হিমি পর্ব-৮+৯

0
860

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

০৮.

ঘড়ির কাটা রাত বারোটার ঘর অতিক্রম করেছে। আকাশে বাঁকা চাঁদ, অগণিত তারাদের মেলা। চাঁদের রঙ সোনালী ঠেকছে। থমথমে পরিবেশ চারপাশে। জানালায় দাঁড়ানো মিশ্মির খোলা চুল গুলো হালকা উড়ছে। চোখের কোনে জমেছে স্বচ্ছ জ্বল। পলকহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চাঁদ দেখছে সে। মনে মনে কথাও বলছে প্রচুর। সে কথাগুলো বাইরের জগতের শোনা বারণ। কাউকে জানানো বারণ। বুকের ভেতরের দীর্ঘশ্বাস বুকেই নিভে যাচ্ছে। মিশ্মির গাল বেয়ে নোনা জ্বল গড়ায়। ঘাড় কাত করে সে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকায়। ঘরের দরজায় টোকা পরে। মিশ্মির ধ্যান ভাঙে। ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘কে?’

ওপাশের ব্যক্তি জবাব না দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে আসে। পুরো ঘর অন্ধকারে নিমজ্জিত। জানালার পাশটায় হালকা আলো। মিশ্মির অবয়ব দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ঘরের দিকে মুখ করে থাকায় চাঁদের আলো পেছনে আঁচড়ে পরছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না মোটেও। হিমি ভ্রু হালকা কুঁচকে মিশ্মির দিকে তাকায়। বলে,

‘তুই ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ঘুমাস নি?’

‘ঘুম আসছে না আপু। তাই হাঁটছিলাম।’

হিমি পকেটে দু হাত গুজে মিশ্মির দিকে এগোয়। মিশ্মি উল্টো ঘুরে আবার‌ও জানালায় হাত রাখে। হিমি বাইরে দেখে মৃদু হাসে। বলে,

‘চাঁদের সাথে গল্প করছিস না কি?’

‘হুম। তুমিই তো বলেছিলে চাঁদের সাথে গল্প করা উচিত!’

হিমি খানিকটা চমকায়। শান্ত গলায় বলে,

‘নিহানকে মনে আছে তোর? আমার মামাতো ভাই! ও নাকি তোর ভার্সিটিতেই পড়ে। দেখা হয়েছে কখনো?’

মিশ্মি মাথা উপর নিচ করে জানান দেয় ‘হ্যাঁ, হয়েছে!’ হিমি কথাটা কি করে বলবে ভেবে পায় না। এমন কোনো কথা তুলতে হবে যাতে বুঝা যায় মিশ্মি নিহানকে ভালোবাসে কি না। কিন্তু কি করে কি বলবে? হিমির অস্বস্তি চোখ এড়ায় না মিশ্মির। কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে প্রশ্ন করে,

‘কিছু বলবে আপু?’

হিমি আর ভণিতা করে না। ঝট করে বলে বসে,

‘তুই কাউকে ভালোবাসিস?’

মিশ্মির বুক ধক করে উঠে। শ্বাস প্রশ্বাস দ্বিগুন গতিবেগে বাড়ছে। হিমির অজান্তেই ঢোক গিলে মিশ্মি। ঠোঁটে জিহ্বা চালিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। বলে,

‘হঠাৎ এ কথা কেনো?’

‘এমনি।’

কথাটা বলে শান্ত দৃষ্টিতে বাইরে তাকালো হিমি। কিছুক্ষন পর বললো,

‘তুই যদি কাউকে ভালোবাসিস তবে আমাকে বলতে পারিস। আমি তোকে সাহায্য করবো। মামী, ছোটমামা ওরাও মেনে নেবে অবশ্য। তবুও যদি কখনো কোনো হেল্পের প্রয়োজন হয় তবে আমি আছি।’

মিশ্মি ঠোঁট চ‌ওড়া করে হাসে। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলে উঠলো,

‘এমন কোনো প্রয়োজন‌ই পরবে না। আমার দ্বারা এসব হবে না জানো! প্রেম ভালোবাসা এসব বুঝা মুশকিল। আমি তো ঠিক করেই রেখেছি আব্বু, আম্মু যাকে বলবে তাকেই বিয়ে করবো। একদম নাইন্টিন্সদের মতো বিয়ে হবে। আমি ছেলেকে দেখবো না। তার সাথে কথা বলবো না। তার নামটাও জানবো না। হুট করেই বিয়েটা হবে।’

হিমি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। মিশ্মি এমন বিয়ে করতে চায়? বিশ্বাস হয় না তার। পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়। মানুষের মনে তো অসম্ভব সব কিছুই সম্ভব। যখন তখন যা তা মন চাইতেই পারে। আর চাওয়াটাকে পাওয়ার অদম্য চেষ্টাও করা যেতে পারে। সুতরাং মিশ্মির চাওয়াটাকেও পাওয়াতে রুপান্তর করতে হবে। হিমি আর কথা বলে না। কথা বলে না মিশ্মিও। বেশ অনেকক্ষন নিরবতায় ছেয়ে থাকে ঘর। পিনপতন নিরবতাকে বজায় রেখেই হিমি বেরিয়ে যায়। মিশ্মি লম্বা শ্বাস টেনে নেয়। বুকের ভেতরের পাথরটা ভারি হচ্ছে। চোখে অশ্রুরা ঝরে পরার চেষ্টায় আছে। মিশ্মি সে সুযোগ না দিয়েই জানালা বন্ধ করে দিলো। ওয়াশরুমে ঢোকে বেসিনের নল ছাড়লো। দুহাতে পানির ঝাপটা মারতে লাগলো চোখে মুখে। নোনা জ্বলগুলো পানিতেই মিশে গেছে। মিশ্মি লাল হয়ে যাওয়া চোখ মুছে হাসলো। বাইরে এসে সটান শুয়ে পরলো খাটে। মুখের পানি মুছলো না। ফ্যানের বাতাসে পানি শুকাতে লাগলো। ঘরের দরজা হাট করে খোলা রেখে হিমি বেরিয়েছিলো। এখনো তাই আছে। মিশ্মির খেয়াল নেই তাতে। ঘুমের অপেক্ষা করতে হলো না অবশ্য‌। মেডিসিনের প্রভাবে চোখ লাগা মাত্র ঘুমের শহরে পারি জমালো মিশ্মি।
.
.
.
ব্রীজের উপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো তাহির। হিমির সাথে দেখা করতেই এখানে আসা তার। গায়ে ধূসর শার্ট, কালো জিন্স। এই মাঝরাতেও চুল পরিপাটি তার। পরনের পোশাকও ফিটফাট। ব্রীজে গাড়ির চলাচল কম নয়। বরং অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি। এতো রাতেও গাড়ি চলে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না তাহির। ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকায়। বেশ অনেকক্ষন পরেও হিমির দেখা না পেয়ে ফুটপাতে গিয়ে বসে। নিজের কাজে নিজেই হতভম্ব সে। একটা মেয়েকে সরি বলতে এতোদূর ছুটে এসেছে? সরি! এই একটা শব্দ বলতে এতো হন্নে কেনো তাহির। তাও সেই মেয়েকে যার নাম ছাড়া আর কিছুই জানে না। তার এই কাজ ঠিক হচ্ছে কি? মা যদি জানতে পারে তবে নিশ্চয় কষ্ট পাবে! তাহিরের মুখ চুপসে যায়। আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। হিমির সাথে হয়তো দেখা হবে না কোনোদিন। না হ‌ওয়াটাই ভালো। কিছু মানুষ অজ্ঞাত‌ই থাকে। তাদের সাথে চলার পথে হুট হাট দেখা হয়, কোনো কারন বশত মনে তাদের ছাপ থেকে যায় কখনো থাকে না। কিন্তু তাদের নিয়ে ভাবলে চলবে না। কোনো একদিন হুট করেই হয়তো দেখা হয়ে যাবে। তখন না হয় সরি বলা হবে, জানা হবে কিছু কথা। তাহিরের কি কিছু জানার আছে হিমির থাকে? এই প্রশ্নটা নিজের কাছেই অদ্ভুত ঠেকে তার। নিজের মনেই হাসে তাহির। মাথা চুলকে ড্রাইভিং সিটে বসে সিটবেল্ট পরে নেয়। সাথে সাথে বেজে উঠে মুঠোফোন। পাশের সিট থেকে ফোন তুলে রিসিভ করে তাহির। মায়ের চিন্তিত কন্ঠস্বর কানে আসে,

‘কোথায় তুমি তাহির? কখন আসছো?’

তাহির শান্ত গলায় জবাব দেয়,

‘অন দ্যা ওয়ে আছি মা। চিন্তা করো না। এক্ষুনি বাড়ি ফিরছি।’

মায়মুনা জামান স্বস্তি পান। হাতের তসবি ঠোঁটে ছুঁয়ান। ছেলের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে আত্মা কেঁপে উঠেছিলো তার। কোনো বিপদ আপদ হলো কি না ভেবেই বুক ফেটে যাচ্ছিলো মায়ের। তসবি হাতে নিয়েই জপতে লাগলেন আল্লাহর নাম। সহীহ সালামত যেনো ফিরে আসে তার একমাত্র সন্তান। ছেলের গলার স্বর শোনে মন তৃপ্তি পেলেও ভয় কাটে নি। কখন বাড়ি ফিরবে এই চিন্তায় সদর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তসবি পড়া থামে নি যদিও।
.
.
.
ব্রেকফাস্ট টেবিলে গোগ্রাসে খাবার গিলছে নিহান। মুহিব রহমান ভাতিজাকে পর্যবেক্ষন করে বললেন,

‘কোথাও যাবি না কি?’

নিহান খাবার মুখে পুরতে পুরতে মাথা নাড়ে। মুহিব মাথা দুলিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। চিনি বেশি হয়ে যাওয়ায় চা শরবতে পরিণত হয়েছে। চোখ মুখ কুঁচকে চায়ের কাপ সরিয়ে রাখলেন তিনি। রুটি ছিড়ে তরকারিতে লাগিয়ে মুখে পুরে বললেন,

‘নিহান? আস্তে খাও! এমন ভাবে খাচ্ছো যেনো অনেক দিনের অভুক্ত।’

নিহান খাবার চিবোতে চিবোতে বললো,

‘চাচ্চু, ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াহুড়া করে না খেলে লেইট হয়ে যাবো!’

মুহিব গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ক্লাসের এতো চিন্তা থাকলে ভোরে উঠা উচিত ছিলো। রাতভর বন্ধুদের সাথে জেগে আড্ডা দিয়ে ভোরসকালে ঘুমালে লেইট তো হবেই!’

নিহান কিছুটা লজ্জা পেলো। মাথাটা নুইয়ে রাখলো সে। মুহিব রহমানের বাবা মতিউর রহমান বিরক্তি গলায় বললেন,

‘আহ! ছেলেটা খাচ্ছে খেতে দাও। এভাবে খাওয়ার মাঝখানে ধমকে ধামকে তাকে লজ্জা দিচ্ছো সাথে কষ্ট‌‌ও! দেরি তো যা হ‌ওয়ার হয়েছেই। এখন পেট ভরে খেয়ে যাক।’

রাদিবা শ্বশুরের কথায় ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটালেন। নিহানের বাবা জনাব নেহাল রহমান মুখ ভার করলেন। আজীবন খাবার তাড়াতাড়ি খান বলেই বাবা তাকে বকেছেন প্রচুর। অথচ নাতিকে একটখ টু শব্দ‌ও বলেন না। ব্যাপারটা ওনার কাছে ভালো লাগে না। ভালো লাগে না আমিনার‌ও! মুহিব রহমান তাচ্ছিল্য হেসে খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পাঞ্জাবী ঠিক করে বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,

‘হিমিও সেদিন তাড়াতাড়ি খাওয়ার চেষ্টায় ছিলো। হাফসার বড় ভাবি তথা হিমির মামানি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। শুনলাম ওর এই অপরাধে প্লেট ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে?’

মতিউর রহমান থমকান। তবে কিছুক্ষনের জন্য। খাওয়ায় মনোযোগী হয়ে বলেন,

‘মেয়েদের একটু শাসনে রাখতে হয়!’

‘ওবাড়ি থেকে এবাড়ি আসতে দু ঘন্টা মতো লাগে বাবা। শুনলাম সেদিন ফিরতে দেরি হয়েছে বলে ঘরে ঢোকতে দেয়া হয় নি?’

মুহিব রহমান তীক্ষ্ণ গলায় বলেন। মতিউর রহমান কঠোর গলায় বললেন,

‘তুমি কোথায় শুনলে? কে দেয় এসব খবর?’

‘সেটা জরুরি নয়। জরুরি হলো মেয়েদের শাসনে রাখতে হবে বলে মাঝরাতে ঘরের বাইরে বের করে দিতে হয়? ‌ওতো রাতে এখান থেকে বেরিয়ে ও বাড়ি যেতে যেতেও প্রচুর সময় লেগেছে। সে রাতে তার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। জানেন?’

মতিউর রহমান ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলেন,

‘মেয়ে বাইক চালায় কেনো?’

মুহিব হাসেন। ধীর পায়ে সে স্থান থেকে প্রস্থান করেন। মতিউর রহমান পুরু ভ্রু জোড়া নিক্ষেপ করেন ব‌ড় ব‌উমার দিকে। আমিনা মাথা নত করে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকেন। এসব খবর যে উনিই দিয়েছেন মুহিব রহমানকে তা বুঝতে কারো বাকি নেই।

চলবে,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

০৯.

আরশিতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসলো সোহিনী। টিপের পাতা থেকে তুলে নিলো ছোট্ট কালো রঙের একটা টিপ। খুব সাবধানে কপালের মাঝ বরাবর সেটে দিলো টিপটা। চোখে মোটা করে কাজল লাগিয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করলো। ভালোবাসা হারিয়ে নিজেকে শেষ করতে চাওয়া সোহিনী আজ নিজেকে সাজাচ্ছে দেখে চমকালো দোহা। অবাক নয়নে সোহিনীকে পর্যবেক্ষন করে বলে উঠলো,

‘কি ব্যাপার দোস্ত? ‌সাজগোজ করছিস যে!’

সোহিনী মিষ্টি করে হাসলো। চুলে লাগানো ক্লীপ ঠিক করতে করতে বললো,

‘ভালো লাগছে তাই সাজছি। হিমি বলে, নিজেকে ভালোবাসতে হয়। সাজার জন্য কোনো কারনের প্রয়োজন পরে না, নিজের জন্য‌ই সাজা উচিত।’

দোহা হাসলো। ব্যাগে ব‌ই খাতা নিতে নিতে বললো,

‘যে মেয়ে নিজে সাজে না সে এসব বলে ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগে না রে?’

সোহিনী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

‘তা ঠিক বলেছিস। জানিস সেদিন কি বলছিলো ফোনে?’

দোহা ভ্রু নাচায়। সোহিনী ব্যস্ততা নিয়ে খাটে এসে বসে। বলতে থাকে,

‘পৃথিবীতে সবকিছুই সুন্দর। সব সুন্দর্য চোখ দিয়ে দেখা যায় না মন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়! ‌একজন মানুষকে সবার চোখে সুন্দর লাগবে না। এটা স্বাভাবিক কিন্তু মনের চোখ দিয়ে দেখলে, মন থেকে উপলব্ধি করলে সেই একজন মানুষ সবার কাছেই সুন্দর বলে বিবেচিত হবে।’

দোহা মাথা নাড়লো। ওড়না মাথায় টেনে নিয়ে বললো,

‘হিমি এতো কিছু জানে কি করে কে জানে? আমার না হিমিকে একটা ব‌ইয়ের মতো মনে হয়। যে ব‌ইয়ের প্রতি পৃষ্ঠায় সমাধান। সমস্যা গুলো যদিও অন্যের তবুও সমাধান সাজিয়ে রাখা তার কাছে।’

সোহিনী ভাবলেশহীন গলায় বলে,

‘হিমি আরেকটা কথা বলেছিলো। বলেছিলো, কার কাছে তুমি কতোটা ভালো, কতোটা সুন্দর তা প্রকাশ করতে যেতে নেই। নিজের মতো করে থাকা উচিত। নিজেকে নিজের কাছে সুন্দর করে তুলতে হবে। মুখে মেক আপের প্রলেপ ঘষে নয়, সাধারন ভাবেই। অতি সাধারন আমার মাঝে অসাধারন জিনিসটা খুঁজতে হবে। সবার মাঝেই না কি অসাধারন কিছু থাকে। খোলসে ঢাকা পরে মাত্র! ‌মানুষের কাছে সমাজের কাছে কখনোই নিজেকে পারফেক্ট করে তুলে ধরার প্রচেষ্টাও করা উচিত না। তুমি যতো পারফেক্ট হবে সমাজ ততো তোমার খুঁত ধরবে। তোমার চেষ্টা থাকবে দিন শেষে পারফেক্ট হতে আর সমাজের চেষ্টা থাকবে আবার‌ও তোমায় নিচে নামানো! কি দরকার পারফেক্ট হ‌ওয়ার? কিই বা হবে? নিজের মতো ইম্পারফেক্ট থাকায় দোষ তো নেই। যেখানে কারো কথায় আমাদের কিছু যায় আসে না সেখানে শুধু শুধু কেনো গায়ে মাখবো সেসব কথা! আমাদের উচিত অপমানজনীত কথা ছুড়ে ফেলা দেয়া। আচ্ছা, এসব কিছু কি সত্যি করা সম্ভব?’

দোহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শুষ্ক চোখ জোড়া ভিজে উঠবে উঠবে ভাব। দোহা সোহিনীর দু কাধে হাত রাখে। শান্ত গলায় বলে,

‘তুই হিমির সব কথা বিশ্বাস করিস?’

সোহিনী মাথা দুলিয়ে সায় দেয়। দোহা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে আহ্লাদী গলায় বলে,

‘তাহলে বিশ্বাস রাখ। হিমি মিথ্যে বলে না। ভুল‌ও বলে না।’

সোহিনী মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ায়। শাড়ির ভাজ ঠিক করে ঝোলার মতো দেখতে ব্যাগ কাধে তুলে নেয়। বাইরে বেরুতে বেরুতে আবার‌ও আরশিতে চোখ বুলায়। টিপটা বুঝি একটু সরে গেছে! সোহিনী টিপ ঠিক করে না। থাক না। যে নিজেই নিখুঁত নয় তার টিপ কেনো নিখুঁত ভাবে বসাতে হবে?

.

শোবার ঘর আবছায়া করে রেখে আরাম কেদারায় বসে মুহিব রহমান। হাতে তার এক সুন্দরী রমনীর আলোকচিত্র। গোলগাল গড়নের রমনীর পরনে মিষ্টি রঙের শাড়ি। রসগোল্লার মতো দু গালে গভীর দুই গর্ত! হাসলে সে গর্ত দুটি আরো গভীর হয়। মুহিব মাঝে মাঝেই টোল ছুঁয়ে দিতেন। কখনো তৃষ্ণার্তের ন্যায় চেয়ে থাকতেন। ছবির সুন্দরী রমনী এক গাল হেসে মুহিবের তাচ্ছিল্য করতেন। মুহিব তখন সুঠাম দেহী জোয়ান পুরুষ। স্ত্রীকে অত্যধিক ভালোবাসার এই মানুষটিই আজ ভালোবাসাহীনতায় ভোগে। কখনো কারন ছাড়াই হো হো করে হাসা ব্যক্তিটিই আজ হাসতে পারেনা। যার হৃদয়ে এক কালে অফুরন্ত ভালোবাসা ছিলো আজ তার হৃদয় পাথরের মতো। প্রচন্ড গম্ভীরতায় মুড়িয়ে গেছে মানুষটি। প্রিয়তমা স্ত্রীর ছবিখানা মাঝে মাঝেই বের করেন আলমারি থেকে। মৃত মানুষের ছবি না কি দেখতে নেই! তবুও তিনি দেখেন। চুপিসারে সবার আড়ালে আলতো করে ছবিটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। হ্যাঁ, এই গুরু গম্ভীর ব্যক্তি কাঁদে! ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’ কথাটার একদম বিপরীত মুহিব। স্ত্রীর মৃত্যুর দিন‌ও হাউমাউ করে কেঁদেছেন তিনি। আজ‌ও কাঁদেন, তবে কারো সামনে নয়। নিজের দূর্বলতা গুলো শুধু নিজেতেই আবদ্ধ তার। হাফসার ছবিতে আলতো পরশ বুলিয়ে বলে উঠেন,

‘হাসি? আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি বোধ হয়। তুমি আটকালে না কেনো? তোমার মেয়েকে এখন কি করে বোঝাই আমি? জানো, আমার সাথে কথা বলে না হিমি। আমি জানি আমিও খুব একটা বলি না তবে মাঝে মাঝে তাকে ফোন তো করি? হতে পারে দরকারে কিন্তু হিমি? ও কেনো আমায় একটাবার ফোন করে না বলতে পারো? ওর কি আমার দরকার পরে না? শেষ কবে আমাকে বাবা বলে ডেকেছিলো আমার সেটাও মনে নেই। তোমার মনে আছে?’

দরজার অপর প্রান্ত থেকে মতিউর রহমান ছেলের বিলাপ শুনে আৎকে উঠেন। মৃত স্ত্রীর ছবির সাথে মুহিব যে এভাবে কথা বলতে পারে তা তার ধারনার বাইরে ছিলো। তাও আবার হিমির কথা বলছে? যে ছেলে মেয়ের জন্মের পর মেয়েকে কোলে অব্দি নেই নি সেই কি না মেয়েকে নিয়ে এতো আবেগী? এতোগুলো বছর মেয়েকে আদর করে ডাকে নি মুহিব। অথচ আজকাল হিমিকে শাসন করায় বাবার মুখের উপর কথা বলে। অবাক হন মতিউর রহমান। আশ্চর্যান্বিত হয়েই লাঠিতে ভর দিয়ে নিজ কক্ষে ফিরেন তিনি।
.

ভার্সিটি ক্যান্টিনে তিনটে চেয়ার জুরে বসে আছে ইমন, সূর্য আর মেঘ। টেবিলে সমুচার প্লেট আর চা। তিনজন‌ই চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে আড্ডায় মত্ত। কাচের স্বচ্ছ জানালা ভেদ করে বাইরে তাকালো মেঘ। দোহা, সোহিনীর অপেক্ষায় এই নিয়ে তিন কাপ চা শেষ করেছে বন্ধুরা। এখনো তাদের আসার খবর নেই। সূর্য বিরক্তি নিয়ে বললো,

‘ওরা আসবে বলে মনে হয় না। আর বসে থেকে লাভ নেই। এই কাপ শেষ হলে উঠি মামা। কি বলিস?’

ইমন‌ও সায় দিলো তাতে। মেঘ খাপছাড়া ভাবে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে সমুচা উঠালো। সস ঢেলে এক কামড় মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বললো,

‘সমুচা তো শেষ কর। বিল যখন দিতে হবেই তবে সব শেষ করে উঠবো। ওই ইমন খা।’

সূর্য আবার‌ও বিরক্তির শীষ তুললো। বললো,

‘তোর ভাই পেটে বাঘ ঢোকছে। খালি খাইতেই আছোস। একটু কমাই খা। ভুরি টুরি হ‌ইয়া গেলে বিয়া করার সময় মাইয়া পাবা না।’

মেঘ ধীর স্থীরে সমুচা খায়। পানি দু ঢোক খেয়ে নিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলে,

‘আমি যতোই খাই ভুরি হয় না জানিস। আর হলেও চিন্তা নাই। যাকে বিয়ে করবো সে এসব ভুরি টুরি দেখে দৌড়ে পালাবে না বরং নতুন নতুন রান্না রপ্ত করবে। মিলিয়ে নিস!’

ইমন সন্দিহান গলায় বললো,

‘সেটিং করে রাখছিস না কি মামা? আল্লাহ রে! (সূর্যের দিকে তাকিয়ে) এসব কি শুনি দোস্ত!’

সূর্য জোড়ালো গলায় বললো,

‘ঠিক‌ই শুনছোত! শালায় মাইয়া ঠিক ক‌ইরা রাখছে। হুদাই আমাগো কয় কেউ নাই। খুঁইজা দে!’

মেঘ হাসে। টেবিলের দিকে ঝুঁকে বললো,

‘কসম খোদার কেউ নাই দোস্ত। একজন এনে দে।’

সূর্য কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। অপর দিক থেকে আসা ব্যক্তিদের প্রতিচ্ছবি সামনের কাঁচে দেখে চমকে উঠে সে। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আপন মনেই বলে উঠে,

‘আরিব্বাস!’

ইমন সমুচা চিবোচ্ছিলো। সূর্যের কথায় মাথা নেড়ে নেড়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কি হ‌ইছে?’

মেঘ হুট করেই দাঁড়িয়ে যায়। চোখে মুখে বিস্ময় তার। ইমন মেঘের দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে। ক্যান্টিনের দরজা পেরিয়ে ভেতরে আসছে তাদের এতক্ষনের কাঙ্খিত দুজন মানুষ। দোহা আর সোহিনী। কিন্তু তাদের ভড়কানোর কারন হলো সোহিনীর বেশ ভুসা। এর আগে কখনোই সোহিনীকে শাড়ি পরতে দেখে নি তারা। সোহিনী কখনোই টিপ পরে নি কপালে। সোহিনী বলতো টিপে তাকে মানায় না। বিশেষ করে কালো রঙের টিপ! অথচ সোহিনীর গায়ে জড়ানো কালো শাড়ি। কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শাড়ি পরার কথা বলা হলে সোহিনী তাচ্ছিল্য করে বলেছিলো, ফর্সা, সুন্দরী মেয়েদের শাড়িতে অসাধারন লাগলেও তাকে ফকিন্নি টাইপ লাগবে। সোহিনীর সে কথার সাথে আজকে কোনো মিল নেই। তাদের ভাবনার মাঝেই সোহিনী আর দোহা চেয়ার টেনে বসে পাশে। সূর্য সোহিনীকে আগাগোড়া দেখে হাসে। সোহিনী ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,

‘সরি রে একটু দেরি হয়ে গেলো! বাহ, তোরা দেখি খাওয়াও শুরু করে দিয়েছিস!’

ইমন চোখের ইশারায় সূর্য‌কে মেঘের দিকে তাকাতে বলে। সূর্য মেঘকে হা করে সোহিনীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খেঁকিয়ে উঠে,

‘ওই হারামী! খাড়াই আছোস ক্যান? ‌হার্ট ফেইল করছোস?’

মেঘের ধ্যান ভাঙে। গলা কেশে আগের জায়গায় বসে সে। ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন করে শাড়ি পরার কারন। সোহিনী বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,

‘ইচ্ছে হলো তাই পরলাম।’

সূর্য ডান চোখ টিপে দিয়ে বললো,

‘হেব্বি লাগতেছে কিন্তু!’

সোহিনী মাথাটা খানিক ঝুঁকিয়ে ডান হাত বুকের উপর রেখে বললো,

‘আমি কৃতার্থ!’

মেঘ ছাড়া বাকি চারজন উচ্চস্বরে হাসিতে ফেটে পরলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই তাদের সাথে যোগ হলো হিমি। ব্যাতিব্যস্ত হয়ে টেবিলের উপর রাখা বোতল হাতে তুলে নিলো। বোতলের মুখ খোলে ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে নিলো একসাথে। ইমন হিমির উদ্দেশ্যে বললো,

‘আস্তে আস্তে খা না।’

হিমির তাৎক্ষনিক জবাব,

‘সময় নাই দোস্ত। যেতে হবে।’

বন্ধুরা সমস্বরে প্রশ্ন করলো,

‘ক‌ই যাবি?’

‘আরেহ অথৈরা শপিংএ গেছে। কয়দিন পর ওর বিয়ে তো। আমাকেও ওখানে থাকতে হবে। আসি।’

সূর্য রাগি গলায় বললো,

‘যাবিই যখন তাইলে আসছোস ক্যান বেক্কল? হুদাই বাইকের পেট্রোল খতম করার কি মানে?’

‘তোদের জানানোর জন্য আসছি ডাফার!’

মেঘ হাই তুলে দুহাত টান টান করে বললো,

‘বলা শেষ? এখন ভাগ!’

হিমি কোমরে হাত রেখে দম নিলো। বললো,

‘শুরুই তো করি নি ভাগি কেমনে!’

সবাই ভ্রু উচিয়ে তাকালো। হিমি হাতের উল্টো পিঠে মাথার ঘাম মোছে নিয়ে বললো,

‘বাইকের টায়ার পাঞ্চার। ফোন বাবাজি আবার‌ও শহীদ হয়ে পরে আছে। এই মুহুর্তে এতো খরচ করার পয়সা নাই আমার। তোদের মধ্যে কেউ হৃদয়বান হয়ে থাকলে আমায় একটা নতুন ফোন কিনে দিস। আর মেঘ? বাইকটা গ্যারেজ থেকে বাসায় পৌঁছে দিস। আমি গেলাম। কয়েকদিন আমার দেখা পাবি না খবরদার জ্বালাতে আসবি না। টাটা!’

বন্ধুরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে করতেই হিমি হাওয়া। পাঁচ জোড়া চোখ ক্লান্তি, বিস্ময়, আর রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে হিমির যাওয়ার দিকে। যাদের তাকে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই তাদের জন্য নিরলস ভাবে ছুটে চলেছে সর্বত্র। মেয়েটা ভারি অদ্ভুত।

চলবে,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে