সুখ একটি প্রজাপতি পর্ব-১৮+১৯+২০

0
1974

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৮)

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ঝিল আর অভিনব দুজনেই নিস্তব্ধ। একে অপরের খুব কাছে বসে। ব্যাগ থেকে ঝিলের ডায়েরীটা বের করে মৃদু স্বরে অভিনব বলল, “এটা ফেরত নিয়ে নিন ঝিল।”

“কেন?”

“আমায় কষ্ট দেয়। সকালে আপনি ম্যাসেজ করেছিলেন আমি ডায়েরীটা সম্পূর্ণ পড়েছি কি না। নানান ঝামেলায় পড়া হচ্ছিল না। তাই তখুনি পড়ে ফেলি। আর শেষ পাতাতে একটাই লাইন পেয়েছি।”

চমৎকার করে হাসল ঝিল। অভিনবর থেকে ডায়েরীটা নিয়ে শেষের পাতাটা খুলল। লেখাটা এখনো চকচক করছে।
“প্রেমিক পুরুষ, আপনি তো আমার নামে দলিল হয়ে গেলেন। তবু কেন এত দূরত্ব আমাদের মাঝে! আমার কথা কি কখনো মনে আসবে আপনার?”

কিশোরী হৃদয়ের আবেগ থেকে অগোছালো কিন্তু অনুভূতিতে ঠাসা লেখাটা লিখেছিল ঝিল। এই লেখাটাই শেষ লিখেছিল ডায়েরীতে। মেয়েটির গলায় একটি লকেট রয়েছে। লকেটটা ছোট হলেও বেশ সুন্দর। সর্বদা চকচক করে। অভিনব সেটাই দেখছিল। ও লক্ষ্য করেছে মেয়েটি এটা সর্বদা আগলে রাখে। ছেলেটির মুখের ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারল প্রশ্নটি।
“এটাতে আমার ছয় বছরের আশা জমা করা ছিল। আপনার মুখটা হাল্কা মনে আসলেও নামটা ভুলে গিয়েছিলাম আমি।”

কথাটা শুনে অভিনব হাসল। সত্যিই কি অদ্ভুত ওদের জীবন।

লকেটটা হাতে নিয়ে অভিনব বলল, “কি আছে এটার ভেতর?”

“নিজেই খুলে দেখুন।”

অভিনব তৎক্ষণাৎ খুলল লকেটটা। ছবিটা দেখে বলল, “আমার ছবি!”

“হ্যাঁ। মা লকেটটা আমায় বানিয়ে দিয়েছিল। আর এটার ভেতরই ছবিটা ছিল। মায়ের স্মৃতি বিধায় যত্নে রেখেছিলাম। ট্যুরে যাবার সময় এটা পরেছিলাম। ভেতরের ছবিটা সেদিনই নজরে এলো। আপনাকে চিনতে আমার অসুবিধা হয় নি।”

“কিন্তু তার আগে তো চিনতে পারেন নি। তাহলে প্রথমদিন জড়িয়ে ধরার পর ও কেন চুপ ছিলেন? আমার জন্য কেন চিন্তা করছিলেন?”

“এটা সত্যিই আমার জানা নেই। কিন্তু মনে হচ্ছিল মানুষটা আমার আপন। আমার খুব কাছের। যাকে সবটা উজাড় করে দিলেও পাপ হবে না। একটা ইনার কানেকশন অনুভব করেছিলাম।”

“অথচ এতে আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল।”

বিস্মিত হয়ে তাকালো ঝিল। অভিনব মেয়েটির হাত বুকের মাঝে এনে বলল, “মনে আছে শপিংমলে আপনাকে ইগ্নোর করেছিলাম।”

“হ্যাঁ তাই তো। ইগ্নোর করেছিলেন কেন?”

“দুটো কারণ।”

“কি কি?”

“প্রথমত আমাকে নজরে রাখছিলেন মামা। আর দ্বিতীয়ত আপনি আমার বাড়াবাড়ি গুলো এলাউ করছিলেন। এটা মানতে আমার কষ্ট হচ্ছিল।”

“কষ্ট কেন হচ্ছিল?”

“আপনি আপনার স্বামীকে ভুলে অন্য পুরুষকে অন্তরে জায়গা দিচ্ছেন কষ্ট হবে না?”

এবার সত্যিই ঝিলের হাসি পেল। শব্দ করে হেসে ফেলল সে। অভিনব একটু মন খারাপ করে বলল, “যদি সত্যিই আমায় মনে না রাখতেন। আর এভাবে অন্য কাউকে স্থান দিতেন।”

“তবে কি হতো?”

“তাহলে অভিনব সত্যিই পাগল হয়ে যেত। গত ছয় বছরে একটি বাচ্চা মেয়ে আমায় পাগল করে দিয়েছে। আমার সমস্ত কাজে মেয়েটি ঘুরপাক খেয়েছে। সব মিলিয়ে শুরুর দিকে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আপনি বললেন না এত বড় নিউজ পাওয়ার পর ও কেন আমরা আসি নি খোঁজ নিতে। এটা সত্যিই ভুল। মম আর পাপা বার বার এসেছে। কিন্তু সবাই তো ওদেরই দোষারোপ করেছে। সবার ধারণা মম আর পাপার জন্যই তোমার ফ্যামিলির সবাই মা রা গেছেন। বিষয়টা মম আর পাপাকে ভেঙে দিয়েছিল। সে সময়ে মামারা ও খুব রেগে যায়। কারণ ওদের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের বিয়েটা হয়েছিল। আর তোমার ফ্যামিলি সমস্ত দোষ দিয়েছিল মামাদের আর মম পাপাকে। আমরা সব দিক থেকে আ ঘা ত পেয়ে ইউ এস এ ফিরে যাই। মম আর পাপাকে সামলাতে সামলাতে আমিই অসুস্থ হয়ে পড়ি। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়। আর আমরা খবর নিয়ে জানতে পারি তোমার ব্রেনে আ ঘা ত লেগেছে। কিছু মনে করতে পারছো না। শুধু দুর্ঘটনাটা ছাড়া।”

কান্নার শব্দে থেমে গেল অভিনব। ঝিলের চোখ মুখ লাল হয়ে এসেছে। মেয়েটির দুটি চোখ থেকে ঝরছে নোনা জল। অভিনবর মন হু হু করে উঠল। বুকের মাঝে আগলে নিল মেয়েটিকে।
“সেদিন আমি কেন মা রা গেলাম না অভিনব? সেদিন আমি মা রা গেলে এত ঝামেলা থাকত না। সত্যিই এত কষ্ট নিতে হতো না।”

“চুপ করুন ঝিল।”

অভিনবর বুকের মধ্যে ওভাবেই থেমে রইল ঝিল। সে দিনটা হয়ত কখনোই ভোলার নয়। একটা দুর্ঘটনা সব শেষ করে দিল! অভিনব আর ঝিলের বিয়ের মুহুর্তটা অল্প সময়েই ঘটে যায়। এক পলকের দেখা দুজনের। শুধুমাত্র পেপার সাইন করার সময় একে অপরকে দেখেছিল। বিয়ের কার্যক্রম শেষ হতেই ফিরে আসে ঝিলরা। বাড়িতে আসার পর শুনতে পায় মির্জা আর শিকদারদের মাঝে পুনরায় ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার মাত্রা এতই বেশি যে বিয়ের খবরটা জানানোর পরিস্থিতি থাকে না। অগোচরেই রয়ে যায় বিষয়টা। বদলে যায় সমস্ত ঘটনা।
কেটে যায় একটি মাস। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছিলই না। কিন্তু এভাবেও তো চলে না। এদিকে বেঁকে বসেছেন জাফর মির্জা। শুরুর দিকে তিনি বলেছিলেন শিকদাররা এলে ওনি মেয়ের বিয়ে দিবেন। কিন্তু এখন কিছুতেই দিবেন না। অপমানিত হয় শিকদাররা। এই নিয়েই ঝামেলার শুরু হয়। ঝিলের মা জেহেনাজ চৌধুরী ভেবেছিলেন এবার সত্যিটা জানানো প্রয়োজন। তিনি বলেন ঝিলের বিয়ে তিনি আগেই দিয়ে দিয়েছেন। কথাটা শোনার পর পরিস্থিতি আরও হাতের বাহিরে চলে আসে। প্রচন্ড কোন্দলের মাঝে জাফর মির্জা স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে বসেন। দুঃখটা সহ্য করতে পারেন নি তিনি। মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসেন। ওনার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসেন বাড়ির বাকি দুই বউ ও। সেদিনটা এখনো মনে আছে ঝিলের। হাইওয়ে দিয়ে চলছিল গাড়ি। হঠাৎ করেই একটা ট্রাক এসে ধাক্কা লাগে। সেখানেই প্রাণ হারান সবাই। কোনো এক ভাগ্যের জোরেই গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ে ঝিল। আর বেঁচে যায়। ঘটনাটা সব নিউজ চ্যানেলে দেখানো হয়। ছুটে আসেন অভিনবর মা বাবা। কিন্তু ততক্ষণে মির্জারা শিকদারদের নামে অভিযোগ করে বসেছে। ঝড় থামার বদলে ঝড় নেমে আসে পুনুরায়। একটা দুর্ঘটনা ঝিল আর অভিনবর জীবন বদলে দেয়। মেয়েটি শুরুর দিকে কান্না করত কেবল। স্যালাইনের জোরে বেঁচে ছিল। একটা সময় একাকিত্ব এসে চেপে ধরে। স্মৃতিরা সব হারাতে থাকে। অনেক ঘটনাই ঝিলের মনে ছিল না। কিন্তু এই টুকরো টুকরো স্মৃতি ওকে ঘুমাতে দিত না। মাস খানেক পর সুস্থ হয় মেয়েটি। সবটাই মনে আসে। রোজ পুলিশ আসত শিকদারদের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড়ের আশায়। মেয়েটির ছোট্ট মস্তিষ্ক বুঝেছিল এসব কেবল একটা দুর্ঘটনা। তাই তখন থেকে শুরু হয় অভিনয়। মেয়েটি জানায় কিছুই মনে নেই ওর। কেইস সেখানেই ক্লোজ হয়। বিয়েটা পরিবারের সকলের মতো,সে নিজে ও ধরে নেয় কেবল এক দুঃস্বপ্ন। শুরু হয় এক অভিমানের গল্প। যে গল্পের নায়ক অভিনব আর নায়িকা ঝিল।

শীতল হাওয়া নেমেছে। ত্বকে স্পর্শ করতেই এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। ঝিলের কান্না থেমেছে। অভিনবর বুকের মাঝে মাথাটা এলোনো। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়াতে ঝিলকে যেতে হলো এবার। রজনী শুরুতেই প্রশ্ন করল, “একটা ঘন্টা কোথায় ছিলে?”

“বাইরেটা ঘুরছিলাম আপু।”

“বসে যাও। সময় নেই হাতে। সাজাতে টাইম লাগবে তো।”

“হুম।”

ঝিলকে সাজানো হয়। মেয়েটি পুরোটা সময় একদমই চুপ ছিল। সাজ শেষে নিজেকে দেখে অবাক হয়। তাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। অথচ মেয়েটি সর্বদা হাল্কা সাজে সেজে থাকে। সন্ধ্যায় ফিরল ওরা। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ছেলের বাড়ি থেকে দলে দলে লোক আসছে। বেশ নামজাদা পরিবারে বিয়ে হচ্ছে রজনীর।

চলবে…

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (১৯)

মোহ,মুগ্ধতা, প্রেম, ভালোবাসা এসব কেবল কাব্যিক শব্দ নয় বরং এক একটা লুকানো অনুভূতি। সব কিছু মিলেমিশে যখন একাকার হয়ে যায় আর ভাগ্য সহায় থাকে তখনি হয় পরিনয়। তবে এই পরিনয় সর্বদা সুখের হয় না। রজনীর বিয়ের আয়োজন তাক লেগে যাওয়ার মতোই। এই মুহূর্তে যে গানটা চলছে সেটা বেশ বিখ্যাত। সকলেই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। অভিনব ড্রাম বাজাতে পারে ভালো। তাই সে নিজেও বসেছে গানের আসরে। ঝিল ওকেই দেখছিল। ভালোবাসার মানুষটির সমস্ত কিছু ভালো লাগতে হবে এমন নয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে অভিনবর সব কিছুই ভীষণ আর্কষণ করে মেয়েটিকে। এই ছেলেটা ওর কিশোরী বয়সের আবেগ। যে বয়সটায় মানুষ প্রথম প্রেমে পড়ে থাকে। ঠিক সে বয়সেই অভিনব ওর জীবনে এসেছে। শুধু তাই নয় ওর জীবনের সাথে ভীষণভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। সম্পর্কটা একদিক থেকে বেশ সুন্দর লাগলেও কোথাও একটা টানাপোড়ন রয়েছে। পরিবারের দ্বন্দ্বেই মেয়েটির দীপশিখার মতো জীবন নিভে গেছে। হয়ত অভিযোগ নেই তবে অভিমান আছে। এই অভিমানের আবার প্রকাশ নেই। থাকবেই বা কেমন করে? পরিবারের প্রতিটি মানুষ এতটা আদরে রেখেছিল যে মেয়েটি একটা সময় স্বীয় ভালোবাসাকে ভুলতে বসেছিল। তবে ভুলে নি। আসলে ভালোবাসাকে ভোলা যায় না। কোনো না কোনো ভাবে ভালোবাসা আমাদের হৃদয়ে ঠিকই উৎপাত করতে থাকে। গানটি সবে শেষ হয়েছে। চারপাশ থেকে হৈ হৈ আওয়াজ আসছে। অভিনব সুযোগ বুঝে নেমে এলো। ঝিলের থেকে কিছুটা দূরে ওমন সময় ঝিলের বড় মামা এলেন, “রজনীর সাথে গিয়ে বসো।”

“জী মামা।”

অভিনবর দিকে একপলক তাকিয়ে চলে গেল ঝিল। মন খারাপ হলো ছেলেটার। আয়ুষ এলো একটু বাদে। অভিনব চলে যেতে নিচ্ছিল সে সময়টাতেই ডাক পড়ে। কিছুটা এগিয়ে এসে বলে, “ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাইন্ডলি গিয়ে বসুন।”

অভিনব ডিনারে জন্য যায়। ঝিল রজনীর পাশে বসে অনেকগুলো ছবি তুলে। খানিক বাদে অভিনবর ম্যাসেজ আসে, “সময় করে একটু বাহিরে আসবেন প্রজাপতি।”

রজনীর বান্ধবীরা ঝিলকে ছাড়ছিলই না। ওরা নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। অনেকটা সময় লাগল বের হতে। অভিনব বাহিরের গেটে দাড়ানো ছিল। ঝিলকে দেখেই এগিয়ে এলো, “সুন্দর লাগছে।”

লজ্জা লাগল মেয়েটির। সাধারণত প্রশংসা শুনতে মেয়েরা অধিক পছন্দ করে থাকে। কিন্তু সে প্রশংসাটাই যখন প্রিয় মানুষটা করে তখন একটা অদ্ভুত ভালো লাগার সাথে সাথে লজ্জাও লাগে। বাইরে অনেকদূর অবধি লাইটিং করা হয়েছে। নিরলস ভাবে চলছে দুজনেই। আজকের আকাশে চাঁদ অতো সুন্দর নয়। অর্ধেক উঠেছে। তবে পরিবেশটা স্নিগ্ধ। বাড়ি থেকে অনেক দূর চলে এসেছে। এপথে মানুষ কম। নেই বললেই চলে। প্রায় মধ্যরাত। সমস্ত আর্কষণ তো হলুদের অনুষ্ঠানে।
“চা খাবেন?”

মাথা দুলায় মেয়েটি। অভিনব বাজারে গিয়ে টং এর দোকান থেকে চা নিয়ে আসে। পুরো বাজারটা জনমানবহীন। এই একটা দোকানই খোলা। রাতের আঁধারে টিম টিম করে জ্বলছে একটা বাতি। হাল্কা হাল্কা ধোঁয়া। দু একটা কুকুরের ডাক। কেমন যেন ভৌতিক পরিবেশ। ঝিলের শরীরে কম্পন ধরে গেল। অভিনব আলগা হাতে মেয়েটির ত্বক স্পর্শ করেছে। এই শিহরণে মেয়েটির যে ম রে যেতে ইচ্ছে করছে। কাকে বোঝাবে এসব?
“প্রজাপতি।”

“হু।”

“কেমন লাগছে?”

“ভীষণ ভালো।”

“আপনার শখ ছিল মধ্য রাতের আঁধারে কোনো এক গ্রামের কাঁচা সড়কে পথ চলতে চলতে চা পান করবেন।”

মেয়েটির মনে পড়ল এবার। খুব ছোট বেলায় এই শখটাও জেগেছিল ওর। সিনেমা দেখতে দেখতে নিজের জীবন নিয়ে কত কল্পনাই করত। সে সব জানে অভিনব। ডায়েরিতে সব কিছুই তো লিখা আছে। চা শেষ করে অভিনবর বাহুতে মাথা রাখল ঝিল।
“থ্যাংকস।”

“শুধু থ্যাংকস?”

মেয়েটি ভেবে পেল না আর কি দেওয়া যায়। অভিনব নিজ থেকেই জানালো কথাটি। সে সময় ঝিলের মুখ রক্তিম হয়ে উঠল। ছেলেটা নিজ থেকেই টেনে নিল। ঈষৎ ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিল অধর যুগল। একে অপরের শুধা পান করে যেন তৃপ্ত হলো দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা অন্তর অনল। মেয়েটি এই অনুভূতির সাথে পরিচিত নয়।
“প্রজাপতি, আপনি প্লিজ কাছে আসবেন না। আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাই। আমার যুবক হৃদয়ের এই হাহাকার আপনি বুঝতে পারছেন না।”

এমন একটি কথা শোনার জন্য আসলেই প্রস্তুত ছিল না মেয়েটি। প্রতিটা ভালোবাসার কোনো না কোনো পর্যায়ে শারীরিক আর্কষণ থাকে। সে দিক থেকে ভাবতে গেল ওদের দুজনের বয়সটাই মারাত্মক। ওরা যখন ফিরে এলো তখন আবার গান শুরু হয়েছে। ভীড়ের কারণে সেভাবে লক্ষ্য করেনি কেউ। ঝিল সরাসরি নিজের ঘরে চলে এলো। আজ সারারাত ই গান চলবে। আরশির সামনে দাড়িয়ে মেয়েটি হাসল। গালের এক পাশে কিছুটা হলুদ লাগানো। অভিনব লাগিয়ে দিয়েছে। ওর ইচ্ছে করছে এই হলুদ আজন্ম অবধি রেখে দিতে। কিন্তু তেমনটা সম্ভব নয়।

ভোর রাতের চিল্লাচিল্লিতে ঝিলের ঘুম ছুটে গেল। বাড়ির প্রতিটা মানুষ ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মাঝে চিন্তার ছাপ। কান্নার শব্দ ও শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই কি থেকে কি হয়ে গেল। সবটাই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ঝিল কেবল খুঁজে যাচ্ছে। একটা শান্ত, পরিপক্ব মানুষ চাচ্ছে সে। যাকে ধরে জানা যাবে সবটা। কিন্তু তেমন কাউকেই পেল না। এই মুহূর্তে কাউকেই শান্ত দেখাচ্ছে না। একটু বাদে নজর এলো সুমাকে। বাচ্চা মেয়েটি নিজেও হয়ত বুঝতে পারছে না।
“সুমা, এদিকে এসো তো।”

“হ্যাঁ আপু।”

“আমায় একটা কথা বলো তো। সবাই এত চিন্তিত কেন! কি হয়েছে, তুমি কি জানো?”

“রজনী আপুকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“পাওয়া যাচ্ছে না! কেন, কোথায় গিয়েছে আপু?”

“জানি না। মা বলছিল আপু নাকি পালিয়ে গেছে।”

বুকের ভেতরটা নড়ে উঠল। ঝিলের দুটি চোখ একদম বিচলিত হয়ে পড়েছে। চারপাশের গন্ডগোল বেড়ে যাচ্ছে। ভোরের আলো যত বৃদ্ধি পাচ্ছে শব্দের বেগও তত ব্যকুল হচ্ছে। এসব ওর মন মস্তিষ্ককে দিশেহারা করে দেয়।
ঘটনাটা খুব দ্রুতই ঘটে গেল। ঝিলের মাথা ঘুরে গেল হঠাৎ। মেয়েটিকে ধরে বসালো একজন সার্ভেন্ট। পানি এগিয়ে দিল। সবটা শেষ করে ঝিল উঠে আসে। ঝিলের ছোট মামা রকিবুল চৌধুরী বলছেন,”পুলিশে ইনফর্ম করেছি। খোঁজ চলছে। তোমরা কি কেউ কিছু বুঝতে পারো নি?”

“তোমাদের আগেই বলেছি আমি। মেয়েটার মনে কিছু চলছিল। কোথাও একটা সমস্যা। সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সেসব কেউ আমলেই নিচ্ছিল না। দেখ এখন কি থেকে কি হয়ে গেল।”

রজনীর মা ডালিয়ে বেগম এবার কেঁদে ফেললেন, “আমি কি করে বুঝব? মেয়ের মা আমি। আমার সাথে তো বন্ধুত্বের সম্পর্ক নয়।”

“কিন্তু আপা আমি তোকে বলেছিলাম রজনীর মতামত নে। বার বার বলেছিলাম। কি বলেছিলাম তো?”

সুমতি বেগমের প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারলেন না। মেয়ে তার শিক্ষিত। স্পষ্ট করেই কথা বলে। যদি কাউকে পছন্দ করেই থাকে তবে লুকানোর কথা নয়। কি এমন ঘটে গেল যে লুকাতে হলো। আয়ুষ আর রাশিদ চৌধুরী কিছুক্ষণের মধ্যেই সবটা সামলে নিলেন। সব কিছু যেন ঘরের মধ্যেই থাকে এর জন্য দেওয়া হলো কড়াকড়ি নির্দেশ। রাশিদ চৌধুরী শান্ত মস্তিষ্কের মানুষ। মেয়ের এই ভাবনা আগেই ধরে ছিলেন। এই নিয়ে খোলামেলা কথাও বলেছেন। যদিও এই বিষয়টা তাদের বাবা মেয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মেয়েটা তখন খুব বুঝদারের মতো করে কথা বলেছিল। তাই অনেকটা নিশ্চিন্তেই বিয়ের আয়োজন করেছিলেন ভদ্রলোক। কিন্তু শেষে এমন কিছু করে বসবে ধারণাও ছিল না। রকিবুল চৌধুরী সি সি টিভি ফুটেজ দেখতে বসলেন। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। গত এক মাসের বাড়ির সামনের সবগুলো সি সি টিভি ফুটেজ ডিলেট করা! সবাই খুব ভালো করেই বুঝতে পারল জল খুব ভালোই ঘোলা হয়েছে। ওমন সময় একটা ভিডিও পাওয়া গেল। কাল রাতে ছেলেরা যখন নাচানাচি করছিল সেই ভিডিওতেই উঠেছে। তবে বিশেষ কিছু স্পষ্ট নয়। শুধু দেখা যাচ্ছে একটা ছেলের হাত ধরে চলে যাচ্ছে রজনী। ঝিল উপর থেকে নেমে এলো। লোকটার থেকে ফোন নিয়ে ভিডিওটা অন করল। এতে করে মেয়েটির হৃদয়ে গর্জন নেমে আসে। তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে বাহিরে। গেস্ট হাউজে কেউ নেই। সম্ভবত কাল রাতেই পোগ্রাম শেষ করে চলে গেছে সবাই। ভীষণ অসহায় লাগছে। অভিনবর নাম্বারে লাগাতার কল করে যাচ্ছে। কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ! এবার ঝিলের দুটি চোখে বর্ষণ নামে। আর্তনাদ গুলো গলায় এসে ঠেকেছে। বার বার ভাসছে ভিডিওটা। যেখানে হলুদের কাপড় পরা রজনীর মেহেদী রাঙা হাত ধরে চলে যাওয়া ছেলেটিকে চিনতে একটুও সমস্যা হয় নি ওর। ছেলেটা যে আর কেউ নয় ওর নিজের ভালোবাসা অভিনব!

চলবে….

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২০)

বিগত দুটো দিন ঝিলের জীবনে তোলপাড় করার মতোই ছিল। রজনী আর অভিনবর পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য যেন ওকে দ্বিধান্বিত করে তুলেছিল। স্বীয় ভালোবাসা যখন দূরে সরে যায় আমাদের মস্তিষ্ক তখন নিজ থেকেই কিছু ধারণা করে নেয়। তবে মন প্রায়শই ব্যতিক্রম ভাবে। এই মন মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে ব্যক্তির জীবন হয়ে উঠে অতিষ্ঠ। একটা সময় শ্বাস ভারী হয়। মনে হয় এই জীবন রেখে লাভ নেই। এমনি কিছু উগ্র চিন্তা এসেছিল ঝিলের মাঝে। সে সময়টায় কেউ পাশে ছিল না। এক অব্যক্ত অনুভূতি এসে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিল ওকে। অনুভূতিকে সাড়া না দিয়ে আচানাক ভাইকে কল করে বসেছে ঝিল। ফোনের এপাশ থেকে কান্না করছে। ওপাশ থেকে আহনাফ বিচলিত হয়ে পড়ল।
“বনু, বনু কি হয়েছে তোর?”

“আমার ভালো লাগছে না ভাইয়া। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমি দম আটকে মা রা যাব। প্লিজ আমায় নিয়ে যাও। আমি থাকতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে খুব। আমি মা রা যাব ভাইয়া।”

“নিয়ে যাব তো, কিন্তু তোর কি হয়েছে বনু? কেউ কি কিছু বলেছে? এই বনু কথা বলছিস না কেন? বনু। এই বনু।”

কান্নাভেজা কণ্ঠটা আর শুনতে পেল না আহনাফ। ঝিল মেঝেতে বসে পড়েছে। দরজার ওপাশ থেকে রীতিমতো ঝড় শুরু হয়ে গেছে। মেয়েটির কান্নাকাটির আওয়াজে চিন্তিত হয়ে পড়ল বাড়ির সকলেই। এত এত অশান্তি আর নেওয়া যাচ্ছে না। কি হচ্ছে কেউ যেন বুঝতেই পারছে না। সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছে আয়ুষ। ঝিলের কান্নার অর্থ বুঝতে পারল না সে। কেবল বলল, “দরজা খোল ঝিল, না হলে ভাঙতে হবে।”

কয়েক সেকেন্ড থেমে রইল সবাই। ততক্ষণে ঝিলের বাড়ি থেকে কল এসে পড়েছে। আহনাফ জানাল সে রওনা দিয়ে দিয়েছে।
খুব ভোর বিধায় রাস্তা এখন একদম খালি। আধ ঘন্টার মধ্যেই চলে আসবে। ততক্ষণ অবধি যেন ঝিলের কাছে থাকে কেউ। একা রেখে না যায়। আহনাফের কল রেখে আয়ুষ বলল, “সবাই যাও আমি দেখি কি করা যায়।”

“কি অশান্তি বল তো। মেয়েটা এভাবে কান্নাকাটি করছে কেন।”

“দেখি, কিছু জানতে পারি কি না। তুমি ঘুমাতে যাও মা।”

“ঘুম কি আর আসবে? তোর বোনটা এভাবে…”

“থাক না সেসব। মামুনি প্লিজ মাকে ঘরে নিয়ে যাও।”

সুমতি বেগম বোনকে নিয়ে চলে গেলেন। ঝিলের কান্নার শব্দ কমে এসেছে। এবার আয়ুষ বলল, “কথা না বল। তবে অবুঝদের মতো কাজ করিস না। আমি বাইরেই আছি। একটু পরই আহনাফ আসবে।”

একটা চেয়ার নিয়ে দরজার কাছেই বসল আয়ুষ। গত দুদিনে একটি বার চোখের পাতা এক করে নি। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত। রজনীর দ্বারা এমন কিছু সম্ভব তা ঘুণাক্ষরেও ভাবনাতে আসে না। মেয়েটি তো ভীষণ শান্ত। পরিবারের প্রতি বেশ মায়াও রয়েছে। তবে কেন এমন করল সে?

আহনাফের ডাকে হন্তদন্ত হয়ে উঠল ঝিল। মেয়েটি এতটাই বেপরোয়া ছিল যে বেডের কোণের সাথে লেগে পা হড়কে গেল। নখের কোণ ভেঙেছে। তবে সেসবে ধ্যান নেই। উঠে গিয়ে দরজা খুলল সে। আহনাফের দৃষ্টিতে বিস্ময়। ভাইকে জড়িয়ে ধরল ঝিল। আহনাফ বুঝতে পারছে না। কি হয়েছে ওর! মেয়েটির মাথায় হাল্কা হাতে বুলিয়ে বলল, “এসে গেছি, আর কান্না নয়। ভাইয়া সব ঠিক করে দিব।”

ঝিল মৌন রইল। একদমই কথা নেই। আয়ুষ একটু দূরে দাঁড়িয়ে। বোঝার চেষ্টা করছে সবটা। কিন্তু কিছুই আসছে না মস্তিষ্কে। রজনীর কাহিনীটায় মস্তিষ্ক জ্যাম হয়ে আছে।
“যা যা নেওয়ার গুছিয়ে নে। এখনি বের হবো আমরা।”

“কিছু নেওয়ার নেই। আমি এখনি যেতে চাই। প্লিজ এখনি নিয়ে যাও ভাইয়া।”

আহনাফ আর ঝিল তখুনি বের হয়ে গেল। অদ্ভুতভাবে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল আয়ুষ। একটা যন্ত্রণা ওর দেহ মন সর্বত্র ছড়িয়ে গেল।

বাড়িতে এসে একটা কথাও বলল না ঝিল। নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। গোসল করে এসে শুয়ে রইল। পরিশ্রান্ত আর নির্ঘুম থাকা দেহটা খানিকবাদেই হারিয়ে গেল ঘুমের দেশে। আহনাফ কোনো কথা না বলেই নেমে এসেছে। থাকুক মেয়েটা আলাদা। রোহনকে কল করে ঘটনাটা জানাতেই রোহন বলল দুপুরে এসে কথা বলবে। বিষয়টা মোটেও স্বাভাবিক নয়। রোহন আরও জানায় তাদের থেকে কিছু তো লুকানো হচ্ছেই। এই বিষয় গুলো খোলসা হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।

ঝিলের মামারা বাড়ি ফিরে মেয়েটির চলে যাওয়ার ঘটনা শুনতে পেল। একটা মন খারাপ হলো ওনাদের সকলেরই। তবে পরিস্থিতি এতটাই হাতের বাহিরে যে বিশেষ কিছু বললেন না ওনারা। আয়ুষ পুনরায় বের হয়ে গেল। বর্তমানে সে গ্রামের অলি গলি থেকে ছেলেপেলে নিতে যাবে। যারা রজনীকে খুঁজতে সাহায্য করবে।

.

দুপরের ঘটনা। আহনাফ আর রোহন একসাথে হয়ে বিষয়টা নিয়ে ভাবছে। ঝিলের সব থেকে কাছের বন্ধু হলো মৌনতা। মেয়েটি ওর জীবনে বেশ গুরুত্বের সাথে বাস করছে। তার থেকে কোনো তথ্য জানা যাবে বলেই রোহনের ধারণা। সে বহুদিন পর চিরচেনা নাম্বারটা ডায়াল করল। যে নাম্বারটা ডায়াল করা হয় নি বহুদিন বহুমাস। ওপাশের ব্যক্তিটি বোধহয় ভীষণ ব্যস্ত। তাই কল রিসিভ হলো না। রোহনের নাকের অগ্রভাগ লাল হয়ে এসেছে। রাগের কারণে চোখ দুটো যেন রঙের হাট বসিয়েছে। একটা অভিমান কিংবা আত্মসম্মান থেকে পুনরায় কল করল না সে। কিন্তু ওপাশ থেকে ঠিকই কল এল। রোহন বিষয়টা খেয়াল করতে করতে কল কেটে গেল। সে কল দিল না। বরং চেয়ে রইল কল আসার অপেক্ষাতে। ঘন্টা পেরিয়ে গেল অথচ কল এল না। রাগে শরীর রি রি করছে ছেলেটির। বিকেলের শুরুতে সমস্ত ইগোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রোহন পুনরায় কল করল। এবার রিসিভ হলো।
“হ্যালো। আসলে আমার ফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গিয়েছিল। লোন নেওয়া ছিল বিধায় পুনরায় লোন নিতে পারছিলাম না। একটা অনুষ্ঠানে এসেছি তাই বের ও হতে পারছি না। স্যরি।”

রোহন মনে মনে অনেক কিছুই কল্পনা করেছিল। সে ভেবেছিল মেয়েটিকে এসব নিয়ে কোনো এক সময় অনেক কথা শুনাবে। কিন্তু এত গুলো কথা শুনে সে বুঝতে পারল মৌনতা নিরুপায়। তাই সে স্বাভাবিক রইল।
“ইটস ওকে।”

“হ্যাঁ।”

বলেই থেমে গেল মেয়েটি। সে আসলে বুঝতে পারছে না সম্মোধনে তুমি বলবে নাকি আপনি। আগে তো তুমি বলেই এসেছে। কিন্তু এখন সম্পর্কটাও স্বাভাবিকের কাতারে নেই।
“কল কেন করেছিলেন?”

“একটু দরকার ছিল। সমস্যা না থাকলে আজ বাসায় এসো একবার।”

“ঠিক আছে।”

উত্তেজনায় কাঁপছে মৌনতা। সে কি রেখে কি করবে বুঝতে পারছে না। রোহন তাকে কল করেছে! এতদিন পর! ছেলেটার মনে বুঝি পুরনো হাওয়া লেগেছে? না না অন্য কিছুও তো হতে পারে। কিন্তু কি হবে? হওয়ার মতো কিছু তো নেই। মৌনতার নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। সে তখুনি বের হয়ে গেল। এমনকি উত্তেজনার কারণে ফোনটা ও ফেলে গেল।

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে