অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-২২+২৩+২৪

0
287

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দ্বাবিংশ পর্ব

রবিবার সকাল ১০ টা,

ইমতিয়াজ একটা জরুরি কাজে অফিসের বাইরে গিয়েছিল। ফিরে এসে এমডির কেবিনে ফাইলগুলো জমা দিয়ে নিজের কেবিনে আসে।

কেবিনে এসে তানজিমকে দেখে অবাক হয়। তানজিম স্বাভাবিকভাবে হেসে বলে,
“ভালো আছেন ভাইয়া?”

ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, হঠাৎ অফিসে?”

ইমতিয়াজ নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো। তানজিম বলে,
“আপনি আবারো বিয়ে করবেন ভাইয়া?”

ইমতিয়াজ চমকে উঠে তানজিমের দিকে তাকায়। ভূমিকা ছাড়া হঠাৎ এমন কথায় সে হতভ°ম্ব। গতরাতে ফোনে লুৎফর রহমান ইমতিয়াজকে বিয়ের কথা বললেও ইমতিয়াজ হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর দেয়নি। লুৎফর রহমানও জোর করেননি।

তানজিমের কথায় ইমতিয়াজ হেসে বলে,
“কনে, কাজী সব নিয়ে আসছো নাকি?”

দুষ্টুমির ছলে কথাটা বললেও তানজিমের মুখে হাসি এলো না। ইমতিয়াজ সিরিয়াস হয়ে বলল,
“কি সমস্যা তানজিম?”

হঠাৎ তানজিমের কন্ঠ পরিবর্তিত হয়। একটু ক°ড়া ভাষায় বলে, যেন ইমতিয়াজকে হুমকি দিচ্ছে সে।

“মিউকো আপু তোমাকে বিয়ে করতে চায়। বাবা অথবা মামা যদি বিয়ের প্রস্তাব আনে তবে সোজা না করে দিবে।”

ইমতিয়াজ হাত নেড়ে বলল,
“শান্তভাবে কথা বলো, এটা অফিস।”
“সো হোয়াট, মিউকো আপুকে তুমি বিয়ে করতে পারবা না।”

তানজিমের ফোন বেজে উঠে। দুইবার বাজলে ইমতিয়াজ বি°র°ক্ত হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে,
“ফোন বের করো।”

তানজিম ফোন বের করে৷ ইমতিয়াজ কল কে°টে ফোনটা সাইলেন্ট করে তানজিমের সামনে ফেলে বলে,
“এখন বলো সমস্যা কি?”
“বাবা তোমার সাথে কথা বলেছে?”
“হ্যাঁ বলেছে।”
ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে।

তানজিম উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি বলেছো তুমি? বিয়ে করবে?”
“সিদ্ধান্ত কি তুমি নিবে নাকি আমি?”

তানজিম টেবিলের উপর হাত দিয়ে দুইটা চাপড় দিয়ে বলে,
“ভালো হচ্ছে না, ভাইয়া।”

ইমতিয়াজের রাগ হলেও শান্ত গলায় বলল,
“অফিসে সিনক্রিয়েট করো না। আমার ডিউটি আছে, এখন তুমি যাও।”

তানজিম চেয়ারে একটা লা°থি দিয়ে বলল,
“যা খুশি তাই করো।”

ইমতিয়াজ তাকিয়ে থাকলো তানজিমের দিকে৷ এমন উ°গ্র স্বভাব কবে থেকে আসলো তার মধ্যে। ইমতিয়াজ কম্পিউটার অন করলেও মন বসাতে পারলো না। এই পুরো পরিবার হয়তো পাগল। নাহলে একটা উচ্চশিক্ষিত মেয়েকে কারো দ্বিতীয় স্ত্রী করার প্রস্তাব কিভাবে দেয়।
______________________________________

বাসায় ফেরার পর থেকেই গু°ম°রে আছে সারাহ্। কাল থেকে নিচুস্বরে একটা দুইটা প্রশ্নের জবাব ছাড়া আর কোনো কথাই বলেনি সে। আব্বাস সাহেব ভেবেছেন হয়তো উনার সামনে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছে ওর, কিন্তু আহনাফ জানে সে ঘরেও কথা বলছে না। আহনাফ যে কথা বলেনি বিষয়টা তা নয়, সারাহ্ জবাব দেয়নি।

কলেজে যাওয়ার পথে আহনাফের সাথে কথা হয়নি সারাহ্-র। এই এলোমেলো ভয় আহনাফকে কিভাবে জানাবে সে। কথা গুছিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে বেচারী।

প্রথম ক্লাস শেষে বেরিয়ে আহনাফ সারাহ্-কে দেখে টিচার্স রুমের দিকে যেতে। সে এতোটাই অন্যমনস্ক যে নিজের হাতের তিন তিনটা মার্কার যে মাটিতে লু°টোপুটি খাচ্ছে তা দেখেই নি।

আহনাফ মার্কারগুলো কুড়িয়ে সারাহ্-কে ডাকে,
“ঐশী।”

সারাহ্ ভূ°ত দেখার মতো চমকে পিছনে ফিরে,
“জি।”
“এগুলো নাও।”
মার্কার এগিয়ে দেয়।

সারাহ্ এগুলো হাতে নিলে আহনাফ বলল,
“কি হয়েছে তোমার? কিছু নিয়ে চিন্তা করছো?”

সারাহ্ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আহনাফ বলে,
“বই রেখে আসো। আমি গেইটের কাছে অপেক্ষা করছি।”

আহনাফের কথামতো বই রেখে গেইটের কাছে যায় সারাহ্। বড় গেইটটার কাছে একটা বড় পুকুর। তার পাশে সারি সারি গাছ লাগানো। আহনাফ একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সারাহ্ গিয়ে চুপচাপ মুখোমুখি দাঁড়ায়।
“কি যেন বলতে চেয়েও থেমে যাচ্ছো? সমস্যা কোনো?”

সারাহ্ একহাত দিয়ে অন্যহাতে ঘ°সতে থাকে। আহনাফ ওর হাত ধরে বলে,
“বলো, এতো ফরমালিটির দরকার নেই।”
“আসলে কাল এয়ারপোর্টে দুজন লোক কথা বলছিলো সামিহাকে নিয়ে।”

আহনাফ কপাল কুঁচকায়। সারাহ্ আবারো বলে,
“হয় মানবে আর না হয় ম°রবে, এমন একটা কথা বলেছিল।”
“আর কি বলেছে?”

সারাহ্ পুরো ঘটনা আহনাফকে খুলে বলে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একদম পাই টু পাই।

আহনাফ একটু উত্তেজিত হয়েই বলে,
“ইয়া আল্লাহ্, তুমি আগে আমাকে বলোনি কেন? কাল তো বলতে পারতে? গাড়ির নাম্বার দেখেছো?”

সারাহ্ ফোন বের করে একটা ছবি দেখায়। গাড়ির জানলা থেকে ছবিটা তুলেছিল সে। আহনাফ ছবিটা দেখে বলে,
“আমি কালকে ঢাকা যাবো। তুমি বাসায় এ ব্যাপারে কিছু বলো না আর বাবাকেও কিছু জানিও না।”
“ঠিক আছে।”

আহনাফ চলে যেতে নিলে সারাহ্ বলে,
“যদি ওদের নজর আপনার উপর হয়?”

আহনাফ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল,
“সাধারণ একজন সরকারি টিচারকে হুদাই কেউ সন্দেহ করবে না। চিন্তা করো না। চলো।”
সারাহ্ও আহনাফের পিছুপিছু চলে গেল।
______________________________________

সন্ধ্যা ৬ টা, শাফিন সাহেব ড্রইংরুমে বসে ইমতিয়াজকে কল করে।

নাম্বার দেখে কিছুক্ষণ চুপ থাকে ইমতিয়াজ। রিসিভ করা না করা নিয়ে সে সিদ্ধানহীনতায় আছে। অবশেষে রিসিভ করে নেয়।

“আসসালামু আলাইকুম, মামা।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন এখন?”
“এইতো ভালোই। (একটু থেমে) একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলতে চাইছিলাম।”
“জি, মামা বলেন।”

শাফিন সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“ইমতিয়াজ, লুৎফর হয়তো তোমার সাথে কথা বলেছে। তোমারও একটা সংসার হওয়া উচিত, সন্তান থাকা প্রয়োজন। (একটু থেমে) তাই আমরা তোমার বিয়ের কথা ভাবছিলাম।”

ইমতিয়াজ একটু গলা ঝেড়ে বলল,
“মামা, আমার একটু চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন। এটা এমন কোনো সিদ্ধান্ত না, যা আমি হুট করে নিতে পারবো৷ কিছু মনে করবেন না।”
“আরে না না, কিছু মনে করার নেই। তুমি ভেবেচিন্তে জানিও।”

এদিকে সুরভি মৃত্তিকার হাতে কয়েকটা বড় বড় কার্টুন বক্স দিয়ে বলে,
“মিউকো এগুলো একটু স্টোররুমে রেখে আসবা। আমি তো যেতে পারবো না।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপু। আমি রেখে আসছি।”

মৃত্তিকা বক্সগুলো তাকে তাকে সাজিয়ে নিয়ে সুরভিকে বলল,
“স্টোর রুমের চাবি কোথায়?”
“বাবার কাছে।”

শাফিন সাহেব ড্রইংরুমে, সুরভি উনার রুমে গিয়ে চাবি এনে মৃত্তিকাকে দিয়ে দেয়। বক্সগুলো নিয়ে মৃত্তিকা চলে যায়৷

নিচতলায় স্টোররুম, সেখানের দরজা খুলতেই ধুলার কারণে নি°শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। রুমের লাইট জ্বা°লি°য়ে মৃত্তিকা বক্সগুলো রেখে নিজে নিজেই বলে,
“এরুম কি কেউ কোনোদিন পরিষ্কার করে না?”

খুব বেশি বড় না হলেও রুমের মধ্যে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্র ঠাসা। মৃত্তিকার চোখ পড়ে একটা বক্সের দিকে। দেখতে খুব সুন্দর কারুকাজের বক্সটার কাছে গিয়েই ভ°য় পায় সে, এ যে ক°ফি°ন। একদম নতুন একটা ক°ফি°ন এটা, যেন মাত্র কিছুক্ষণ আগেই আনা হয়েছে। রুমে আবার কয়েকটা পায়ের ছাপ।

মৃত্তিকা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে আসে। দরজা লাগিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। কথায় বলে বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। বেচারির হয়েছে সেই অবস্থা।
______________________________________

রাত প্রায় দুইটা, নির্ঘুম রাত কাটছে সারাহ্-র। আহনাফ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। সারাহ্ ওর দিকে ফিরে শুয়ে থাকে। ওর গালে হাত দেয়। সারাহ্ জানে না ওই লোকগুলো কে হতে পারে, তবে সামিহাকে নিয়ে তার প্রচুর চিন্তা হচ্ছে।

আহনাফ ওর হাতের উপর হাত দিয়ে বলে,
“ঐশী, ঘুমাওনি?”

আহনাফ চোখ খুলে, সারাহ্ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আহনাফ ওর কাছাকাছি চলে আসে।

“ঘুমাওনি?”
“ঘুম আসছে না।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সারাহ্ বলল,
“আহনাফ।”
“উম, নাম ধরে ডাকে না।”

সারাহ্ বি°র°ক্ত হয়। বলে,
“আচ্ছা, ডাকলাম না। তবে আমার বারবার মনে হচ্ছে আমাদের দুইবোনকেই কেউ টার্গেটে রেখেছে।”

আহনাফ কপাল কুঁচকে বলল,
“কোনো বিশেষ কারণ?”
“মনে হচ্ছে, নাহলে শুধু শুধু সামিহাকে কেউ কেন মারতে যাবে? ও তো ইনোসেন্ট, কারো ক্ষতি বা লাভের চিন্তায় ও নেই।”

আহনাফ সারাহ্-র নাকে, গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
“চিন্তা করো না, সত্যটা জানা যাবে।”
সারাহ্ আহনাফকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। হয়তো এবারে ঘুম হবে।

ফজরের নামাজের পরই আহনাফ বেরিয়ে যায়। আব্বাস সাহেবকে জানিয়েছে একটা জরুরি কাজে ঢাকায় যেতে হবে এবং কাজটা কলেজ সংক্রান্ত।

আহনাফকে এগিয়ে দিতে নিচে বাসার সামনে যায় সারাহ্।
“ঐশী, এতো চিন্তা করো না।”

আহনাফের কথায় সারাহ্ নিচুস্বরে বলে,
“নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কি এমন হয়েছে সামিহার সাথে।”

আহনাফ সারাহ্-র কপালে চুম্বন করে। ওর গালে হাত দিয়ে বলে,
“আসছি।”
______________________________________

সকাল সাতটায় মৃত্তিকা এসেছে এয়ারপোর্টে। কারণ ওর ফ্রেন্ড ইসরাত ও ফিওনা ইতালি থেকে দেশে আসবে। বড় শালটা মৃত্তিকার গায়ে জড়ানো, চুল খোলা, একটু এলোমেলো অবস্থায় আছে সে।

গতসন্ধ্যার সেই ক°ফি°ন দেখার ঘটনা কারো সাথে শেয়ার করেনি মৃত্তিকা। তবে ওই ঘটনার একটু গভীরে সে যাবে, সবার অগোচরে লুকিয়ে যাবে।

সাড়ে আটটায় ইসরাত ও ফিওনা এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়। কুশল বিনিময় করে ওরা গাড়িতে উঠে বসে। ওদের জার্নি হোটেল অরনেট পর্যন্ত হয়। রাস্তায় এটা সেটা বেশ অনেকক্ষণ কথা বলে ওরা।

হোটেলের রুম আগে থেকেই বুক করা ছিল। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসেই কথা বলা শুরু করে ওরা। ওদের আলোচনার মূল বিষয় মৃত্তিকার বিয়ে।

“পুরো ভার্সিটি লাইফ একা থেকে এখন একজন লোকের সেকেন্ড ওয়াইফ হচ্ছিস? এতো আবেগ কবে থেকে আসলো তোর?”

ইসরাতের প্রশ্নটা স্বাভাবিক। মৃত্তিকা হেসে বলল,
“তোর মনে হয় আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না? এসব আবেগ অনুভূতিকে আমি কবেই মে°রে ফেলতাম, কিন্তু রাখতে হবে বলেই রাখলাম।”

ফিওনা বাংলা বলতে পারে না, তবে ওদের সাথে থেকে থেকে বাংলা ভালোই বুঝে। সে যা বলল তার বাংলা করলে বিষয়টা এমন দাঁড়ায়,
“কেন রাখতে হলো? কি এমন বিশেষত্ব আছে তার? কি যেন ছিল নামটা, ইমতিয়াজ।”

মৃত্তিকা হাত তুলে না দেখিয়ে বলল,
“আরে না, তেমন কিছু না। তবে দেশে থাকাটা এখন আমার জন্য জরুরি, তাই বিয়ে করা। আর তাছাড়া (একটু থেমে) ইমতিয়াজ মানুষ ভালো, মানসিক শান্তি পাই উনার কাছে।”

মৃত্তিকা শালটা খুলে চেয়ারে রেখে বলে,
“এসব বাদ দে। বাড়িটা বিক্রি হয়েছে?”

ইতালিতে থাকা মৃত্তিকার বাড়িটা সে বিক্রি করে দিয়েছে। কারণটা হলো একটা বিজনেস শুরু করা।

ইসরাত বিছানায় শুয়ে বলে,
“ব্যাংকে বাড়ি বিক্রির সব টাকা জমা হয়েছে। শেয়ার কেনার এটাই ভালো সুযোগ।”

মৃত্তিকা বুকে হাত বেঁধে বলল,
“শেয়ার নয়, পুরো কোম্পানি আমি কিনতে চাই।”

ফিওনা ফোন থেকে কিছু একটা দেখে বলে,
“কোম্পানির প্রোফিট ভালো, তবে ওরা কেন বিক্রি করবে?”
“বাধ্য করবো।”

মৃত্তিকার কথায় ইসরাত অবাক হয়, ফিওনার অবাকের পাল্লাও ভারি। মেয়েটা এমন ব্যবহার আগে কখনো করেনি। ব্যবসা কিংবা কোম্পানির শেয়ারের জন্য কখনোই আগ্রহ ছিল না, তবে হঠাৎ কেন এমন ইচ্ছা জাগলো?

মৃত্তিকাকে প্রশ্ন করার আগেই সে উত্তর দিলো,
“কোম্পানির ওনার হলো কলরবের ফাদার, চিনেছিস কলরবকে? আমার মামকে নিয়ে খারাপ কথা বলেছিল। আবার পরে মামাকে বলেছিল, এমন ভ°ব°ঘুরে মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না। তাই নিজের একটা পরিচয় করবো।”

ইসরাত ঠোঁট উল্টায়। বলে,
“পরিচয় করার উপায়টা দারুণ।”

মৃত্তিকা এসে বিছানায় বসে বলল,
“মামা যখন চাকরি করতো তখন কলরবের বাবাও চাকরি করেছে সেখানে। তারপর মামা চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় এলো আর উনি উনার বিশাল কোম্পানিতে বিনিয়োগ শুরু করেছে। কি মনে হয়? সবটা হালাল টাকা?”
“মোটেও না।”

ফিওনা ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে৷ কিন্তু বেচারী অর্ধেক কথা বুঝতে পারছে না। সে শুধু এইটুকু বুঝেছে মৃত্তিকা কোম্পানির শেয়ার কিনবে আর সেটা কলরবের বাবার কোম্পানি।

“আমি ইতালি যেতে চেয়েছিলাম, বাট মন বদলে ফেলেছি। এভাবে সব ছেড়েছুড়ে পালাবো না।”

ইসরাত মাথা নেড়ে বলল,
“তা ঠিক, তবে বিয়ের সিদ্ধান্তটা অবাক করছে। কেন তুই এমন বয়স্ক একজনকে বিয়ে করছিস তাই বুঝলাম না।”

মৃত্তিকা উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে বলল,
“এতো লম্বা কাহিনী একদিনে কিভাবে বলি?”

মৃত্তিকা বুঝতে পারছে না ও ইমতিয়াজকে ভালোবেসেছে কিনা। তবে সুখের জন্য, একটু শান্তির জন্য, ফুরসতের জন্য ওর ইমতিয়াজকেই লাগবে। এ কি ভালোবাসা নাকি স্বা°র্থ°পরতা? যা খুশি হোক, মৃত্তিকার তাতে আশে যায় না।

সমস্তটা দিন মৃত্তিকা হোটেলে কা°টায়। সবকিছু নিয়ে কথাবার্তা বলে সিদ্ধান্ত হয় যা ডলার আছে তাতে পুরো কোম্পানি কেনা না গেলেও একটা শেয়ার কেনা যাবে৷ ইমতিয়াজের কথাই সই, কলরবকে প্রত্যেকটা কথার হিসাব দিবে সে৷ শুধু পদ্ধতিটা ভিন্ন।

চলবে……

(সর্তকতা- আজকের পর্বটি নিজ দায়িত্বে পড়বেন। অস্বাভাবিক কিছু দৃশ্যের বর্ণনা রয়েছে।)

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ত্রয়োবিংশ পর্ব

রাত আটটায় বাসায় ফিরে ইমতিয়াজ। ঠিক ফ্ল্যাটের দরজার সামনে একটা লাল গোলাপের তোড়া দেখে সে। ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে তালা খুলে বাসায় ঢুকে।

বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করে। ফ্রেশ হয়ে এসে ফুলগুলো হাতে নেয়। তোড়ার ভিতরের দিকে একটা কাগজ। ইমতিয়াজ কাগজটা বের করে।

“মৃত্তিকাকে বিয়ে করো বা না করো, ওই বাসা থেকে বের করে আনো। হয়তো আজ রাতটাই হয়তো ওর জীবনের শেষ রাত।”

ইমতিয়াজ চোখমুখ কুঁচকে চিরকুটটা পড়লো। এ কেমন কথা? ওই বাসায় কি সমস্যা বা কে এই চিঠি পাঠিয়েছে সবকিছু নিয়ে দোটানায় পড়ে ইমতিয়াজ। প্রশ্নে প্রশ্নে জড়জড়িত মানুষটা চিন্তিত হয়ে সোফায় বসে পড়ে। ঠিক কি হতে পারে আজ রাতে?

ফোন বের করে মৃত্তিকাকে কল দেয়।
“হ্যালো।”

মৃত্তিকার কোমল সুরের জবাব দিলো ইমতিয়াজ।
“আমি ইমতিয়াজ বলছিলাম।”
“জি বলেন।”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“কোথায় আছেন?”

বিকালের দিকে হোটেল থেকে বাসায় ফিরেছে মৃত্তিকা। স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো,
“বাসায়।”
“কোথাও বের হবেন?”

মৃত্তিকা হাসলো। বলল,
“না, কেন বলুন তো?”
“এমনিই, সাবধানে থাকবেন।”

ইমতিয়াজ ফোন রেখে দিলো। মৃত্তিকা চোখ কুঁচকায়, এ কেমন আচরণ?

মাথার চুল টেনে ইমতিয়াজ কোনো সুরাহা পাচ্ছে না, আর না নিজেকে শান্ত করতে পারছে। মৃত্তিকার আজ শেষ রাত। কে বলেছে এ কথা? মৃত্তিকার বাবা?
______________________________________

রাত বারোটা ত্রিশ মিনিট, মৃত্তিকা স্টোররুমের চাবিটা নিয়ে চুপিচুপি নিচতলায় আসে। দরজার সামনে এসে তালা খোলা দেখে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে যায়।

ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। দরজা ঠেলে ভিতরে গিয়ে চোখ বুলায়।

ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে আশেপাশে দেখতে থাকে। পূর্ব দিকের দেয়ালে কয়েকটা ছবি ঝুলিয়ে রাখা আছে। বেশ কয়েকটা ফ্যামিলি ফটো। এখানে চেনা থেকে অচেনা মানুষের সংখ্যাই বেশি।

একবার দরজার দিকে তাকিয়ে একটা অচেনা ফ্যামিলির ছবি হাতে নিলো, এখানের দুইটা মানুষকে ও চিনে। একজন সারাহ্, সাথে সামিহা। ছবিটাতে সারাহ্ আর সামিহার চেহারার গঠনে মনে হচ্ছে ছবিটা আরো দুই তিনবছর আগের।

“ওদের ফ্যামিলির ফটো এখানে কেন?”

আবারো ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। ছবিটা যথাস্থানে রেখে ও আবারো ঘুরে ফিরে জায়গাগুলো দেখতে থাকে।

এই জায়গাটা নিয়ে ওর কৌতুহলের শেষ নেই। আগ্রহ নিয়ে দেখে আবারো যায় সেই কফিনের কাছে। ক°ফি°নের মুখটা খুলে ভিতরে কিছু আছে কিনা দেখে সে। ভেতরে একটা পাথর রাখা আর তাতে কোনো একটা নাম খোদাই করা আছে।

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ওর উপর হা°ম°লা করলে নামটা আর মৃত্তিকার দেখা হয় না। ফোনটা হাত থেকে ক°ফি°নের ভেতর পড়ে যায়। মাথায় প্রচন্ড আ°ঘা°ত পাওয়া মৃত্তিকার মুখ থেকে র°ক্ত বেরিয়ে আসে। মাথার পেছন দিকে হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলে ওর গলায় শক্ত কিছুর প্যাঁ°চ অনুভব করে। চিৎকার করার আগেই মৃত্তিকার হাত ও মুখ বাঁ°ধা হলো, গলায় প্যাঁ°চানো মোটা ওড়নাটার বাঁধন আরো শক্ত হলো।

গলা কা°টা মুরগির মতো ছ°টফ°ট করতে থাকে মৃত্তিকা, পা দুটো অসম্ভব দ্রুত গতিতে নাড়ছে সাথে শরীর ঝাঁ°কা°চ্ছে। ধীরে ধীরে ও শান্ত হয়, চোখ বন্ধ হয়। শরীর স্থির হলে মুখ থেকে খানিকটা র°ক্ত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ফ্লোরে। নাকে থেকে বের হওয়া র°ক্ত ঠোঁটের আশেপাশে আর গালে গড়াগড়ি খায়।

যে রহস্যের খোঁজে দেশে থেকে যাওয়া তা মৃত্তিকার সাথেই ক°ফি°ন°বন্ধী হয়ে যায়। ক°ফি°নের দরজা বন্ধের আগে কেউ বলল,

“মিউকো, এতোটা সহজ মৃ°ত্যু তোমার কাম্য ছিল না। মায়ের মতো নিরীহ হয়েও বাবার মতো ধূ°র্ত তুমি।”

অন্ধকারের এই বাক্যের সাথে আরেকটা বাক্য যুক্ত হলো,
“মেয়েটা অবশ্যই কিছু সন্দেহ করছে।”
“কিছু না সবটাই বুঝে গেছে সে, প্রমাণ খুঁজতে এসেছে এখানে।”
“তবে এখন?”
“শেষ প্রমাণ লো°পা°ট হবে, নার্গিস পারভিন ও রোমি খন্দকার।”
______________________________________

“ঐশী, আজ রাতটা আমার থাকতেই হবে।”
“কোথায় আছেন?”
“চাচ্চুর বাসায়। কাল সকালে সিআইডি অফিসে আবার যেতে হবে।”
“যাই করেন, নিজের খেয়াল রাখবেন প্লিজ। চিন্তা হচ্ছে আমার।”

আহনাফের সাথে ফোন যোগে কথা বলছে সারাহ্। আজকে সিআইডি অফিসে ওদের এইরকম অদ্ভুত সমস্যার বিষয় নিয়ে কথা বলেছিল আহনাফ। কিন্তু সমস্যাটা এমন যে একটা উড়াল কথার ভিত্তিতে এখান থেকে গভীরে যাওয়া কঠিন এবং যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ।

আহনাফ বলল,
“চিন্তা করো না তুমি, তবে আমার মাথায় একটা বিষয় ঢুকছে না৷ (একটু থেমে) তুমি ওখানে গেলে আর ওরা কথা বলল?”

সারাহ্ চমকে উঠে। তারমানে কেউ ওকে শোনানোর জন্য এমন কথা বলেছে।

“সত্যি বলেছেন, এভাবে তো ভাবিনি। তারমানে কেউ আমাকে শোনাতে চাচ্ছিলো?”
“একদম এটাই। ওরা তোমাকে দেখেছে।”

সারাহ্ নিজের মস্তিষ্কের মধ্যে খোঁজা শুরু করে। এমন কোনো শত্রু কি আদৌ ওদের আছে। কই, পরিবার বা বাইরের এমন কারো কথা তো ও জানে না।

“রাতে খেয়েছো?”

আহনাফের কথায় সারাহ্ আকাশকুসুম চিন্তা থেকে বাস্তবে ফিরে,
“জি, আপনি খাওয়া দাওয়া করেছেন?”
“হুম, তারপর বাবার সাথে কথা বললাম। ফ্রি হয়ে আমার বাচ্চার আম্মুটাকে কল দিলাম।”

“বাচ্চার আম্মু” এমন সম্মোধনে লজ্জা পায় সারাহ্। চুপ করে থাকে সে। পাশে থাকা আহনাফের বালিশটা বুকে জড়িয়ে আবেশে চোখ বুজে।

“কি বলো ঐশী? বেবির চিন্তা করবো? তবে একটা সুবিধা হবে। তুমি আমাকে সাদাবের আব্বু, সাইদার আব্বু বলে ডাকতে পারবে।”

সারাহ্ মুচকি হাসছে। বাচ্চার নামও ঠিক করে ফেলেছে লোকটা। কিছু বলার মতো ভাষা সে পাচ্ছে না।

আহনাফ আবারো বলে,
“ইশ, ফোনে এসব কথা বলছি। তোমার সামনে গিয়ে বলতাম। আমার দেখতে ইচ্ছা করছে তুমি কতটা লজ্জা পাচ্ছো।”
“ঘুমান।”
“স্বপ্নেও চলে আসবে। কিভাবে ঘুমাই?”

আহনাফ সামনে নেই তবুও সারাহ্ মুখ ঢেকে ফেলে। আহনাফ শব্দ করে হাসে। তারপর সারাহ্-কে বলে,
“শীতের ছুটিতে এবারে কোথায় যাবে ঘুরতে?”

সারাহ্ উঠে বসে নিজেকে ঠিকঠাক করে বলে,
“কোথাও না, বাবার সাথে গল্প করে আর আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে কা°টিয়ে দিবো।”

আহনাফ হেসে বলে,
“ওকে, বাবার নাতি-নাতনি আসার আগেই গল্প সেরে নাও।”
“থামেন এবারে। বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”

আহনাফ হাসলো। সারাহ্ নরমসুরে বলল,
“ঘুমান, শুভ রাত্রি।”
“হুম, স্বপ্নে এসো কিন্তু।”
______________________________________

ফজরের পর গো°র°স্থানে এসেছে ইমতিয়াজ। কাল রাতে কি হয়েছে তা এখনো ওর অজানা। ধীর পায়ে গো°রস্থানের লোহার গেইট ঠেলে ভিতরে ঢুকে, মরিচা ধরা লোহার গেইটে একটা কড়কড়ে শব্দ হয়। রিপা বেগমের কবরের পাশে নতুন একটা কবর খনন করা হয়েছে, তারপাশে একটা ক°ফি°ন।

ইমতিয়াজ সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বেশ যত্ন নিয়ে কবরটা খোঁড়া হয়েছে। তবে নিচে এখনো কাদা আর পানি রয়ে গেছে।

সে তানমিনার কবরের পাশে গিয়ে বসে।
“খুব বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে মনে হচ্ছে। মিনা, কি করবো আমি? আমার পাশে কেউ নেই যে আমাকে একটু পরামর্শ দিবে।”

“আবারো স্ত্রীর কবরের পাশে এসেছো?”

কারো কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে ইমতিয়াজ দেখে সেই পৌঢ় নারী। প্রায়ই এই মহিলাকে গো°র°স্থানে দেখে সে।

মহিলাটি নিজের স্বামীর কবরের পাশে গিয়ে মোনাজাত করে। তারপর নতুন খোঁড়া কবরের সামনে গিয়ে বলে,
“আহ কবর, প্রিয়মানুষদের টে°নে টে°নে নিয়ে যায়।”

ইমতিয়াজ স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“আপনার পরিচিত কেউ?”

কবরটার উপরে যে পাথরে খোদাই নাম লাগানো হয়েছে মহিলাটি তা পড়ে।
“মৃত্তিকা মেহজাবিন মিউকো, ১৯৯৫ থেকে ২০২৩।”

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে যায়, নামটা তার পরিচিত। গতরাতের ওই চিঠি তবে সত্যি। মৃত্তিকার জন্য কালকের রাতটাই শেষ রাত ছিল।

আরো একজন লোক গো°র°স্থানে আসে। মহিলাটি হেসে বলে,
“অনুমান সত্য হয়েছে, তাহমিনার হাসবেন্ডই পরবর্তী লোক।”

ইমতিয়াজ দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে তাহসিনার কবরের পাথরটা তুলে ছুড়ে মারে। লোকটা সরে যাওয়ায় গায়ে লাগে না।

রাগে হি°তা°হিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মহিলাটিকে ধরতে গেলেই হাতে থাকা স্প্রে বোতল থেকে কোনো একটা তরল ইমতিয়াজের মুখের সামনে নির্গত করে দেয়। নে°শা জাতীয় কিছু আছে এখানে। ইমতিয়াজ টা°ল সামলাতে পারে না, দাঁড়ানো থেকে সোজা সেই খুঁড়ে রাখা কবরে পড়ে যায়। কাদামাটি আর পানি তার শরীরে ছিটকে পড়ে। কিছু পানি বাইরে এসেও মাটিকে ভিজায়। কিছুটা আবার রিপা বেগমের কবরের উপরে পড়ে।

মাটিতে বারবার হাতড়াতে থাকে ইমতিয়াজ। কোনোভাবে উঠার চেষ্টা করতে থাকে। লোকটা কয়েক মুঠো মাটি ওর মুখ আর শরীরের উপর দিয়ে বলে,
“জীবন্ত স°মা°ধী। কবরের খুব ভয় থাকে মানুষের, এখন নিজচোখে দেখো সেটা।”

বারবার মাটিতে মু°ষ্টি শক্ত করতে করতে ইমতিয়াজের চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। ওর চোখ বোজার সাথে সাথে একটা পরিবার শেষ হলো। বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তানের পর আজ ইমতিয়াজের রওনা দেয়ার পালা। এই যাত্রা সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত চলছে এবং কি°য়া°মাত পর্যন্ত চলবে।

লোকটা বলে,
“আবারো একটা কবর খুঁড়তে হবে?”
“হ্যাঁ, আরো একটা খুঁড়ে মৃত্তিকাকে চা°পা দেও। মামের আদুরিকে মামের পাশে আর থাকা হলো না।”

লোকটি কফিন খুলে চেঁ°চিয়ে উঠে,
“মৃত্তিকার বডি নেই।”
“কিসব বলছো? ডে°ড বডি কোথায় যাবে?”

গেইটের কাছ থেকে একজন মধ্যবয়সী পুরুষ বলে উঠে,
“আমার নিশানা ও অনুমান এখন আর ভুল হয় না।”

পরপর দুটো গু°লির শব্দ হয়। র°ক্ত ছি°টকে গিয়ে পড়ে রিপা বেগমের কবরের উপর, ইমতিয়াজের শরীরটার উপর গিয়ে পড়ে একটা লা°শ।

গেইটের কাছ থেকে সাদা হুডি পড়া মানুষটা এগিয়ে আসে। মুখ তার মাস্কে ঢাকা। হুডির ক্যাপের জন্য চোখদুটোও দেখা যাচ্ছে না।
“মৃত্তিকাকে মে°রে ফেলা এতো সহজ নয়।”

দুজন মানুষের মৃ°ত্যু নিশ্চিত করতে আরো দুবার করে চারবার গু°লি করে। ছয় ছয়টা গু°লি একই জায়গায় শেষ হয়।

ইমতিয়াজের উপরে থাকা সেই লা°শের টাটকা র°ক্তে ইমতিয়াজের শরীরও র°ঞ্জি°ত হয়। মুখটা র°ক্তা°ক্ত হয়ে ভ°য়ং°কর রূপ নিয়েছে, যেন কোনো মানুষ খে°কো ভ্যাম্পায়ার।
______________________________________

“মিউকো বাসায় নেই, বাবা। কোথাও নেই।”

পাগলের মতো মৃত্তিকাকে খুঁজেছে সুরভি, শাফিন ও দেলোয়ারা। ভোর রাত থেকে এ পর্যন্ত না খুঁজে পেয়ে লুৎফর রহমানকে জানানো হয়েছে। হুট করে হদিস পাওয়া যাচ্ছে না, কোথায় গেছে কেউ জানে না, সাথে ফোন অফ।

শাফিন সাহেব মলিন মুখে সিঁড়িতে বসে পড়লেন। এ বয়সে আর কত ধকল নিবে এ শরীরটা। এখনো ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না, অথচ মৃত্তিকাকে খুঁজতে পুরো বাসায় উনি ছোটাছুটি করেছেন।

দরজার কাছে সুরভি দাঁড়িয়ে রইলো। মৃত্তিকার বাবার কাজ নয় তো এটা, এই চিন্তা তার মস্তিষ্কে ঘুরঘুর করছে।

দেলোয়ারা বলেন,
“একবার ইমতিয়াজকে কল দাও। হয়তো কোনো সাহায্য করতে পারে।”

শাফিন সাহেব নিষ্প্রাণ হয়ে আছেন, কথা বলা ভুলে গেছেন যেন। সুরভি উনার ফোন থেকে কল দেয় ইমতিয়াজকে। ফোন বাজছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। একবার, দুবার, তিনবার করে পনেরো-বিশবার নিয়েও সেই এক কথা,
“নো এন্সার।”

সময় গড়ায়, সকাল ৮ টা বেজে যায়। লুৎফর রহমান মমতাজ বেগমকে সাথে নিয়ে এ বাসায় এসেছে। লুৎফর রহমান পুলিশ কে°ই°স করতে চাইলে শাফিন সাহেব বাধা দিয়ে বলে,
“যদি মিউকোর বাবা ওকে নিয়ে যায় তবে পুলিশ কে°ই°সে হিতে বিপরীত হতে পারে। মিউকোর প্রা°ণনা°শের আশংকা আছে।”

মমতাজ বেগম শাফিন সাহেবের কথায় সম্মত হলেন। সুরভি বলে,
“কালকেও মিউকো সারাদিন বাসায় ছিল না। আমাদের একটু অপেক্ষা করা উচিত।”

দেলোয়ারা বলেন,
“কাল তো ফোন উঠিয়েছিল, বাসায় বলে গিয়েছিল। আজ তো ওকে যেতেই দেখিনি।”

কথা যুক্তিযুক্ত, তবুও পরিবারটা নিরুপায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা না করে হুট করে কে°ই_স করাটা বোকামি বই আর কিছু নয়। ওরা তো আর জানে না প্রিয়মানুষগুলোর পরিণতির ব্যাপারে।
______________________________________

যোহরের নামাজের পর কাকরাইল গো°র°স্থানে আসে আহনাফ। আজ নতুন দুইটা কবর পড়েছে। প্রতিদিন নতুন কবর হচ্ছে, এ তো ভিন্ন কিছু নয়। তাই রিপা বেগমের পাশের দুটি কবরের দিকে আলাদা করে নজর যাওয়ার কোনো কারণ নেই।

তাহসিনার কবরের পাথরটা নেই, আহনাফ আশেপাশে তাকিয়ে দূরে ছিন্নভিন্ন পাথরটা দেখলো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শ্যাওলা পড়েছে। এখন তো বৃষ্টি নেই, পথের ধূলায় সবুজ শ্যাওলা সাদা হয়ে আছে।

মোনাজাত শেষে আহনাফ দেখে রিপা বেগমের কবরের উপরের মাটি খানিক নেই। মনে হচ্ছে আজই কেউ কোদাল দিয়ে উপরের মাটি সমান করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।

নতুন কবর দিবে বলে পাশের কবরের মাটি কেন সরাবে। বি°র°ক্ত হয় আহনাফ। তারপর বেরিয়ে এসে সিএনজি নেয়, গন্তব্য কমলাপুর।

বাসে করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। সারাহ্-র সাথেও এরমধ্যে কথা হয়েছে।

ক্যান্টনমেন্ট নামতেই দেখে সারাহ্ এসে হাজির, ওর অপেক্ষা করছে। কাঁধের ব্যাগটা একটু উঠিয়ে ওর কাছে যায়।

“একদম আমাকে নিতে চলে এলে?”

সারাহ্ হেসে বলল,
“প্রচুর চিন্তা হচ্ছে। আপনার জন্য, সামিহার জন্য।”

আহনাফ রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“পরশুদিন তোমাকেও যেতে হবে। কি কি কথা শুনেছো প্লাস তোমাদের ফ্যামিলিতে কোনো প্রবলেম আছে কিনা জানবে। তোমার আব্বুকেও যাওয়া লাগতে পারে।”

সারাহ্ ঠোঁট উলটে বলল,
“বাবা বাসায়, যদি এসবে কিছু মনে করে।”
“আরে না, আমি বুঝিয়ে বলবো।”

সারাহ্ মুচকি হাসে। সব ঠিকঠাক থাকুক। আর যা যা এলোমেলো তাও ঠিকঠাক হয়ে যাক। সহ্য শক্তি বোধহয় কমে গেছে ওর।

চলবে…….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুর্বিংশ পর্ব

দুইদিন পর,

সিআইডি অফিসে এসেছে সারাহ্ ও আহনাফ। সারাহ্-র সকল কথা আবারো মনোযোগ দিয়ে শুনছে অফিসার গালিব ও নাইমা।

তারপর গালিব বলে,
“ম্যাডাম, আপনার কথার ভিত্তিতে আমরা সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি। ওই গাড়িটার নাম্বারও সংগ্রহ করেছি। (একটু থেমে) দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, এরকম নাম্বারের কোনো গাড়ি এ পর্যন্ত দেশে নেই। রেকর্ডে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সবটাই নকল। ড্রাইভারের মুখে একটা ফেস মাস্ক ছিল, কোনো একটা কার্টুনের।”

সারাহ্ আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ বুঝতে পারে বেশ বড়সড় একটা জা°লে ফেঁ°সে°ছে ওরা। যেখানে শুধু সামিহা না সারাহ্-র জীবনও সংশয়ে আছে।

আহনাফ একটা কাশি দিয়ে বলে,
“এখন এই সল্যুশন কি?”
“আমরা আমাদের মতো করে চেষ্টা করবো। ম্যাডামের পুরো পরিবারের ডিটেইলস আমার লাগবে।”

সারাহ্ হালকা মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে, আমি দিয়ে যাবো।”

সকল ফরমালিটি শেষ করে দুজনে বেরিয়ে আসে। কাল আবারো ওদেরকে আসতে হবে এখানে।

আহনাফ ওর অবস্থাটা বুঝেছে। সারাহ্-র একহাত ধরে বলল,
“এতো ভাবছো কেন ঐশী? আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই তো করে।”

সারাহ্ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
“আমি জানি, হয়তো এতেও আল্লাহ্ কোনো একটা ভালো লিখে রেখেছেন। তাওয়াক্কুল করতে হবে, ধৈর্য রাখতে হবে। তবে মনটা যে অশান্ত আমার।”

আহনাফ রিকশা ডাকে। দুজনে উঠে বসলে আহনাফ দুষ্টুমি করে বলে,
“মনকে শান্ত করার একটা উপায় বলি? তুমি এখন আমাদের বাবুদের কথা চিন্তা করো। সাদাবের আব্বু, সাইদার আব্বু বলে আমাকে ডেকে ডেকে প্র‍্যাকটিস করো।”

সারাহ্ রেগে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছি আর আপনি মজা করছেন?”
“আরে না, সিরিয়াস।”

সারাহ্ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। ওর মন ভালো করার বৃথা চেষ্টা করতে থাকে আহনাফ। একসময় সারাহ্ ওর কাঁধে মাথা রাখে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। আহনাফ মুছে দেয়। এ মন সহজে ভালো হবে না।

পরিবারের বড় মেয়েগুলো খুব দায়িত্বশীল হয়। এরা একদিনে হয় পরিবারের জন্য ঢা°লস্বরূপ, অন্যদিকে ওরাই পরিবারের জন্য বেশি স্যাক্রিফাইস করে।
______________________________________

ধীরে ধীরে চোখ খুলে ইমতিয়াজ। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো সে হাসপাতালে আছে। ডানহাতে স্যালাইন লাগানো, হাত নাড়াতে পারলো না সে। পায়ের নাড়াতে চেষ্টা করে বুঝলো সেখানে ব্যান্ডেজ আছে।

“নড়াচড়া করবেন না। আপনি এখনো অসুস্থ।”

পাশ থেকে কথাটা বলল এক সুকন্ঠী যুবতী। ইমতিয়াজ সেদিকে তাকিয়ে মুখের অক্সিজেন মাস্কটা খুলে বলল,
“কে আপনি?”

মেয়েটি আলতো হেসে বলে,
“আপনার বউ বললে তো আর বিশ্বাস করবেন না। আমি নীলুফার, একজন নার্স।”

নীলুফার ওকে অক্সিজেন মাস্ক পড়াতে চাইলে ইমতিয়াজ বাধা দিয়ে বলে,
“আমাকে এখানে কে এনেছে?”

নীলুফার হাসলো। বলল,
“একজন ডাক্তার।”
“আর কাউকে এনেছে? কোনো মেয়ে?”

নীলুফার ওর অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার হাত ভেঙ্গেছে। নিজে ম°র°তে গিয়েছিলেন অথচ বউকে ভুলেননি? আজব প্রেম। (একটু থেমে) আপনার স্ত্রীকে খুঁজছেন তো, মিউকো? উনি আইসিইউতে।”

“আমি যাবো।”
ইমতিয়াজ উঠতে চায়। ডানহাতে ভর দিতেই “উহ” বলে আবারো শুয়ে পড়ে। অসহ্য ব্য°থা এখানে।

সোজা দাঁড়ানো থেকে কবরে পড়ে যাওয়া সহজ কথা নয়। ডানহাত দিয়েই সে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে চেয়েছিল। এতো বড় শরীরের ভার কি একহাত নিতে পারে?

নীলুফার সাহায্য নিয়ে উঠে বসে ইমতিয়াজ। ডানহাতটা গলার সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। হাঁটার সময় পায়ে জো°র দিতেও পারছে না।

কেবিন থেকে বেরিয়ে আরেকদফা অবাক হয় ইমতিয়াজ। শান্ত একটা পরিবেশ এখানে। পুরোটা জায়গায় সাদা রং চকচক করছে। বোঝা যাচ্ছে এখানের রং মাত্র কিছুদিন আগেই করা হয়েছে।

কোনো মানুষ না দেখে ইমতিয়াজ প্রশ্ন করে,
“হাসপাতাল এতো ফাঁকা কেন?”

নীলুফার কেবিনের দরজা লাগিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“এই বিল্ডিং এখনো ওপেন হয়নি।”
“তবে আমরা এখানে?”

নীলুফার আবারো হাসলো। তারপর সোজা হাঁটা শুরু করে। ইমতিয়াজ খুব ধীরেসুস্থে হাঁটছে৷ মেয়েটার আচরণ অদ্ভুত লাগলো তার। হাসিহাসি চেহারার পিছনে কিছু তো একটা লুকাচ্ছে। হাসপাতালের ফাঁকা বিল্ডিংয়ে ওর চিকিৎসা, সেদিন ওই মহিলার ওকে জীবন্ত কবর দিতে চাওয়া। সব মিলিয়ে ইমতিয়াজ ভাবনা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

আইসিইউর সামনে গিয়ে কাচের ওপারে মৃত্তিকাকে দেখে। শান্ত হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। চোখ বন্ধ, হাতে স্যালাইন। পাশের মেশিনটা জানান দিচ্ছে সে জীবিত।

“ভিতরে যেতে পারেন।”

নীলুফার কথায় ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে ভিতরে যায়। মৃত্তিকার পুরো মাথায় ব্যা°ন্ডে°জ, বোঝা যাচ্ছে হয়তো চুল সব ফেলে দেয়া হয়েছে। কয়েকটা ইলেকট্রোড লাগানো আছে মাথায়, হাতে ও পায়ে।

নীলুফার এসে স্যালাইনের প্যাকেট দেখে। ইমতিয়াজ নিচুস্বরে বলে,
“কি হয়েছে ওর?”
“মাথার স্পাইনাল কর্ড ইন°জুরি, সারভাইভাল নার্ভ সিস্টেম ক্ষ°তি°গ্র°স্ত হয়েছে।”

ইমতিয়াজ অপলক তাকিয়ে থাকে। ঠোঁট দুটো নিজের অজান্তেই ফাঁক হয়। মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ও সুস্থ হবে তো?”

নীলুফার মাথা নাড়ে। বলে,
“সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি, হাই সারভাইভাল নার্ভ ইন°জুরিতে সুস্থ হওয়া কঠিন। হলেও বেশ সময় সাপেক্ষ।”

ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না, শুধু মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে থাকে। নীলুফার বলল,
“চলুন, আপনার কেবিনে যাই?”

ইমতিয়াজ মাথা উঠিয়ে বলে,
“এই বিল্ডিং পুরো খালি তো?”
“হুম।”
“আমি যেকোনো রুমে থাকতে পারবো?”

নীলুফার হেসে বলে,
“ম°র্গেও থাকতে পারবেন।”
“তবে এখানে থাকতে চাই আমি।”
হাতের ইশারায় মৃত্তিকার পাশের বেডটা দেখায় ইমতিয়াজ।

নীলুফার মুখ টিপে হাসে। মাথা নেড়ে বলে,
“লাকি গার্ল।”
______________________________________

মতিঝিলে নিজের বাসায় এসেছে সারাহ্। কাল বাবার সাথে কথা হয়েছে, আজ মায়ের সাথে অবশ্যই কথা বলতে হবে। ওদের পারিবারিক শত্রু কে হতে পারে।

ফ্রেশ না হয়েই মায়ের রুমে যায় সে।
“আম্মু, আসবো?”
“আসো।”

নার্গিস পারভিন বিছানা ঠিক করছেন। সারাহ্ ভিতরে গিয়ে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে,
“কাল বাবার সাথে কথা বলার সময় জবাব দাওনি কেন?”

নার্গিস পারভিন কাজ করতে করতে স্বাভাবিকভাবে বললেন,
“এমনিই।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে বলল,
“কিছু লুকাচ্ছো তুমি আম্মু?”

এবারেও জবাব এলো না। উনার হাতে বিছানা ঝাড়ুটা টে°নে এনে সারাহ্ ফেলে দেয়। তারপর উনাকে বসিয়ে বলে,
“এসব পরেও করা যাবে। আগে বলো কি লুকাচ্ছো?”

উনি মাথা নেড়ে বলেন,
“কিছুই না।”

সারাহ্ জে°দ ছাড়লো না। রাগি কন্ঠে বলে উঠে,
“তোমার মেয়েরা মরে গেলে তারপর বলবে?”

সারাহ্-র রাগে নার্গিস পারভিনও রেগে যান। চেঁচিয়ে বলেন,
“হ্যাঁ, ম°রে যা। সব মায়েরা মেয়েদের তো বাঁচিয়ে রাখে না, কেউ কেউ মে°রেও ফেলে। যা, ম°রেই যা।”

সারাহ্ উঠে দাঁড়ায়। মায়ের এমন তী°ক্ষ্ণ আচরণ তার অপরিচিত। সারাহ্ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নার্গিস পারভিন একইভাবে একইস্থানে চুপচাপ বসে থাকেন।

সারাহ্ রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে নিতে বলে,
“বাসায় চলেন।”

আহনাফ ফোনের কথা বলছে। সারাহ্-কে হাতের ইশারায় শান্ত থাকতে দেখিয়ে আবারো কথায় মনোযোগ দেয়। সারাহ্ বুঝলো কলেজের কারো সাথে কথা বলছে আহনাফ।

সারাহ্ গিয়ে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে। ওর বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। আহনাফ চমকে উঠে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“স্যার, একটু পরে কল দিচ্ছি।”

ফোন ছুড়ে বিছানায় ফেলে আহনাফ বলে,
“ঐশী, কি হয়েছে?”

সারাহ্ কিছু বলে না। মাথাও তুলে না। আহনাফ ওর মুখটা জোর করে উঠিয়ে চোখ মুছে দেয়। সারাহ্ বলে,
“বাসায় যাবো আমি।”
“কাল বিকালে যাবো, ঐশী। কাঁদে না প্লিজ।”
______________________________________

বিকাল চারটায় তানজিম বাসায় ফিরেই চেঁচামেচি শুরু করে,
“বিয়ের কথা হয়েছে, বিয়ে হয়ে যায় নাই যে ওরা যেখানে ইচ্ছা চলে যাবে। আর তোমরা এমনভাবে বসে আছো যেন ওরা হানিমুনে গেছে।”

শাফিন সাহেব চিন্তিত মুখে বসে রইলেন। মৃত্তিকা আর ইমতিয়াজের চিন্তায় বাসার সবাই প্রায় অসুস্থ। দুইদিন আগে অর্থাৎ যেদিন ওদের উপর আ°ক্র°ম°ণ হয়েছিল বিকালে ইমতিয়াজের নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে যে, মৃত্তিকাকে নিয়ে সে ঢাকার বাইরে এসেছে। যদিও তারপর থেকে ইমতিয়াজের ফোন অফ।

বাসার সবাই তা বিশ্বাস করে নেয়, কিন্তু তানজিম তা মানতে পারছে না। সেদিন থেকে প্রতিদিন তানজিম যতক্ষণ বাসায় থাকবে চেঁচামেচি লেগেই থাকবে।

শাফিন সাহেব ধমক দিয়ে বলেন,
“চুপ করো তানজিম। এমন উ°গ্র বিহেভ কেন তোমার?”

মমতাজ বেগম আজকাল ভয় পায় ছেলেকে নিয়ে। ছেলের ব্যবহার দিনদিন খারাপ হচ্ছে। লুৎফর রহমানের শাসন নেহাৎ কম নয়। তবুও যেন ছেলে তা মানে না।

“যা খুশি করো।”

লুৎফর রহমান তানজিমের গালে একটা চ°ড় বসায়। ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“নিজের ঘরে যাও। বড়দের মুখে মুখে তর্ক করবে না।”

তানজিম রুমে চলে যায়। লুৎফর রহমান বেরিয়ে যান নিজের দোকানের উদ্দেশ্যে। উনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে গেছে। কোথাও একটা সন্দেহ উনাকে কু°ড়ে°কু°ড়ে খাচ্ছে।
______________________________________

রাত পেরিয়ে যাচ্ছে নিজের আপন ছন্দে। এক সময় পেরিয়ে যায়৷ ইমতিয়াজ ফজরের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে আছে।

মনে তার অনেক চিন্তা। কে বা কারা ওকে মা°র°তে চাইলো, আবার মৃত্তিকাকে মা°র‍°তে চাইলো, ওই মহিলা কে যে ওর উপর নজর রেখেছে, কেই না ওদেরকে বাঁচালো।

দরজার শব্দ শুনে ইমতিয়াজ সেদিকে তাকায়। নীলুফার সাথে আরেকজন নারী এসেছে, পোশাক-আশাক দেখে একজন ডাক্তার বলে চিহ্নিত করে ইমতিয়াজ।

“কেমন আছো, বাবা? আমি ডা. পল্লবী ইসলাম।”
খুব মিষ্টি করে ইমতিয়াজকে জিজ্ঞাসা করেন পল্লবী।

ইমতিয়াজ ঘাড় দুলিয়ে বলল,
“ঠিক আছি।”

ইমতিয়াজ উঠে বিছানায় বসে। পল্লবী মৃত্তিকার রিপোর্টগুলো একে একে দেখে বলে,
“ওর অবস্থা খুবই খারাপ।”

ইমতিয়াজ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তারি রিপোর্ট সে বুঝে না, বোঝার কথাও না। এতো বড় বড় বিষয়ের রিপোর্ট বড় মানুষরাই বুঝবে।

“মৃত্তিকার কি হয়েছে?”

পল্লবী ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ঘাড়ের দিকটায় আর মাথার পেছনে আ°ঘা°ত পেয়েছিল। অবস্থা ভালো হবার কোনো লক্ষণ নেই।”

ইমতিয়াজ তাকিয়ে থাকে মৃত্তিকার চেহারার দিকে। মেয়েটার চেহারায় একটা পাকিস্তানি ভাব আছে। পাকিস্তানের মেয়েদের মতো লম্বা মুখ, চিকন গাল, হালকা-পাতলা ঠোঁট, মোটা ভ্রূ আর উঁচু নাক।

পল্লবী ইমতিয়াজের দৃষ্টি লক্ষ করে। বলল,
“দেখো, মানুষ তার নিজের ভাগ্য নিজে লিখে না। সৃষ্টিকর্তা যা দিয়ে দিয়েছে তা খ°ন্ডাবে কার সাধ্য।”

ইমতিয়াজ জিজ্ঞাসা করে,
“আমাদেরকে কি আপনি বাঁচিয়েছেন?”
“বাঁচাতে আর পারলাম কই? মৃত্তিকা তো বাঁচেনি, ও হয়তো কো°মায় থাকবে। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”

ইমতিয়াজের মনটা ছটফটিয়ে উঠে। পল্লবী এসে ওর পাশে বসে বলল,
“আমি না, আমার ভাই তোমাদের বাঁচিয়েছে। আমি তো তোমাদের অবস্থার কথা ভেবে এখানে শিফট করেছি।”

পল্লবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যেভাবে তোমাকে জি°ন্দা কবরস্থ করছিলো, এমন শ°ত্রু আমার শ°ত্রুরও না হোক।”

ইমতিয়াজ কিছুই বলে না, ওই শত্রুকে সে চেনে না। পল্লবী ওর হাতটা দেখে বলে,
“এটা এভাবে ভিজিয়ো না। নামাজ ছাড়া বোধহয় থাকো না। নামাজের সময় তায়াম্মুম করে নিও, আমি মাটি পাঠিয়ে দিবো।”

ইমতিয়াজের সন্দেহ নীলুফার আর পল্লবীর উপরেও হতে থাকে। এতো ভালো আচরণ কেন করছে, উদ্দেশ্য কি আসলেও ভালো নাকি নজর রাখা?

“আমাকে তোমার মায়ের বয়সী বলতে পারবে না। কিন্তু খালা কিংবা ফুপ্পির জায়গা অবশ্যই দিতে পারো। আন্টি ডাকতে পারো।”

পল্লবী চলে যাওয়ার সময় আবারো ফিরে দাঁড়িয়ে বলে,
“নাম ইমতিয়াজ, তাইতো?”

ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
“আমাদেরকে কি আপনি পার্সোনালি চিনেন?”
“না চিনলে কি কাউকে বাঁচানো যায় না?”
উত্তরের অপেক্ষা না করে সে চলে যায়।

ইমতিয়াজ অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। জীবনে তো কম মানুষের মৃ°ত্যু সে দেখেনি, চলে যাওয়া মানুষের মধ্যে আপনজন তো অনেক। তবে এভাবে জীবন্ত মৃত্তিকার জন্য কেন এতো কষ্ট হচ্ছে।

এই কষ্টের নাম দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে ইমতিয়াজ। নিজের য°ন্ত্র°ণাগুলো সে ভুলে গেছে। মনে আছে একটা কথা, ও হয়তো কো°মায় থাকবে। মৃত্তিকা আর ওই বড়বড় চোখ মেলে তাকাবে না। ওর লাজুক ভাবের খেলা ইমতিয়াজ আগেই খেয়াল করেছিল, যা এখন একটা বিছানায় সীমাবদ্ধ। সিল্কি লালচে সোনালী চুলগুলো আর গোছাতে ব্যস্ত হবে না সে।

অবশেষে এই খারাপ লাগার নাম দিয়ে দেয় ইমতিয়াজ। হয়তো এটা ভালোবাসা।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে