স্বপ্নে মাতোয়ারা – লেখকের নাম : মাসুদ রানা তাসিন

0
608

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগষ্ট_২০২০
গল্পের নাম : স্বপ্নে মাতোয়ারা
লেখকের নাম : মাসুদ রানা তাসিন
ক্যাটাগরি : রোমান্টিক

চৈত্রের দুপুরের প্রচণ্ড রোদে এক পশলা ইলশে বৃষ্টির আনাগোনা। বেলকনির কার্ণিশ জুড়ে অসংখ্য ফুলের সমাহার। কাশফিয়া সেই ফাঁক দিয়ে তাকিয়েছে মেঘের দিকে। অবাক নয়নে মুগ্ধ হয়ে দেখছে, সৃষ্টিকর্তার নৈস্বর্গিক সৃষ্টি।

মেঘের আড়ালে তো ঢাকা পড়ে যায় চাঁদ, সূর্য, তারা! অভিমানের আড়ালে হারিয়ে যায় নতুন স্বপ্নের সূচনা! অপমানের প্রতিশোধের নেশায় আসক্ত হলে ধ্বংস হয় সকল মান, অভিমান, সম্ভ্রম। এসব ভাবতে ভাবতেই পুরো দুপুর কাটিয়ে দিল কাশফিয়া।

পড়ন্ত বিকেলে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ভাবছে। পৃথিবীর রূপ বৈচিত্র্য কত ভিন্ন, কত মানুষ সৃষ্টি করেছে সৃষ্টিকর্তা। তবে সবচেয়ে বড় অধম করে সৃষ্টি করেছে কাশফিয়াকে। তখন ঘর থেকে উড়ে আসে এক টুকরো কাগজ। কাগজের ভাঁজ খুলে দেখে তার দেওয়া শেষ চিহ্ন। এক টুকরো শিরোনাম বিহীন চিঠি।

তুমি,

আজও স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে যাই তোর জন্য। আজও বিভোর হই তোর সাথে কাটানো ভ্যাপসা স্মৃতি গুলো নিয়ে। হয়তো চিঠির প্রথমে প্রিয় দিয়ে শুরু করিনি। প্রিয় একদিন অপ্রিয় হয়ে যায়, তুই তো আছিস আমার হৃদয়ের গভীরে, যেখানে থাকে শুধু আত্মা নামক ছোট জিনিসটি। তোর সময় হবে না ফিরে আসার। বেশি কিছু লিখব না, চলে আয় আমার কাছে। তোকে ছাড়া শূন্য মনে হয় নিজেকে। তাইতো ডুবে থাকি তোর স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে।

ইতি,
তোর মন

কফির মগ রেখে অতীত নামক স্মৃতির ক্যানভাসে ডুব দিল কাশফিয়া। অতীত স্মৃতি বিজড়িত ঘটনাগুলো সর্বদা মনে বিষাদ সৃষ্টি করে। যাতে অজস্র অভিমান চাপা পড়েছে অপমানের চাদরে। সুখ নামক আপেক্ষিক তত্ত্ব কোনোদিন ধরা দেয়নি কাশফিয়ার কাছে। জন্ম থেকে আজ অবধি শুধু দুঃখ, যাতনা ও অপমান সহ্য করে আসছে।

আকাশমনি গ্রামের ছোট্ট একটি পরিবারে জন্ম হয় কাশফিয়ার। চার বোনের পর জন্ম হয়, পরিবারের কেউ খুশি নয় কাশফিয়ার জন্মে। সবাই একটা ছেলের আশায় বুক বেঁধেছিল। ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়ে এসেছিল কাশফিয়া। তখনই জন্ম যেন আজন্মের বড় অপরাধ হয়ে গেছিল।

তিন বছর বয়সী কাশফিয়া চারপাশে তাকিয়ে দেখত। মা ছাড়া কেউ কাছে আসে না। সবাই একসাথে থাকত কিন্তু সবার থেকে আলাদা করে রাখতো তাকে। তখন ছোট অবস্থা কিছু বুঝতে পারেনি।

চার বছর বয়সে যেইবার প্রচুর পরিমাণে জ্বর বাঁধল শরীরে। প্রচণ্ড জ্বরে তখন কাউকেই কাছে পায়নি। জীবনের প্রথম ধাক্কাটা সেদিন পায়।

কাশফিয়ার যখন বয়স পাঁচ বছর, তখন কাশফিয়ার মা আবারো সন্তানসম্ভবা। সবার মুখে একটাই কথা, “এবার ছেলে না হলে তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে।”
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
তখন থেকে মুখে একটাই বুলি ছিল সারাদিন। একটা পুত্র দে আল্লাহ, একটা পুত্র দে। কামাই খাবার আশা নাই মোর মাটি দিবে কে। অন্যবারের চেয়ে আল্লাহ এবার মুখ তুলে তাকিয়েছে। ছেলে হয়েছে, বিনিময়ে কাশফিয়া পেয়েছে একরাশ হতাশা, শূন্যতা, একাকীত্ব। ঠাঁই হয়েছে বোনদের ঘরে, তবে বিছানায় নয়। মাদুর বিছিয়ে বালিশ ছাড়া। তবুও কারো কিছুতে সে কিছু বলত না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মেনে নিয়েছে।

ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল তখন। বড় আপু পাশের বাড়ির ফারহান ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরেছিল। সেটা দেখে অবুঝ মনে বাবাকে বলে দিয়ে ছিল। বাবা আপুকে বকাবকি না করে সেদিন কাশফিয়াকে প্রচুর মেরেছিল। বলেছিল “তুই ভালো না, তুই এখানে থাকলে আমি শান্তিতে বাঁচব না। তোকে কালই বাড়ি ছাড়া করবো। তার দুইদিন পর ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

ফুপুর বাড়িতে আসার এক মাসের বেশি হয়েছে। এক মাসের ভেতর বাবা শুধু এসে বই খাতা গুলো দিয়ে গেছেন। বলেছেন এখানে কাজ শেষ করে যদি পড়াশোনার সময় হয় তাহলে পড়াশোনা করতে। সেদিন বুঝেছিল ফুপু কাজ করতে দেরি হলে গায়ে হাত তুলতো কেনো।

সেদিনের পর থেকে ফুপুকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দেইনি। ভাগ্যটা তো মেনে নিয়েছিল। কাজ করেই নিজেকে চালিয়ে নিতে হবে। বারো বছর বয়সী একটা মেয়ে অবলীলায় অস্ত্র বিহীন যুদ্ধ শুরু করে।

সারাদিন সমস্ত কাজ মিটিয়ে, রাতের বেলা পড়তে বসে। লক্ষ্য অনেক বড় কিছু করতে হবে। সেই চিন্তায় অবিচল অটুট থাকে।

নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে আসে নতুন একটি ভোর, একটা সাফল্য। তবুও সাফল্যের মাঝেও নেমে আসে ঘনকালো অন্ধকার।

একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে নতুন মানুষ। যাকে ছবিতে দেখেছিল, এখন সামনে চাক্ষুষ দেখছে। রিমন ভাই! কাশফিয়ার রিমন ভাই। এতো দিন বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য ছিল। রিমন কাশফিয়ার চেয়ে গুণে গুণে বারো বছরের বড়।

কাশফিয়ার রিমন ভাই একটা নীল টি শার্ট ও সাদা প্যান্ট পরে, কুশন কভার কোলে নিয়ে সোফায় বসে আছে। যেন বলিউডের অভিনেতা শাহরুখ খানের মতো। কাশফিয়া চোখ সরাতে পারছে না। যেন নতুন কোন স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে গেছে সে।

রিমন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে। পুঁচকি একটা মেয়ে, মাথায় অর্ধেক চুল ঝুঁটি করা। অর্ধেক চুল বাতাসে উড়ছে। গায়ে সাদা রঙের স্কুল ড্রেস, চিবুকে টোল, হাসির ফাঁকে বেরিয়ে আসছে গজ দাঁত। রিমন যেন একটা মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে। বয়সের কথা ভাবছে না, রঙিন প্রজাপতির ডানায় ভর করে, কাশফিয়ার স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে পড়ছে।

দু’জনের ধ্যান ভাঙে ফুপু রাইনা বেগমের ডাকে।

– রিমন বাবা মা হাত মুখ ধুয়ে আয়, অনেক দিন নিজ হাতে খাওয়াই না।
– যাচ্ছি মা, অনেক দিন তোমার হাতে খাবার খাই না।

কাশফিয়ার উদ্দেশ্যে বলা শুরু করলো ” কিরে নবাবজাদী তোকে কি আলাদা করে দাওয়াত করতে হবে? যা কাপড় ছেড়ে রান্নাঘরের কাজ সামলা। ”

কাশফিয়া নীরবে স্থান ত্যাগ করলো। থাকলে ফুপু গায়ে হাত তুলতে পারে। যদিও এটা অভ্যেস হয়ে গেছে।

সেদিন রিয়ানের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে বলে খুব মারলো। রিয়ান বাজে ভাবে শরীরে হাত দেওয়ার বিচার দিয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এমন হচ্ছে। নয়তো অন্দর বাহিরে কিছু মানুষরূপী রিয়ানের মতো জানোয়ারের জন্য নারীরা সঠিক ভাবে চলতে পারে না।

রিমন আসার পর থেকেই কাশফিয়ার উপরে অত্যাচার করতে পারে না। দেখতে দেখতে কাশফিয়া এইচ এস সি শেষ করে। আঠারো বছর বয়স হয়ে গেল।

বসন্তের আগমনে মুখরিত কাশফিয়ার হৃদয় আঙিনা। আঠারো বছর বয়সটা যে এমনই। সব সময় হৃদয়ে দোলা দেয়। বারো বছর বয়স থেকে হাজারো ঝড়ে, প্রতিনিয়ত ভাঙা গড়ার স্বপ্নে সাথে থেকেছে যেই মানুষটি বন্ধুর মতো। সেই মানুষটি দোলা দেয় হৃদয় নীড়ে।

বয়স দেখে কোনোদিন প্রেম হয় না যার বাস্তব প্রমাণ কাশফিয়া। রিমন চোখের আড়াল হলে হৃদয় ভেঙে যায়। কাশফিয়া নিজেকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করছে। কোন অবস্থাতেই তবুও ভুলতে পারছে না রিমন। ছোট বেলায় যে কাশফিয়া রিমন ভাই ডাকত! আজ সে ডাকে মন বলে।

কাশফিয়া ও রিমনের কর্মকাণ্ড গুলো সবার চোখ এড়ালেও রাইনা বেগমের চোখ এড়ায় না। তখনই ধরে ফেলে রিমনের বিয়ে না করার কারণ। রাইনা বেগমের সব দিক পছন্দ হলেও কাশফিয়াকে পছন্দ নয় তার।

রাইনা বেগম ভেবেই নেয় যত দ্রুত কাশফিয়াকে বাইরে বের করা।

বিকেলে কফির মগে চুমুক দিয়ে রিমন কাশফিয়ার খোলা চুলে ডুবে আছে। ভাবছে কেমন করে প্রোপজ করবে। জীবনের ত্রিশটি বসন্তেও কাউকে মুখ ফুটে বলেনি। মেয়েদের দিকে তাকানো তো দূর।

জীবনানন্দের বনলতা কবিতা আবৃত্তি শুরু করে এসময়। ” চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য “। কাশফিয়া উপরে তাকিয়ে দেখে রিমন তাকিয়ে আছে তার দিকে। কাশফিয়া লজ্জানত মুখ নিয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুটলো।

বসন্তের সন্ধ্যের আকাশে ইলশে বৃষ্টি। ছাদের কার্নিশের উপর পা তুলে বসে আছে কাশফিয়া। চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। সাদা পোশাকে আবৃত কাশফিয়াকে পরীর থেকে কম লাগছে না। কাশফিয়া সে তো আকাশ বিলাসে ব্যস্ত। একজন যে তার দিকে তাকিয়ে আছে একটা হৃদয় ছোঁয়া দৃষ্টি নিয়ে। এসেছে এক পশলা ভালোবাসা নিয়ে।

একগুচ্ছ মহুয়া ফুলের তোড়া ও মালা নিয়ে কাশফিয়ার সামনে বসে পড়লো। কাশফিয়া যেনো আকাশ থেকে পড়ল। আজ নতুন রিমন কে দেখছে সে! রিমন সে তো তার হৃদয় অন্তরালের মোহিনীকে দেখতে ব্যস্ত।

দীর্ঘ অনেকক্ষণ পর রিমন কাশফিয়ার উদ্দেশ্যে বলা শুরু করলো। কাশফিয়া যেনো নীরব দর্শক ও শ্রোতার মতো শুনে যাচ্ছে। রিমন বলেই যাচ্ছে পলকহীন চোখে কাশফিয়ার কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে।

” বসন্তের মহুয়া ফুলে মাতাল হইনি কখনো। শুধু তোমাকে কল্পনা করেছি। নিজেকে নিজের মাঝে ডুবিয়েছি বার বার। আমি মগ্ন হয়েছি নিজেতে, আমি নেশা গ্রস্থ হয়ে উঠিনি মৃদু মলয়ে। আমি উদাসীন হয়েছি বারে বারে, করেছি রাগ ক্ষণে ক্ষণে। শুধু তোমায় আমার অভ্যন্তরে বলা কথাগুলো বলতে না পেরে। ”

” কী কথা লুকিয়ে রেখেছ মন? আমিও শুনতে চাই সব। বল তুমি সকল কিছু ফেলে তাড়াতাড়ি কাজ আছে আমার না হলে হবে দেরি। ”

” বসন্তের আগমনে মুখরিত চারদিক। তোমাকেও দেখেছিলাম বসন্তের এক দুপুরে। তখন ছিলে ছোট পিচ্চি। যখন আমাদের বাড়িতে এলে তখন চঞ্চলময়ী। আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলে। একটু একটু করে জায়গা নিতে শুরু করলে। জানি না কখন বসেছ আমার হৃদয় নীড়ে সবটা জুড়ে। ততটা পেঁচিয়ে বলতে পারি না। বলছি বসন্তের মহুয়া ফুলে নয় মাতাল হতে চাই তোমাতে। কল্পনায় নয় বারবার ডুব দিতে চাই তোমার মাঝে। আমি উদাসীন হতে চাই শুধু তোমার সাথে থেকে। ভালোবাসি তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি। তাইতো জীবনের ত্রিশ বসন্তেও কাউকে আপন করিনি। তোমায় আপন করবো বলে। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি! আমার হৃদয়ের গভীর থেকে, সবটা জুড়ে সকল আস্তরণে মিশে। ভালোবাসবে কি তুমি আমাকে? ”

কাশফিয়া এই কথাগুলো শুনে কেঁদে দিয়েছে একেবারে। কোন উত্তর দিতে পারছে না। সে যে ভালোবাসে এটা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। রিমন উত্তরের অপেক্ষা না করে বলা শুরু করলো।

” কি হল বলছো না কেন? ভালোবাসো কি না বল? তাহলে বারবার ফিরে আসবো না তোমার কাছে? ”

” সব কথা বলে না হৃদয়, কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। ”

রিমন যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেল। কাশফিয়াকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, কারো ছুটানোর সাধ্য নেই। ধরেছে এমন ভাবে যেন কাশফিয়াকে ছেড়ে দিলে চলে যাবে।

কেটে গেছে কয়েক দিন।

সবার অলক্ষ্যে চলছে মধুময় প্রেম কাহিনী। কিন্তু ঐ যে বাংলায় প্রবাদ আছে “অভাগী যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়।” কাশফিয়ার বেলা ঠিক তাই হলো।

রাইনা বেগম ও রিয়ানের বৌ আফরা দু’জনে মিলে গল্প করে। কাশফিয়া ও রিমনের আচরণ সবার সুবিধার ঠেকছে না। প্রতিদিন সন্ধ্যে বেলায় ছাদে উঠে। এসব নিয়ে আলোচনা ও কাশফিয়াকে কেমন করে বাড়ি থেকে তাড়ানো যায়।

মায়ের সব কথা শুনে ফেলে রিমন। মনে মনে বুদ্ধি করে নেয়। সন্ধ্যেটা দুজনের ছাদে কাটে। রিমন কাশফিয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠে।

” পিচ্চি পাখি আমার সাথে যেতে হবে তোমায় কাল, তুমি পারবে যেতে?”

“পারবো তোমার সাথে সাত সমুদ্র তের নদী পেরোতে পারবো। তুমি যে আমার সকল ভরসার জায়গা।”

” তাহলে কাল থেকে নতুন জীবন শুরু হবে তোমার।”

“আমি প্রস্তুত আমার মন।”

এশারের আজানের ধ্বনি শুনে নিচে নেমে গেলো দু’জনে। সারারাত দু’জনের এপাশ ওপাশ করে কেটে যায়। রিমনের হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে। কাশফিয়া নতুন কিছুর সন্ধান করতে। অস্ত্র ছাড়া জীবন যুদ্ধ করতে করতে যে ক্লান্ত কাশফিয়া।

পরের দিন দুপুরে রিমন ও কাশফিয়া কাজী অফিস থেকে বিয়ে সেরে বের হয়েছে। সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিমনের বন্ধু ও তার বউ। আজ থেকে কাশফিয়া যেন এক নতুন রুপ ধারণ করলো।

প্রথা অনুযায়ী আজ দু’জনের বাসর রাত। প্রত্যেক ছেলে ও মেয়ের স্বপ্ন থাকে এই রাত নিয়ে।

কাশফিয়া রিমনের ঘরে সেদিন সবাইকে লুকিয়ে। কাশফিয়ার জীবনের প্রথম কোন ছেলের সংস্পর্শে আসা। এটা যেন এক অজানা অনুভূতি।

রিমন কাশফিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ যে মানস প্রিয়াকে কাছে পাওয়ার দিন। আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো কাশফিয়া।

দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নতুন জীবনের সূচনা করলো। নামাজের পাটিতে কাশফিয়ার হাতে তুলে দিল ব্যাংকের চেক। যাতে রিমনের অবর্তমানে কোন ভোগান্তিতে পড়তে না হয়।

নামাজের স্থান ছেড়ে উঠে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকল কাশফিয়া। ভয় ও শিহরণ মিশ্রিত চেহারায় নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। রিমন কাশফিয়ার কাছে গিয়ে খোঁপা খুলে দিল। আর বলল ” যতক্ষণ আমার সামনে থাকবে ততক্ষণ চুল যেন বাঁধা না থাকে।” বলেই কোলে তুলে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।

পরের দিন সকালে রাইনা বেগমের চিৎকারে, পুরো পরিবারের সবাই রিমনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রিমন ও কাশফিয়া চমকে গেছে। কাশফিয়াকে চরিত্রহীন উপাধি দেয়া হয়েছে। রিমন যেন পাথর মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কারণ সে যে মায়ের ওয়াদা ও কসমের কষাঘাতে জর্জরিত। মা যদি বলে এখানে একটা কথা বললে মরা মুখ দেখবি! সেখানে সন্তানের কিইবা বলার থাকে।

খারাপ চরিত্রের মানুষ হিসেবে সেদিন, বেরিয়ে আসে কাশফিয়া। বাবার বাড়িতে যার স্থান ছিল না। সেখানে সে যাবে কেমন করে। অনেক সংগ্রাম করেছে।

আজ সে একজন উকিল। নারীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার।

চোখের জল আড়াল করে বিষাদময় অতীত থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসলো।

রাতের আটটা বেজে গেছে। পাঁচটায় বসেছে অতীতের স্মৃতির ক্যানভাসে। এখন সময় আমার এটাই নিয়তি।

আট বছরের মেয়েটাকে নিয়ে কাশফিয়ার সংসার। রিনফিয়া সব সময় ছুটাছুটি করে। আজ স্কুল শেষ করে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কাশফিয়া শরীরে হাত দিয়ে দেখে। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেল। জরুরী বিভাগে ভর্তি করলো। জরুরী বিভাগে বাইরের কাউকে এলাও করে না, তাই বাহিরের বসার জায়গায় বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে।

সামনে কারো উপস্থিতি পেয়ে, উপরে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে রাইনা বেগম। নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে রাইনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো কাশফিয়া।

রাইনা বেগম লজ্জানত মুখ নিয়ে বলল, সেদিন নিজের অধিকার নিয়ে কেন থাকলি না পাগলী? আমি যে তোর প্রতিবাদী চেহারা দেখতে চেয়েছি প্রতিবার। কিন্তু আমাকে ছেলের কাছে অপরাধী করে চলে গেলি। যা তোর মনের কাছে। আমি আমার নাতনির কাছে থাকছি।

রিমনের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কাশফিয়া। রিমন তার অর্ধাঙ্গিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বলছে “তুমি নাহয় দূরে ছিলে, কিন্তু আমাদের দু’জনের কাটানো সময়গুলো এক ছিল। দু’জনে দুজনের স্বপ্নে মাতোয়ারা ছিলাম।”

কাশফিয়া নিচু স্বরে বলছে আমার তো এখনো মনে হচ্ছে, আমি এখনো তোমার ” স্বপ্নে মাতোয়ারা। “

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে