হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-৩৯

0
278

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩৯|
#শার্লিন_হাসান

আজকে আর্থ,শশীর বিয়ের রিসিপশন অনুষ্ঠান। চৌধুরী বাড়ীতে ব্যস্ততা। আর্থ শশীকে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়েছে। তাঁদের ভা’ঙা খাটের দিকে একবার চোখ ভোলায়। বুঝতে পারছে না এটা ভাঙতে গেলো কেন? মনে হয় অনেকদিন হয়ে গেছে তাই। শুভ্রর কথা মতো খাটটা চেঞ্জ করা উচিত ছিলো। ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে আর্থ। দু’জনে ফ্রেয় হয়ে নিচে যেতে দেখে, বাকী কাজ কর্ম ঠিকই হচ্ছে শুধু চৌধুরী পরিবারের সবাই ঘুমোচ্ছে। দু’জনে নাস্তা করে রুমে চলে যায়।

সকাল দশটার দিকে সবাই নাস্তা করতে বসে। নাস্তা শেষ হতে শশী,সেরিন,আদ্রিতা,অধরা তারা রেডি হতে চলে যায়। আয়মান চৌধুরী, শুভ্র তারা বাকী সব দেখছে। তাঁদের ইনভাইট দেওয়া গেস্ট রা আজকে আসবে। বাড়ীর ভেতরের বিশাল লিভিং রুমেই সব ঠিক করা হয়।

সেরিন আজকে শাড়ী পড়েছে। শশী গাউন পরিধান করেছে সাথে মেক-আপ। মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যে গেস্ট আসা শুরু করে। আর্থ,শশী স্টেজে বসে। শুভ্র সবার সাথে কথা বলছে। তার কিছু গেস্ট আছে। আবার তার বাবার কিছু গেস্ট আছে। সব মিলিয়ে শুভ্র একটু ব্যস্ত । বাকীরা সবাই নিচে আসলেও সেরিন এখন অব্দি আসেনি। ফ্যামিলি ফটো তুলবে অথচ সেরিন মিস্টেক। সবাই এক প্রকার তাড়া দেয় সেরিন কেনো আসেনি। শুভ্র মূহুর্তে মেজাজ হারায়। সেই তো গতকাল বড় মুখ করে বললো রেডি হতে বেশী সময় লাগবে না। শুভ্র একটু সাইডে এসে উপরে চলে যায়। রুমে প্রবেশ করতে দেখে সেরিন ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে কিছু কুড়াচ্ছে। শুভ্র ভেতরে প্রবেশ করে রাগ দেখিয়ে, চেঁচিয়ে ধমকে বলে,
“টাইম মেইনটেইন করা শিখোনি তুমি? এই তুমি এতো লেজি কেনো? তুমি এই বাড়ীর বড় বউ একটু দায়িত্ব জ্ঞান থাকা উচিত তোমার।”

ধমক শুনে সেরিন সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শুভ্রর ধমকটা তার পছন্দ হয়নি। মুখ দিয়ে কিছু বলার আগে চোখে জেনো পানি টলমল করছে তার। তখন শুভ্র পুনরায় ধমকে বলে,
“আবারো দাঁড়িয়ে আছো? আমার কথা তোমার কানে যায়নি মেয়ে?”

“আসছি। আপনি আগে যান?”

“কেনো? তুমি আবার লেট করতে? আমার সাথে আসবা তুমি।”

“পেছন দিয়ে আসছি।”

“এই তুমি কী লুকাচ্ছো?”

কথাটা বলে শুভ্র সেরিনের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এক হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে আরেক হাত পেছনে সেরিনের হাত নিজের মুঠোয় নেয়। সেরিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। শুভ্র সেরিনের হাত সামনে আনতে দেখে হাতে কাঁচের বোতলের টুকরো। শুভ্র তখন জিজ্ঞেস করে,
“এটা কিসের বোতল?”

“ওই পারফিউমের বোতল।”

“তো এটা নিয়ে এতো লুকোচুরির কী আছে? এটা ভে’ঙে গেছে ফেলে দাও। হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না।”

“আপনার পছন্দের এটা।”

“তো?”

“যদি বকা দেন?”

“সেরিন এই পারফিউম শপিংমলে হাজারটা আছে। তুমি এই সামান্য বিষয় নিয়ে ভয় পাচ্ছো?”

“আপনার যেই ধমক ভয় না পেয়ে উপায় আছে?”

সেরিনের কথা শুভ্র মাথা চুলকে বলে,
“আসলেই বেশী ধমক দেই?”

“তা নয়ত কী!”

“আচ্ছা আর দিবো না। এবার আসো।”

সেরিন মাথা নাড়িয়ে কাচের টুকরো গুলো ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে শুভ্রর সামনে দাঁড়ায়। শুভ্রর দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“আমায় কেমন লাগছে?”

“পরীর মতো।”

“তাহলে আসুন আমার জ্বীন। আপনাকে একটা চুমু খাই।”

“পরে। এখন লেট হয়ে যাবে।”

“আপনি এতো আনরোমান্টিক কেনো?”

“আমি এমনই।”

“আমার আর বাবুর আম্মু হওয়া লাগবে না।”

“ওটা সময় হলে দেখা যাবে।”

সেরিন শুভ্রর বরাবর দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে শুভ্রর গলা জড়িয়ে ধরে। চুপচাপ শুভ্রর অধরে নিজের অধর ছোঁয়ায়। কপালে চুমু দিয়ে বলে,
“এটা হলো বউয়ের দেওয়া নজর টিকা। দেখবেন দেখতে বিবাহিত,বিবাহিতদের মতো লাগবে তখন কেউ নজর দিবে না।”

“কেউ জানবে না এই কপালে কেউ চুমু দিয়েছে।”

“আচ্ছা চুলন।”

শুভ্র সেরিন বেড়িয়ে আসতে অধরার সাথে দেখা। তাকেও পাঠানো হয়েছে শুভ,সেরিনকে ডেকে নেওয়ার জন্য। তারা তিনজন এক সাথে যায় নিচে। সেরিনের সাথে শুভ্র সবার পরিচয় করিয়ে দেয়। সবাই মিলে সুন্দর একটা সময় কাটায়। শশী,আর্থ তারা সবাই পাটওয়ারী বাড়ীতে যাবে। সেরিনের কেনো জেনো যেতে ইচ্ছে করছে না। শুভ্র যাবে না মূলত সেইজন্য। মুখ ফুটে বলতে পারছে না। নাহলে সবাই ভাববে জামাই পাগ’ল মেয়ে। সেরিনের বিরক্ত লাগছে। এই বিরক্তি নিয়েই গাড়ীতে উঠে সে। মাহী ড্রাইভ করছে পাশে সেরিন বসা। মনে,মনে সবাইকে বকা দিচ্ছে সেরিন।

“আমার আর বাবুর আম্মু হওয়া লাগবে না। যে যেভাবে পারছে আমায় জামাইয়ের থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এক ঢাকা শহর আরেক পাটওয়ারী বাড়ী। এই শুভ্র টা ও না। বউয়ের জন্য একটু ও টান নেই। আমার মতো রোমান্টিক মেয়ের জামাই হওয়া চাই আরো চারগুণ রোমান্টিক। তা না! কী এক করলার জুশ।”

সেরিনের ভাবনার মাঝেই পাটওয়ারী বাড়ীতে এসে গাড়ী থামে।
সন্ধ্যাটা আড্ডা মাস্তিতে কেটে যায়। তবে সেরিন শুভ্রকে ভীষণ মিস করছে।
পাটওয়ারী বাড়ীতে পুনরায় শশীর রুম সাজানো হয়। সেরিন আসেনি সাজাতে। সে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দিয়েছে। কেউ আর জাগায়নি তাকে।

আর্থ ও তার শালিকাদের সাথে ঝগড়াঝাটি, আড্ডা মাস্তি দিয়ে সময় কাটিয়ে দেয়।

*********

এরই মাঝে কেটে গেছে এক সপ্তাহ। বিয়ের আমেজ শেষ হয়ে ব্যস্ততার আমেজ শুরু। সেরিনের ও পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। যদিও শশীও এখন আছে চৌধুরী বাড়ীতে। দুই বোনের একটা ভালো সময় কাটে। সন্ধ্যায় শুভ্রর রুলস অনুযায়ী খাটের উপর পড়তে বসে সেরিন। তখন কোথা থেকে শুভ্র আসে। চুপচাপ সেরিনের পায়ের উপর মাথায় রাখে শুভ্র। সেরিন একনজর শুভ্রর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। শুভ্র সেরিনের সামনে আসা চুলে হাত ভোলায়। পুনরায় শুধায়,
“কয়েকদিন পর তুমি ঢাকায় ব্যাক করবা।”

“আম্মুউউউ!”

“আস্তে!চেঁচাচ্ছে কেনো?”

“আমি ঢাকায় যাবো না।”

“এই তুমি আমার কথা শোনবা নাকী মা-ইর দিবো?”

“আমি গেলে অন্য মেয়েরা কলেজে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে। স্যার,স্যার বলে হোমওয়ার্ক দেখাবে?”

“এই তুমি খোটা দিচ্ছো?”

“তা নয়ত কী? দেখুন আপনি ওদের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। আপনার কত সুন্দর একটা বউ আছে।”

“আসলে কী জানো সেরিন? আমি তোমায় বিয়ে করার পর থেকে একটু নরম হয়ে গেছি। আগের মতো তেমন রাগ দেখাই না কারোর সাথে। এই মানুষ সুযোগ ও পেয়েছে তাই এমন।”

“এখনি ঠিক আছেন। ওতো রাগী হতে হবে না। শুধু মেয়েদের এভয়েড করবেন।”

“ধুর পা’গল। তোমার আমাকে কী মনে হয়? তুমি থাকতে আমি কেনো অন্য মেয়ের দিকে তাকাবো?”

“মনে থাকে যেনো।”

“থাকবে।”

**********

শশীর বেলকনি শুভ্রদের বেলনির সোজা পূর্ব সাইডে। রাতের ডিনার করে ফ্রেশ হয়ে সবে রুমে এসেছে শশী। আর্থ এখনো আসেনি তার চাচ্চুর কাছে কী দরকারে গিয়েছে। শশী বেলকনিতে আসতে ভয় পেয়ে যায়। বাইরে অন্ধকার। অথচ সন্ধ্যা থেকেই আলো জ্বলেছে। তারউপর কেউ একজন হাল্কা মৃদু আলোতে পূর্ব সাইডে যাচ্ছে। যেটা দেখে ভয়ে রীতিমতো শশী জ্ঞান হারানোর উপক্রম। তড়িঘড়ি বেলকনির দরজা লাগিয়ে দিয়ে রুমে আসে। তার পেছন দিয়ে আর্থ নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করে, “শশী!” বলে ডাক দিতে বেচারি সেখানে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। আর্থ শশীকে ধরে বলে,
” হায় তুমি মা হতে চলেছো? কিন্তু আমি তো এখনো কিছুই করিনি।”

আর্থর কথাটা কানে বাজলেও চোখ মেলে তাকতে পারেনি শশী। বার কয়েক ডাক দিয়ে শশীকে খাটের উপর শুইয়ে বাইরে যায় আর্থ। সবাইকে ডেকে ডুকে তার রুমে নিয়ে আসে। সবাই বেশ চিন্তিত। আয়মান চৌধুরী ডক্টরকে কল দিতে বিশ মিনিটের মধ্যে ডক্টর হাজির। শশীর প্রেসার চেক করে। আর্থ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। পাশে শুভ্র তাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। তাতে জেনো আর্থর গা জ্বলে যাচ্ছে। শুভ্রকে আলতো করে কি’ল মেরে বলে,
“বিশ্বাস কর ভাই আমি কিছু করিনি। কিন্তু ও যদি প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়?”

“না করলে বুঝি খাট ভেঙেছে? আর এটাতো খুশির খবর আমিও বাবা হবো। আইমিন তোর বাবুর বড় বাবা।”

“রাখ তোর বাবা। খাট ভাঙলেই যে বাসর করা হয়ে যায় বিষয়টা এমন না। খাটটা আগে থেকে ভাঙা ছিলো। দু’জন বসায় আরো তাড়াতাড়ি ভে’ঙে গেছে। আর আর আমি ওকে কিছুই করিনি যে ওর বাবু হবে।”

“তাহলে বাবুটা অন্যের তুই সেটা বলতে চাচ্ছিস?”

“আরে ভাই বাসরই করলাম না বাবু আসবে কোথা থেকে?”

“শ্লা তাহলে তোর খাট আমি এসে ভেঙে দিয়ে গেছি?”

“আরে ভাই ওটা তোর বদ দোয়া লেগেছে।”

ওদের কথার মাঝে ডক্টর বলে,
“কেন কিছু নিয়ে ভয় পেয়েছে। চিন্তার কারণ নেই জ্ঞান ফিরে যাবে।”

তখন আর্থ জোরেই বলে, “আল্লাহ বাচাইছে।”

আর্থর কথায় সবার দৃষ্টি আর্থর দিকে। বেচারা মুখ ফসকে কথাটা বলে আশে পাশে তাকাতে হুশ আসে। তখন আমতা,আমতা করে বলে, “আসলে আমি ভেবেছিলাম শুভ্র ভাই যেভাবে ভাবীকে ধমক দিয়ে অজ্ঞান করেছে নাকী আমার ধমকে শশী অজ্ঞান হয়ে গেছে। নাহলে তো আবার সবাই আমায় বকা দিতো।”

তখন সুলতানা খানম বলেন,
“তার মানে তুমি ওকে ধমক দিয়েছো আর ও ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে?”

তখন আরফিন চৌধুরী ধমকে বলেন,
“কী ছেলে তোমরা? এতো ধমকা ধমকি কিসের? এই তোমরা তো মেয়ে দুটোকে দুই দিনে হার্ট অ্যাটাকের রোগী বানিয়ে দিবে। এগুলো কোন ধরনের ধমকাধমকি যে মানুষ অজ্ঞান করে দাও।”

“আরে বাবা ওটা শুভ্র ভাই দেয়। আমি কোন ধমক দেইনি।…..

“শুধু বলেছিলো শশী কাছে আসো।”

আর্থর কথার মাঝে পোড়ন কেটে কথাটা বলে শুভ্র রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ওদের দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে বাকীরাও কিছু বলেনা। যে যেভাবে পেরেছে কেটে পরেছে। আর্থ মনে,মনে শুভ্রকে বকা দিচ্ছে। সব চেৈ বেশী বকা দিচ্ছে শশীকে। কী এমন দেখেছে যে অজ্ঞান হয়েছে? আর এই অজ্ঞান হওয়াকে ঘিরে কত গল্প রটে গেলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে