অতঃপর দুজনে একা পর্ব-০৭

0
1284

#অতঃপর দুজনে একা – [০৭]
লাবিবা ওয়াহিদ

——————————-
–“নিলয়? দেখো তো কে এসেছে? কলিংবেল বাজছে তো। এই নিলয়! শুনতে পাচ্ছো?”
–“হ্যাঁ শুনেছি। এতবার বলা লাগে? যাচ্ছি তো!”

মেঘার কথায় নিলয় হাই তুলতে তুলতে সদর দরজা খুলে দিলো। অনাকাঙ্খিত মানুষকে দেখে নিলয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের দর্শন পেতেই আয়ন্তির চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। কতদিন সরাসরি দেখা করতে পারেনি ভাইয়ের সাথে। নীলা পাশ থেকে আয়ন্তির কাঁধে হাত রাখলো। নীলা আসতে চায়নি, অথচ আয়ন্তি তাকে জোর করে এনেছে। নিলয়ের নীলার দিকে নজর নেই, সে তার বোনের দিকেই পলকহীন তাকিয়ে আছে। আয়ন্তি টলমলে চোখ নিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
–“ভেতরে আসতে দিবি না? দাঁড়িয়ে থাকবো?”

নিলয়ের সম্বিৎ ফিরতেই সেও হেসে দিলো। হেসে হেসে বললো,
–“আমিও কী বোকা। আয় ভেতরে আয়।”

নিলয়ের হঠাৎ নজর পরে নীলার দিকে। নীলা কেমন প্রাণহীন নজরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয় জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে,
–“কী হলো, নীলু? আয়। তোকে কী এখন এক্সট্রা রিকুয়েষ্ট করতে হবে ভেতরে আসার জন্যে?”

কতদিন পর নিলয়ের কন্ঠে সেই আকাঙ্খিত ডাক। “নীলু”। নীলা নিজেকে সামলে অধরে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলে,
–“তা কেন? এইতো আসছি!”
বলেই আয়ন্তির পিছে নীলা ভেতরে প্রবেশ করলো। মেঘা নিলয়ের কন্ঠস্বর শুনে রান্নাঘর থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। নিলয় কার সাথে কথা বলছে তা দেখার আশায়। বৈঠক ঘরে আসতেই দেখলো তার দুই ননদ এসেছে। মেঘার মুখজুড়ে আনন্দের রেশ ফুটে ওঠে। অস্ফুট স্বরে ডেকে ওঠে,
–“আ..আয়ন্তি?”

আয়ন্তি মেঘার দিকে তাকায়। মেঘা পেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘা ছয় মাসের অন্তসঃত্ত্বা। আয়ন্তি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবীর কাছে ছুটে চলে গেলো। মেঘাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে ধীরে মেঘাকে সোফায় বসিয়ে দিলো। আয়ন্তি মেঘার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“কেমন আছো ভাবী?”
–“আল্লাহ রেখেছে ভালো। তুমি কেমন আছো? এতদিন আসোনি কেন?”

আয়ন্তি একবার নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“ব্যস্ত ছিলাম।”
নিলয় হুট করে কাঠ কাঠ গলায় বলে ওঠে,
–“তোর এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে?”
আয়ন্তি বেশ চমকালো ভাইয়ের কথাতে। ভাই জানলো কীভাবে? পরমুহূর্তে মাথায় এলো, হয়তো তানজিলা বা মুনিয়া নিলয়কে জানিয়েছে। মেঘা বিষ্ময়ের সাথে বললো,
–“এঙ্গেজমেন্ট? কিসের এঙ্গেজমেন্ট নিলয়?”
–“তোমার ননদের!”

এবার মেঘা বিষ্ময়কর চাহনি নিক্ষেপ করে আয়ন্তির পানে। আয়ন্তি ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
–“এঙ্গেজমেন্ট হয়নি। তোমাদের ছাড়া আমি বিয়ে করবো ভাবলে কী করে?”

আয়ন্তির কথায় নিলয় বেশ চমকালো।
–“মানে? গতকালই না তোর এঙ্গেজমেন্ট পার্টি ছিলো?”
–“বিয়ে ক্যান্সেল।”

অতঃপর আয়ন্তি দু’জনকে একে একে সব ঘটনা খুলে বললো। নিলয় অবাকের চরম পর্যায়ে। কিছুক্ষণ বোনের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
–“এটা তুই ঠিক করিসনি আয়ন্তি। কেন বাবাকে ছেড়ে আলাদা থাকবি?”
–“আব্বুর দাম্ভিকতা ছাড়ানোর জন্যে ভাইয়া। তাকে উপলব্ধি করাতে চাই ছেলে-মেয়ে দূরে থাকলে সময় কেমন কাটে। আমি চাই আব্বু তার ভুলগুলো শুধরে নিক, বোঝাতে চাই জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলেই ছেলে-মেয়ে সুখী হয় না!”

আয়ন্তি কথাগুলো বলে নীলার দিকে তাকালো। নীলা নাক লাল করে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। আয়ন্তি তাকাতেই নীলা সপ্তপর্ণে নজর ঘুরিয়ে ফেললো। মেঘা কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় থেকে বলে,
–“এটা ঠিক করেছো কিন্তু মায়ের কী হবে?”
–“মায়ের সাথে আমি যোগাযোগ বন্ধ রাখিনি তো। মায়ের সাথে দিনে চার বেলা হলেও কথা হবে।”
–“আচ্ছা। থাকো, আমি তোমাদের জন্যে কিছু বানিয়ে আনছি।”
–“এই না না। তোমার প্রোপার রেস্ট জরুরি।”

মেঘা মমতার সাথে পেটে হাত বুলাতে বুলাতে আনমনে বললো,
–“প্রথমজনকে তো নিজ গাফিলতির কারণে হারিয়ে ফেলেছি। ইন শা আল্লাহ তাকে হারাতে দিবো না।”

আয়ন্তি মেঘার দিকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রয়। নিলয় বললো,
–“আমি গিয়ে তোদের জন্যে খাবার নিয়ে আসি।”
–“আচ্ছা।”

নিলয় চলে গেলো। মেঘা এর আগেও কনসিভ করেছিলো। কিন্তু মেঘা সেবার পরে যাওয়ায় তার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। এতে মেঘা অনেকদিন মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পরেছিলো। ধীরে ধীরে মেঘা স্বাভাবিক হয়, আর দ্বিতীয়বারের জন্যে কনসিভ করে। নীলা সেই প্রথম থেকেই চুপ আছে, একটা টু-শব্দও করছে না। আয়ন্তি মেঘাকে নিলয়ের কাছে রেখে বললো,
–“ভাই৷ আমার মনে হচ্ছে এখন যাওয়া জরুরি।”
–“মানেহ? এলি তো সবে এক ঘন্টা হলো। এত তাড়া কিসের?”
–“সত্যি ভাইয়া যাওয়া প্রয়োজন। বুঝিস-ই আজ প্রথম উঠেছি বাড়িতে। আমি তো আসবোই, কাছাকাছি-ই তো আছি এখন। যাওয়া আসা হবেই। প্লিজ। জোর করিস না!”

নিলয়, মেঘা দুজনেই আয়ন্তিদের রাখতে চাইলো৷ কিন্তু আয়ন্তি শুনেনি। একসময় তারা রাজি হলো। তবে শর্ত হচ্ছে নিলয় দিয়ে আসবে। আয়ন্তি সাথে সাথেই না করে দিলো।
–“শুধু শুধু পেরাশানির কী দরকার ভাইয়া? আমরা দু’জন একটা রিকশায় উঠেই চলে যেতে পারবো।”
–“তোর কোনো কথা শুনবো না। অন্তত রিকশায় উঠিয়ে দেই তোদের?”
–“তাও করা যায়। আসি ভাবী!”

মেঘার থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বাসা থেকে নেমে গেলো। বাসার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই রিকশা পাওয়া গেলো। নিলয় নিজ দায়িত্বে ওদের রিকশায় উঠিয়ে ভাড়া দিয়ে দিলো। আয়ন্তির গালে হাত রেখে আলতো স্বরে বলে,
–“সাবধানে যা!”

নিলয় এবার নীলার দিকে তাকালো। নীলা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে,
–“বাই।”

নিলয় ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। রিকশা চলতে শুরু করলেই নীলা চোখ বুজলো। চোখের কোণ বেয়ে তার দু ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। আয়ন্তি নিরবে নীলাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
–“এখনো ভালোবাসিস ভাইয়াকে?”

হাসলো নীলা। হাসতে হাসতে বলল,
–“কীসব বলিস আয়ন্তি।”
–“লুকিয়ে লাভ নেই। তোর আচরণ-ই সব বলে দিয়েছে।”

আয়ন্তি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নীলা উত্তরে কিছু বললো না। আয়ন্তি অনুতপ্তের সুরে বললো,
–“তখন আমি শুধু ভাইয়া এবং ভাবীর সুখটাই দেখলাম। অথচ তোকে আমি নিঃশ্ব করে ফেললাম।”
–“চুপ। আমি কই নিঃশ্ব হলাম? আমি নিজেই তোকে পারমিশন দিয়েছি যাতে নিলয় তোর সাহায্যে পালিয়ে যায়। যেখানে সে আমায় ভালোই বাসতো না তাকে আমি জোর করে কীভাবে বেঁধে রাখতাম বল? এজন্যই আমি নিলয়কে আর আটকাইনি, করে নিক সে বিয়ে তার ভালোবাসার মানুষটিকে। জানিস কী, ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা মানুষটার সুখ দেখা অতি সুখের, গৌরবের!”

নীলার কথাগুলো শুনে আয়ন্তির চোখে ভেসে উঠলো মাহবিনের মুখশ্রী। অন্যান্য সময় হয়তো আয়ন্তি নীলার কথাগুলো উপলব্ধি করতে পারতো না। তবে এখন সে একজনকে ভালোবাসে, তাইতো এই কথাগুলোর গভীরতা অনুভব করতে পারছে। আয়ন্তি তাও মিনমিন স্বরে বলে ওঠে,
–“সরি।”
–“বেশি বলছিস এবার। রিকশা থেকে ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে দিবো কিন্তু।”

আয়ন্তি ফিক করে হেসে দেয়। নীলাও হাসে। চোখের জল সে আগেই মুছে নিয়েছে।

—-
রাতে মায়ের সাথে কথা বলে ফোন রাখতেই রিয়নের কল এলো। আয়ন্তি সময় ব্যয় না করে দ্রুত কল রিসিভ করে। অতঃপর সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল,
–“হ্যাঁ ভাইয়া!”
–“এতক্ষণ ধরে কল দিলাম, বিজি বলছিলো কেন? কার সাথে কথা বলছিলি?”
–“মায়ের সাথে। কেন?”
–“ওহ। কিছু না এমনি। খেয়েছিস কিছু? আমার খেয়ালই ছিলো না তোকে খাবার কিনে দেয়ার কথা। এখন দেখ, সেই বিকাল থেকে একটুও স্বস্তি পাচ্ছি না। কিছু খেয়েছিস নাকি আমি আবার আসবো? কী খাবি বল!”

একনাগাড়ে সব বলে রিয়ন থামলো। আয়ন্তি এদিকে থতমত খেয়ে বসে আছে। রিয়ন বিরিয়ানি না পাঠালে কে পাঠালো? দুশ্চিন্তায় বারংবার পলক ফেলছে আয়ন্তি। অপরপাশ থেকে পুণরায় শোনা গেলো রিয়নের ডাক।
–“কী হলো আয়ন্তি? চুপ আছিস কেন? কিছু বলছি আমি। এন্সা আমি!”
আয়ন্তি আমতা আমতা করে বললো,
–“খেয়েছি ভাইয়া।”
–“কী খেয়েছিস?”
–“পাশের বাড়ির আন্টিটা আমাদের খাবার দিয়ে গেছিলো। আর ডিনারের জন্যে বিরিয়ানি অর্ডার করেছি।”
–“টাকা আছে তোর কাছে? তুই বললে আমি এখনই পেমেন্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি!”

আয়ন্তি চোখ বড়ো বড়ো করে দ্রুত ভঙ্গিতে বললো,
–“না, না। আমার বিকাশে এনাফ টাকা আছে। তুমি চিন্তা করিও না।”
–“বলছিস তাহলে?”
–“হ্যাঁ, বলছি। কল রাখো, আমি ঘুমাবো!”

রিয়নের উত্তরের অপেক্ষা না করে আয়ন্তি কল খট করে কেটে দেয়। রিয়নকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলেছে সে, কারণ রিয়ন আগে থেকেই ডিপ্রেসড। এমতাবস্থায় আলাদা প্রেশার বা চিন্তা দিতে একদমই রাজি নয় আয়ন্তি। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পেছনের দেয়ালে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে রইলো। তার সকল চিন্তা বিরিয়ানি পাঠানো আগন্তুককে নিয়ে। কে পাঠালো? নীলা গিয়েছে পাশের ফ্ল্যাটে। নীলার ফ্ল্যাটে কোনো ফ্রিজ নেই বিধায় বিরিয়ানি গুলো হালিমা আন্টির ফ্রিজেই রেখেছিলো। মহিলা আবার নীলাকে নিয়ে বড্ড যত্নশীল। আয়ন্তিও পরিচিত হয়েছে হালিমা আন্টির সাথে। বিরিয়ানিগুলো নষ্ট হতে পারে বলে আয়ন্তি রিস্ক নিতে চায়নি। এখন আয়ন্তির মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, নীলাকে কী এসব সম্পর্কে অবগত করবে? নাহ, এখন কিছু বলার দরকার নেই। আগামীকাল দারোয়ান থেকে সবটা জেনে নেয়া যাবে।

আয়ন্তির ভাবনার মাঝেই নীলা বিরিয়ানি গুলো নিয়ে আসলো। সে একেবারে গরম করেই এনেছে। সন্ধ্যার সময় বিরিয়ানি গুলো আয়ন্তির গলা দিয়ে নামলেও এখন একদমই নামছে না। কারণ তখন জানতো রিয়ন দিয়েছে, কিন্তু এখন জেনেছে তার পরিচিত কেউ দেয়নি। অজানা কেউ পাঠিয়েছে। গলা দিয়ে আদৌ নামবে এই খাবার? কখনো না। তাও একপ্রকার বাধ্য হয়ে গলা দিয়ে নামাতে বলো। নয়তো নীলা সন্দেহ করবে। খুব কষ্টে অর্ধেক খেলো আয়ন্তি। বাকি অর্ধেক ফেলে রাখলো। আর খাওয়া সম্ভব না তার পক্ষে। নীলা খাবার চিবুতে চিবুতে বললো,
–“কী হলো? ফেললি কেন?”
–“খুদা নেই।”
–“বললেই হলো? আচ্ছা যা, আমি-ই খেয়ে নিবো।”

আয়ন্তি উত্তরে কিছু বললো না। হাত ধুঁয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। প্যাকেট থেকেই খেয়েছে বিধায় আলাদা প্লেট ওদের নষ্ট হয়নি, তাই বাসন ধোঁয়ার ব্যাপারটাও থাকলো না। নীলা খাওয়া শেষ করে প্যাকেটগুলো ফেলে নিজেও এসে শুয়ে পরলো আয়ন্তির পাশে। নীলা শুতেই আয়ন্তি ছাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শুধায়,
–“ওই রুমটা তালাবদ্ধ করে রেখেছিস কেন?”
–“আমি করিনি। এছাড়া আমি তো এক রুমের-ই ভাড়া দেই!”

আয়ন্তি ঘাড় বাঁকিয়ে নীলার পানে তাকিয়ে বলে,
–“মানে?”
–“দেখ এটা ভার্সিটি এরিয়া। অনেক স্টূডেন্ট-ই ভাড়া বাসাতে অথবা হোস্টেলে উঠে। তাই এদিকে বাড়িগুলাতেও স্টুডেন্টদের জন্যে কিছুটা সুবিধা আছে। আমি হোস্টেলে থাকতে পারি না, কেমন সব গুমোট লাগে। তাইতো বাবা এই ফ্ল্যাটে ভাড়া নিলেন। এছাড়া আমার এক রুমের সামর্থ্য ছিলো বিধায় এক রুমেই উঠেছি। বাড়ির মালিক চাইলেই ওই ঘরটা ভাড়া দিয়ে দিতে পারবে।”
–“এক ফ্ল্যাটে আলাদা দুইজন মানুষ?”
–“হ্যাঁ। দুইজন, চারজন, পাঁচজন থাকতেই পারে। আমি তো একাই থাকি, এখন তুই এসেছিস ভালো হলো। একা একা আর থাকতে হবে না!”
–“আচ্ছা। ঘুম পাচ্ছে আমার, গুড নাইট!”

আয়ন্তি পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরলো। ঘুমানোর পূর্বে মাহবিনের নাম্বারে একবার নজর বুলিয়ে নিলো সে। ইচ্ছে করে নাম্বারটিতে কল দিতে কিন্তু কল দেয়ার মতো সাহসটা নেই। আয়ন্তি ঘুমিয়ে পরতেই নীলা উঠে বসলো। হাটু উঠিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে কিছুক্ষণ বসে রয়। কী মনে করে ফোনটা হাতে নিলো। গেলারি থেকে একটা ছবি বের করলো। ছবিটা হলুদের ফাংশনে। নীলা এবং নিলয় পাশাপাশি বসে আছে। সেদিন ছিল নীলা এবং নিলয়ের হলুদ সন্ধ্যা। নীলা সেজেছিলো নিলয়ের জন্যে। নীলার গায়ে হলুদ লাগানো হয়েছিলো নিলয়ের জন্যে। ছবিটায় নীলাকে লাজুক হাসতে দেখা গেলেও নিলয়ের মুখে ছিলো না কোনো হাসি। হ্যাঁ, তাদের বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো। নীলা ছিলো তখন উঠতি বয়স, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। সেই সময়টায় নীলা তার মন-প্রাণ সবটা উজাড় করে দিয়েছিলো নিলয়ের ভালোবাসায়। নিলয় ছিলো তার প্রথম প্রেমিক পুরুষ। যাকে নিয়ে তার পরিবার স্বপ্ন দেখিয়েছে, আয়ন্তির বাবা স্বপ্ন দেখিয়েছে। গভীর স্বপ্ন। অলমোস্ট ওদের বিয়ে হয়েই যাচ্ছিলো। কিন্তু বিয়ের আগের দিন রাতে হঠাৎ আয়ন্তি তার কাছে আসে এবং তাকে জানায় নিলয় আরেকটি মেয়েকে ভালোবাসে, তাদের সম্পর্কও চলছে প্রায় পাঁচ বছর। মেয়েটির কথা জানতে পেরেই মূলত নুরুল আলম একপ্রকার জেদের বশে নিলয় এবং নীলার বিয়ে ঠিক করেছে। এমনটা শুনে নীলার এক নিমিষেই সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে চুড়মাড় হয়ে যায়। খুব বাজেভাবে তার মন ভাঙ্গে। পরবর্তীতে আয়ন্তি এও বলে,
–“ওই আপুটা সুইসাইড করতে যাচ্ছে নীলা। এখন ভাইয়া না গেলে সত্যি-ই মহা বিপদ হয়ে যাবে। নীলা, আমি তোর থেকে পারমিশন নিয়ে ভাইয়াকে পালাতে সাহায্য করতে চাই। প্লিজ বোন আমার, নিজের সাথে আরও দুইটা জীবন নষ্ট করিস না।”

সেদিন নীলা থমকে যায়। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিলয়ের গোমড়া মুখো মুখশ্রী। এতক্ষণে নীলা উপলব্ধি করেছে কেন নিলয়ের মুখে হাসি ছিলো না, কেন সে সবকিছু এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলো। সত্য’রা যেন চোখের সামনে আঙুল তুলে সবটা বুঝিয়ে দিলো। কল্পনা করলো ওই মেয়েটি সুইসাইড করলে তার পরিবারের কী হবে? নিলয়ের কী হবে? তাদের সংসার কখনোই সুখের হবে না। নীলা তখনই বড়ো এক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। আয়ন্তির উদ্দেশ্যে বললো,
–“নিলয়কে যেতে বল আয়ন্তি। গিয়েই যেন বিয়ে করে ফেলে আপুটাকে। তাদের জন্যে আমার দোয়া এবং নতুন জীবনের জন্যে শুভেচ্ছা রইলো।”

আয়ন্তি সেদিন হাসিমুখে নীলাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,
–“থ্যাঙ্কিউ নীলু। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোর খারাপ হতে দিবে না।”

নীলা সেদিন স্বচক্ষে দেখেছিলো নিলয়ের চলে যাওয়া। সেদিন নীলা কাঁদেনি। একদম কাঁদেনি। কথায় আছে না মানুষ অতি শোকে পাথর হয়ে যায়? তার বেলাতেও সেরকমই হয়েছিলো।

অতীত চোখের সামনে ভেসে উঠতেই নীলার চোখের কোণ বেয়ে অবিরাম জল গড়াতে লাগলো। নীলা চোখ বুজে পিছে খাটের ডিজাইন করা জায়গাটায় মাথা এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ চোখ বুজে নিলয়ের ছবিটায় গভীরভাবে চোখ বুলিয়ে আপনমনে বিড়বিড়ায়,,

–“ভালোবাসার মানুষটিকে যেখানে ঘৃণা করার কথা কখনো কেউ ভাবতেও পারে না, সেখানে একসময় তাদের প্রতি-ই জমা হয় তীব্র ঘৃণা। তাহলে আপনার প্রতি কেন ভালোবাসাটা-ই থেকে গেলো নিলয়?”

———————
পরেরদিন সকালে আয়ন্তি আগে ঘুম থেকে উঠে যায়। ফ্রেশ হয়ে কিচেনে চলে যায় নাস্তার ব্যবস্থা করতে। নাস্তা হিসেবে আপাত দৃষ্টিতে ব্রেড-ই দেখলো। তাইতো সময় বিলম্ব না করে আয়ন্তি ব্রেডে জেল লাগিয়ে নিলো। আলাদা ঝামেলার ইচ্ছে নেই তার। নীলা এখনো ঘুমাচ্ছে দেখে আয়ন্তি ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখলো। সাতটা বেজে পয়তাল্লিশ। এখনই সুযোগ নিচে দারোয়ানের সাথে দেখা করার। নীলার ঘুম এত সহজে ভাঙবে বলে মনেও হয় না। আয়ন্তি মাথায় ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। নিচে নেমে দারোয়ানকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো অন্য দারোয়ান। এ কী? গতকালকের দারোয়ান কই? নীলা সেই দারোয়ানের কাছে গিয়ে বলে,
–“আসসালামু আলাইকুম চাচা। এখানে কী আরেকজন দারোয়ান আছে?”
–“ওয়া আলাইকুম আসসালাম। জ্বী মা, আছে। দুই বেলার দারোয়ান আছে। আমার ডিউটি সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয়। কেন মা? কিছু দরকার?”
–“না চাচা এমনি। ওই দারোয়ান আসবে কখন?”
–“নয়টার দিকে।”
–“আচ্ছা ধন্যবাদ চাচা। আমি আসি!”

বলেই আয়ন্তি নিরাশ হয়ে চলে আসলো। নাহ, হার মানলে চলবে না। যে করেই হোক খবর তার বের করতেই হবে।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে