হিমি পর্ব-২৬+২৭

0
698

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

২৬.

উদ্বিগ্ন চেহারায় মিশ্মি বলে উঠলো,

-তুমি মিথ্যে কেনো বললে আপু?

হিমি শার্টের হাতা গুটালো। কলার ঠিক করতে করতে বললো,

-সত্য বলতাম?

মিশ্মি অস্বস্তি নিয়ে বললো,

-অন্য কিছু বলতে নাহয় আমায় মার খেতে দিতে। তা না করে শুধু শুধু নিহান ভাইয়াকে জড়ালে এতে। এখন যদি জেঠিমা তোমার মামার বাড়ি যায়?

হিমি দায়সারা গলায় জবাব দিলো,

-গেলে যাবে। আমি কি করবো?

-তোমার কোনো দায় দায়িত্ব নেই? নিহান ভাইয়া তো ফেঁসে যাবে। সাথে তুমি বকা খাবে মিথ্যে বলার জন্য। আমার অবস্থা তো বাদ‌ই দিলাম।

হিমি শান্ত গলায় বললো,

-তোর কথা বাদ দেয়ার প্রশ্ন‌ই উঠে না। তোকে উদুম কেলানি দেয়া উচিত। দিন রাত নিয়ম করে চড় থাপ্পড় লাগানো উচিত বেয়াদব! কখন কি আকাম ঘটাচ্ছিস তার বিন্দু বিসর্গ‌ও জানতে দিচ্চিস না। আবার সহজভাবে ধরাও পরছিস। নিজে তো মরবি সাথে যে তোকে বাঁচাতে চাইবে তাকেও মারবি। গাধী কোথাকার।

মিশ্মি যেনো লজ্জা পেলো হিমির কথায়। মুখ নামিয়ে স্মিত গলায় বললো,

-সরি তো।

-তোর সরি দিয়ে আমি আচার বানাবো? চিঠি দিয়েছিস দিয়েছিস সেগুলোর কাগজপত্র রাখতে গেলি কেনো আহাম্মক? ‌ছবি তুলেছিস মানলাম। তা বলে এতো ছবি? একটাতে হয় নি? চেহারাটাও দেখা যায় নি হুদাই টাকা নষ্ট! ‌আর ভাই পুড়াবিই যখন তখন চুলায় দিয়ে দিতি। তা না করে অর্ধেক পুড়িয়ে বাকি অর্ধেক রেখেছিস কোন আক্কেলে?

মিশ্মি মুখ কাচুমাচু করে বললো,

-একসাথে সব পুড়ালে তো অতিরিক্ত ধোয়ায় সবাই সন্দেহ করতো!

-হ্যা আর এখন যেমন করছে না! যা তুই নিজের ঘরে যা।

-আপু?

হিমি হাই তুলে বললো,

-আবার কি হলো?

মিশ্মি চোখে জ্বল নিয়ে বললো,

-যদি সবাই জেনে যায় ছবিগুলো নিহান ভাইয়ার নয় ইয়াসির স্যারের?

-তাহলে কিছুই না। তোকে এক দড়িতে ঝুলাবে আমাকে আরেক দড়িতে ঝুলাবে। তারপর দুম করে মরে যাবো দুজন। তাই বলছি ডিস্টার্ব করিস না। কাজ আছে। জীবন বাঁচাতে হলে এক্ষুনি কাজে লেগে পরতে হবে বুঝলি!

মিশ্মির কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো হিমি। মুঠোফোনে বার বার কারো নাম্বার ডায়াল করছে সে। অপর প্রান্তের ব্যক্তি ফোন উঠাচ্ছে না দেখে অসম রাগ লাগছে তার। কিন্তু এখন মাথা গরম করলে চলবে না। সবকিছু শান্তিতে গোছাতে হবে।

________________

ছয়জনের আড্ডাগ্রুপে আজ সবে চারজন। আড্ডাটা ঠিক জমছে না তাদের। সবার মনই বিষন্ন। রোজকার অসাধারন চা বিস্বাদ। সুন্দর দিনটাও বিশ্রী মনে হচ্ছে। সূর্য চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

-সবকটা হারামী। আরে ভাই, নিজেরে ল‌ইয়া ব্যস্ত হবি হ! ‌ব্যস্ততার ফাঁকে একটু খানি সময় আমাদের‌ও দে নাহয়। তা না করে কয়দিন ধরে লাপাত্তা হয়ে আছে। কোনো মানে হয়?

ইমন চেয়ারে হেলান দিয়ে বুকের উপর দু হাত বেঁধে বললো,

-এখন তাদের উকি মারার‌ও সময় নাই মামা। আর তুমি বলো কিছু সময় আমাদের দিতে!

সোহিনী ক্লান্ত গলায় বললো,

-এই আমাদের সেমিস্টার কবে রে? কোনো আইডিয়া আছে?

সূর্য বড় বড় চোখ করে বললো,

-থাপ্ড়াইয়া তোর দাঁত ফালাই দিমু বেক্কল। আমরা কি নিয়া কথা ক‌ই আর তুই কি কস! এখন সেমিস্টার ফেমিস্টার নিয়ে ভাববার সময় নাই এখন ভাবতে হবে ওই দুই শয়তানের খালার সমস্যা কি? দেখা পাওন যায় না ক্যান? পারলে এই বিষয়ে আলোচনা কর নয়তো চুপ করে থাক।

সূর্যের কথায় সোহিনীর ভাবাবেগ হলো না। অলস ভঙ্গীতে টেবিলে একহাত কাত করে রেখে অন্যহাতের কনুই ঠেকালো। গালে হাত রেখে বললো,

-একজন হবু বরের সাথে বাইরে ঘুরতে ব্যস্ত আর অন্যজন পারিবারিক সমস্যার নিচে যাতাকলে পিষ্ট!

মেঘ ভ্রু কুঁচকে বললো,

-বুঝলাম না।

সূর্য দুষ্টু হেসে বললো,

-প্রেমিকরা প্রেমিকার চোখের ভাষা বুঝে যায় আর তুমি মামা আমাগো সোহুর কথা বুঝো না! এইটা তো ঠিক না মামা। এই ইমন? ‌মেঘের এই অন্যায় কাজের লাইগা কি করা যায় ক তো!

ইমন সিরিয়াস ভঙ্গীতে বললো,

-থাম তো এখন। ভালো লাগছে না মজা ফজা।

-তা কি ভালো লাগছে? হবু ব‌উয়ের কথা ভাবতে?

মেঘের এহেন কথায় ভড়কায় সোহিনী। গোল গোল চোখে তাকায় ইমনের দিকে। ইমন হাসলো। সূর্য দুষ্টু হেসে বললো,

-কি ভাবো মামা? আমাদের ক‌ওন যাইবো না কি ক‌ইতে শরম লাগবো?

মেঘ উচ্চস্বরে হাসলো। সোহিনী ভরাট গলায় বললো,

-তুই বিয়ে করছিস? আমাদের জানালি না তো!

-তুই ছাড়া সবাই জানে সোহু।

সূর্যের কথায় এবার রাগ লাগলো সোহিনীর। তারমানে দোহা হিমিও জানে? তবে সে কেনো জানে না? তাকে জানানো হলো না কেনো? অপমানিত বোধ হয় তার। ইমন অপরাধী গলায় বলে,

-সরি দোস্ত। আসলে যখন‌ই এই বিষয় নিয়ে কথা হতো তুই থাকতি না।

-কোথায় থাকতাম আমি?

-ব্যস্ত থাকতি। তোর ওই হারামজাদা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে।

সোহিনী চোখ কপালে তুলে বললো,

-এতো আগে থেকে তোর বিয়ে ঠিক! কার সাথে? এই তুই প্রেম করতি?

ইমন মাথা নাড়লো। বললো,

-প্রেম করার চান্স পাই নি।

-এরেঞ্জ ম্যারেইজ?

সূর্য‌ বলে উঠলো,

-আরেহ না। বন্ধু তো বহু আগে থেকে ডুবে ডুবে জ্বল খেতো। আমাদের জানায় নাই লজ্জায়!(দুষ্টুমি করে)

-এসব কিছু না রে সোহু। খালাতো বোনের উপর ক্রাশ্ড ছিলাম। সেটা সে জানতো। তবে ভাবি নি ব্যাপারটা এতোদূর গড়াবে। কি করে কি হয়েছে সেসব‌ও জানি না। হঠাৎ একদিন বাবা বললো পাত্রী দেখতে যাবে। বিয়ের তারিখ‌ও ঠিক করবে। আমি তখন‌ও জানতাম না পাত্রী কে। পাত্রী হিসেবে সুপ্তিকে দেখে ভয়ানক চমকেছিলাম।

-তোর চমক তো এখনো যায় নি ভাই। দিন রাত চমকাচ্ছিস।

মেঘের কথায় হেসে ফেললো ইমন। সোহিনীও হাসলো। তবে মন খারাপ হয়ে গেছে তার। এতোগুলো দিন পর কেনো তাকে জানতে হবে তার‌ই বন্ধুর বিয়ে? কেনো ওরা আগে জানালো না? সোহিনীর বোধ হয় তাদের কাছে খুব ইম্পর্টেন্স নেই! হিমি দোহা না থাকায় তারা যেমন আড্ডার আসর বসাতে পারছে না সোহিনী না থাকলে নিশ্চয় তাদের আড্ডা থেমে থাকবে না? সবকিছুই স্বাভাবিক থাকবে। নিজেকে খুব মূল্যহীন মনে হয় সোহিনীর। এ জীবনে কখনোই কারো কাছে মূল্যবান হতে পারলো না। কারো জীবনের উদ্দেশ্য, কারো প্রিয়জন, কারো খুব আপন হতে পারলো না। বুকে জমে হাহাকার। তবু হাসে সোহিনী। বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে বড় গলায় গান‌ও গায়।

_________________

পিনপতন নিরবতা ভেঙে সতর্কতা মিশ্রিত গলায় কাশলেন মতিউর রহমান। ভর দুপুরে হানিফ শরীফ পরিবার সমেত ওনার বাড়িতে কেনো এসেছেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না। কদিন আগেই তাদের মেয়ের বিয়েতে ইনভিটেশন পেয়ে স্বপরিবারে উপস্থিত হয়েছিলেন বিধায় এখন কটু কথাও শোনানো যাচ্ছে না। কি এক মুসিবত! আমিনা বেগম ট্রেতে করে চা বিস্কুট দিয়ে গেলেন। রাদিবা পেছন পেছন ট্রে তে করে স্ন্যাকস নিয়ে এলেন। হানিফ শরীফ শুকনো হেসে বিনয়ী গলায় বললেন,

-আপনাদের না জানিয়ে হঠাৎ চলে আসায় হয়তো আপনারা বিব্রত বোধ করছেন। তার জন্য আমরা দুঃখিত। আসলে বিষয়টাই এমন যে না এসে পারলাম না।

মতিউর রহমান মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,

-না ঠিক আছে। তা কি বিষয়?

অনাহিতা নাহার দাপটের স্বরে বললেন,

-আপনাদের ছেলে নিহান কোথায়?

রাদিবা চমকে উঠলেন। চমকানো স্বরেই বললেন,

-কেনো? ওর সাথে কি দরকার আপনাদের?

-দরকারটা আপনাদের সামনেই বলবো। ডাকুন ওকে।

রাদিবা ঢোক গিলে মতিউর রহমানের দিকে তাকালেন। মতিউর রহমানের কপাল কিছুটা কুঁচকানো। তিনিও ভাবছেন নিহানকে ডাকার কারন। সেই সময় বসার ঘরে এসে উপস্থিত হলেন মুহিব রহমান। হানিফ শরীফ এগিয়ে গিয়ে গলা মিলিয়ে কুশলাদি করলেন। অনাহিতার গায়ে যেনো জ্বালা ধরলো। কিছুটা গম্ভীর গলায় বললেন,

-নিহান বাড়ি নেই?

-আছে। ছোট ব‌উমা? ডাকো তো ওকে। বলো আমি ডাকছি।

শ্বশুরের কথায় রাদিবা মাথা নেড়ে ভেতর ঘরে ঢোকেন। তুমুল গতিতে ছুটা হৃদপিন্ডের সহিত‌ই ছেলেকে ডেকে আনেন বসার ঘরে। নিহান অমায়িক হেসে তাদের সালাম জানায়। মতিউর রহমান পান চিবোতে চিবোতে বলেন,

-এনাদের চিনেছো?

নিহান মাথা দুলিয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়। অনাহিতা ভণিতা না করেই বলেন,

-মিশ্মিকে কবে থেকে চেনো? কতোদিনের আলাপ?

নিহান ঢোক গিলে আশেপাশে তাকায়। তার পরিবারের সবাই ভ্রু কুটি করে দেখছে তাকে। নিহান জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রাখলো। অনাহিতা ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে বললেন,

-উত্তর দাও।

-ইয়ে মানে,,,,,,

হানিফ শরীফ স্ত্রীকে থামিয়ে বললেন,

-কি জানতে এসে কি জানতে চাইছো? নিহান, তুমি কি আমাদের মিশ্মিকে কয়েকটা চিঠি দিয়েছো?

অনাহিতা তাচ্ছিল্য গলায় বলেন,

-কয়েকটা!

হানিফ শরীফ নিজের কথা শুধরে বলেন,

-মানে অনেকগুলো। দিয়েছো?

নিহান মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। হানিফ শরীফ আবার‌ও প্রশ্ন করেন,

-মিশ্মির কাছে চিঠির সাথে যে এক গাদা ছবি রয়েছে সেগুলোও কি তোমার?

নিহান এবার‌ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। হানিফ শরীফ আবার‌ও বললেন,

-মিশ্মির থেকে নিজের পরিচয় লুকাতে এসব করেছো। মিশ্মি তো জানতেও পারে নি ওটা তুমি। আর আমরা সবাই,,,,,

হাশিম শরীফ স্ত্রী রোশন আরার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠেন,

-দেখলে? আমার মিশুর কোনো দোষ ছিলো না। শুধু শুধু ওকে মারলে এতো!

মতিউর রহামন কড়া গলায় বললেন,

-কি নিয়ে কথা হচ্ছে কিছুই বুঝছি না। এই মিশ্মি কে?

অনাহিতা নরম গলায় বললেন,

-আমাদের বাড়ির ছোট মেয়ে। আপনাদের ছেলে আর আমাদের মেয়ে এক‌ই কলেজে পড়ে। নিহান মিশ্মিকে অনেকগুলো চিঠি দিয়েছে। সাথে নিজের কিছু ছবি। ছবিগুলোতে নিহানের চেহারা দেখা যাচ্ছিলো না বলে আমরা অন্য কাউকে ধরে নিয়েছিলাম। মিশ্মি এসবের কিছু জানতোও না। সেসব না জেনেই অনেক কথা বার্তা বলে ফেলেছি ওকে। দোষটা মিশুর ছিলো না আপনাদের ছেলে নিহানের ছিলো। ভালোবাসে বলেই চিঠি লিখে প্রেম নিবেদন করতে হবে? তাও আবার এতো চিঠি!

সবার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। আমিনা বেগম চোখ উজ্জল করে ভাতিজা কে দেখছেন। ছেলে তাহলে মিশ্মিকে নিয়ে সিরিয়াস। রাদিবা কম্পিত গলায় বললেন,

-নিহান? এসব ওনারা কি বলছেন?

-আমরা ঠিক‌ই বলছি। আপনাদের ছেলের জন্য কাল আমার মেয়েটা প্রচুর কথা শুনেছে। রাতে খায় নি অব্দি।

হাশিম শরীফের কথা শেষ হতেই রোশন আরা বলেন,

-তুমি আমাদের মেয়েকে ভালোবাসো? না কি মজা করতে গিয়েও ওসব লিখেছো?

রাদিবা আশা নিয়ে তাকালেন ছেলের দিকে। নিহান নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইলো। আমিনা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,

-মজা নয় আপা। নিহান সত্যি ভালোবাসে মিশ্মিকে। ওর ব‌ইয়ের পাতায় মিশ্মির ছবিও ছিলো। আমি তো ওই বিয়েতে এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সুযোগে হয়ে উঠে নি।

-তুমি কি করে জানলো আপা? কে বলেছে নিহান ওই মেয়েকে ভালোবাসে? কার না কার ছবি ছিলো!

রাদিবার কথার জবাবে এক গাল হেসে আমিনা বললেন,

-তোর ছেলে নিজে আমাকে বলেছে ছোট! ওই ঝড় বৃষ্টির রাতে আমার ঘরে এসেছিলো মনে নেই? সেদিন‌ই তো বলছিলো যেনো তাড়াতাড়ি ওর পরিবারের সাথে কথা বলি।

রাদিবার পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গেলো বলে মনে হলো। ছেলে ওনার অথচ উনি কিছুই জানেন না? অন্য একজন ওনার ছেলের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছেন? সেই অধিকারটাও আবার ছেলের দেয়া। প্রচন্ড অভিমানে বুক ভরে আসে তার। এদিকে মতিউর রহমান চরম হতাশ। আদরের নাতিও ভালোবাসার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত! বাড়ি বয়ে লোক এসে কথা শুনাচ্ছে তাদের। এসব অনাচার তো মানা যায় না। মানা যায় না অপমান‌ও। যে করেই হোক এদের বিদায় করতে হবে। এ পরিবারের সাথে আর কোনো সম্পর্ক গড়া যাবে না। কিছুতেই না। নিহানের বিয়ে এ বাড়ির মেয়ে সাথে হবে না। ধমকা ধমকিতে কাজ না হলে মারধর করবেন। দরকার পরলে ধরে বেঁধে রাখবেন। যে করেই হোক নিহানে মাথা থেকে ভালোবাসার ভুত নামাবেন তিনি।

চলবে,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

২৭.

ঢকঢক করে গ্লাসের সবটুকু পানি খেয়ে বড় বড় শ্বাস ফেললো নিহান। হাত দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে ঢোক গিলে বললো,

-পরের পদক্ষেপ কি হবে?

হিমি চুইঙ্গাম চিবোচ্ছিলো। দীর্ঘ এক ঘন্টা যাবত‌ই চিবোচ্ছে। অনেকক্ষন আগেই চুইঙ্গামের মিষ্টি স্বাদ বিস্বাদ হয়ে গেছে। এখন কিছুটা তেতো লাগছে। তবুও হিমি আপন মনে চিবিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে জিব দিয়ে ঠেলে চুইঙ্গাম মুখের বাইরে বের করছে। কখনো ফুলাচ্ছে। নিহানের কথায় আড়চোখে তাকে দেখলো হিমি। বাঁকা হেসে বললো,

-এখন তোর আমার কোনো চিন্তা করতে হবে না। যা চিন্তা করার সব আমাদের পরিবার করবে। তুই রেস্ট নে। অনেক ধকল গেছে।

নিহান আশ্বস্ত হলো না। তার চিন্তা দ্বিগুন বেড়ে গেলো। চিন্তিত গলায় বললো,

-তোর কথা মতো আমি ওদের সব সৃজনশীল প্রশ্ন এভয়েড করে সত্য মিথ্যা প্রশ্নের উত্তরে মাথা দুলিয়ে হ্যা জানালাম। কিন্তু কথা হলো, যেসব উত্তর হ্যা তে দিয়েছি সবগুলোই তো মিথ্যে ছিলো! একটা ছাড়া।

হিমি প্রত্যুত্তর করলো না। নিহান হিমির দিকে কাতর চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,

-সত্যি কি হিমি? বল না! চিঠি ছবি এসবের মানে কি?

হিমি মুখে আরেকটা চুইঙ্গাম পুরলো। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দু হাত বুকের উপর বেঁধে বললো,

-এসব নিয়ে ভাববার সময় নাই তোর। এখন তোকে তৈরি হতে হবে।

-আবার কিসের জন্য তৈরি করবি তুই আমায়?

-সবে তো মিশুর পরিবার জিজ্ঞাসা বাদ করলো। এখনো তোর পরিবারের কাছে জবাবদিহি করা বাকি আছে।

নিহান ভয়ার্ত গলায় বললো,

-মানে?

হিমি স্টাডি টেবিলের দিকে ইশারা করে বললো,

-স্ক্রিপ্ট লিখে রেখেছি। ঝটপট মুখস্ত করে নে। আমার ধারনা ঠিক হলে এছাড়া আর কিছু বলতে হবে না। আর যদি স্ক্রিপ্টের বাইরে থেকে কোনো প্রশ্ন করা হয় তাহলে সেটা তুই তোর মগজে থাকা একটু খানি বুদ্ধির প্রয়োগ করে জবাব দিয়ে দিস। টাটা!

হিমি চলে যেতে নিলে নিহান দৌড়ে এসে তার পথ আটকায়। গমগমে গলায় বলে,

-দাঁড়া বলছি। শোন, আমি আর তোর কথায় কোনো কাজ করছি না।

হিমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,

-করিস না! আমি তো তোর জন্য বলছিলাম। যতোই হোক, তুই মিশুকে ভালোবাসিস! ভালোবাসার খাতিরে বিশ্ব ইতিহাসের প্রেমিকরা জান দিয়ে দিতো। আর তুই জবাব দিতে পারবি না? না দে, আমার কি? কিছুই না। পথ থেকে সরে দাঁড়া আমি বেরুবো!

নিহান মুখ কাঁচু মাঁচু করে সরলো। সাথে সাথেই ঝড়ের বেগে দৌড় লাগালো হিমি। দুরু দুরু বুক নিয়ে স্টাডি টেবিলে রাখা কাগজটা তুললো নিহান। সম্পূর্ণ কাগজ পরে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো নিহান। কাগজের মাঝখানে ছোট ছোট অক্ষরে দুটো লাইন‌ লিখা। “আমি মিশ্মিকে ভালোবাসি। যা করেছি ওর জন্য করেছি।” নিহান হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। বুঝলো এরা যাই প্রশ্ন করুক না কেনো ওর উত্তর হতে হবে হিমির লিখে দেয়া দুই লাইন। ঘুরেফিরে বাঁশ নিহান‌ই খাবে!

………………………

-কেমন আছেন?

তাহিরের প্রশ্নে এক ভ্রু উচিয়ে তাকায় হিমি। বলে,

-এটাই জানার ছিলো?

তাহির হাসি মুখে জবাব দেয়,

-জানার তো অনেক কিছু আছে। শুরুটা কেমন আছেন জেনেই হোক!

হিমি শান্ত গলায় বললো,

-ভালো। আপনি?

-আমিও ভালো।

কিছুক্ষন নিরবতায় কাটিয়ে তাহির গলা কেশে বললো,

-এখানে কোথাও চা পাওয়া যাবে?

হিমি হতচকিত হলো। সরু চোখে তাকিয়ে বললো,

-আপনি খাবেন?

-চা দিয়ে গোসল করা যায়?

হিমি নিঃশব্দে হাসলো। উজ্জল দৃষ্টিতে তাহিরকে দেখে বললো,

-চলুন। ওদিকে একটা স্টল আছে। দেখি খোলা কি না।

তাহির মাথা দুলিয়ে পা মেলালো হিমির সাথে। দুজনেই ধীর গতিতে হাঁটছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো ছাড়াও চাঁদের ফর্সা আলো রয়েছে। ঝিরঝির বাতাস। হিমির খোপায় মোড়ানো চুলের কিছু অংশ খোপা থেকে বেরিয়ে পরেছে। বাতাসে ঘাড়ের উপর অবাধ্যের মতো উড়ছে। হিমি শান্ত ভঙ্গীতে চললেও তাহিরের মনে হতে লাগলো অশান্ত হয়ে আছে হিমির মন। কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি না ভাবতে ভাবতে হঠাৎ‌ই বলে উঠলো,

-পড়াশোনা ছেড়ে দিলেন কেনো? একবার রেজাল্ট খারাপ করলেই যে পড়া বাদ দিতে হবে, এমন তো নয়!

হিমি মনে মনে অনেক কথা বললেও মুখে বললো,

-পড়তে ভালো লাগে না।

তাহির মৃদু হেসে বললো,

-পড়াশোনার বয়সে কারোর‌ই পড়তে ভালো লাগে না। সময় চলে গেলে মনে হয় পড়া উচিত ছিলো। আপনার‌ও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। এট লিস্ট ভালো চাকরি করতে পারতেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতেন।

-এখন‌ও তো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি।

-হিমি!

হিমি হাসলো। বললো,

-আমি মজা করে বলি নি কথা টা। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি মানে এখন ছোটখাট একটা চাকরি করছি।

তাহির চমকানো গলায় বললো,

-চাকরি? আপনি তো ইন্টারের পর আর পড়েন নি। কি চাকরি পেয়েছেন?

-ম্যানেজমেন্ট অফিসের চাকরি। জন্মদিন, বিয়েসহ যেকোনো উৎসবে ডেকোরেটিং, ক্যাটারিংএর বড় এক কোম্পানির ছোট একজন কর্মচারি আমি।

তাহির ভ্রু কুঁচকালো। হিমি বললো,

-অফিসের বাকি সবার মতো আমার জন্য আলাদা বসার জায়গা নেই ঠিক তবে কাজ সবার মতোই করতে হয়। যদিও আমি সব ঠিক ঠাক পারি না তবে ফুলের স্টক, গেস্ট লিস্ট, মেনু লিস্ট এগুলোতে পারদর্শী।

তাহির শান্ত শীতল গলায় বললো,

-আপনার কাজের কথা সবাই জানে?

হিমি মাথা নেড়ে বললো,

-মামু আর বন্ধুরা ছাড়া কেউ জানে না।

-কেনো?

-জানাতে ইচ্ছে করে না আমার। আসুন, চায়ের স্টোলের দেখা পেয়েছি। চাচা? দু কাপ দুধ চা দি‌ও। কড়া করে।

তাহির হিমির পিছু পিছু এসে দাঁড়ালো স্টোলের কাছে। হিমি চানাচুরের ছোট একটা প্যাকেট ছিড়ে তাহিরকে ইশারায় খেতে বললো। তাহির চোখ মুখ ছোট করে মাথা নাড়িয়ে খাবে না জানালো। হিমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডান হাতের তালুতে অনেকটা চানাচুর ঢেলে নিয়ে মুখে পুরে বললো,

-এবার আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করি?

তাহির সরু চোখে তাকালো। হিমি তার জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো,

-পিয়ানোটা কে দিয়েছিলো?

তাহির তটস্থ হলো। বেশ কিছুক্ষন নিরব থাকার পর‌ও হিমির দৃষ্টি তার থেকে সরলো না। বরং প্রতি সেকেন্ডে তীক্ষ্ণ হলো। তাহির কাঠ কাঠ গলায় বললো,

-আমার বাবা।

হিমি কৌতুহলী হয়ে বললো,

-আপনার বাবা আপনাকে এমন জিনিস কেনো দিলেন যা আপনি বাজাতে পারেন না? উনি হয়তো চেয়েছিলেন আপনি পিয়ানো বাজানো শিখেন। তাই না?

-না। পিয়ানোটা বাবার ছিলো।

হিমি উৎসুক গলায় বললো,

-আপনার বাবা পিয়ানো বাজাতে পারেন!

-পারতেন। এখন পারেন কি না জানি না।

হিমি থমকালো। তাহিরের কথা বুঝার চেষ্টা করলো। দোকানি স্টোল থেকে চা এগিয়ে দিতেই তাহির এগিয়ে গেলো। হিমিকে তার চা দিয়ে নিজের কাপে ফুঁ দিয়ে চুমুক বসালো সে। হিমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তাহির হিমির চাহনি উপেক্ষা করে বললো,

-চা টা দারুণ হয়েছে। সব চায়ের দোকানেই সেইম স্বাদ?

দোকানি পান খাওয়া লাল দাঁত কপাটি মেলে হাসলো। হিমি কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে উঠলো,

-আপনার বাবাও আপনাকে ভালোবাসেন না?

তাহির বুকের গভীর থেকে শ্বাস টেনে বললো,

-বাসতেন বলেই নিজের এতো প্রিয় জিনিস আমায় উপহার হিসেবে দিয়ে গেছেন। হয়তো এখনো বাসেন। আমি জানি না।

হিমি মাথা দুলালো। চানাচুরের খালি প্যাকেট রাস্তার ধারে ফেলে দিয়ে এক ঢোক চা খেলো। তাহিরের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বললো,

-উনি কি মারা গেছেন?

তাহির চোখ তুলে হিমির দিকে দেখলো। তাহিরের দৃষ্টি শান্ত। চেহারায় উদ্বিগ্নতা নেই। কোনো ভাবাবেগ হলো না তার। নির্বিকার গলায় বললো,

-বলতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় উনি জীবিত আছেন। কোথায় আছেন সেসব জানি না। স্টিল, আই ফিল লাইক হি ইজ এলাইভ!

হিমি কপালে ভাজ ফেললো। তাহির মৃদু গলায় বললো,

-আপনার চা ঠান্ডা হচ্ছে।

হিমি কেঁপে উঠলো খানিক। কোনো এক ঘোরে চলে গেছিলো সে। তাহিরের কথায় বাস্তবে ফিরলো।গলার স্বর নিচু করে বললো,

-আপনার কথা শোনে মনে হলো আপনার বাবা আপনার সাথে থাকেন না। তবুও আপনি জানেন উনি আপনাকে ভালোবাসতেন এবং বাসেন হয়তো। অথচ আমি!

-আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আপনার বাবা আপনাকে ভালোবাসেন। খুউব ভালোবাসেন।

-এখনো আমায় ঠিক করে চিনে উঠতে পারলেন না আর আমার বাবার কথা বলছেন! হাসালেন ডাক্তার!

তাহির বাঁকা হেসে বললো,

-হাসি পেলে হাসুন। তবে আমি সত্যি বলছি। মুহিব আঙ্কেল আপনাকে সত্যি ভীষন ভালোবাসেন।

হিমি চমকে উঠলো। ‘মুহিব আঙ্কেল’ অর্থাৎ তার বাবা। তাহির কি করে জানলো হিমির বাবার নাম? হিমি তো তাকে এসব বলে নি। আশ্চর্যান্বিত গলায় হিমি প্রশ্ন করলো,

-আমার বাবাকে চিনেন আপনি?

-খুব বেশি না। একটু আধটু চিনি।

হিমি ঢোক গিললো। এই লোককে অচেনা ভেবে কতো কথাই বলে ফেলেছে। যদি লোকটা তার বাবাকে বলে দেয় এসব? ‌বাবার কাছে অপমানিত হবে না? নিশ্চয় সবার চোখে করুণার পাত্রী হবে হিমি। দয়া দেখাবে কেউ কেউ? হিমির মাথা ঝিনঝিন করে উঠলো। সত্যি ভীষন বোকা সে। নাহলে যাকে তাকে পারিবারিক কথাবার্তা জানায়? সেদিন নাহয় জ্বরের ঘোরে বলে ফেলেছিলো কিছু কথা আজ কেনো বলতে গেলো চাকরির ব্যাপারে? বাবা জেনে গেলে কি করবে? কোনোভাবে যদি দাদু মামানি এরা জানে? তবে? ভেবে পায় না হিমি। সমস্যা বাড়ছে। সমাধান নেই। মাথায় হাত রেখে কাঁদো কাঁদো চেহারায় সামনে তাকায়। তাহির রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হিমির থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেছে সে। হিমি হন্তদন্ত হয়ে দৌড়তে গিয়েও থেমে যায়। দোকানির দিকে তাকিয়ে বলে,

-কতো টাকা চাচা?

-স্যার টেকা দিয়া দিছে। আর ক‌ইছে আপনেরে ক‌ওনের লাইগা।

-আচ্ছা।

হিমি দৌড়তে গেলে আবার‌ও আটকে দেয় দোকানি। ব্যস্ত গলায় বললো,

-কি ক‌ইতে ক‌ইছে হেইডা তো হু‌ইনা লন।

হিমি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। দোকানি কিছু একটা মনে করে বললো,

-হ হ, স্যার ক‌ইছে কাইল রাইত ওই জায়গায় যাইতে। ওই এক‌ই সময়ে।

হিমি ভাবুক গলায় বললো,

-কোন জায়গায় কখন? ‌আর আমায় না বলে আপনাকে বললো কেনো?

-আপনি কিসব ভাবতেছিলেন! হের লাইগা স্যার আমারে ক‌ইয়া গেছে গা। দৌড়াইয়া নাগাল পাইবেন না। বাড়ি চ‌ইলা যান। কাইল আবার আইবেন! ‌

হিমি দ্বিধান্বিত হয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। তাহির অনেক আগেই চোখের সীমানার বাইরে চলে গেছে। এতক্ষনে হয়তো গাড়ি‌ও স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। আশ্চর্য! চা খেতে এসে তাকে একা ফেলেই চলে গেলো? দুদিন ধরে ‘দরকারি কথা’ আছে বলে বলে বলে এত রাতে এতদূর এসে শুধু এক কাপ চা খেয়ে হাজারটা প্রশ্ন উৎপন্ন করে দুম করে চলে যাওয়ার মানে কি? ফাইজলামি করে লোকটা? হিমির আকাশচুম্বি রাগ লাগে। সেই রাগটাও তুলোর মতো মিলিয়ে যায় তাহিরের বলা কথায়। মনে বার বার একটাই কথা আসছে, বাবাও কি ডাক্তারকে চিনে? কথা হয় ডাক্তারের সাথে?

চলবে,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে