হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-৪০

0
274

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৪০|
#শার্লিন_হাসান

এরই মাঝে কেটে যায় প্রায় পনেরো দিন। সেরিন ঢাকায় ব্যাক করলেও বেশীদিন থাকেনি। শুভ্রকে বলে আবার কুমিল্লায় চলে এসেছে। সময় রাত এগারোটা প্রায়। সবাই ডিনার করে রুনে চলে গেলেও সেরিন যায়নি। সে জগে পানি নিয়ে উপরে যাবে। লিভিং রুমে কেউ নেই। সবাই উপরে। সেরিন টেবিলের উপররে ফিল্টারের থেকে জগে পানি নিচ্ছিলো। তার ডান সাইডে একটা কাঠের আলমারী টাইপের রাখা। তবে সেটায় কাঁচের আয়না ভেতরে কিছু প্রাইজ টাইপের জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা। দেওয়ালের ওপার থেকে সেরিন কারোর কান্নার আওয়াজ পায়। কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে শক্ত করে নেয় সে। এই বিষয়টা নিয়ে অবশয় শশীর সাথে মেলা আলোচনা হয়েছে। ভূত টুত কিছুই না। সেরিন আলমারীর সাইডে যায়। ফোনের ফ্লাশ অন করতে দেখেআলমারীর পেছনে হালকা ফাঁক দিয়ে একটা দরজার কাঠ বোঝা যাচ্ছে। সেরিনের আর বুঝতে বাকী রইলো না বিষয়টা। সে সিদ্ধান্ত নেয় এটা সরিয়ে দরজার ওপারে যাবে। এর পেছনের মানুষটাই হয়ত অনেক কিছু বলতে পারবে। বাট কে এই মানুষটা? আর কেনোই বা দেওয়ালের ওপারে বন্দী? সেরিন জগ রেখে আলমারীটা টান দেয়। ওতোটাও ভারী না তবে সরানো যায়ই। একটু কষ্ট হবে। শক্ত করে আলমারীতে স্পর্শ করতে কারোর ছোঁয়া কাঁধে পেতে শিওরে উঠে সেরিন। গাড় ঘুরাতে দেখে জান্নাতুল ফেরদৌস। সেরিনের দিকে তাকিয়ে সে কী ডেভিল হাসি। সেরিন আমতা আমতা করে বলে, “আরে মা আপনি এখানে?”

“তুমি আলমারীতে কী করছো?”

“এমনিতে পানি নিতে এসেছি। আলমারীটা দেখছিলাম কাঠের তো আবার পোকায় ধরেছে কী না।”

“গুড!”

“আমি তাহলে আসি মা?”

কথাটা বলে সেরিন জগ আর ফোন হাতে এক কদম ফেলতে জান্নাতুল ফেরদৌস খপ করে সেরিনের হাত ধরে নেয়। সেরিন পুনরায় পা স্থির করে তাকায়। তখন জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,
“আমি জানি তুমি অনেক কিছু বুঝে গেছো। তো চলো তোমায় আরো কিছু বুঝাই এবং বলি।”

থেমে পুনরায় বলেন,
“আসলে দেওয়ালের ওপারে একজন মানুষ বন্দী আছে। যাকে আমি আটকে রেখেছি। অবশ্য তুমি বলতে পারো আমি কেনো আটকে রাখলাম।আমার মতলব টা আসলে কী! দেওয়ালের ওপারের মানুষটা একজন মহিলা। এই মহিলাটা আমার বোন।”

সেরিন জেনো শকড। তখন জান্নাতুল ফেরদৌস তাকে হাতে দরে সোফায় বসায়। সেরিনের পাশে বসে বলে,
” জানো তো মা আমি ভীষণ খারাপ একজন মা। শুভ্রকে আমি ভালোবাসি কিন্তু ও আমার থেকে দূরে থাকে। কিঞ্চিৎ রাগ আমার উপর। মূলত তার মায়ের মৃ’ত্যুর পর আমি তার বাবার জীবনে না আসলেও পারতাম। জানো তো! আমি চাইলে সন্তান নিতে পারতাম। নেইনি, কারণ আমি চেয়েছি শুভ্রর বাবার ভালোবাসাতে কারোর ভাগ না বসে। সৎ ভাই বোন আসলে যতই ভালো সম্পর্ক থাকুক কিঞ্চিৎ হলেও ঈর্ষা থাকে। আমার বোন ও তোমার শ্বশুর কে পছন্দ করতো। জানো তো তোমার শাশুড়ী আসলে রোড এক্সিডেন্টে নাম দুর্ঘটনায় মা’রা গেলেও তাকে মা’রা হয়েছে। আমার বোন মে’রেছে। এতো দিনআমি অনেকটা পর,পর বা ভিলেন টাইপের আচরণ করে নিজেকে রহস্যময়ী করতে চেয়েছি। যাতে আমার বোনের উপর সন্দেহ না পড়ে। ওর পরিকল্পনা ছিলো চৌধুরী বাড়ীতে ঢুকে সবাইকে নিজের কথায় চালানোর। কিন্তু চৌধুরীরা সোসাইটিতে অনেক সন্মানীয় লোকজন। ওদের সম্মানহানি বা পরিবার তছনছ হয়ে যাক আমি চাইনি। সেজন্য ওকে সরিয়ে আমিই বিয়েটা করেছি। ওকে ঠিক কী শাস্তি দিলে ওর পাপের শাস্তিটা পূর্ণ হবে আমার জানা নেই। তটিনী আমার ভালো ফ্রেন্ড ছিলো। শুধু তটিনী না আশরাফ মালিথার ওয়াইফ ও আমার ভালো ফ্রেন্ড ছিলো। তুমি জানো বেস্টফ্রেন্ড এর মর্ম। তুমি তো এই যুগের মেয়ে।”

“ওনাকে ছেড়ে দিন তাহলে?”

“হুম দিবো ছেড়ে। সময় হয়ত হয়েছে। আশা করি ও আর এই পরিবারে ঢুকতে চাইবে না।”

“ওনার নাম কী?”

” জাহানারা।”

“ওনাকে কবে ছেড়ে দিবেন?”

“তুমি বলো?”

“আগামী কালকে?”

“আচ্ছা।”

সেরিন জান্নাতুল ফেরদৌসকে আগলে ধরেন। জান্নাতুল ফেরদৌসে সেরিনের কপালে চুমু খেয়ে বলেন, “তোমার কাছে এই পরিবার নিয়ে বা শুভ্র নিয়ে প্রথমে যা বলেছি তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”

“ইট’স ওকে মা।”

“শুভ্রকে বলিও আমায় যাতে মা বলে ডাকে। আর বলিও কঠোর ভাবটা কমাতে।”

“বলবো।”

“আচ্ছা যাও শুভ্র অপেক্ষা করছে।”

“ঠিক আছে মা।”

কথাটা বলে সেরিন উঠে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে কয়েক কদম ফেলতে শুভ্রকে দেখে। সেরিনের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। জান্নাতুল ফেরদৌস সেরিনের পেছন দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুভ্রকে দেখে। দু’জনেই ভয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন সেরিন আমতা আমতা করে বলে, “নিচে আসার কী হলো? আমি তো যাচ্ছিলামই।”

সেরিনের কথায় শুভ্র জান্নাতুল ফেরদৌসের থেকে দৃষ্টি সরায়। সেরিনের কথায় পাত্তা না দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখের কোণে তার ওানি চিকচিক করছে। জান্নাতুল ফেরদৌস শুভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেরিন পরিস্থিতি বুঝে শুভ্র সামনে এসে শুধায়, “প্লিজ মাকে ভুল বুঝবেন না। মা পরিবারের খারাপ চায় না। আপনি মাকে আমার মতো করে মা ডাকুন না?”

শুভ্র কথা গুলো শ্রবণ করে বলে, “মা!”

জান্নাতুল ফেরদৌসের মনটা জুড়িয়ে যায়। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে। শুভ্রকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খায় জান্নাতুল ফেরদৌস। সেরিন তাঁদের দেখে খুশি হয়ে যায়। তখন আবার আর্থ,শশী কিছু নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে,করতে নিচে আসে। ওঁদের তিনজনকে দেখে শশী বলে,
“আরে তোমরা এখনো ঘুমাওনি?”

“এই বনু তোমরা কোথায় যাচ্ছো?”

সেরিনের কথায় শশী বলে,
“ওই যে দেওয়ালের ওপাশের রহস্য উদঘাটন করতে।”

“ওইটা জেনে গেছি।”

সেরিনের কথায় শশী চোখ মুখ ঢলা দিয়ে সামনে আসে। সেরিনকে বলে, “এবার আমায় বল বনু?”

সেরিন তখন জান্নাতুল ফেরদৌসের বলা কথাগুলো বলে। এবং তারা সিদ্ধান্ত নেয় আগামী কালকে জাহানরাকে বের করে দিবে। শুভ্র সেরিনের সাথে উপরে যায়। শশী,আর্থ তারা একটু বাইরে যাবে। এই আর্থর শশীকে নিয়ে রাতের আকাশের শশী দেখতে যাবে তারা।

শুভ্র সহ সেরিন রুমে আসতে, শুভ্র সোফায় বসে পড়ে। সেরিন দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে সোজা শুভ্রর কোলে বসে,শুভ্রর গলা জড়িয়ে ধরে। ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে, “এবার প্লিজ নরম মনের হয়ে যাও মাই ডিয়ার হ্যান্ডাসাম শুভ্র স্যার ওরফে বাবুর পাপা।”

“বাবুর আম্মু যখন বলেছে হওয়া যায়ই।”

“আচ্ছা চলো আমরা বাবুর পাপা এবং বাবুর মাম্মাম হওয়ার মতো রোমান্টিক কাজটা করি।”

“এই তোমার মাথায় কী এই বাবুর আম্মু হওয়া ছাড়া কোন কথা নেই?”

“এই শুনুন তো! আপনি আমার স্বামী। মানে একটা হালাল সম্পর্কে আছি আমরা। আর স্ত্রী হয়ে আমি আমার অধিকার টা আদায় করে নিচ্ছি। আপনি বলুন আপনার উপর আমার হক নেই?”

“সে তো আছে।”

“তাহলে এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছেন কেনো?”

“আচ্ছা আর তাড়াবো না। এখন আসো আদর করি।”
কথাটা বলে সেরিনের কোমড় জড়িয়ে ধরে শুভ্র। প্রিয় পুরুষের ছোঁয়া নিজের সর্বাঙ্গে মাখছে সেরিন।

*******

আর্থ শশী গাড়ী এক সাইডে থামিয়ে রাস্তায় হাঁটছে। শশী ভাবছে সেদিনের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা। পরের দিন সকালে যখন জ্ঞান ফিরে তখন জানতে পারে আর্থ সবার কী পরিমান বকা শুনেছিলো। সেই সাথে দুইদিন পর তাঁদের খাট চেঞ্জ করা সে আরেক ঘটনা। শুভ্র এখনো আর্থকে চেতায় খাট ভা’ঙা নিয়ে। কিন্তু কে জানতো খাটটা এভাবে ভে’ঙে যাবে? আর্থ শশীর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“শোনো আমার ব্যক্তিগত চাঁদ আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি।”

“তাহলে শুনুন আমার ব্যক্তিগত সূর্য। আপনাকে প্রথমে সেরিন আমি সেজে ইমপ্রেস করেছে।”

“এই তুমি কী বলছো?”

“ঠিকই বলেছি। ওই যে কলেজে গেলেন চিনতে পারিনি কারণ জানিনা তো আপনি প্রেম করছেন আমার সাথে। মানে সেরিনের সাথে।”

“আসতাগফিরুল্লাহ আমি বড় ভাবীর সাথে প্রেম করেছি?”

“আরে ওটা তো আমিই ছিলাম। আমি আর সেরিন কী? দু’টি দেহ একটা আত্মা। আমরা টুইনের মতো।”

“সে নাহয় বুঝলাম।”

“এবার বলুন আ-মৃ’ত্যু অব্দি আমায় ভালোবাসবেন?”

“বাসবো,বাসবো,বাসবো।”

“ভালোবাসি।”

“আমিও ভালোবাসি।”

“এবং আমরা ভালেবাসি।”

শশীর কথায় আর্থ হাসে। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে তারা দু’জন বাড়ী ফিরে আসে।

*********

পরের দিন ওই রুমটায় যায় সবাই। সবাই বলতে মূলত শুভ্র,সেরিন,জান্নাতুল ফেরদৌস। জাহানারার অবস্থা অনেকটা কংকালের মতো। জান্নাতুল ফেরদৌসকে দেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“বোন আমায় মুক্তি দে। আমি অনুতপ্ত। শুভ্র আমায় ক্ষমা করো। আমায় বের করো। কতো গুলো বছর হলো দুনিয়ার আলো দেখিনি।”

তখন জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,
“আজকে তোর মুক্তির দিন। আশা করি বাকীটা জীবন সুন্দর ভাবে কাটাবি।”

“কাটাবো।”

তখন শুভ্র জাহানারার হাতের বাঁধন খুলে দেয়। সেরিন,জান্নাতুল ফেরদৌস তাকে ধরে বাইরে আনে
শুভ্র গাড়ী আনতে তাকে গাড়ীতে বসিয়ে রওনা হয় জান্নাতুল ফেরদৌসের বাড়ীতে। তারা দুই বোন ছিলো। কোন ভাই নেই। বাবা-মা অনেক আগে মা’রা যায়। বাড়ীতে পুরান হলেও দেখা শোনা করার মতো মানুষ আছে। প্রথমে জাহানারাকে ডক্টর দেখানো হয়। মেডিসিন, জামাকাপড় কিনে তাকে বাড়ীতে পাঠানো হয়। জাহানারার টেক কেয়ার করার জন্য দু’জনকে রাখেন জান্নাতুল ফেরদৌসে।

সেরিনকে নিয়ে শুভ্র চলে আসে। এরই মাঝে সেরিনের একটা কনসার্টের ডেট ফাইনাল হয়। সেইফ ফুড কার্নিভাল,বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টার, আগারগাঁও ঢাকা। ( লোকেশন কালেক্টেড)
আগামী কালকের মধ্যে সেরিন ঢাকা চলে যাবে। শুভ্র তাকে নিয়ে একটু শপিং মলের দিকে যায়। দু’জন মিলে কিছু কেনাকাটা করে। দুপুরের লান্স টা তারা বাইরেই করে নেয়। বাড়ীতে ফিরতে,ফিরতে প্রায় তিনটা বেজে যায়।

শুভ্র সেরিনকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। এই তো তাঁদের সবার দিন গুলো ভালোই কাটছে। স্বাভাবিক আর দশটা মানুষের জীবনের মতোই।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে