অতঃপর দুজনে একা পর্ব-০৬

0
1305

#অতঃপর দুজনে একা – [০৬]
লাবিবা ওয়াহিদ

————————
–“এসবের মানে কী আয়ন্তি? তুই কেন খালামণি, খালুকে ফেলে আলাদা থাকবি?”

আয়ন্তি নিরুত্তর। শূন্য নজরে জানালা ভেদ করে বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে সে। ব্যস্ত শহরের মানুষদের আনাগোনা পেছনে চলে যাচ্ছে একে একে। নিলা ফোন টিপছে এবং আড়চোখে রিয়ন, আয়ন্তিকে দেখছে। রিয়ন ড্রাইভিং এ ব্যস্ত। তার পাশের সিটেই আয়ন্তি বসে আছে৷ রিয়ন আয়ন্তির উত্তর না পেয়ে আবারও প্রশ্ন করে উঠলো। আয়ন্তি অন্যমনস্ক হয়ে রিয়নের উদ্দেশ্যে বলে,
–“ভার্সিটি থেকে বাড়ি দূরে, তাই এসেছি৷ তুমি ড্রাইভিং এ মনোযোগ দাও ভাইয়া।”
–“তোর মনোযোগ মাই ফুট! আমারে শিখাতে আসছিস কেমনে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিতে হয়? এমনি এমনি লাইসেন্স পাই নাই আমি!!”

আয়ন্তি ফিচেল হাসলো। নিলাও মুচকি, মুচকি হাসলো। রিয়ন লুকিং গ্লাসে নিলার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বলে,
–“হোয়াট? হাসির কী আছে এখানে?”

নিলা থতমত খেয়ে হাসি থামিয়ে দিলো। রিয়ন পুণরায় কোণা চোখে আয়ন্তিকে দেখে নিলো। আগের মতোই সে অন্যমনস্ক। রিয়ন স্পষ্ট শুনেছে নুরুল আলমের ঘরে আয়ন্তি এবং তার চেঁচামেচির শব্দ। এখন আয়ন্তি যদি কথা ঘুরিয়ে ফেলে তাহলে তারই বা কী করার আছে? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো রিয়ন। সব কেমন এলোমেলো লাগছে তার। আয়ন্তির জন্যে বড্ড টেনশন হচ্ছে তার।
–“আরে আরে, রিয়ন ভাই কই যাচ্ছেন? আপনি তো আমার এপার্টমেন্টের গলি পিছনে ফেলে আসছেন। গাড়ি থামান!”

সম্বিৎ ফিরে রিয়নের। কিছুটা হকচকিয়ে কষিয়ে গাড়ি ব্রেক করে। খুব দ্রুত বেগ কষায় আয়ন্তি এবং নিলা উভয়েই কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। আয়ন্তিরও খেয়াল ছিলো না সিটবেল্ট বাঁধতে। ভাগ্যিস বড়ো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি! রিয়ন এমনটি দেখে বেশ রেগে যায়। হুংকার ছেড়ে বলে,
–“কমনসেন্স নেই তোর? সিটবেল্ট বাঁধিসনি কেন? প্রাণের মায়া নেই? অ’ সভ্য মেয়ে!”

আয়ন্তি মুখ ভার করে রিয়নের দিকে তাকালো। রিয়ন প্রচন্ড রেগে। আয়ন্তি মুখ ভার করে বলে,
–“তুমি বকা ছাড়া আর কিছু বলতে পারো না ভাইয়া? আমার কী খেয়াল ছিলো?”
–“তো খেয়াল থাকে কোথায়? আমার ঘাড়ে চেপেছে যত্তসব যা-তা!”

রিয়ন ফুঁসতে ফুঁসতে গাড়ি ঘুরালো। আয়ন্তি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সিটবেল্ট বেঁধে নেয়। সে বুঝতে পারছে রিয়নের মনের অবস্থা। জয়া যা করেছে তার রাগ এখনো রিয়নের যায়নি। জয়া চোখের সামনে থাকলে নির্ঘাত তাকে চি’বিয়ে খেত। তাই আয়ন্তি আর কথা বাড়ায় না। শুধু শুধু রাগিয়ে কাজ নেই। মনের অবস্থা আপাতত কারোই ভালো নেই। বিষণ্ণ সময়টা এভাবেই কেটে গেলো। এপার্টমেন্টের সামনে এসে গাড়ি থামলো। আয়ন্তি এপার্টমেন্ট দেখতে দেখতে গাড়ি থেকে নামলো। রিয়ন ততক্ষণে গাড়ির পেছন থেকে আয়ন্তির লাগেজগুলো নামিয়ে নিলো। নিলা আমতা আমতা করে শুধায়,
–“আমার লাগেজটাও নামিয়ে দিন রিয়ন ভাইয়া!”
–“নিজের কাজ নিজে কর!”

গাল ফুলালো নিলা। তারটা মিডিয়াম সাইজের লাগেজ। কাপড়-চোপড় খুব একটা নেই। কিন্তু ভাব এমন যেন ওটা পঞ্চাশ কেজি চালের বস্তা। নিলাকে অবাক করে দিয়ে রিয়ন নিলার লাগেজও নামিয়ে দিলো।

আয়ন্তির সামনে লাগেজ গুলো আনতেই আয়ন্তি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে,
–“আজকের জন্যে ধন্যবাদ ভাইয়া। আর তোমাকে বিরক্ত করবো না।”
–“এ পর্যন্ত যেহেতু বিরক্ত করেছিস তাহলে আরেকটু বিরক্ত কর। তোর ফ্ল্যাট অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি। নিলা, যা চাবি নিয়ে দ্রুত দরজা খুল!”

নিলা ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেলো। আয়ন্তি তার এক লাগেজ ধরতে গেলে রিয়নও সেই লাগেজে হাত রাখে। যার ফলস্বরূপ এখন একে অপরের হাত স্পর্শ করেছে। আয়ন্তি চমকে রিয়নের দিকে তাকালো। মুহূর্তে-ই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাহবিন, মাহবিনের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত। আয়ন্তি দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। রিয়নও গলা খাঁকারি দিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা চালালো। কোনো দিক না তাকিয়ে রিয়ন লাগেজ নিয়ে ভেতরে ছুটলো। আয়ন্তি রিয়নের যাওয়ার পানে কিছু সময় তাকিয়ে নিজেও ভেতরে চলে গেলো।

রিয়ন লাগেজ রাখতে রাখতে নিলা সরবত বানিয়ে আনলো তার জন্যে৷ আয়ন্তি ততক্ষণে ঘুরে ঘুরে সবটা দেখছে। দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট, একটা লিভিংরুমও আছে। তবে লিভিংরুমে দুইটা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। একরুম তো পুরোই খালি, ওটা নিলা তালাবদ্ধ করে রেখেছে। আরেকটা রুম আছে, সেটায় এটার্চ ওয়াশরুম এবং সাথে ছোট একটি বারান্দা। বায়ু চলাচলে এই মাঝারো সাইজের রুমটিতে কোনো কমতি নেই। রুমের মধ্যে একটা খাট, একটি টেবিল আর একটি কাপড়ের র‍্যাক। কিছুটা অগোছালো রুমটি, তবে আয়ন্তি ম্যানেজ করে নিবে।

রিয়ন সরবত পান করে উঠে দাঁড়ায়। আয়ন্তির উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়ে। আয়ন্তি চটজলদি রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আয়ন্তি আসতেই রিয়ন বলে,
–“কোনো হেল্প লাগবে? লাগলে বল, নয়তো আমি যাচ্ছি!?”

আয়ন্তি মাথা নাড়ায় এবং বলে,
–“যতটুকু করেছো ততটুকুই বেশ। এখন চলো, তোমায় এগিয়ে দেই!”

আয়ন্তি রিয়নের পাশাপাশি সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বললো,
–“আব্বুকে বলে দিও, এখানকার অবস্থা!”
–“তুই বলে দিস। আমি কেন বলতে যাবো?”
–“তুমি বুঝবে না। তুমি-ই বলে দিও, প্লিজ!”
–“আহ! হাটুর বয়সী বাচ্চা মেয়ে আমায় বলে বুঝবো না। তুই বুঝি গাছ পাকা কাঁঠাল?”

হাসে আয়ন্তি। খুবই ক্ষুদ্র সেই হাসি। হাসি দিয়েই বলে,
–“তুমি তো আমার বড়ো ভাইয়ের মতো। তোমাকে সব বলে লজ্জিত হতে চাই না। সময় হোক, সব বলবো!”

অদ্ভুতভাবে বড়ো ভাই শব্দটি শুনে রিয়ন দমে গেলো। কোনো কথাও বললো না সে। আয়ন্তিও খুব একটা ঘাটলো না রিয়নকে। গাড়ির কাছে আসতেই আয়ন্তি বলে ওঠে,
–“খালার খেয়াল রেখো। তার আপডেট জানাতে ভুলিও না!”
–“তুই চিন্তা করবি না। ভালো ভাবে থাকবি!”

আয়ন্তি অধর জোড়া প্রসারিত করে ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। রিয়ন গাড়িতে উঠেই আয়ন্তির উদ্দেশ্যে বলে,
–“তুই ভেতরে যা। আমি এখান থেকে তোকে দেখবো!”

আয়ন্তি বিনা-বাক্যে ভেতরে চলে গেলো। রিয়ন তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রওনা হয় নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। অনেকটা পথ আসার পর রিয়নের খেয়াল এলো আয়ন্তি এবং নিলার খাবারের কথা। ওরা তো দুপুরে কিছুই খায়নি। বাসায় বাজার আছে কি না তাও জানা নেই! রিয়ন রাগে গাড়ির স্টেয়ারিং এ এক থাবা বসালো। কীভাবে ভুলে গেলো আয়ন্তিদের খাবারের কথা? রিয়ন পিছে তাকালো। এত বড়ো জ্যাম টপকে পুণরায় আয়ন্তির দিকে যাওয়া সম্ভব না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো রিয়ন।

আয়ন্তি যখন তার জামাকাপড় গুছাচ্ছিলো তখনই হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। আয়ন্তি চমকালো কিছুটা। নিলা কাজ ফেলে উঠতে নিলে আয়ন্তি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
–“তুই গুছা, আমি গিয়ে দেখছি!”

নিলা মাথা নাড়িয়ে কাজে মনোযোগ দিলো। আয়ন্তি উঠে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হয়। দরজা খুলতেই দেখে দারোয়ান হাতে একটি প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ চমকালো আয়ন্তি। গোল গোল চোখে একবার দারোয়ান তো একবার প্যাকেটের দিকে তাকাচ্ছে। দারোয়ান প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে থমথমে গলায় বলে,
–“আপনাদের পার্সেল এসেছে।”

বলেই দারোয়ান প্যাকেটটি আয়ন্তির হাতে ধরিয়ে দিলো। আয়ন্তি পিছে ডাকলো। কিন্তু দারোয়ান কানে নেয়নি। যেন তিনি কোনো বিরাট কাজ ফেলে এসেছে। আয়ন্তি মিনমিন করে আওড়ায়,
–“আমাদের আবার কিসের পার্সেল? আর এত ভারই বা কেন? একটা পরিচিত সুগন্ধীও নাকে বিঁধছে?”

আয়ন্তি দরজা লাগিয়ে ভেতরে চলে গেলো। নিলা তখন কিচেনে ছুটাছুটি করতে ব্যস্ত। ছুটতে ছুটতে নিলা বিলাপ করছে,
–“দেখেছিস কান্ড? এতক্ষণ ধরে আসলাম অথচ কিছুই খেলাম না। তোকেও খেতে দিলাম না। ভুলে গেলি এখন বিকাল হয়ে এসেছে, দুপুরে তো কিছু খেলামই না! আজব!!”

আয়ন্তি প্যাকেট খুলতে খুলতে কিচেনে আসলো। প্যাকেটের ভেতরে চোখ বুলাতেই আয়ন্তি হাসলো। হেসে হেসে বললো,
–“খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে!”

নিলা দমে আয়ন্তির পানে তাকায়। এমন ভাবে তাকায় যেন কোটর হতে চোখ বেরিয়ে আসবে তার। নিলা ভ্রু কুচকে অস্ফুট স্বরে বলে,
–“মানে?”
–“রিয়ন ভাইয়া বিরিয়ানি পাঠিয়েছে। চার প্যাকেট!”

নিলা হাসি দিলো অমায়িক হাসি। খুশিতে পাগল হবার জোগান তার। নিলা উচ্ছ্বাসের সাথে বলে,
–“সত্যি? কই, দেখি!”

আয়ন্তি নিলার হাতে প্যাকেটটি দিলো। নিলা একে একে সকল বিরিয়ানির প্যাকেট বের করলো। নিলা খাবার দেখতে দেখতে বলে,
–“রিয়ন ভাইয়াটা আসলেই জোস।”

হাসে আয়ন্তি।
–“হইছে, এখন ফ্রেশ হতে চল। বহুত কাজ করেছি। ফ্রেশ হয়ে খাবো।”

নিলা মাথা নাড়ায়। যেহেতু দুইটা ওয়াশরুম সেহেতু দুজনে আলাদা আলাদা ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো।

——————–
নুরুল আলম মাথায় হাত গুঁজে বসে আছে। আয়েশা তার মুখোমুখি বিছানাতে ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ চললো তাদের মাঝে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। একসময়ে আয়েশা কাতর স্বরে বলে ওঠে,
–“আমার মেয়েটা দুপুরে কিছু খেয়েছে নাকি গো?”

নুরুল আলম পলক ফেলে আয়েশার দিকে তাকালেন। আয়েশা পূর্বের ন্যায় ভাবলেশহীন। আয়েশা পুণরায় অন্যমনস্ক হয়ে বলতে লাগলো,
–“বাড়িটা বড্ড প্রাণহীন, ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কী ক্ষতি হতো মেয়েটাকে আটকালে?”

এবার ক্ষেপে গেলেন নুরুল আলম। স্ত্রীর পানে কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
–“তোমার কী মনে হয় আমি ইচ্ছাকৃত ওকে ছেড়েছি? কম তো বুঝাইনি তোমার মেয়েকে। তোমার মেয়ে আমার কথা শুনলে তো! সে নিজেই জেদ ধরে চলে গেলো। যাওয়ার সময় আমার দিকে ফিরেও তাকালো না।”
–“তাকাবে কেন আপনার দিকে? আপনি তো মেয়ের জীবনটাই অর্ধেক নষ্ট করে দিলেন। পুরো মহল্লায় বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পরেছে গতকালের ঘটনা। সেগুলো কী হাতের মোয়া? কী হতো মেয়েটাকে একটু বুঝলে? আমার মেয়ে দূরে গিয়েছে যদি আপনাকে শিক্ষা দিতেই তাহলে আমাকে কেন আপনার সাথে ঝুলিয়ে দিলো? একপট্টিও সময় দিলো না তার পাশে দাঁড়াবার, চলে গেলো আমার মেয়েটা।”

আয়েশা আর বসলো না। চোখে জল নিয়ে বেরিয়ে পরলো রুম থেকে। মেয়ের রুমে বসে আজ ভিষণ কাঁদবে, ভিষণ। সেই কান্না তার একার। কাউকে দেখাতে রাজি নয় সে। নুরুল আলম নানান প্রেশারে চোখ বুজলো এবং পেছনে মাথা এলিয়ে দিলো। এক মুঠো শান্তির সন্ধানে সে বড্ড তৃষ্ণার্ত।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে