অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৬৫ এবং শেষ পর্ব

0
437

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অন্তিম পর্ব (প্রথমাংশ)

সারাহ্-কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। র°ক্তচাপ কমানোর জন্য এতোটা দেরি করলেও এখনো সারাহ্-র অস্থিরতা কমেনি।

সকাল সাতটায় আহনাফ এসেছে, এখন দুপুর সাড়ে বারোটা। দশটার আগেই জাহাঙ্গীর সাহেব ও সামিহা এসে হাজির।

সারাহ্-কে প্রস্তুত করে নিয়ে যাওয়ার সময় সে আরেক গ্যা°ঞ্জা°ম বাধায়, আহনাফকেও সাথে যেতে হবে।

“ঐশী, এমন আচরণ কেন করছো তুমি?”

আহনাফের শান্ত কথায় সারাহ্ কান্না করে দেয়। খেই তুলে বলল,
“আপনাকে ছাড়া আমার ভ°য় লাগছে, আহনাফ। যদি ওখান থেকে বেরিয়ে আপনাকে আর না দেখি।”

আহনাফ ওর কপালে চুম্বন করে, গালে হাত রেখে বলল,
“সব ঠিক থাকবে। বেবিকে আমরা একসাথে ওয়েলকাম করবো।”

সারাহ্ আহনাফের হাত ধরে রাখে। আহনাফ জোরপূর্বক নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। জাহাঙ্গীর সাহেব মেয়েকে আদর করে সান্ত্বনা দিয়ে দেয়।

সারাহ্-কে ভিতরে নিয়ে গেল। আহনাফ ধীরে ধীরে হেঁটে একটু দূরে এসে স্থির হয়। জীবনে যেসব ক্ষেত্রে ও বেশি প্ল্যান করে, সেখানেই কেন যেন বিপত্তি আসে। এখন সে তাই বেশি কিছু ভাবতে চাচ্ছে না।
______________________________________

বাসার সামনের রাস্তায় শাফিনকে মাঝে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পিবিআই সদস্যরা ক্র°স°ফা°য়ারের প্রস্তুতি নেয়, তাৎক্ষণিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শাফিনের দুইহাত পিছনে বাঁধা, তার চোখও বেঁধে দিয়েছে।

ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা এসে গেইটের সামনে দাঁড়ায়৷ দুপাশে মানুষের ভীড়। নাহিদ মাইকিং করে সব মানুষকে একদিকে পাঠিয়ে দেয়।

“ইমতিয়াজ, ওরা এতো দেরি কেন করছে?”
ভ°য় জড়ানো কন্ঠে কথাটা বলে মৃত্তিকা।

“সবকিছুর প্রস্তুতি লাগে, মৃত্তিকা।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের হাত ধরে কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু অদ্ভুত লাগছে তার, আবার না শাফিন বেরিয়ে যায়।

রিজভি ওদের দুজনের দিকে কয়েকবার তাকায়। গলির মুখে শরীফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইমতিয়াজ। শরীফ হাতের ইশারায় ওদেরকে চলে যেতে বলে।

ইমতিয়াজের কপাল কুঁচকে যায়। মৃত্তিকাকে বলে,
“তুমি চলে যাও, কিছু গন্ডগোল আছে।”

“কেন?”
অবাক হয় মৃত্তিকা।

ইমতিয়াজ ওকে একটু ধা°ক্কা দিয়ে বলল,
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক লাগছে না। চলে যাও।”

আচমকা রিজভি গু°লি চালায় মৃত্তিকার দিকে। ইমতিয়াজ ওকে সরিয়ে দিলেও গু°লিটা ইমতিয়াজের বামহাতে লাগে, কনুইয়ের খুব কাছে লেগে হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে।

উপস্থিত লোকজন চমকে উঠে। চিৎকার, চেঁচামেচিতে একটা হুলস্থুল কান্ড বেঁধে গেল। পায়ের আঘাতে রাস্তায় অবহেলায় পড়ে থাকা ধুলাবালি বাতাসে বিচরণ করতে শুরু করেছে।

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে ছুটে ভিতরে চলে আসে। এরমধ্যে আরো কয়েকটা গু°লি পর পর চলে। নিশানা ওদের মৃত্তিকাই। বারবার ইমতিয়াজ-মৃত্তিকা নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করায় ওদের নিশানা ঠিক থাকে না।

গালিবের উপর গু°লি লেগেছে, এএসপি নাহিদও খারাপভাবে আ°হত হয়েছে।

শরীফের লোকজনও পাল্টা গু°লি চালায়। এলোপাথাড়ি গুলিতে বেশ কয়েকটা লা°শ পড়ে, আ°হতও হয় অনেকে।

শাফিনের চোখ খুলে দেয়া হয়েছে অনেক আগেই, রিজভিই খুলেছে৷ হাত বাঁধা অবস্থায় শাফিনে দৌড়ে চলে গেল, রিজভির গাড়ি প্রস্তুত আছে তাতে করেই পালিয়ে গেল শাফিন।

গ্যারেজে একটা পিলারের পেছনে মৃত্তিকাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের হাত থেকে ক্রমাগত র°ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ইমতিয়াজ বারবার গেইটের দিকে তাকাচ্ছে, হাতের খেয়াল তার নেই। নিজেকে শেষ করে দিয়ে হলেও সে মৃত্তিকাকে বাঁচাবে।

মৃত্তিকা ওর হাতটা ধরে বলল,
“তাহলে কি রিজভিও এদের সাথেই ছিল?”

“এখন তো তাই মনে হচ্ছে, আর নাহয় বিজনেসের কাগজপত্র নাহিদের থেকে নেয়ার পর পাল্টি খেয়েছে।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“র°ক্ত পড়ছে ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে, ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে বলল,
“পড়ুক, (একটু থেমে) ওদের টার্গেট তুমি ছিলে। তুমি ঠিক আছো তাতেই চলবে।”

কিছুক্ষণ পর গোলাগু°লি থেমে যায়। পরিবেশ শান্ত হয়। ধুলায় পুরো জায়গা অন্ধকার হয়ে আছে, যেন মরুর ধূলিঝ°ড় এখানে হয়ে গেছে।

মৃত্তিকাকে ভিতরে রেখে ইমতিয়াজ বেরিয়ে আসে। গালিব আর নাহিদসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। কেউ যেন নেই যে তাদের সাহায্য করে।

এতোক্ষণ এতো লোক এখানে জড়ো ছিল, এতো মানুষ কি শুধুই তামাশা দেখতে এসেছিল?

উপায় না পেয়ে ইমতিয়াজ নিজেই এম্বুলেন্স কল করে এবং থানায়ও যোগাযোগ করে। মৃত্তিকা গেইটের কাছে এসে বলল,
“ইমতিয়াজ, এভাবে বাইরে থাকবেন না। ওরা আশেপাশেই থাকতে পারে।”

ইমতিয়াজের মন এমনিতেই ছটফট করছে। শাফিন যে আবার পালিয়ে গেল। রাগ হচ্ছে তাফ প্রচুর। বারবার কেন সে পালিয়ে যেতে পারে? এতোগুলো মানুষের মাঝখান থেকে কিভাবে পালিয়ে যেতে পারে?

মৃত্তিকাকে ধ°মক দিয়ে বলে,
“ভিতরে যাও, এখানে তোমার কোনো কাজ নেই।”

মৃত্তিকা কোথাও যায় না। এখানেই থম মে°রে দাঁড়িয়ে থাকে।

ইমতিয়াজের ফোন বেজে উঠে। শরীফের নাম্বার দেখে সে রিসিভও করে।

“আমি শাফিনের পিছনে আছি, ও সম্ভবত ঢাকার বাইরে যাবে, আমি ভুল না করলে খুলনা যেতে পারে। সুযোগ বুঝে ওকে মে°রে দিবো আমি।”

ইমতিয়াজ শুধুই ওর কথা শুনে, কিছুই বলে না। কল কেটে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলতে নিয়েও ফেলে না।

কিছুক্ষণ পরই এম্বুলেন্স চলে আসে। সবাইকে হাসপাতালে পাঠানো হলেও ইমতিয়াজ নিজে যায় না। মৃত্তিকার সাথে এটা নিয়ে একদফা কথা কা°টাকা°টিও হয়ে যায়।

ধ°মক দিয়ে মৃত্তিকাকে বাসায় পাঠায় ইমতিয়াজ। মৃত্তিকার জেদ ইমতিয়াজের কাছে হার মানে, নিজের অনিচ্ছায় বাসায় এসেছে সে। দরজা খুলে ভিতরে এসেই কান্নায় ভে°ঙে পড়ে।

দেলোয়ারা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে দেখে। উনি কি আর বলবেন, উনার স্বামীর জন্যই তো আজ এ অবস্থা। একজন নারীর কাছে নিজের স্বামীর মৃ°ত্যু প্রার্থনা করা কতটা কঠিন তা দেলোয়ারা জানে।
______________________________________

দুশ্চিন্তা, অস্বস্তি সবকিছুর অবসান ঘটে ছোট্ট প্রাণের চিৎকারে। এই এক কান্না যা শুনে মানুষ খুশি হয়। আহনাফ মনের অজান্তে হেসে উঠে।

একদম সুস্থ একটা সন্তান পৃথিবীতে এসেছে, আহনাফের সাদাব এসেছে। আনুষ্ঠানিক ভাবটা শেষ হয়, জাহাঙ্গীর সাহেব নাতির কানে আযান দেন। এরপর তাকে সারাহ্-র কোলে দেয়া হয়।

তানজিম হাসপাতালে এসেছে, সে মৃত্তিকার বাসায় হওয়া ঘটনা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কিছু জানে না। সামিহার কল পেয়ে এসে এসেছে।

সামিহা তানজিমকে দেখেই দৌড়ে এসে বলল,
“আমি খালামনি হয়ে গেছি, ছেলেবাবু হয়েছে।”

তানজিম হেসে বলল,
“বেচারা বেবি খালাম্মার য°ন্ত্র°ণায় শেষ হবে।”

সামিহা গাল ফুলিয়ে তাকায়। আহনাফকে দেখে তানজিম বলে,
“কনগ্রেচুলেশন ভাইয়া।”

আহনাফ হাসে। বলে,
“থ্যাংকস। আমি একটু আসছি।”

আহনাফ অন্যদিকে চলে যায়। সামিহা আর তানজিম এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে থাকে। এরমধ্যে নার্গিস পারভিন এসে সরাসরি তানজিমকে প্রশ্ন করে,
“তুমি শাফিনের ভাগ্নে না?”

তানজিমের হাসিমুখটা চুপসে যায়। সামিহার দিকে একপলক তাকিয়ে হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“জি, আন্টি।”

সামিহা বুঝতে পারে মায়ের দৃষ্টি, উনি কিছুটা ঘৃ°ণার চোখে তানজিমকে দেখে। সামিহা বলে,
“আম্মু, ও আমার ফ্রেন্ড।”

নার্গিস পারভিন সামিহার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলল,
“এমন ফ্রেন্ড থাকার চেয়ে একা থাকা ভালো।”

সামিহাকে নিয়ে অন্যদিকে চলে যায় নার্গিস পারভিন। সামিহা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তানজিমকে দেখে মায়ের সাথে সাথে যেতে থাকে।

তানজিম কষ্ট পায়। বুঝতে পারে এ অনুভূতি নিজের অপমানের জন্য না, সামিহার দূরে যাওয়ার জন্য। নিজেকে সংযত রাখে সে। তারপর ধীরেসুস্থে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়।

এদিকে সারাহ্-র কেবিনের সামনে গিয়ে উঁকি দেয় আহনাফ। সারাহ্ ওকে দেখে বলে,
“সাদাবের আব্বু কি তাকে দেখবে না?”

“সাদাবের আব্বুর সাইদা চাই।”
কথাটা বলে আহনাফ ভিতরে আসে।

সারাহ্ মুচকি হাসে। আহনাফ চেয়ারে না বসে সারাহ্-কে ঠেলেঠুলে কোনোমতে বেডের মধ্যেই জায়গা করে নেয়। সাদাব পৃথিবীতে নিজের প্রথম খাবার খেয়ে মায়ের কোল দখল করে ঘুমাচ্ছে।

কিছুক্ষণ ছেলেকে দেখে আহনাফ একহাতে সারাহ্-কে আগলে ধরে কপালে চুম্বন করে। তারপর বলল,
“আজকে যতবার আমাকে আহনাফ আহনাফ বলে ডেকেছো, আমি কি তার প্রতি°শো°ধ নিবো না?”

“কিভাবে নিবেন? আপনি তো এখন আর রাগ করেন না? আমার উপর রাগ মিটান না।”

সারাহ্-র দিকে তাকায় আহনাফ। সারাহ্ চোখ নামিয়ে নেয়। আহনাফ জানে ওর কথার মানে, সারাহ্-র লজ্জায় সে নিজের জানাকে আরো পাকাপোক্ত করে।

নিচু হয়ে সারাহ্-র গলায় মুখ গুঁজে দেয়। শক্ত ভারি ওষ্ঠের স্পর্শ পায় সারাহ্। কাঁপা কন্ঠে বলে,
“ছেলেটাকে একটু শান্তি দেন।”

আহনাফ ফিসফিস করে বলল,
“আমার রাগ হচ্ছে, ঐশী।”

আহনাফের গরম নিশ্বাস অনুভব করে সারাহ্ চোখ বন্ধ করে ফেলে, সমস্ত দেহ তার স্থির হয়ে গেছে। তার মনে হয় এক অদ্ভুত অন্ধকারে আছে সে, অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছে। আহনাফ ভালোবাসি না বলেও যে প্রচন্ড ভালোবাসে।
______________________________________

সন্ধ্যা সাতটা বেজেছে, হাসপাতাল থেকে নিজের প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু সেরে নিয়েছে ইমতিয়াজ। গু°লিটা বের হয়ে যাওয়ায় র°ক্ত°ক্ষরণ হলেও ভয়াবহ অবস্থা হয়নি।

গালিবের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়েছে। নাহিদ মোটামুটি ভালো আছে, গু°লি বের হওয়ার পরই সে ফোন যোগে একটা টিমকে শাফিনের পিছু ধরার অর্ডার দিয়ে দিয়েছে।

ইমতিয়াজ নিজেও শরীফের সাথে যোগাযোগ করে শাফিনের পিছু নিয়েছে। শরীফ জানিয়েছে শাফিন খুলনার পথেই যাচ্ছে এবং রিজভি তার সাথেই আছে। খুব সম্ভবত ওরা জমিদার বাড়িতেই যাবে।

আজকে সকালে নাহিদের কাছ থেকে শাফিনের বিজনেসের কাগজপত্র রিজভি নিয়ে নেয়ার কারণ ইমতিয়াজ এখন ভালোই বুঝতে পারছে।

এদিকে মৃত্তিকা চিন্তায় চিন্তায় পাগলপ্রায় হয়ে আছে। একবার ভাবছে সে ইমতিয়াজকে খুঁজতে যাবে, আরেকবার ভাবছে বাসায় দেলোয়ারাকে একা রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হবে কিনা।

ইমতিয়াজকে কল করেও উপায় হয় না। ফোন বাজলেও রিসিভ করছে না। অবশেষে সৌভাগ্য হলো, ইমতিয়াজ কলব্যাক করে।

“ইমতিয়াজ, কোথায় আছে? কোথায় আছেন আপনি? ঠিক আছেন? ডাক্তার দেখিয়েছেন? হাসপাতালে গিয়েছিলেন?”
একনাগাড়ে ছটফট করে প্রশ্ন করছে মৃত্তিকা।

ইমতিয়াজের শান্ত জবাব,
“আমি ঠিক আছি, একটু দূরে যাচ্ছি। আশা রাখতে পারো কালকের মধ্যেই ফিরে আসবো।”

“কোথায় যাচ্ছেন? শাফিনের খোঁজে যাচ্ছেন আপনি, তাই না? প্লিজ ফিরে আসুন।”

মৃত্তিকা কান্না করে দেয়। আজ আবারো সে অসহায় হয়ে গেছে।

“আমি যদি ফিরে না-ও আসি, তবুও তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আমাদের বেবির খেয়াল রেখো।”

মৃত্তিকা অবাক হয়।
“এভাবে কেন বলছেন?”

“হতে পারে শেষবারের মতো আমার সাথে কথা বলছো, হয়তো আজ রাতেই আমি চলে যাবো ওই ফেরারির কাছে। আর এই কন্ঠস্বরটা আমাকে শেষবারের মতো ডাকছে..”

ইমতিয়াজের কথার মাঝেই মৃত্তিকা কান্নাভরা কন্ঠে বলে,
“ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ চুপ, মৃত্তিকাও চুপ। দুজনের ওষ্ঠোধর কাঁপছে, কণ্ঠনালি বারবার ধ্বনি পাঠালেও তা কেউ উচ্চারণ করছে না। হঠাৎ করে কলটা কে°টে যায়।

কান থেকে ফোনটা সরিয়ে মৃত্তিকা নিজে নিজেই ভাবে,
“তাহমিনাকে এতোই ভালোবাসেন যে তার কাছে যাবার জন্য এতো তাড়া আপনার। আমাকে একটু ভালোবাসলে কি হতো?”

ইমতিয়াজ ফোনের স্ক্রিনে মৃত্তিকার ছবিটা দেখে সিটে হেলান দেয়। আকাশে নিভুনিভু তারার দিকে তাকিয়ে বলে,
“শাফিনকে না মা°রলে সে তোমাকে মে°রে ফেলবে মৃত্তিকা। ভুল বুঝো না আমাকে, আর কাউকে আমি হারাতে পারবো না।”

ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে। মৃত্তিকার লাজুক মুখখানা ভেসে উঠে, সেই হাসি যেন তার একদম সামনে। আবারো তার কাছে আসবে এক আবেদনময়ী হয়ে, আবারো চোখের ভাষায় বলবে, ‘আমাকে পাগল করে দাও’।
______________________________________

মধ্যরাতে খুলনা পৌঁছায় ইমতিয়াজ। বাস থেকে নেমে সিএনজি করে এসে পৌঁছায় জমিদার বাড়িতে৷

বাড়ির আশপাশটা শান্ত, নিরব। গা ছমছমে রহস্যময়তা ভেদ করে ইমতিয়াজ এগিয়ে চলে। বাড়ির পেছনদিকের দরজার কাছে গিয়ে সে কারো কথা বলার শব্দ শুনতে পায়। আবার সাথে দা-ব°টির টুংটাং শব্দ।

“আমার পি°স্তল কোথায়? এগুলো দিয়ে আমি কি করবো?”

কন্ঠটা শাফিনের। ইমতিয়াজ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।

এবারে রিজভির কন্ঠ পাওয়া যায়।
“পি°স্তলের গু°লি শেষ। তাছাড়া তোমাকে পি°স্তল দেয়া হবে না। তুমি বহু কুকীর্তি করেছো, আমি তোমাকে শুধুমাত্র বিজনেসের জন্যই বাঁচিয়েছি। এছাড়া তোমার সাথে আমার কোনো বোঝাপড়া নেই। (একটু থেমে) শরীফের থেকে বাঁচার জন্য আপাতত এই হাতি°য়ারই ব্যবহার করতে হবে।”

কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে শাফিন বলে,
“তবে কি এই বোঝাপড়ার পর আমাকে মে°রে দিবে?”

রিজভি হাসে। বলল,
“তোমার মতো কৃ°তঘ্ন আমি নই। প্রাণে বেঁচে যাবে।”

কিছুক্ষণের জন্য আবারো নিরবতা বিরাজ করে। তারপর শাফিন বলে,
“ঠিক আছে, আমি রাজি। এগুলো এখানে না রেখে অন্দরমহলে রাখো।”

“আমাকে আদেশ করো না শাফিন। নিজে নিয়ে রেখে দাও। আমি অনেক বড় রিস্ক নিয়েছি।”

ইমতিয়াজ হাত দিয়ে দরজায় আলতো করে ধা°ক্কা দিয়ে বুঝতে পারে দরজা বন্ধ। ভিতরে আবারো টুংটাং শব্দ শুরু হয়েছে।

রিজভি বলছে,
“সব শান দেয়া হয়েছে। অনেক ধা°রালো।”

“এটার ধার কম লাগছে, আমি একটু ধার করে আনি।”

“যা করার করো, তবে আগে আমার খাবারের ব্যবস্থা করো।”

শাফিন দরজা খুলে, ইমতিয়াজ দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। শাফিন বের হতেই পেছন থেকে দুহাতে ওর গলা শক্ত করে পেঁ°চিয়ে ধরে ভিতরে ছিটকে ফেলে।

রিজভি চমকে উঠে দরজার দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ ভিতরে এসে দেখে বড় বড় রাম°দা আর তার সাথে ত°লো°য়ার থরে থরে সাজানো। তার পাশে কয়েকটা লোহার পাইপ আর পিভিসি ভাঙাচোরা পাইপের সারি।

“তর°বারির যুদ্ধ লাগাবে নাকি?”
হাসতে হাসতে কথাটা বলে ইমতিয়াজ।

রিজভি কাঁপাকাঁপা হাতে তার পি°স্তলটা হাতে নিয়ে বলল,
“দেখো ইমতিয়াজ, বাঁচবে না তুমি। আমার লোকজন কিন্তু চলে আসবে।”

ইমতিয়াজ হাসে। বলে,
“গু°লিতে যে ছেলে ভ°য় পায় না, তাকে গু°লি ছাড়া খেলনাসম পি°স্তল দিয়ে ভ°য় দেখাও। হাউ ফানি।”

ইমতিয়াজ একটা লোহার পাইপ নিয়ে রিজভির হাতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আ°ঘাত করে। খুব দ্রুত ঘটনা হয়ে যাওয়ায় রিজভি পালানোর সুযোগ পায় না। প্রচন্ড ব্য°থায় চিৎকার করে রিজভি পি°স্তল ফেলে দেয়।

ইমতিয়াজ পাইপটা ছুঁড়ে ফেলে শাফিনের পা নিশানা করে৷ নিশানা লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছায়। শাফিনের পা এখনো ঠিক হয়নি, ক্ষ°তও পুরোপুরি শুকায়। কেবল পঁচন বন্ধ হয়ে শুকাতে শুরু করেছে। এখন এতোবড় একটা আ°ঘাত পেয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়, সাথে গো°ঙা°তে থাকে।

ইমতিয়াজ দ্রুত গতিতে ত°লো°য়ার হাতে তুলে নেয়। রিজভি এবারে পালাতে নিলে দৌড়ে গিয়ে ওর ডানহাতে এক কো°প বসায়, একবারই যথেষ্ট হয়েছে ওর হাতের কবজি আলাদা হতে।

রিজভির গগনবিদারী চিৎকার অবহেলা করে ইমতিয়াজ বলে,
“ত°লো°য়ারটা বেশি ধা°রা°লো করে ফেলেছো?”

শাফিন এবারে ভ°য় পেতে শুরু করে৷ তাহমিনাকে খু°নের সময় সে ভ°য় পায়নি, ভ°য় পায়নি একা বাসায় মৃত্তিকার উপর হা°মলা করতে, সে ভ°য় পায়নি ইমতিয়াজকে খু°নের চেষ্টা করতে। তবে আজ পাচ্ছে কেন?

ইমতিয়াজ যে আজ নেকড়ের রূপ ধারণ করেছে। নেকড়ে যেভাবে শি°কারের দিকে ধেয়ে আসে, ইমতিয়াজও খোলা তর°বারি হাতে এগিয়ে আসে। পিছনে চিৎকার করছে রিজভি। তার কা°টা হাত তারই সামনে পড়ে আছে।

শাফিন পায়ের জন্য উঠতেও পারছে না। তারউপর সে বামচোখে দেখে না, ওখানে একটা পট্টি বাঁধা আছে।

শাফিনে গড়িয়ে সরে গিয়ে ইমতিয়াজকে বলে,
“ইমতিয়াজ, তুমি আমাকে খু°ন করে জেলে যাবে, মৃত্তিকার কি হবে ভাবো তো? তোমার সন্তানের কি হবে?”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে,
“আমি ভাবছি না ওসব নিয়ে।”

শাফিনের ডানহাত টেনে কভার খুলে ফেলে ইমতিয়াজ। ক্ষ°ত জায়গায় তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয় সে। শাফিন চিৎকার করে বলে,
“ইমতিয়াজ, মে°রো না আমাকে।”

“ইমতিয়াজ ডাক শোনার খুব শখ হয়েছিল না তোমার?”
ত°লো°য়ারটা ঘুরাতে থাকে ইমতিয়াজ।

“হ্যাঁ হয়েছিল। তাহমিনার চিৎকার আমার ভালো লেগেছিল, তাই তো মৃত্তিকার থেকেও একই চিৎকার শুনতে চেয়েছিলাম।”

ইমতিয়াজ ত°লো°য়ার উঠিয়ে ছুঁড়ে ফেলে শাফিনের নাকেমুখে ঘু°ষি দিতে শুরু করে। শাফিনকে তুলে ওর মাথা নিয়ে দেয়ালের সাথে পর পর কয়েকবার আছড়ে ফেলে সে ক্ষান্ত হয়।

ইমতিয়াজ সরে আসে। এতো অত্যাচারে শাফিন আর চোখ খুলে তাকাতেও পারছে না। পুরোনো ব্য°থার সাথে নতুন করে আরো কিছু যুক্ত হয়েছে।

শাফিন মাটিতে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে,
“বাঁচতে দাও আমাকে।”

“আমার নিষ্পাপ সন্তানটাও এটা বলেছিল, আমার মিনা এটাই বলেছিল।”
ছন্নছাড়া ইমতিয়াজের এগোছালো জবাব।

এমনসময় বাইরে চারটা গু°লির শব্দ হয়। ইমতিয়াজ চমকে দরজা বন্ধ করতে গেলে শরীফ এসে ভিতরে ঢুকে। রিজভির দুজন লোককে মাত্রই গু°লি করে হ°ত্যা করেছে সে।

ভিতরের অবস্থা দেখে শরীফ থমকে যায়।
“এ কি করেছো, ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ আবারো গিয়ে ত°লো°য়ারটা তুলে বলল,
“শাফিনকে আমি নিজ হাতে মা°রবো। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেও আবার পুরোনো সিদ্ধান্তে ফিরে যাচ্ছি।”

“এমন করো না..”

শরীফ কথার মাঝেই ইমতিয়াজ বলে,
“কেন? মৃত্তিকার কথা ভাবছেন? আমিও ওর কথাই ভাবছি, ওর কথা ভেবেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

রিজভি জ্ঞান হারাবে হারাবে ভাব। সে আর স্থির থাকতে পারছে না। চোখ তার নিভুনিভু, হাতের র°ক্তে সে মাখোমাখো হয়ে গেছে।

শরীফ তার কষ্ট আর বাড়ায় না। সোজা গু°লি করে তার বুকে, একটা গু°লিতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

ইমতিয়াজ একবার তাকায় রিজভির প্রাণহীন দেহের দিকে। বলে,
“এতো সহজভাবে শাফিন ম°রতে পারে না।”

“মৃ°ত্যুতে সহজ বলে কিছু নেই, মৃ°ত্যুর য°ন্ত্রণা কঠিনই হয়।”

ইমতিয়াজ শাফিনকে টে°নে তুলে। তড়িৎগতিতে ইমতিয়াজকে ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে ওর হাতের তলোয়ার নিয়ে শাফিনের গলায় ঢুকিয়ে দেয় শরীফ।

গলার মাঝ বরাবর ঢুকে তা পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফি°ন°কি দিয়ে র°ক্ত বেরিয়ে এসে শরীফকে ভিজিয়ে দেয়। তাৎক্ষণিক এমন ঘটনায় ইমতিয়াজ নিজেও হতবাক।

শরীফ ত°লো°য়ারটা ঘুরাতে শুরু করে। একবার ঘুরিয়ে একটা°নে বের করে নিয়ে আসে। শাফিন মাটিতে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ শান্ত থেকে আবারো কেঁপে উঠলো, দুইপা একসাথে নড়ে উঠে, দুইহাত নড়তে নিয়ে থেমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে র°ক্ত বেরিয়ে আসে গলার ছিদ্রপথে, নাকমুখ দিয়ে। র°ক্তের সাথে ‘কু’ ধরনের চিকন একটা শব্দ বের হয়।

শব্দের বেগ ধীরে ধীরে কমে, শাফিন হাত হয়। হাতপা ছেড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। চোখ একটা তো চিরকালের মতো অন্ধ করেছিল আহনাফ, অন্যটা এখনো খোলা রয়েছে।

এতোদিনের ফে°ত°নার মৃ°ত্যু হয়েছে। অবশ্যই মৃ°ত্যু°য°ন্ত্রণা কঠিন, চরম কঠিন।

‘মৃ°ত্যু°য°ন্ত্রণা সত্যই আসবে। এটা হতে তোমরা অব্যাহতি চেয়ে এসেছ।’ (সুরা কাফ, আয়াত : ১৯)

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অন্তিম পর্ব (শেষাংশ)

ইমতিয়াজ ও শরীফ দুজনকেই গ্রে°ফ°তার করেছে পিবিআই। যদিও গ্রে°ফ°তার কথাটা এখানে ভুল, ওরা নিজে থেকেই ধরা দিয়েছে।

ঢাকায় নিয়ে আসার পর মৃত্তিকা খোঁজ পায় ওদের। সারারাত পাগলের মতো ছটফট করছিল সে, বিশেষ করে ইমতিয়াজকে ফোনে না পেয়ে সে আরো চিন্তিত ছিল। দুপুরে খবরটা পেয়েই ছুটে এসেছে।

ইমতিয়াজ একটু দূর থেকে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। দুহাতে হাত°কড়া লাগানো অবস্থায় একটা মানুষ কিভাবে হাসতে পারে? শরীফ পাশে নির্বিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আশেপাশে ওদেরকে ঘিরে রেখে সাংবাদিক আর টিভি ক্যামেরা, একের পর এক ছবি তুলছে আর ব্রেকিং নিউজ প্রকাশ করছে।

পাশের লা°শবাহী গাড়িতে শাফিন, রিজভিসহ তাদের লোকজনের দেহ। শাফিনের লা°শ যে দেখেছে সেই ভ°য় পেয়েছে।

ভীড় ঠেলে এগিয়ে যায় মৃত্তিকা। পুলিশ সদস্যদের বাধা কা°টিয়ে ইমতিয়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

“আপনি না বলেছিলেন নিজের সন্তানকে খু°নির সন্তান হতে দিবেন না? তবে এটা কেন করলেন ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ ওর চোখে চোখ রাখে না। অন্যদিকে তাকিয়ে বেশ শান্তভাবে জবাব দেয়,
“তার মা তাকে ভালো রাখবে।”

মৃত্তিকার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ঠিক যে কারণে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, আজ ইমতিয়াজই তাই করে বসেছে।

শরীফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাবা, আমার সাথে থাকতে তোমার কখনোই ইচ্ছা হয়নি?”

শরীফ উত্তর দেয় না। মৃত্তিকা অস্ফুটস্বরে বলল,
“বাবা?”

আবারো ইমতিয়াজের দিকে তাকায় সে। ইমতিয়াজ সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চলে যাও এখান থেকে। সাংবাদিকদের তো°পে তুমি পড়ো না।”

“আমাকে ভালোবাসলে কি খুব অপ°রাধ হতো ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ তাকায় ওর দিকে, এবারে দুজনে চোখে চোখ রাখে। মৃত্তিকার লাল দুইচোখ দেখে ইমতিয়াজের কষ্টের পাল্লা ভারি হয়।

কিছু বলতে নিলে মৃত্তিকা ওকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। ইমতিয়াজ চমকে উঠে, আশেপাশের ক্যামেরায় ছবি তোলার গতি বাড়ে।

দুজন মহিলা কন্সটেবল কাছে আসতে নিলে ইমতিয়াজ বলে,
“প্লিজ, একটু সময় দিন।”

অনুরোধ রাখে, কিন্তু মৃত্তিকাকে সরানো যায় না। ওর চোখের জলে ইমতিয়াজের শার্টের বুকের ডানপাশের অংশটা ভিজে গেছে, বারে বারে হিঁ°চকি দিচ্ছে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ চুপ করে আছে, শান্ত তার দৃষ্টি।

কাঁদতে কাঁদতে একসময় ক্লান্ত মৃত্তিকা জ্ঞান হারায়। ইমতিয়াজের দুহাত সামনের দিকে এনে আটকে রাখা ছিল, সে দুহাত একসাথে মৃত্তিকার মাথা উপর দিয়ে নিয়ে ওর পিঠের দিকে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“মৃত্তিকা আমার, মৃত্তিকা।”

ওই দুজন কন্সটেবল আসলে ইমতিয়াজ অসহায় কন্ঠে বলল,
“ও প্রেগন্যান্ট, প্লিজ ওকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। প্লিজ।”

আবারো সে মৃত্তিকার দিকে তাকায়। ওর শরীরের সাথে মিশে আছে মেয়েটা। ইমতিয়াজের গালের সাথে ওর কপাল লেগে আছে।

ইমতিয়াজ ওর কপালে চুম্বন করে, একটু নিচু হয়ে ওর ওষ্ঠপুটেও চুম্বন করে। নিজের গাল ওর ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলে,
“মৃত্তিকা, কেন এতো করে চাইছো আমাকে? নিজেকে কেন শেষ করছো?”

জোরপূর্বক ইমতিয়াজের থেকে মৃত্তিকাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। ইমতিয়াজের চেহারায় অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। এই লোকগুলোর মধ্যে আবারো যদি কোনো পশুর উদয় হয়, কিভাবে মৃত্তিকাকে রক্ষা করবে ইমতিয়াজ?

ভীড়ের মাঝে মৃত্তিকার সাথে একটা পরিচিত চেহারা দেখে ইমতিয়াজ। মানুষটা তানজিম। মৃত্তিকাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠে হাত নাড়ে সে।

“অপ°রাধ হতো বলেই হয়তো তুমি আমি এক হইনি।”
ইমতিয়াজের বুক চি°ড়ে দীর্ঘশ্বাসের সাথে কথা বের হয়।
______________________________________

আব্বাস সাহেব ঢাকায় এসেছেন। সাথে এনেছেন নাতির জন্য অনেক রকমের খেলনা। আহনাফ তো একটা দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আছে। হাসপাতালের এ কাগজ, ও কাগজ নিয়ে তাড়াহুড়ো করছে সে।

টাকা জমা দিতে গিয়ে পাশে চলতে থাকা টিভিতে সে ইমতিয়াজ-মৃত্তিকাকে দেখে। সাথে চলছে রঙঢঙ মেশানো এক হেডলাইন।

টাকা জমা দিয়ে রিসিট জাহাঙ্গীর সাহেবের হাতে দিয়েই সে ছুটেছে থানার উদ্দেশ্যে৷ কাল থেকে ওর অগোচরে এতো ঘটনা ঘটে গেছে, অথচ সে টেরই পেল না।

থানায় সে কারো সাথে কথা বলতে পারে না। তাই তানজিমের সাথে যোগাযোগ করে মৃত্তিকাকে দেখতে ক্লিনিকে আসে।

মৃত্তিকার জ্ঞান ফিরেছে, তবে চুপচাপ বসে আছে সে। ইমতিয়াজের এমন কান্ড সে এখনো মেনে নিতে পারছে না।

তানজিম আহনাফকে বলে,
“সকালে আমি খবরটা পেয়েছি। শাফিন মা°রা গেছে আর রিজভিও। শরীফ আংকেল বলছে উনিই মে°রেছেন, তবে সহযোগী সন্দেহে ইমতিয়াজ ভাইয়াকে গ্রে°ফ°তার করেছে।”

আহনাফ চুপ করে যায়। মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে দেখে অনুভূতিহীন একটা মানবী নিরবে তাকিয়ে আছে সাদা টাইলসের মেঝেতে।
______________________________________

একদিন, দুইদিন করে সপ্তাহ পার হয়। আজ সাদাবের আকিকা। কুমিল্লায় আহনাফের বাসায় বেশ রমরমা আয়োজন। একমাত্র ছেলের আকিকা উপলক্ষ্যে হাঁটের বড়বড় দুই খাসি কিনে এনেছে আহনাফ।

সামিহা তো সারাদিন সাদাবকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছে। সাদাবকে খাওয়ানো ছাড়া সারাহ্-র আর কোনো কাজ নেই, বাকি সব সামিহাই দেখে।

রান্নার দিকটা দেখে আহনাফ রুমে আসে। সারাহ্ শাড়ি পড়ছে। আঁচল বেশি রাখায় তা ফ্লোর স্পর্শ করছে।

আহনাফ কাছে এসে আঁচলটা তুলে হাতে দিয়ে বলল,
“আঁচল তো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।”

“আঁচল ধরার মানুষ থাকলে মাঝে মাঝে লুটোপুটি খাওয়া ভালো।”

“কে ধরবে? আমি? অসম্ভব, আমি কোনো নারীর আঁচল ধরতে রাজি নই।”

সারাহ্ হেসে দেয়। গলায় নেকলেস পড়তে শুরু করলে আহনাফ বলে,
“মনে হচ্ছে বিয়ে করবে। অবশ্য আমি রাজি, বাসর করার ফিলিংসও এখনো আছে। প্রথম বাসর তো করা হয়নি, এখন করতেই পারি।”

সারাহ্ ফিরে দাঁড়িয়ে বলে,
“এই আপনার লজ্জা নেই, সভ্য হবেন না কোনোদিন?”

আহনাফ হেসে ওর কাছে এসে বলল,
“এভাবে কথা বলো না, আমার রাগ হয়।”

আহনাফ নিচু হতে নিলে সারাহ্ ওকে বাধা দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আহনাফও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সাদাবকে পেয়ে সাইদার পাপাকে ভুললে চলবে না। আমার কিন্তু সাইদাও চাই।”

সারাহ্ ফিসফিসিয়ে উঠে,
“তবে আরো রাগ করুন, বারেবারে রাগ করতে থাকুন।”

হঠাৎ করেই বাইরে শোরগোল শুরু হয়। দুজনে চমকে দুদিকে সরে যায়। আহনাফ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে দেখে, তানজিমকে আসতে দেখেই নার্গিস পারভিন রেগে গেছেন।

“মা, আমি ওকে ইনভাইট করেছি। তানজিম এসো।”

আহনাফের কথায় নার্গিস পারভিন শান্ত হয়ে যায়। চুপ করে চলে যায় নিজের কাজে। সামিহা সাদাবকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ দিয়ে টুপটুপ করে জল পড়ছে।

আহনাফ একবার সামিহার দিকে তাকিয়ে আবারো তাকায় তানজিমের দিকে। তানজিম যে জ°ঘ°ন্যরকম অপমানিত হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে।

“তানজিম, সাদাবকে আজও দেখবে না?”

আহনাফের কথায় তানজিম নির্জীব হয়ে তাকিয়ে বলল,
“থাক ভাইয়া, আজ না। এই খু°নি র°ক্ত ওকে স্পর্শ না করলেই বোধহয় ভালো হবে।”

তানজিম বের হয়ে যায়। সামিহার ইচ্ছে করছিলো ওকে আটকাতে, কিন্তু সে আটকায় না। সে দ্রুত পায়ে সারাহ্-র কোলে সাদাবকে দিয়ে ভিতরে চলে যায়।
______________________________________

মৃত্তিকা নিজের রুমে বসে আছে। এই কয়েকদিন তার খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই, আর না নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি কোনো খেয়াল আছে।

রাইদ এক মাকে হারিয়ে আরেকটা মা পেয়েছিল আর সেও এখন তার থেকে দূরে থাকে। কোনোরকমে ওকে খাইয়ে দিয়ে মৃত্তিকা আবারো দূরে বসে থাকে।

দেলোয়ারা ওর এমন অবস্থা খেয়াল করছে। খাবার নিয়ে মাঝেমধ্যেই জোর করে খাইয়ে দেয়। এছাড়া কোনো উপায় নেই, ওকে শত বললেও ও নিজের থেকে খাবে না।

সময় মৃত্তিকার এভাবেই কাটে, বেশ অনেকদিন পার হয়। সাড়ে পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা এখন মৃত্তিকা। ওর মধ্যে সময়ের প্রতিচ্ছবি ভালোই ফুটেছে।

কোর্ট থেকে আজ রায় দেয়ার কথা। সবাই সেটা নিয়েই ব্যস্ত, শুধু ব্যস্ততা নেই মৃত্তিকার মধ্যে। তার ইমতিয়াজ যে তাকে ভালোবাসে না। সে টিভি দেখেনি, খোঁজও পায়নি যে ইমতিয়াজ ছাড়া পেয়েছে।

শরীফের জন্য আবারো শুনানি হবে আর ইমতিয়াজ খা°লাশ পেয়ে গেছে। বিষয়টা এমন হয়েছিল যে নাহিদের টিম সেখানে গিয়ে দুজনকে একসাথে পেলেও শরীফকেই মূলত শাফিনকে মা°রতে দেখেছে। তাছাড়া যেহেতু এর আগে নাহিদের সাথে ইমতিয়াজের যোগাযোগ ছিল, তাই পিবিআইয়ের অনেকেই তার পক্ষে কথা বলেছে। সাক্ষী মজবুত হওয়ায় আর যুক্তিযুক্ত প্রমাণ না পাওয়ায় সে ছাড়া পেয়ে যায়।

আজ আবার এটাও জানিয়েছে আগামীকাল মমতাজ বেগমের ফাঁ°সি হবে। শারমিলির খু°ন ও বাকি তিন খু°নের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সুরভির জন্য সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।

সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে সন্ধ্যায় ইমতিয়াজ বাসায় পৌঁছায়। দেলোয়ারা দরজা খুলে ওকে দেখে মলিন মুখে হাসে। ইমতিয়াজ উনাকে সালাম দিয়ে বাসায় প্রবেশ করে।

“মৃত্তিকা কোথায়?”

ইমতিয়াজের প্রশ্নে দেলোয়ারা চিন্তিত হয়ে জবাব দেয়,
“সে রুমে, তুমি যাও।”

ইমতিয়াজ ধীর পায়ে রুমে এসে দরজা খুলে। হালকা শব্দ হয়। বিছানায় হেলান দিয়ে মৃত্তিকা বসে আছে। ওকে দেখে হা করে তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজও ওকে দেখে। চোখের নিচে কালি পড়েছে, গালমুখ ফুলে আছে। সাহসী, শান্ত মেয়েটার মন যে বড় ভীতু আর অশান্ত হয়ে উঠেছে।

ইমতিয়াজ দরজা লাগিয়ে ওর সামনে এসে বসে। মৃত্তিকা বলে,
“চলে যাওয়ার জন্য বারবার কেন আসেন?”

“চলে যেতে আমি আসিনি, মৃত্তিকা।”

মৃত্তিকা এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ এমন ধা°ক্কায় ইমতিয়াজ বিছানায় শুয়ে পড়ে। মৃত্তিকা ছাড়ে না, দুহাতে জোর করে ধরে রেখেছে। ইমতিয়াজ ওকে খুব আলতো করে ধরে রাখে৷ থেমে থেমে ফুঁপিয়ে উঠছে মৃত্তিকা।

বামহাতটা মেলে দিয়ে ইমতিয়াজ ওর মাথাটা হাতের উপর রেখে বলল,
“শান্ত হও, আমিই এসেছি।”

মৃত্তিকা ওর গালে হাত দেয়। একটা ঢোক গিলে বলল,
“বাবা কবে আসবে?”

ইমতিয়াজ ওর গালের সাথে নিজের গাল ঘ°ষে বলল,
“আসবে, খুব তাড়াতাড়ি আসবে।”

“মি°থ্যা বলছেন, তাই না? বাবাকে ওরা ছাড়বে না।”

ইমতিয়াজ চেয়ে থাকে। ওর দৃষ্টিতেই মৃত্তিকা বুঝে যায় তার বাবা আসবে না। ইমতিয়াজ চোখ সরিয়ে উঠে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওকে কাছে টে°নে আনে।

“চলে যেতে আসেননি তো চলে কেন যাচ্ছেন?”
______________________________________

পরদিন সকালে, মমতাজ বেগমের ফাঁ°সি আজ কার্যকর হয়েছে। উনার লা°শ গ্রহণ করতে এসেছে মৃত্তিকা, ইমতিয়াজ, তানজিম। লুৎফর রহমান আসেননি, উনি আসবেন না।

মমতাজ বেগমের সাথে শেষবার দেখায় শুধু বলেছিলেন,
“শারমিলির প্রতি আমার ভালোবাসা দেখে হিং°সা করেছো, অথচ তোমাকে কত ভালোবেসেছিলাম তা কখনো বুঝোনি। হিং°সা তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে মমতা। তুমি আমাকে বুঝতেই চাওনি।”

লা°শ বের করে আনা হলো। তানজিম সরে যায়, মায়ের লা°শ দেখার ক্ষমতা তার নেই। মৃত্তিকা কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে চিৎকার করে কান্না করে দেয়। বড্ড বেশি ভালোবাসতো সে তার বড়মণিকে। বড়মণির এই নি°কৃষ্ট কর্ম আজও তার বিশ্বাসের বাইরে।

ইমতিয়াজ ওকে জড়িয়ে ধরে, তার কান্না থামে না। ইমতিয়াজের বুকে মাথা রেখে ক্রমাগত কাঁদছে মৃত্তিকা।

তানজিম একটু দূরে থম মে°রে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে তারই মায়ের মৃ°তদেহ। চোখের পানি আজ একফোঁটাও গড়িয়ে পড়ছে না। থেমে থেমে সে ঢোক গিলছে, তার শরীর কেঁপে উঠছে।
______________________________________

চারমাস পর,
“তানজিম যেন এই বাসায় আর না আসে। তোমার আশেপাশেও ওকে আমি দেখতে চাই না।”

সামিহা চুপ করে আছে। আজ ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় তানজিম ওকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। আর তখনই ওদেরকে একসাথে দেখে নার্গিস পারভিন।

“আম্মু, সবাই একরকম হয় না। তানজিমের মামা আর মা খারাপ ছিল বলে, সেও খারাপ হবে- এটা কেমন যুক্তি?”

নার্গিস পারভিন কিছু না বলে চলে যায়। সামিহা মায়ের দিকে চলে যাওয়া দেখে। তানজিমের জন্য ওর যে অনুভূতিটা আছে তা সে না তানজিমকে বলতে পারছে আর না নিজের মাকে। বলছে না বলে কি কেউ বুঝতেও পারছে না?

সামিহা রুমে এসে সারাহ্-কে কল দেয়। সাদাবকে নিয়ের সমস্তদিন সারাহ্-র ব্যস্ততা। এখনো এই কাজই করছে। সারাদিনে সাদাবের নোংরা করা কাপড় ধুয়ে বারান্দায় ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত সে।

সামিহার নাম্বার দেখে রিসিভ করে,
“হ্যাঁ সামিহা, বল।”

সামিহার কন্ঠ কাঁপছে। ভা°ঙা ভা°ঙা গলায় বলে,
“আপু, তানজিমকে আমি ছাড়তে পারবো না।”

সারাহ্ নিজের কাজকর্ম থামিয়ে দেয়। কপাল কুঁচকে বলে,
“হঠাৎ এই কথা?”
“আম্মু ওকে পছন্দ করে না।”

সারাহ্ চুপ করে থাকে। আহনাফ মাত্রই কলেজ থেকে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে ছেলের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত সে। সারাহ্ সেদিকে তাকিয়ে “রাখছি” বলে কল কে°টে দেয়।

সারাহ্ মলিন মুখ করে রুমে আসে। ফোন পাশে রেখে চুপচাপ বসে থাকে।

“ঐশী? কি হয়েছে?”

সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আম্মু আবারো তানজিমের বিষয়টা নিয়ে সামিহার সাথে বাড়াবাড়ি করেছে।”

আহনাফ শোয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে বলল,
“সামিহা আর তানজিমের সম্পর্ক গভীর হয়েছে, ঐশী। চাইলেই ওদের আলাদা করতে পারবে না।”

“আমি চাইছিও না, কিন্তু আম্মু বারবার কেন শাফিনের কথা বলে তানজিমকে অপমান করছে?”

“শাফিনের সাথে উনার স্মৃতি খারাপ। এরকমটা হওয়া স্বাভাবিক। তবে উনি বুঝদার মানুষ, আমি বুঝিয়ে বলবো সবটা।”

সারাহ্ আলতো করে মাথা নাড়ে। কিছুক্ষণ আহনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে ওকে তাড়া দিয়ে বলল,
“খেয়ে নিবেন চলুন।”
______________________________________

আগামীকাল মৃত্তিকার ডেলিভারির তারিখ দিয়েছে আর আজ শরীফের চূড়ান্ত রায় হবে। সকলের চোখে এখন শরীফ খু°নি, শরীফও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়নি।

আজ বাবার সাথে দেখা করতে এসেছে মৃত্তিকা। বাবার কাছে গিয়ে নিরবে দাঁড়ায় মৃত্তিকা। কিছুক্ষণ পরই শরীফকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে।

লোহার বে°ড়াজালে আঙ্গুল দিয়ে বাবার হাতে স্পর্শ করে মৃত্তিকা।

“বাবা, তোমার মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিও। কোনোদিন তোমাকে বুঝিনি আমি।”

সবাই ধরে নিয়েছে শরীফের ফাঁ°সি হবে। সে তো খু°ন কম করেনি, অনেকগুলো মানুষকে সে মে°রেছে। কেন মে°রেছে তা তো বহু কথা, কিন্তু মে°রেছে সেটাই আসল।

শরীফ মেয়ের আঙ্গুলে চুমো দেয়। বলে,
“নাতি-নাতনিকে কোলে নেয়ার সৌভাগ্য এই অভাগার হয়নি রে মা। তোমার জীবনের সুখ শান্তি আমি কে°ড়ে নিয়েছি, ক্ষমা তো তুমি আমাকে করবে।”

“বাবা..”

মৃত্তিকা আর কিছু বলতে পারে না। অনবরত কাঁদতে থাকে। ইমতিয়াজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে এগিয়ে আসে।

শরীফ মৃত্তিকাকে নিয়ে যেতে ইশারা করে। ইমতিয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কি করবে সে? উপায় কি আছে এছাড়া?

হঠাৎ মৃত্তিকা ব্য°থায় চিৎকার করে উঠে। হয়তো সময় হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।

“ইমতিয়াজ আমাকে ছেড়ে দিয়ে যাবেন না, থাকেন আমার সাথে।”

“কোথাও যাচ্ছি না আমি, আছি তোমার পাশে।”

যাচ্ছি না বলেও লেবাররুমে ওকে রেখেই বাইরে আসতে হয় ইমতিয়াজের। ওর চিৎকার সহ্য করার ক্ষমতা ইমতিয়াজের নেই।

পৃথিবীতে নতুন একটা মুখ আসলো। কাঁদতে কাঁদতে প্রচুর আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলো পৃথিবীর আলো। কন্যা সন্তান এসেছে, দুজনের এতোদিনের অপেক্ষার সমাপ্তি হয়েছে।

ইমতিয়াজ নিজেই মেয়ের কানে আযান দেয়। মেয়ের কপালে চুমো খায়। মেয়েকে কোলে নিয়ে মৃত্তিকার প্রথম কথা,
“বাবার সাথে ওর দেখা করাতে পারবেন? বাবা ওকে দেখবে।”

মৃত্তিকা সঙ্গে সঙ্গেই কান্না করে দেয়। ইমতিয়াজ ঘড়িতে দেখে সময় দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন এমন সদ্য জন্ম নেয়া নবজাতককে নিয়ে বের হওয়াও মুসকিল।

তবুও ইমতিয়াজ ঝুঁ°কি নেয়। মৃত্তিকাকে রেখে যেতে চাইলেও সে রাজি হয় না। ইমতিয়াজের সাথে যাওয়ার জন্য জে°দ ধরে। ওর জে°দের কাছে ইমতিয়াজ বরাবরের মতো এবারেও পরাজিত হয়।

ফোনযোগে জানতে পারে শরীফের ফাঁ°সির রায় হয়নি, যাবজ্জীবন কা°রা°দণ্ড হয়েছে। বিশেষ বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

জেলে এসে শরীফের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়। তবে শরীফ নাতনিকে কোলে নিতে পারেনা। দূর থেকে চেয়ে দেখে। এইতো ওই মিউকো, রিপার আদরের মৃত্তিকা।

বিদায়ের সময় শরীফের বলা কথাটায় মৃত্তিকার কান্নার রেশ আবারো আসে,
“আমি তোমার মামের কাছে যেতে চাইছিলাম মিউকো, ক্ষমা চাইতাম তার কাছে। তোমার মাম কি এখনো রেগে আছে আমার উপর? তুমি বলে দিও যেন এই অধমের উপর রেগে না থাকে।”

শরীফের কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে ছোট্ট মৃত্তিকার সাথে কথা বলছে সে। দুর্বল মৃত্তিকা ইমতিয়াজের শরীরের উপর ঢলে পড়ে৷ ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে।
______________________________________

বিরামহীন সময়ে বিরাম পড়বে না, এটা তো সর্বদাই সত্য। এবারেও তাই হলো, তিনবছর পেরিয়ে গেল।

অবশেষে আহনাফের এতোদিনের চেষ্টায় সামিহা-তানজিমের বিয়েতে রাজি হয়েছে নার্গিস পারভিন। একটা অসম্ভবকে সে সম্ভব করেছে।

পুরো বাড়িতে রমরমা পরিবেশ৷ আত্নীয়স্বজন, প্রতিবেশীতে একদম হইহই করছে। এরমধ্যে সাদাবকে সামলে রাখা বেশ কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজও তাকে সামিহাই শান্ত করে নিজের পাশে বসিয়ে রেখেছে। পার্লার থেকে সাজগোজ করে এসে সে এখন অপেক্ষা করছে তার তানজিমের জন্য।

সারাহ্ তো সাইদাকে নিয়ে ভারি ব্যস্ত, মেয়েটা কিছুতেই ঘুমাচ্ছে না। বয়স কত হলো মেয়ের? মাত্রই সাতমাসে পড়েছে।

বর্তমানে দেশে থাকায়, জাহাঙ্গীর সাহেবের দাওয়াত রক্ষা করতে ওদের বাসায় এসেছে আফরোজা-জুহাইব, সাথে ওদের ছেলে জাবের আবরারও এসেছে।

বাবার মতো টার্কিশ চেহারা হয়েছে আবরারের। সাদাবের সাথে বনিবনাও ভালো। দুজনে বেশ আনন্দে খেলতে শুরু করে।

বরপক্ষের লোক হিসেবে লোকজন খুবই কম। তানজিমের বাবা লুৎফর রহমান, ওর চাচা আর ইমতিয়াজ, মৃত্তিকা এসেছে।

ইমতিয়াজ, মৃত্তিকার দুই মেয়ে আর রাইদও এসেছে। বড়মেয়ে সৈয়দ মেহরিবা মেহজাবিন আর ছোট মেয়ে সৈয়দ বারাকাহ্ মেহজাবিন, বারাকাহ্ এবারে একমাসে পড়লো।

সাদাব, আবরারের প্রায় সমবয়সী হওয়ায় মেহরিবা ও রাইদ ওদের সাথে মিশে যায়।

কোনোরকম ঝা°মেলা ছাড়াই নিরিবিলিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যায়। সামিহা ঘোমটার আড়াল থেকে তানজিমকে ঠিকই দেখে।

তানজিমের কানের কাছে গিয়ে বলল,
“বিয়ের দিন বরকে এমন বেকুব বেকুব লাগে কেন রে?”

তানজিমও ফিসফিস করে বলে,
“বেকুবের বর চালাক হলেও দেখতে বেকুবই লাগে।”

সামিহা মুখ ভেংচায়। সাদাব এসে আবারো ওর কোল দখল করে ফেলে। সাদাবের সাথে মেহরিবা আসে। সামিহা দুজনকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে আবরার আর রাইদকেও ডাকে।

“বাচ্চারা তোমাকে এতো পছন্দ করে কেন?”
মৃত্তিকা হাসিমুখে কথাটা বলল।

সামিহাও হাসে। বলে,
“ওরা বোধহয় আমাকে ওদের বয়সীই ভাবে।”

তানজিম পাশ থেকে বলে,
“ওদের ভাবনা সঠিক।”
______________________________________

চারদিন পর, মৃত্তিকা-ইমতিয়াজ পরিবারসহ ইতালি যাবে। মৃত্তিকার বিক্রি করে দেয়া রিপা বেগমের সেই বাড়িটি ইমতিয়াজ পুনরায় কিনে নিয়েছে। সেখানে কিছুদিন থাকার জন্যই ইতালি যাবে ওরা।

আজ সামিহার সাথে মৃত্তিকা এসেছে একটা বৃদ্ধাশ্রমে, মেহরিবাও এসেছে ওদের সাথে। এখানে আজ খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেছে মৃত্তিকা।

মেহরিবা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাকে দেখছে তাকেই নানু, দাদু ডাকছে। সামিহা ওকে খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখে শতবর্ষী এক বৃদ্ধার কাছে মেহরিবা দাঁড়িয়ে আছে।

“মেহরিবা আসো, মিউকো আপু ডাকছে তোমাকে।”

সামিহার ডাকে মেহরিবা শান্তভাবে বলে,
“থাকি কিছুক্ষণ।”

বৃদ্ধা মহিলাটি চমকে উঠে হাতড়ে হাতড়ে মেহরিবাকে টে°নে ধরে বলল,
“তুমি মেহরিবা, সেই মেহরিবা না তুমি? রাহার মা তুমি?”

মেহরিবা ভয় পেয়ে কান্না করে দেয়। সামিহা এসে ওকে সরিয়ে নিতে চায়। বৃদ্ধা জোর করে ধরে রাখে ওকে। ব্য°থা পাবে ভেবে সামিহা টা°না°টা°নি করে না।

মৃত্তিকা এসে এ অবস্থা দেখে বৃদ্ধাকে বলল,
“দাদুমণি, ও আমার মেয়ে, মেহরিবা। আপনি কার কথা বলছেন?”

বৃদ্ধা হাত আলগা করে বলে,
“সেই মেহরিবা, আমার সন্তানকে বাঁচিয়েছিল যে, আমাকে যে বাঁচিয়েছিল। রাহার মা মেহরিবা।”

বৃদ্ধা কাঁদতে শুরু করে। বৃদ্ধাশ্রমের একজন স্বেচ্ছাসেবী বলে,
“উনি সারাদিন এই দুইটা নামই জপতে থাকেন। মেহরিবা আর রাহা। নিজেকে সবসময় পা°পী জোসনা বলে।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে ফেলে। বলে,
“আপনি কে? জোসনা?”

বৃদ্ধা কাঁপা হাতে মৃত্তিকাকে ধরে বলে,
“আমি জোসনা, পা°পী জোসনা।”

মৃত্তিকা বুঝতে পেরেছে কে এই জোসনা। মমতাজ, শাফিনের মা। যাকে মমতাজ বেগম জীবিত অবস্থায় এতো খুঁজেছে, অথচ খুঁজে পায়নি। ভেবেছি মা°রা গেছে, অথচ আল্লাহ্ তার ম°রণ এতো তাড়াতাড়ি রাখেনি।
______________________________________

তাহসিনার কবর জিয়ারত করে আহনাফ। একটু দূরে সারাহ্ও দাঁড়িয়ে আছে। আজ ওরা আবারো কুমিল্লা ফিরে যাবে।

আহনাফ সারাহ্-র আড়ালে চোখের পানি মুছলেও সারাহ্ তা খেয়াল করে, যদিও সে কিছুই বলে না।

বাইরে রাখা গাড়িতে উঠে বসে ওরা। আহনাফ নিজেই গাড়ি কিনেছে, ওর শখ পূরণ করেছে। গাড়ি স্টার্ট করে আহনাফ বলে,
“তুমি কিন্তু এখনো তোমার শেয়ার দাওনি, ঐশী।”

“কিসের?”

“কিসের আবার? যেটাতে চ°ড়ে বেড়াচ্ছো।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে রাগ দেখিয়ে বলে,
“ওহ, কিছুই দেইনি? এই যে সমস্ত দিন আপনার সাদাব-সাইদা মিলে আমাকে ভ°র্তা করছে, তার বেলা?”

সাদাব পিছন থেকে বলে,
“ইয়েস পাপা, তার বেলা?”

আহনাফ সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওরে, ব্যাটা দেখি মায়ের পক্ষে চলে যায়।”

সারাহ্ ভাব নিয়ে বলে,
“মা কে দেখতে হবে তো।”

আহনাফ গাড়ি থামিয়ে দেয়। হঠাৎ করে থামায় সারাহ্ সামনে ঝুঁ°কে পড়ে। আহনাফ সিটবেল্ট খুলে ওর কাছে এসে চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখি একটু।”

সারাহ্ ওকে হালকা ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
“ছেলে এখানে, কি করেন?”

“কি করি, তোমাকে দেখতেছি। দেখতেই তো বললে।”

“দূর, বে°হায়া লোক।”

সাদাব পিছন থেকে সারাহ্-র হাত টে°নে বলল,
“আম্মু, সাইদাকে আমার কাছে বসিয়ে দাও না প্লিজ প্লিজ।”

“না, সাইদা ঘুমাচ্ছে। তুমি উঠিয়ে ফেলবে।”
“প্লিজ।”
“নো।”

আহনাফ আবারো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, সাইদাকে সাদাবের কাছেই রেখে দাও। তারপর তো ওদের আবার একটা ভাইবোন আসবে।”

সারাহ্ মুচকি হাসে। লজ্জায় আজও সে লাল হয়ে আসে। তারপর বলে,
“ভাইবোন আসছে ওদের। এবার তো আপনার অ°স্থিরতা কমান।”

আহনাফ চোখ বড়বড় করে বলল,
“কি বললে তুমি?”

সারাহ্ লাজুক হেসে মাথা নাড়ায়। আহনাফ গাড়ি রাস্তার পাশে থামিয়ে বের হয়ে সারাহ্ দিকে এসে দরজা খুলে বলে,
“সত্যি বলছো?”

সারাহ্ মাথানেড়ে বলল,
“হুম।”

আহনাফ দুহাত দুদিকে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“আল্লাহ্, আল্লাহ্, এতো খুশি আমি কোথায় রাখবো?”

“আহনাফ, আস্তে। কি করছেন? লোকজন তাকিয়ে আছে।”

“থাকুক, তাকিয়ে থাকুক।”

সারাহ্ দুগালে হাত দিয়ে কপালে চুম্বন করে আহনাফ। সাদাব বলে,
“পাপা, আমাকেও চুমু দাও।”

আহনাফ ওকেও চুম্বন করে। সারাহ্ হাসতে হাসতে বলে,
“পাপার মতোই হবে। বেহায়া একটা।”
______________________________________

রাতে বাসায় আসার পথে গো°র°স্থানে এসেছে ইমতিয়াজ। এটা আজ নতুন নয়, প্রায় প্রতিদিনই আসা হয়।

তাহমিনার কবরটা পরিষ্কার করে সে। কিছুক্ষণ নিরবে সময় কা°টায়। কতটা বছর চলে গেছে, ছয়বছরের বেশি সময়।

অনেকক্ষণ পর ইমতিয়াজ গো°র°স্থান থেকে বের হয়, বাসায় ফিরে আসে সে। বেল বাজালে মেহরিবা দৌড়ে এসে খুলে দেয়। দরজা খুলেই সে ইমতিয়াজের কোল দখল করে আজকের দিনের গল্প বলতে শুরু করে।

মৃত্তিকা এসে বলে,
“উনি ওই জোসনাই, বড়মণির মা। জমিদার বাড়িতে আমি ছবি দেখেছিলাম, চেনা চেনা লেগেছে।”

ইমতিয়াজ মেহরিবার গালে চুমো দিয়ে ওকে কোল থেকে নামিয়ে বলে,
“এখন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো?”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে বলল,
“উনি যেখানে আছে, ওখানেই থাকবে। শুধু আমি খরচ দিবো।”

“বাসায় নিয়ে আসলে কি হবে?”

“চাচ্ছি না আমি।”

মৃত্তিকার বারাকাহ্-র কাছে চলে যায়। সে চাচ্ছে না জোসনাকে বাসায় আনতে। কারণ তো স্পষ্ট, সে জোসনাকে ভালোবাসে না বা ভালোবাসতে চাচ্ছে না।

ইমতিয়াজ গিয়ে মেহরিবাকে দেখে মিউকোর সাথে খেলছে। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে মৃত্তিকার পাশে বসে বলল,
“ঠিক আছে তোমার ইচ্ছাই সই।”

মৃত্তিকা ওর দিকে ফিরে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
“ইতালি থেকে এসে আমি আপনার গ্রামে যাবো। নিয়ে যাবেন?”
“ওখানে কেন আবার?”
“বাবা-মায়ের কবর দেখে আসবো।”

ইমতিয়াজ মলিন হেসে বলল,
“আচ্ছা, নিয়ে গেলাম। তারপর কি চাই?”
“কিছু না।”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে। ইমতিয়াজের এই দৃষ্টি ওর চেনা। ইমতিয়াজ কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমাকে কিন্তু আবারো অস্ট্রেলিয়া যেতে হবে।”
“কবে?”
“এ বছরের শেষে।”
“বহু দেরি।”

মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের কাছে এনে বলল,
“বুড়ো হয়ে গেছেন, আজ আপনি আটত্রিশে পড়েছেন।”

ইমতিয়াজ হাসে। বলে,
“মনে রেখেছো? আমার তো মনে ছিল না।”
“আর মনে রাখবো না বুড়ো।”
“বুড়ি।”
চট করে কথাটা বলে মৃত্তিকার নাক টে°নে দেয় ইমতিয়াজ।

এটা তো সবে শুরু, যাত্রা এখনো বহুদূর বাকি। ওদেরকে চলতে হবে একসাথে, পায়ে পা মিলাতে হবে। হয়তো আরো কঠিন সময় আসবে, তবে পাশে থাকলে কঠিনকে সহজ করাও সম্ভব হবে।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে