাছে, আমার ভ°য় করে।”

আহনাফ ওর কপালে চুম্বন করে বলে,
“আমার সাইদা-সাদাব আসছে, ভ°য় পেয়ো না।”

সারাহ্ ধ°মক দিয়ে উঠে,
“একটু আগে ডাক্তার কি বলল শুনেননি? বেবির পজিশন ঠিক নেই। (নরমসুরে) আহনাফ, আহনাফ, আমার বেবি ঠিক আছে না?”

“একদম ঠিক আছে। কিচ্ছু হয়নি।”

সারাহ্-র সমস্যা অনেক দেখা দিয়েছে। র°ক্তের সুগার বেড়ে আছে, উচ্চ র°ক্তচাপও দেখা দিয়েছে। এ সময় এমন হওয়া স্বাভাবিক, তবে দু°শ্চিন্তার কারণে শরীর আরো খারাপ হতে পারে।

“আহনাফ, যদি আমাদের আর দেখা না হয়? আহনাফ, আমার ভ°য় করে।”

সারাহ্-র পাগলামিতে আহনাফের কষ্ট বাড়ছে। দেখা না হওয়ার কথা শুনে ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে তার।

আহনাফ নার্গিস পারভিনের দিকে তাকায়। নার্গিস পারভিন মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে শুরু করে।

পাশের বেডের মহিলার মা বলে,
“আরে মেয়ে, এতো ভ°য় পেলে মা হবে কি করে? মায়েরা মজবুত হয় পাহাড়ের মতো, আবার তাদের ভালোবাসা হয় সমুদ্রসম। মাতৃত্ব সহজ নয়, কষ্ট পেতে হবে। এটা তো কেবল শুরু।”

আহনাফের আর সহ্য হয় না, সে বের হয়ে যায়। সে নিজে যে শান্ত আছে তা নয়, তবে শান্ত রাখতে হচ্ছে। ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসে থাকে সে। বাসায় যেতে মন মানছে না।

কিছুক্ষণ পর আবারো উঠে এসে সামিহাকে বলে,
“সামিহা, তুমি থাকো, তবে ঐশী ভ°য় কম পাবে।”

সারাহ্ মাথা তুলে বলল,
“খবরদার, এশা যদি এখানে থাকে তবে আমি থাকবো না বললাম।”

সামিহা হাই তুলে বলে,
“আপু, তোমার কি লেবার পে°ইন উঠেছে? এমন লাফালাফি করতেছো কেন?”

“এশা, লা°ত্থি খাবি বললাম।”

“এই পেট নিয়ে লা°থি তুমি দিতে পারবা না। সো, আজকের দিনটাই আমার।”

সারাহ্ নার্গিস পারভিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার আরো দশটা শ°ত্রু বেশি থাকতো, তাও এমন একটা বোন না থাকতো।”

সামিহা উঠে দরজা কাছে এসে আহনাফকে বলে,
“আমি আর জীবনে এখানে আসবো না। এমন অপ°মান মানা যায় না, না না, কিছুতেই না।”

আহনাফ হেসে দেয়। সারাহ্-র দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটার চোখেমুখে আকুতি। “থেকে যাও আহনাফ” তার চোখদুটো যেন তাই বলছে।

আহনাফ হাত নেড়ে বিদায় জানায়। সারাহ্ কান্না চেপে বিদায় দেয়। একটা ভ°য় তার, সাদাব-সাইদা ঠিকমতো আসবে তো? সন্তানকে কোলে নিয়ে আহনাফকে দেখতে পারবে তো সে?
______________________________________

গতকাল গভীর রাতে শাফিন দেশে ফিরে এসেছে। নাহিদ শাফিনের সকল কিছুর কর্তৃত্ব আজ সকালেই নিজের করে নিয়েছে। শাফিনের এসবের রেকর্ডও রেখেছে সে। শাফিন ফাঁ°দে পড়ে গেছে, এখন শুধুই সফল হওয়ার পালা।

সকাল এগারোটা, কিছু দরকারী জিনিস কিনতে মৃত্তিকা গ্রোসারি সুপারশপে এসেছে।

ওর পিছুপিছু এসে হাজির হয়েছে শাফিন। সকালে নাহিদের থেকে বিদায় নিয়েই সে মৃত্তিকার পিছু নিয়েছে। আর কোনো বাড়তি সময় না নিয়ে সুযোগ বুঝে মৃত্তিকাকে মা°রতে চায় সে।

মৃত্তিকা কেনাকাটা শেষ করে বাড়ির পথে যাওয়া শুরু করে। বাসা বেশি দূরে না হওয়ায় সে হেঁটে হেঁটেই যাচ্ছে।

লিফটে ওর সাথেই উঠে শাফিন। মাস্ক পড়া ও বড় হ্যাট থাকায় শাফিন ভাবে মৃত্তিকা তার চেহারা খেয়াল করেনি, অথচ মৃত্তিকা তাকে ঠিকই দেখেছে।

মৃত্তিকা বাসার দরজা খুলতেই ওকে ধা°ক্কা দিয়ে ভিতরে এসে হাজির হয় শাফিন।

ডানহাতের টোকায় হ্যাট ফেলে অন্যহাতে মাস্ক খুলে মৃত্তিকাকে বলে,
“কি ভেবেছিলে? ম°রে যাবো? শাফিন ম°রে না, বারেবারে ফিরে আসে।”

ডানহাতে তার শক্ত কভার লাগানো, মানে হাত এখনো ঠিক হয়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, পায়ের অবস্থাও ঠিক নেই। তবুও যেন জোর কমে না।

মৃত্তিকা তার পা থেকে মাথা অব্ধি দেখে চুপ করে আছে। শাফিনকে দেখে সে অবাক হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফিক করে হেসে দেয়।

ব্যাগটা ফ্লোরে রেখে মৃত্তিকা সোফায় বসে পড়ে। শাফিনের রাগ বাড়ে। দরজা বন্ধ করে দেয় শাফিন।

মৃত্তিকা বলে,
“ঘটনা কি মামা? হাত-পা ঠিক হয়ে গেছে? প্রতিশোধ নিতে এসেছো?”

শাফিন ওর কাছে আসে। বলল,
“প্রশ্নের জবাব দিবো না আমি। ইমতিয়াজ নেই, এভাবে তোমাকে একা পাবো তা কিন্তু ভাবিনি। ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে, তুমিও কি ইমতিয়াজকে ডাকবে?”

মৃত্তিকা ঠোঁট উল্টায়, মুখে তার মুচকি একটা হাসি। শাফিনের হাত টে°নে মৃত্তিকা নিজের ঠোঁটের লিপস্টিক লেপ্টে দেয়, চোখের কাজল হাত দিয়ে নিয়ে শাফিনের সাদা টিশার্টে লাগিয়ে দেয়।

শাফিন চমকে উঠলো, এ কি করছে মেয়েটা। মৃত্তিকা শাফিনের ইন করা টিশার্ট টে°নে তুলে তাকে একপ্রকার এলোমেলো করে দেয়।

“বাঁচাও আমাকে, ঘরে কেউ একজন এসেছে। কে আছো বাঁচাও, আমাকে শেষ করে দিচ্ছে।”

গলা ফা°টিয়ে চিৎকার করতে থাকে মৃত্তিকা। মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে একটু হাসে, তারপর আবারো চেঁ°চাতে থাকে। একপর্যায়ে সে ফ্লোরে বসে পড়ে।

শাফিন বুঝতে পারে এখানে কোনো বড়সড় চাল আছে। দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিলে সামনে পড়ে নাহিদ।

“সময় শেষ, মামা।”

মাথানেড়ে কথাটা বলল মৃত্তিকা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ধ°র্ষ°ণের চেষ্টার সময় এএসপি নাহিদের হাতে ধরা পড়লো ধ°র্ষ°ক শাফিন, হেডলাইনটা কেমন?”

মৃত্তিকার কথায় সমর্থন জানিয়ে নাহিদ বলে,
“এর আগেও অসংখ্য মেয়ে তার নোং°রা দৃষ্টির শি°কার।”

ইমতিয়াজ শার্টের হাতা গু°টাতে গু°টাতে লিফট থেকে বেরিয়ে শাফিনের টিশার্ট ধরে টে°নে ফ্ল্যাট থেকে বের করে বলল,
“ইমতিয়াজ বলে চিৎকারটা তুমি বারবার শুনবে না।”

শাফিন হা করে তাকিয়ে আছে ইমতিয়াজের দিকে। পুরো একটা সত্য থেকে ওকে এভাবে দূরে রেখে বোকা বানালো, আর ও টেরই পেল না।

ইমতিয়াজ ওর কাছে মুখ এনে বলে,
“সিসিটিভিতে শুধু ভিডিও দেখা যায়, ছবি না। বাজেভাবে ফেঁ°সে গেছো তুমি শাফিন।”

মৃত্তিকা বের হয়ে আসে। ইমতিয়াজ শাফিনকে ছেড়ে দেয়। পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন বেরিয়ে আসলে মৃত্তিকা নাকিকান্না করতে করতে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে।

সবাই ধরেই নেয় শাফিন এবারে মৃত্তিকার সাথে খারাপ কিছুই করেছে। ধি°ক্কা°র জানাতে থাকে সবাই। স্যান্ডেল, জুতা ছুঁ°ড়ে ফেলতে থাকে ওর দিকে। ইমতিয়াজ শুধু দেখতে থাকে।

একে একে বেশ কয়েকজন পিবিআইয়ের লোক আসে। অফিসার গালিব ও রিজভিও আছে এখানে। জোরপূর্বক শাফিনকে ধরে গ্যারেজে নিয়ে যায়।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে