হিমি পর্ব-৬৭+৬৮

0
1014

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৬৭.

তখন মধ্যরাত। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই। কোনো কোলাহল নেই, শব্দ নেই। ফ্যানের ক্যাট ক্যাট আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ‌ও নেই। গভীর ভাবে খেয়াল করলে গাছের পাতা নড়ার আওয়াজ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই সময়ে কেউ সে চেষ্টা করছে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শ্রান্ত শরীরকে বিশ্রাম ব্যস্ত। হিমি বোধ হয় সবচেয়ে সুখকর কোনো স্বপ্ন দেখছিলো। ঘুমের মধ্যেও মিটিমিটি হাসছিলো সে। চেহারায় খুশি খুশি ভাব। দু হাতে জড়িয়ে আছে মোটাসোটা এক কোলবালিশ। গায়ে পাতলা কাঁথা। ঘরের জানালা ভেজানো। পর্দা গুটিয়ে রাখা। চাঁদের মৃদু আলো হিমির ঘরে প্রবেশ করে ঘরটা আবছা অন্ধকার করে রেখেছে। খোলা চুল বালিশের উপর এলিয়ে রাখা তার। খানিক পর পর‌ই ঠোঁটে হাসি প্রশস্ত হচ্ছে। স্বপ্ন হারিয়ে যাওয়া হিমির ঘুম ভেঙে যায় মুঠোফোনের বিকট রিংটোনে। নিরবতা ভেঙে গুড়িয়ে যায়। ধরফরিয়ে উঠে বসে হিমি। হাত বাড়িয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে মুঠোফোন হাতে উঠায়। স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়েই কর রিসিভ করে সে। আবার‌ও সব নিস্তব্ধ হয়ে পরে। যেনো এই নিরবতাই কাম্য এসময়। হিমি ক্ষীণ গলায় বলে,

‘কে?’

অপর প্রান্ত থেকে ভরাট গলায় জবাব আসে,

‘আমি।’

হিমি চমকায়। মুঠোফোন কান থেকে না সরিয়েই বলে,

‘আপনি এতো রাতে কল করলেন কেনো? বাড়িতে সব ঠিক আছে?’

তাহির জানায়,

‘হ্যা। ঠিক আছে।’

‘তাহলে মাঝরাতে কল দিয়ে আমায় জাগানোর মানে কি বাচ্চা ডাক্তার?’

‘আপনি ঘুমাচ্ছিলেন?’

আশ্চর্যান্বিত গলায় প্রশ্ন করে তাহির। হিমি অবাক হয়। বলে,

‘এই সময় না ঘুমিয়ে আমি কি ফুটবল খেলবো?’

রাগ হয় তাহিরের। গম্ভীর কর্কশ ধ্বনিতে বলে,

‘ঘুমান তাহলে। রাখছি।’

কথাটা বলেই ফোন কেটে দেয় তাহির। হিমি কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিনে সময় দেখে। রাত দুটো বেজে পঞ্চাশ মিনিট। এমন সময় তাহির তাকে কেনো কল দিলো? দরকার ছিলো কিছু? কি দরকার থাকতে পারে তাহিরের? ‌তাহিরের গলা শুনে তো মনে হলো না সে ঘুমাচ্ছিলো। তবে কি সে জেগে ছিলো? জেগে থেকে কাজ করছিলো? হিমির হঠাৎ মনে হয় তাহির বোধ হয় নাইট ডিউটি করছে। কাজের কোনো দরকারেই হয়তো তাকে ফোন করেছিলো। হিমি আবার তাহিরের নাম্বারে ডায়াল করে। একবার রিং হতেই ফোন উঠায় তাহির। হিমির ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলো না কি লোকটা? কে জানে?

‘আপনি এখন কোথায়? হাসপাতালে?’

‘না। বাড়িতে। কেনো?’

ভ্রু কুঁচকায় হিমি। কৌতুহলী গলায় বলে,

‘আপনি ডিউটি থেকে কখন ফিরেছেন?’

‘এসব কেনো জিজ্ঞেস করছেন? আগে তো কখনো করেন নি?’

‘আগে ইচ্ছে করে নি তাই করিনি। এখন ইচ্ছে করছে তাই করছি। বলুন না!’

হিমির কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি অনুভব করলো তাহির। শান্ত গলায় বললো,

‘এগারোটায়।’

‘তাহলে এখন জেগে আছেন কি করে? মানে কেনো জেগে আছেন? ঘুম নেই?’

‘না।’

‘কেনো? না কেনো?’

‘জানি না। সব কথার উত্তর দিতে পারবো না আমি।’

তাহিরের বিরক্তিমাখা কথা শুনে হাই তুলতে তুলতে হিমি বলে,

‘দিতে পারবেন না ভালো কথা। দিতে হবে না। ফোন কেনো করেছিলেন সেটা বলুন। এর উত্তর না দিতে হবে আপনাকে।’

তাহিরের স্পষ্ট জবাব,

‘ঘুম আসছিলো না আমার।’

‘তো?’

‘তো আর কি! আমি ভেবেছিলাম আপনার‌ও হয়তো ঘুম আসছে না। তাই ফোন করেছিলাম।’

‘আপনার ঘুম আসছে না বলে আমার ঘুম আসবে না? এটা কোনো কথা? আজব!’

কিছুটা অভিমান মিশ্রিত শুনা যায় তাহিরের কন্ঠ,

‘সম্পর্ক তো আমার ঘুম আর আপনার ঘুমের নয়। আমাদের দুজনের।’

তাহিরের কথা বুঝে না হিমি। শুকনো ঠোঁটে জিহ্বা চালিয়ে বলে,

‘মানে?’

‘কিছু না। আপনার ঘুম পাচ্ছে নিশ্চয়। ঘুমান।’

এই কথা বলার পর‌ও ফোন কাটে না তাহির। হিমিও কাটে না। কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে চোখ উজ্জল করে তাকায় হিমি। প্রয়োজনীয় কিছু মনে পরেছে এমন ভাব করে বলে উঠে,

‘জানেন, একটু আগে একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।’

‘ভালো করেছেন। ফোন কলের জন্য স্বপ্নটা পুরোপুরি দেখতে না পারলে ফোন কেটে ঘুমিয়ে পরুন। বাকি টুকুও দেখতে পারবেন।’

‘তার দরকার নেই। যতটুকু দেখেছি ততটুকুই বেস্ট।’

কথার পিঠে কিছুই বলে না তাহির। হিমি নিজ থেকেই বলে,

‘স্বপ্নে আপনি এসেছিলেন বাচ্চা ডাক্তার।’

‘আমি?’

‘হ্যা আপনি। আমি দেখলাম আপনি বিয়ে করছেন।’

‘হুয়াট?’

চটে যায় তাহির। এই মেয়েটা তাহিরের বিয়ে দেখে এতোটা খুশি হচ্ছে কি করে? সামান্য জেলাসি হচ্ছে না রাগ হচ্ছে না। নিজের বর অন্য মেয়েকে বিয়ে করছে সে স্বপ্নে সেটা দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পরছে। অদ্ভুত!

‘হ্যা। আপনি খুব সুন্দর একটা পাঞ্জাবী পরেছিলেন। রঙটা হয়তো খয়েরি বা কমলা ছিলো। মনে নেই। আমি দেখলাম আপনি হাসছেন। শাশুড়ি মাও খুশি ছিলেন। আপনি হেঁটে এসে স্টেজে উঠলেন। স্টেজে লাল টকটকে বেনারসী পরে সেজে গুজে বসে আছে কনে। আর আপনি তাকে মালা পরাচ্ছেন। কনেও আপনাকে মালা পরাচ্ছে। কি কিউট লাগছিলো! জানেন কনে কে ছিলো?’

তাহির ধমকে উঠে বললো,

‘জানতে চাই না আমি। বোকা মেয়ে একটা। কার সাথে কার বিয়ে স্বপ্নে দেখে আনন্দে লাফাচ্ছে! একটুও মায়া দয়া হয় না? বুঝেন না কিছু? এসব আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখেন কি করে?’

ভড়কে যায় হিমি,

‘স্বপ্ন কি আমার হাতে না কি? যে আমি যা দেখতে চাইবো তাই দেখাবে? স্বপ্ন তো স্বাধীন। যখন তখন যার তার ঘুমের ভেতর ঢোকে পরে। আমি কি করে বুঝবো?’

‘সেটা বুঝতে বলি নি। বলেছি আপনার স্বামীর সাথে অন্য একটা মেয়ের বিয়ে দেখে আপনার কষ্ট হয় নি? হিংসা লাগে নি?’

‘না। হিংসা কেনো লাগবে?’

‘কেনো লাগবে না? আপনি জানেন কাল থেকে আমার ঘুম হচ্ছে না। আপনি আমার কাছে নেই বলে শান্তি পাচ্ছি না। অস্বস্তি হচ্ছে। একটাবার‌ও কল করেন না আপনি। জানেন, কতোটা রাগ লাগে? নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অবহেলিত প্রাণী বলে মনে হয়। যাকে তার স্ত্রী নূন্যতম পছন্দ করে না। সময় দেয় না। ভালোও বাসে না। আশ্চর্য! ‌আমি এদিকে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন ওনার কথা ভেবে ভেবে অস্থির আর উনি ওদিকে আমার বিয়ে আরেক মেয়ের সাথে দেখে উৎফুল্ল হচ্ছেন। এসবের কি মানে হিমি? ইউ নো হুয়াট, আমি যদি আপনার জায়গায় থাকতাম আর স্বপ্নে আপনার সাথে অন্য কারো বিয়ে দেখতাম তাহলে স্বপ্নে দেখা আপনার বরকে বাস্তবে খুঁজে বের করে খুন করে দিতাম। মেজাজ টাই খারাপ করে দিলেন।’

হিমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। তাহির তার কথা ভেবে ঘুমাতে পারছে না ভেবেই আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছে হিমির। তাহির রাগ করে কথা গুলো বললেও তার প্রত্যেক কথায় হিমির প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। আর তাতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে হিমির মুখ। এদিকে ভেতরের সমস্ত রাগ ঝেড়ে ফোন কেটে রাগে ফুঁসতে লাগলো তাহির। হিমি বোকা বনে গেলো। এটা কি হলো? হিমির তো বলাই হলো না স্বপ্নে তাহিরের যার সাথে বিয়ে হচ্ছিলো সেই কনে হিমি নিজে। হিমি তাহিরের সাথে নিজের ধুমধাম করে হ‌ওয়া বিয়ে দেখে খুশি হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ সে পেয়ে গেছে। কিন্তু তাহির তো তাকে ভুল বুঝলো। কি করে ভাবলো সে হিমি তার বরের সাথে অন্য কাউকে দেখবে? যদি এটা সত্যি হতো তবে হিমিও তাহিরের কথা মতো বাস্তবে ওই মেয়েকে খুঁজে বের করে খুন করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। কত্তবড় সাহস! ‌হিমির স্বপ্নে এসে তার‌ই বরকে বিয়ে করে? ভাগ্যিস এমনটা হয় নি। নয়তো হিমি সেই মেয়ের সাথে সাথে তাহিরকেও মেরে দিতো। তাহির তো এসব বলার সুযোগ দিলো না তাকে। উল্টো রেগে গেলো। রেগে গেলে আগে বুঝা যেতো না। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতো। যেনো কিছুই হয় নি। কিন্তু এখন ধমকায়। মাঝে মাঝেই চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। লোকটা বদলে যাচ্ছে। হিমির বদলে যাওয়ার মতো করেই বদলে যাচ্ছে।

_________________

বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশ দেখছিলেন মুহিব রহমান। পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি শুনে মাঝে মাঝে পাখি খুঁজছিলেন। ঠিক তখন‌ই পেছন থেকে ডেকে উঠে হিমি,

‘বাবা?’

মুহিব রহমান ফিরে তাকালেন। মুখটা হাসি হাসি করে বললেন,

‘এখানে আয়। দেখ, কি সুন্দর সূর্য!’

হিমি মৃদু হেসে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘তোমার চা।’

মুহিব রহমান চায়ের কাপ হাতে নিলেন। গ্রিলের কাছ থেকে ফিরে এসে কাঠের চেয়ারে বসলেন। হিমি ততক্ষনে বারান্দার গ্রিল ঘেষে দাঁড়িয়েছে। বাইরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,

‘বাবা? তোমার সকাল ভালো লাগে না কি রাত?’

‘সকাল। কেনো বলতো?’

‘এমনি। জানতে ইচ্ছে করলো।’

‘আর কিছু জানতে ইচ্ছে করছে না?’

হিমি ভরসা পেলো। মুহিব রহমানের দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে বললো,

‘তুমি গান শুনো?’

মুহিব রহমান চায়ে চুমুক বসালেন। হাসি হাসি মুখে বললেন,

‘শুনি। তোর মতোই আমার বাংলা গান পছন্দ। রবীন্দ্র সঙ্গীত মাঝে মাঝেই শুনি।’

হিমি কিছুটা অবাক হলো। বললো,

‘তুমি কি করে জানলে আমার বাংলা গান পছন্দ?’

জবাবে ঠোঁট চ‌ওড়া করে হাসলেন মুহিব রহমান। হিমি উল্টো ঘুরে গ্রিলে পিঠ ঠেকালো। কৌতুহলী গলায় বললো,

‘তুমি আমার ব্যাপারে আরো অনেক কিছু জানো। না?’

‘হ্যা তো। জানি। মেয়ের ব্যাপারে বাবা জানবে না তা তো হয় না। এটা ঠিক যে তোর সাথে আমার সহজ হতে সময় লেগেছে। বহু বছরের মান, অভিমান, আড়ষ্টতা কাটতে দেরি হয়েছে। জড়তা কাটিয়ে উঠতে দেরি করে ফেলেছি আমি। সেই সাথে এটাও সত্যি তোর পছন্দ, অপছন্দ, ইচ্ছা, সবটাই জানার চেষ্টা করেছি। তোকে বুঝতে চেয়েছি। বুঝেওছিলাম। শুধু মুখ ফুটে বলতে পারি নি।’

‘দেখলে তো! তুমি আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেও আমায় বুঝো, জানো। আর এদিকে আমি তোমার কাছাকাছি আসতে চেয়েও তোমায় বুঝে উঠতে পারি না। আমি ভালো মেয়ে ন‌ই।’

মুহিব রহমান স্মিত গলায় জানতে চাইলেন,

‘চা তুই করেছিস?’

সতেজ হাসলো হিমি। উৎফুল্লতা বজায় রেখে বললো,

‘কি করে বুঝলে?’

‘চায়ে চিনি বেশি হয়েছে।’

মুখ মলিন হয়ে গেলো হিমির। মুহিব রহমান চুপ করে পুরো কাপ খালি করলেন। তারপর ধীর স্থির ভাবে বললেন,

‘আমি জানি তুই চা বানাতে পারিস না। চা খেতে তোর যতোটা আগ্রহ চা বানাতে আর এক ফুটাও নেই। তবুও বানিয়েছিস। আমি খাবো বলেই বানিয়েছিস। ভাবির থেকে জেনেছিস আমি কেমন চা পছন্দ করি। তুই আমার পছন্দ অপছন্দের খেয়াল রেখেছিস। অর্থাৎ তুই ভালো মেয়ে। তুই বাবাকে ভালোবাসিস।’

হিমির মুখে খনিকের খুশি খেলে গিয়ে আবার‌ও মলিন হয়ে উঠলো। মুখ ফুলিয়ে বললো,

‘চা তো তোমার স্বাদ অনুযায়ি হয় নি। বাজে হয়েছে।’

‘মোটেও না। বরঞ্চ আমার খাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাদ ছিলো এই চায়। জানিস, আমি এমন চা পছন্দ করতাম। ভীষন পছন্দ করতাম। তোর মা এমন চা করতো। হাসি চলে যাওয়ার পর বহু দিন চা খাই নি আমি। দেশে ফিরে যে যেমন দিতো খেতাম। কখনো বলি নি আমার এটা ভালো লাগে না। কেনো জানিস?’

হিমি মাথা নাড়ে। মুহিব রহমান বলেন,

‘আমি চাই নি হাসির হাতে বানানো চায়ের স্বাদ ভুলতে। এ বাড়িতে এক একজন এক একরকম চা বানায়। তোর বড়মা চায়ে চিনি কম দেয়। ছোটমা দুধ কম দেয়। আমি বানাই না। বড়ভাই বানালে দুধ চিনি সব বেশি বেশি। মিশ্মির চায়ে লিকার বেশি হয়ে যায়। এসবের মধ্যে আমি হাসির চায়ের স্বাদ খুঁজি নি কখনো। চোখ বুজে কল্পনায় স্বাদ নিতাম। হাসি সবার থেকে আলাদা ছিলো। সেটাও উপলব্ধি করতাম। আজ তুই তোর মায়ের হাতের সেই বেশি চিনি দেয়া চা বানিয়েছিস। আমার মনে হচ্ছে হাসিই বানিয়েছে। দুই যুগ পর আবার‌ও হাসির হাতের ছুঁয়া পেলাম। বড় শান্তি পাচ্ছি। হাসিও শান্তি পাচ্ছে। অন্য জগতে আমাদের বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখে খুশি হচ্ছে। আফসোস, এই ভালোবাসাটা সরাসরি দেখলো না হাসি। জানিস মা? হাসির বড় লোভ ছিলো। তোকে কোলে নিবে, তোর হাঁটা দেখবে। তোকে বড় হতে দেখবে। হাসি বলতো তোর চুল হাসির মতোই বড় ঘন হবে। ওর লোভ ছিলো। সেই লোভ স‌ইলো না। সে জানলোই না সত্যি সত্যি তার একটা মেয়ে হয়েছিলো। সেই মেয়ে আজ বড় হয়েছে। বিয়ে করেছে। সংসার করছে। হিমি হাসির মেয়ে। আমাকে একলা করে দিয়ে তোর মা চলে গেলো। উচিত হয় নি। এতো লোভ না করলে নিশ্চয় ও আজ জীবিত থাকতো। তোর মা লোভী।’

কথা শেষ করে শব্দ করে হাসলেন মুহিব রহমান। ওনার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরলো। সাবধানে সে জল মুছে নিয়ে হাসিতে মত্ত হলেন তিনি। হিমির চোখেও কিছুটা পানি। মাকে ভীষন কাছে পেতে ইচ্ছে করছে তার। হিমি এগিয়ে এলো মুহিব রহমানের কাছে দাঁড়িয়ে পাশ থেকেই জড়িয়ে ধরলো ওনাকে। কান্না ভুলে সেও হাসলো। বাবার কপালের কোনায় ছোট্ট চুমু দিয়ে ধীর গলায় বললো,

‘ভালোবাসি বাবা।’

মুহিব রহমান হাত বাড়িয়ে মেয়ের মাথায় রাখলেন। হাসি থামিয়ে বললেন,

‘আমিও মা।’

চলবে,,,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৬৮.

সকাল সাতটায় ঘুম ভেঙে নিজেকে তাহিরের বাহুডোরে পেলো হিমি। হিমির মাথা বুকের সাথে জাপটে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তাহির। হিমি মাথা তুলার সর্বস্ব চেষ্টা করেও পারলো না। দমবন্ধ লাগছে তার। হাত দিয়ে ঠেলে তাহিরের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে তাকে ডাকলো হিমি।

‘শুনছেন? ছাড়ুন না! দমবন্ধ লাগছে।’

তাহির শান্ত শীতল গলায় বললো,

‘ছাড়বো না।’

হিমি অবাক হ‌ওয়া গলায় বললো,

‘আপনি জেগে আছেন?’

‘না। ইচ্ছে করে জাগি নি। ঘুম ভেঙে গেছে।’

‘তাহলে উঠুন। হাসপাতালেও তো যেতে হবে!’

‘সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার এখন ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। এখন আপাতত এক ঘন্টা ঘুমাবো।’

‘আপনার ঘুমাতে ইচ্ছে করলে আপনি ঘুমান। আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। আমি উঠবো। ছাড়ুন আমায়।’

তাহিরের দৃঢ় গলার স্পষ্ট জবাব,

‘সরি। ছাড়তে পারলাম না। অনেকদিন পর কাছে পেয়েছি। এখন ছাড়াছাড়ি যাচ্ছে না। আমায় একটু শান্তিতে ঘুমাতে দিন তো। ছটফট করে সময় নষ্ট করবেন না। চুপ করে আমার বুকে ঘুমান। আমার ভালো লাগছে।’

হিমি আবার‌ও হাত দিয়ে ঠেললো তাহিরকে। তাহিরের হাতের বাঁধন শক্ত হলো। মুখে কিছু বললো না সে। হিমি হার স্বীকার করলো। ক্লান্ত হয়ে পরে র‌ইলো তাহিরের বুকেই। তাহির তখন‌ও জেগে। ঘুমানো তো বাহানা মাত্র। হিমিকে কাছে রাখার বাহানা।

দীর্ঘদিন বাপের বাড়ি কাটিয়ে গত রাতে বাড়ি ফিরেছে হিমি। একদিন তাকে ছাড়া বাড়িটা ভীষন ফাঁকা লাগছিলো তাহিরের কাছে। সব কেমন শূণ্য। রঙহীন। আজ থেকে আবার‌ও সবকিছুতে আনন্দ পাচ্ছে তাহির।

রাদিবা আজকাল বেশ খাতির যত্ন করছেন মিশ্মির। বহু বছর পর আবার‌ও বংশে সন্তান আসতে চলেছে। প্রথম বারের মতো দাদি হ‌ওয়ার সুখ আকাশচুম্বি। যদিও এই অনাকাঙ্খিত ঘটনায় নিহান কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পরেছে। মিশ্মির মনের ভাবটাও বুঝা যাচ্ছে না ঠিক। তবে পরিবারের বড়দের খুশির মাত্রা ছাড়াচ্ছে। নিহান মিশ্মি হয়তো এতো তাড়াতাড়ি বাবা মায়ের ভুমিকা পালন করতে চায় নি। হুট করে পরিকল্পনা বিহীন ব্যাপারটা ঘটে গেছে। পরিবারের সবার দিকে তাকিয়ে সে কথা আর কাউকে বলা হয় নি তাদের। নিজেদের মধ্যে বিচার বিবেচনা করে মেনে নিয়েছে সব। আল্লাহ‌র নেয়ামত বলে কথা। ওনার ইচ্ছাতেই সব হয়। আল্লাহ‌র ইচ্ছার উপর কথা বলার সাধ্য কার আছে? যখন থেকে এসব ভেবেছে তখন থেকেই লাজুক হাসছে মিশ্মি নিহান। শরীরে কম্পন ধরছে। শির শির করছে বুকের ভেতর। ভাবতেই অবাক লাগছে আট মাস পর তাদের বাচ্চা তাদের কোলে থাকবে। মিশ্মি ক্ষণিক পর পর‌ই তার পেটের দিকে তাকাচ্ছে। এতো ছোট পেটে একটা বাচ্চা? কি করে সম্ভব? ‌আচ্ছা, বাচ্চাটা কি মিশ্মির কথা শুনতে পাবে? নড়বে? পেট বড় হবে কবে? এতো ছোট জায়গায় থাকতে বাচ্চার কষ্ট হবে না? অদ্ভুত সব কথার বেড়াজালে নিজেই হাসিতে লুটোপুটি খায় মিশ্মি। রাদিবা আর আমিনা বেগমের মধ্যে ভাব হয় নি এখনো। বরঞ্চ এখন অহংকার করছেন রাদিবা। ছেলের সন্তান হবে। এই সুখটা তো আমিনা পাবেন না। কখনোই পাবেন না। প্রথমবারের মতো গর্ব করছেন রাদিবা। আমিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন তিনি। দয়ার চোখে দেখেন আমিনা বেগমকে। আমিনা বেগমের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। বাড়ির ব‌উয়ের দেখভাল করায় দুজনেই উঠে পরে লেগেছেন।

চেম্বারে রোগী দেখার মাঝখানে ঘড়ির দিকে চোখ যায় তাহিরের। হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরুতে গিয়ে মায়ের কাছে শুনেছিলো মিশ্মির প্রেগন্যান্সির খবর শুনে পুরো পরিবার তাকে দেখতে যাচ্ছে। তিনিও যাবেন। অর্থাৎ হিমিও যাবে। তাহিরের আর জিজ্ঞেস করা হয় নি হিমি থাকবে কি না। তবে সে জানে একবার ও বাড়ি গেলে হিমি নিশ্চয় আরো কদিন থেকে আসবে। কোনো মানে হয়? ‌এই না সেদিন ফিরলো? এখন আবার যেতে হবে কেনো? মিশ্মি সবে প্রেগন্যান্ট! বাচ্চা হয় নি এখনো। তাহলে কি দেখতে যাবে? ফোনে কথা বললে হয় না? দেখতে হলে যাক, কিন্তু থাকতে হবে কেনো? বিয়ের পর ঘন ঘন বাপের বাড়ি যাওয়া তো ভালো নয়। স্বামী সংসার থাকতে ও বাড়ি কেনো থাকতে হবে? বাড়ির ব‌উয়ের বাড়ির প্রতি কোনো দায় দায়িত্ব নেই? কবে বুঝবে এসব হিমি? তাহিরের রাগ বিরক্ততে পৌঁছে যায়। মনে মনে ঠিক করে যাই হয়ে যাক হিমিকে বাপের বাড়ি, মামার বাড়ি কোনো বাড়িতেই থাকবে না সে। হাসপাতাল থেকে সোজা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে হিমিকে নিয়ে আসবে। ওবাড়িতে সবাইকে বলবে মা বলে পাঠিয়েছে হিমিকে নিয়ে যেতে। আর হিমিকেও বলে দেবে মায়ের এসব পছন্দ নয়। তাহিরের কথার তো কোনো দাম‌ই নেই তার কাছে। শাশুড়ির কথার আছে।

হাসপাতালের ডিউটি শেষ হয়েছে রাত এগারোটায়। এতো রাতে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া উচিত হবে কি না সেসব এক মুহুর্তের জন্যেও মাথায় আসে নি তাহিরের। কাউকে কিছু না জানিয়ে হিমিকে আনতে চলে গেছে সে। তার ধারনা হিমি ওখানেই আছে। আজ রাত থাকবেও। অথচ তাহিরকে একটাবার জানালোও না। কিছুটা অভিমান জায়গা করে নেয় তার মনে।

কলিং বেলের আওয়াজ শুনে খাওয়া ছেড়েই উঠে আসেন আমিনা বেগম। দরজা খুলে তাহিরকে দেখে ভড়কে যান তিনি। হিমির কিছু হয়েছে কি না সেসব ভেবে মুখ কালো হয়ে যায় ওনার। উদ্বিগ্ন গলায় বলেন,

‘এতো রাতে? কিছু হয়েছে?’

তাহির সালাম জানিয়ে বললো,

‘হিমিকে নিতে এসেছি। কোথায় উনি?’

ভ্রু কুঁচকান আমিনা বেগম। ততক্ষনে বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন মোজাম্মেল রহমান আর মুহিব রহমান। তাহিরকে ভেতরে আসতে বলায় সে ভেতরে ঢোকে হিমির ঘরের দিকে উঁকি দেয়। বলে,

‘হিমি কি ঘুমাচ্ছেন? ডেকে দিলে ভালো হতো। আজ থাকবো না। উনাকে নিয়েই ফিরবো।’

ওনারা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। মোজাম্মেল সাহেব ভরাট গলায় বললেন,

‘হিমিকে নিয়ে ফিরবে মানে? ও তো এখানে নেই।’

‘নেই? কখন ফিরলেন?’

মুহিব রহমান জানালেন হিমি এ বাড়িতে আসে নি আজ। ফোন কলেই মিশ্মি নিহান আর বাড়ির সকালের সাথে কথা বলেছে। মায়মুনা জামান এসেছিলেন। আধঘন্টার বেশি বসেন নি। হৃদিকে নিয়েই এসেছিলেন। টুকটাক কথা বলে দুপুরের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। হিমির এখানে আসার কথা ছিলো না। ও বাড়িতেই আছে। তাহির ভীষন লজ্জা পেলো। ব‌উকে নিতে মাঝরাতে শ্বশুরবাড়ি চলে আসায় সবাই তাকে কি ভাবছে কে জানে! মোজাম্মেল সাহেব মিটিমিটি হাসছেন তার দিকে তাকিয়ে। নিহান তো বলেই বসলো,

‘তাহির ভাই তো দেখি হিমিকে চোখে হারান।’

সকলের চোখের দিকে তাকানোর ক্ষমতা ছিলো না তাহিরের। মুচকি হাসি আটকে পকেটে হাত গুজে ‘অনেক রাত হয়ে গেছে’ এই দোহাই দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সে। কাউকে কিছু বলার সুযোগ‌ও দেয় নি।

…………………………

শোবার ঘরে নীল রঙা ডিম লাইট জ্বলছে। ব্যালকনিতে ফর্সা আলো। তাহির ঘরে ঢোকে হিমিকে খুঁজলো। শোবার ঘরের ডিম লাইট বন্ধ করে রড লাইট জ্বালালো। এক ঝাঁক ফর্সা আলোয় ঘরের আবছা অন্ধকার ভাব কেটে গেলো। ঘরে হিমি নেই। কি ভেবে তাহির ব্যালকনির দিকে অগ্রসর হলো। যেমনটা ভেবেছিলো ঠিক তাই! ব্যালকনির দরজার কোণায় হাত পা গুটিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বসে আছে হিমি। তাহিরের পায়ের আওয়াজ কাছে আসতেই উঠে দাঁড়ালো সে। চটপট ঘুরে দাঁড়িয়ে চমকে দিলো তাহিরকে। তাহির গোল গোল চোখে হিমিকে দেখছে। প্রথমবারের মতো শাড়ি পরেছে হিমি। কমলা রঙের শাড়ি। কোঁকড়ানো লম্বা চুল বাঁধনহারা। দুহাতে মুঠো ভর্তি চুড়ি। কানে স্বর্ণের দুলের পরিবর্তে কমলা রঙের ছোট ঝুমকো। চোখে কি কাজল? হ্যা, তাই তো! হিমি কাজল পরেছে। মোটা করে নয়, খুব সুক্ষ ভাবে। ঠোঁটে বোধ হয় লিপস্টিক তার। সর্বদা গোলাপী থাকা ঠোঁটে লিপস্টিক পরলে বুঝা যায় না ঠিক। মনে হয় আলোর তারতম্যের কারনে ঠোঁটটা রঙিন। হিমির ঠোঁটে লিপস্টিকের পাশাপাশি আরো একটা জিনিস ছিলো। হাসি। মিষ্টি স্বচ্ছ হাসি। কোনো এক আবদারের হাসি। তাহির হয়তো সে হাসির পেছনের কারন উন্মোচন করতে সক্ষম হলো। এক দৃষ্টে মায়াময় মেয়েটাকে দেখে ধীর গতিতে পা বাড়ালো তার দিকে। হিমি ঘাবড়াচ্ছে। তাহির তা ঠাহর করতে পেরে মৃদু হাসলো। হিমির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্মিত গলায় বললো,

‘হঠাৎ সাজগোজ?’

‘নিরামিষ!’

হিমির কথায় ফিক করে হেসে ফেললো তাহির। হাত বাড়িয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো হিমিকে। চোখ বুজে লম্বা গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

‘অসুখটা ভীষন জটিল হিমি। তোমার ভালোবাসার অসুখে আমি পিষ্ট। নিঃশ্বাস নিতেও আজকাল তোমাকে চাই। রোজ রোজ অসুখটা বেড়ে চলেছে। তুমি আবার জর্জরিত করছো। মায়া হয় না? মায়াবতীর চোখ, ঠোঁটে যতোটা মায়া হৃদয়ে কি তার চেয়ে কম? দেখো না আমাকে রুগ্ন হতে? অসুখটা না বাড়ালেই কি নয়?’

হিমি মুচকি হাসে। ফিসফিস কন্ঠে বলে,

‘অসুখটা ছোঁয়াছে। আমার‌ও তো অসুখ করেছে। বাচ্চা ডাক্তারের কাছে বুঝি ঔষধ নেই? ঔষধ থাকলে অবশ্য অসুখকে অসুখ বলে বোধ হয় না।’

‘অসুখ তো আমার আগে হয়েছে হিমি। আগে আমায় সুস্থ করুন। পরে নাহয় আপনাকে ঔষধ দেবো!’

খিলখিল করে হেসে উঠে হিমি। তাহিরের বুক থেকে মাথা তুলে তাকায় তার দিকে। তাহির দেখে হিমির চোখের কোনে একটু খানি জল জমা হয়েছে। বুড়ো আঙুলে খুব সাবধানে জলটুকু মুছে দেয় তাহির। ঠোঁট ছুঁয়ায় কপালে। চাঁদের সম্পূর্ণ আলো বুঝি তাদের গায়ে এসে পরলো! অসুখটা ভালোই কাবু করেছে দুজনকে। একে অপরকে ছাড়া আর কিছুই নজরে পরলো না তাদের। প্রেম ভালোবাসার প্রতি ধাপে সুখ খুঁজতে লাগলো তারা। অসুখটা হয়তো কমবে কিছু। তবে পুরোপুরি যাবে না। এ অসুখ যায় না। যার একবার হয় তার আজীবন থেকে যায়। আমৃত্যু থেকে যায়। অসুখ বয়েই বেড়াতে হয় জীবন। সুখের অসুখ বলে কথা, ছাড়ানো তো অসম্ভব হবেই!

চলবে,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে