সুখ একটি প্রজাপতি পর্ব-৩৯+৪০

0
1959

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৩৯)

ছোট পাহাড়ের মতো উঁচু জায়গাটাতে কিছু পাখি বসে আছে। তার পাশে রয়েছে ছোট এক ঝিরি। টলটল করছে তার জল। গাছের ছায়া পড়েছে এতে। খুবই সুন্দর দৃশ্য। অভিনব পেছনে আসতেই নিজের ছায়াটি লক্ষ্য করল মেয়েটি। তরঙ্গ বয়ে চলেছে পানির মাঝে। তার মাঝেই ওদের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর! ড্যানিয়ালের পিঠে বেশ বড়োসড়ো একটা ব্যাগ। এর ভেতরে কি রহস্য লুকিয়ে রেখেছিল তার উন্মোচন হলো এখন। ব্যক্তিটি সাথে করে শামিয়ানা নিয়ে এসেছে! সেটাই মেলে দিল অলিভিয়া। ব্যাগটা নামিয়ে একে একে বের করল নানান জিনিসপত্র।
“কি কান্ড করেছো ড্যানিয়েল!”

“অভিনব! সবাই মিলে আড্ডা দিব এখন।”

“এত সময় কেন বের করলে না?”

“পারফেক্ট প্লেসের অপেক্ষা করছিলাম।”

“দারুণ। সাথে আর কি কি এনেছো?”

অলিভিয়া ব্যাগ থেকে কিছু ফল আর স্ন্যাকস বের করল। সেগুলো সবাই মিলে সাজিয়ে রাখল। তারপর শুরু হলো গানের আসর। দু একটা বাংলা গান ও হলো। মুগ্ধ হয়ে শুনছে কানাডিয়ান কপোত কপোতি। ভাষা না বুঝতে পারলেও সুর ভালো লাগছে ওদের। উঁচু ভূমিতে সময় কাটিয়ে ওরা এল এবার গ্রিন হাউজে। প্রথমবারের মতো সরাসরি গ্রিন হাউজ দেখল ঝিল। বইয়ের পাতাতে কতোই না পড়েছে এসব। অথচ তখন বড়ো বিরক্ত অনুভব হয়েছে! সরাসরি দেখে বেশ ভালো লাগছে। টবে সাজানো আছে নানান সব প্রজাপতির গাছ। কিছু ফুল স্পর্শ করল ঝিল। নরম এক অনুভূতি। ওর ভালো লাগল। একটু নয় অনেকটা ভালো। অচেনা গাছের মধ্যে চেনা গাছ হলো কলা গাছ। তবে টবে লাগানো বিধায় অন্যরকম লাগছে। কলা থাকলে বোধহয় আরও সুন্দর দেখাত।

গ্রিন হাউজ দর্শন শেষে ওরা পথ চলল ওয়াইল্ডলাইফ হেল্থ সেন্টারে। সেখান থেকে গেল কানাডিয়ান উইটলেন্ডসে। এই পরিবেশটা দারুণ। গ্রামীন ছোঁয়া রয়েছে। জলাশয়ে পানা জমেছে। যার কারণে পানি দেখা যাচ্ছে না। সবটাই সবুজ। গাছের ডাল গুলোতে পাখিরা বসে আছে। একটু পর পর সুর তুলছে। মাথার উপরের সূর্য নরম রোদ দিচ্ছে। চারপাশটা যেন আরও সুন্দর হয়ে এসেছে। থেকে কাঠের প্ল্যাকার্ডে বিভিন্ন শব্দ লেখা। যা আমাদের পরিবেশকে সুন্দর করে তোলার বানী হিসেবে প্রচার হচ্ছে। ওরা ফের ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বেঞ্চে বসতেই ড্যানিয়ালের ফোনটা বেজে উঠল। সে কিছু কথা বলে জানাল বিশেষ কাজের জন্য এখনি ফিরে যেতে হবে। অলিভিয়ার ভীষণ মন খারাপ হলো। সে আরও কিছু সময় থাকতে চায়।
“মাই অলিভিয়া। প্লিজ তুমি মন খারাপ করো না। আচ্ছা তুমি সবার সাথে থাকতে পারো।”

“নো ড্যানিয়েল। ইটস ওকে। তোমার সাথেই ফিরে যাচ্ছি।”

ওর মন খারাপ দেখে সবারই খারাপ লেগেছে। কিন্তু ড্যানিয়ালকে যে এখনি যেতে হবে। ওরা চলে যাওয়ার পর কিছু সময় গল্প করল সবাই। তারপর ফের রওনা হলো। চলতে চলতে জলাশয়ের পাশে একটা লেখা চোখে এল। “উই মেক চেঞ্জ টুগেদার।”

ইউরেশিয়ার ওয়াইল্ডসের গেটের কাছে এসে সব থেকে বেশি যেটা নজর বন্দী হলো সেটা হচ্ছে দুটো প্রাণীর ভাস্কর্য। এরই মাঝে ডাক দিল মাহের। সকলে সেদিকেই ছুটে এল। বিশাল আকৃতির ডায়নাসোরের কঙ্কাল। যা দেখে হা হয়ে গেছে ঝিলের মুখ।
“বলো তো ডায়নাসোররা কোন কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেল।”

হঠাৎ এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল ঝিল। সে ঠিক মনে করতে পারল না। স্মিত হাসল ছেলেটা। আশ্বস্ত করার ন্যায় বলল, “আমি বলছি। মূলত একটি গ্রহাণুর আঘাত হয়েছিল আমাদের পৃথিবীতে। তখনি ওরা ধ্বংস হয়ে যায়। এখন শুধু পাওয়া যায় কেবল,ওদের হাড়গোড়। অথচ একটা সময় ওদের রাজত্ব ছিল এই পৃথিবীতে। মোরালটা কি বলতে পারবে প্রজাপতি?”

“উহু। মাথায় আসছে না।”

“মোরাল হচ্ছে এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। যে যত শক্তিমানই হোক না কেন।”

টাইগার টেরিটরিতে ওরা শুরুতেই বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পেল। তারপর নজরে এল কাচের দেয়ালের ওপাশে থাকা বাঘকে। সে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। অথচ এক দল মানুষ তাকে দেখার জন্য,গর্জন শোনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাঘ মামা এবার কাউকে পাত্তা দিলেন না। সবাই তখন বেরিয়ে যাচ্ছে। অভিনব হুট করেই আঙুলে কিছু রং নিয়ে মেয়েটার গাল ছুঁয়ে দিল। বিষয়টা এত দ্রুত ঘটল যে কেউ কিছু বুঝতেই পারল না। ঝিল ভ্যবলার মতো তাকিয়ে রইল। মানুষটা ওকে ক্ষণে ক্ষমে চমক দিচ্ছে!

অস্ট্রালাসিয়াতে এসেই চোখে পড়ল ক্যাঙ্গারু। প্রানীটির লাফানোর ধরন বেশ উপভোগ করছে ওরা। ঝিলের ইচ্ছে করছে প্রাণীটির মতো লাফাতে। ওর ভাবনায় টান পড়ল অভিনবর কণ্ঠে।
“দ্রুত চলো। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।”

মেয়েটির ভাবনা আর দীর্ঘ হলো না। তারা আবার চলতে লাগল। একটা সাইডে রয়েছে বানর। ওদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। পাশ থেকে একজন বাচ্চা পর্যটক ভেঙ্চি কাটতেই বানরটি ক্ষেপে যায়। চেচিয়ে উঠে। ভয় পেয়ে চলে গেল বাচ্চাটি। অভিনব একটু বিরক্ত বোধ করেছে। প্রাণীদের সাথে এমন আচারণ ঠিক নয়। বানর দেখা শেষে ওরা এল স্নেক জোনে। সেখানে সবুজ রঙের সাপ রয়েছে। প্রাণীগুলো গাছের ডালে আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে আছে। দেখলেই কেমন গা ছমছম করে উঠে।
“এই সাপটার নাম কি অভিনব?”

“এটা হচ্ছে গ্রীন ট্রি পাইথন।”

“কি সাংঘাতিক দেখতে। গাছের পাতার সাথে মিশে থাকলে বোঝা ও যাবে না।”

“হুম। আমরা একবার একটা ট্যুরে গিয়ে এর মুখোমুখি হয়েছিলাম। একটুর জন্যে বেঁচে গেছি।”

গ্রীন পিট পাইথন নিয়ে কথা বলতে বলতে ওরা এল কচ্ছপ দেখতে। বিশাল এক কাচের জারের মধ্যে রাখা হয়েছে প্রাণীগুলোকে। তারা চলাচল করছে নিজেদের মতো করে। একদম কাচের দেয়ালের সাথে মিশে যাচ্ছে কখনো কখনো। অভিনব ঝিলকে নিয়ে নিচু হয়ে বসল। হাত টেনে নিয়ে কাচের দেয়ালে রাখল। একটা কচ্ছপ দেয়ালের ওপাশ থেকে মিশে রইল। ভীষণ ভালো লাগল ঝিলের। কচ্ছপটাকে ছুঁয়ে দেখতে পারলে আরও ভালো লাগত। হুট করেই একটা বিষয় কল্পনা করে ওর মন খারাপ হয়ে গেল।
“ওদের জীবনটা খুবই অসুন্দর তাই না?”

“এমন কেন মনে হলো?”

“ওরা বন্দী। আমাদের বিনোদনের জন্য ওদের জীবনটা কেমন রঙহীন হয়ে আছে।”

“এটা স্বাভাবিক। প্রতিটা প্রাণীই তৈরি হয়েছে কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে।”

“কিন্তু ওরাই কেন বন্দী জীবন কাটাবে বলো তো।”

“সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। আর মানুষ মাছ মাং স আহার করে থাকে। আর মাছ সহ বিভিন্ন প্রাণী আবার অন্য ছোট প্রাণীকে গ্রহণ করে। শৃঙ্খল না থাকলে পৃথিবীটাই থাকত না ঝিল।”

যুক্তিটা মেনে নিল ঝিল। তবু ওর মন খারাপ হয়ে রইল। অভিনব দু হাতে বুকে চেপে ধরল।
“ছোট ছোট বিষয়ে কেউ মন খারাপ করে?”

“আমি করি।”

“কারণ তুমি লক্ষী। সবার কথা চিন্তা করো। কিন্তু কি বলো তো এসব আমাদের হাতে নেই। আল্লাহর পরিকল্পনা নিশ্চয়ই সব থেকে সুন্দর।”

স্মিত হাসল মেয়েটি। সেখান থেকে ওরা এল কোরাল আইল্যান্ডে। পুরো জায়গাটাতে কোরালের ভাস্কর্য রয়েছে। কাচের বিশাল জার গুলোর ভূমিতে ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ। তার মাঝে আবার রঙিন মাছ। চোখের সামনে এসব দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠে শরীর। মনে হচ্ছে ওরা সমুদ্রের নিচে রয়েছে।

টরন্টো জু শহরটির সৌন্দর্যতে অন্যরকম মাত্রা এনে দিয়েছে। ভেতরে প্রথম ন্যাশন আর্ট গার্ডেনের ও দেখা মিলে। সেখানকার শৈল্পিক জিনিস গুলো হৃদয়ে দাগ রাখার মতো। পিকনিকের জন্যেও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। সবটা ভীষণ সুন্দর ভাবে সাজানো গোছানো।

একটু দূরেই আবার গরিলা আরোহণ। প্ল্যাকার্ডে সেটা সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা ও রয়েছে। একে একে ওরা ঘুরল আফ্রিকান রেইনফরেস্ট প্যাভিলিয়ন ও গরিলা রেইনফরেস্ট। মাঝে একবার গরিলাটা গর্জন করে উঠল। আফরা তখন ছবি নিতে ব্যস্ত। হঠাৎ গর্জন শুনে বেশ ঘাবড়ে গেল। চেচিয়ে উঠল উচ্চস্বরে। সবাই হাসল একচোট। অথচ ভয়ে মেয়েটির বুকে এখনো ধীম ধীম করছে। ঝিল আগ্রহ নিয়ে দেখছে সব। দুটো গরিলা নিজেদের শক্তি জানান দিতেই হেঁটে চলেছে। এক মুহূর্তের জন্য প্রাণী দুটোকে বডি বিল্ডার মনে হলো। এরই মধ্যে ঘটে গেল আরেক কান্ড। মাহেরার শরীরে লাল ব্যাঙ উঠে গেল। মেয়েটি এমনিতেই এই প্রাণী দেখে ভয় পায়। তার উপর শরীরে উঠে গেছে! ভয়ের চোটে সে কান্না করে দিল প্রায়। মাহের ছুটে এসে প্রাণীটিকে সরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে কিছু কর্মীকে ইনফর্ম করল অভিনব। লাল ব্যাঙ মূলত কাচের দেয়াল থেকে বেরিয়ে কোনো ভাবে বাইরে চলে এসেছে। লোক গুলোর সাথে কথা বলল সে। অভিনব বিষয়টা ইনফর্ম করায় ধন্যবাদ জানাল ওরা। এর মধ্যে মাহেরা আর আফরার কথা কাটাকাটি শোনা যাচ্ছে। মাহেরা বার বার বলছে ওর ঘাড়ের কাছটা ধুয়ে দিতে কিন্তু আফরা দিচ্ছে না। ওর ভাষ্য মতে এভাবে ঠান্ডা লেগে যাবে। পরিশেষে অভিনব কাছে এল। মাহেরার দৃষ্টি শূন্য।
“আফরার কথা মেনে নাও। ও ঠিক বলছে।”

“কিন্তু এটা খুবই বাজে অনুভূতি দিচ্ছে অভিনব। আই কান্ট স্ট্যান্ড।”

“কিছু হবে না। সব কিছুই আল্লাহর সৃষ্টি। এতে কোনো ক্ষতি হবে না। পানি দিয়ে ক্লিন করতে গেলে উল্টো শরীর খারাপ করবে।”

“হুম।”

ওর কথা মেনে নিল মাহেরা। আফরা চোখ ছোট করে রইল। এদিকে ঝিল আবার রাগ দেখাল। ওর কান্ডে অভিনবর হলো বেহাল দশা। নারীর মন বোঝা আসলেই কঠিন।

চলবে…..

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৪০)

বিকেল নেমে এসেছে। হাতে একদমই সময় নেই। জু বন্ধ হবে কিছু সময় পর। এত দ্রুত ঘোরার পর ও সবটা দেখা হলো না ওদের। এটা আসলে একদিনে সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। সারাদিনের ঘোরাফেরায় ক্লান্ত সবার শরীর। বিশেষ করে ঝিল। মেয়েটি সবার থেকে রোগা। এত চেষ্টা করেও খাবারের প্রতি অনীহা দূর করা যাচ্ছে না। তাছাড়া ধকল ও তো কম নয়। অভিনব তার শক্তপোক্ত বাহুতে আবদ্ধ করে রেখেছে। মেয়েটির শরীরে এখনো রয়েছে জ্যাকেটটা। যদিও শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে তবু মানুষটার শরীরের ঘ্রাণের লোভ সামলাতে পারছে না সে। অথচ সর্বদা পাশাপাশি আছে ওরা। ভালোবাসা এমনি হয়। ছোট ছোট জিনিস নিয়ে পাগলামি করতেও ভালো লাগে। ঝিলের অবস্থাও তেমনি। সিংহ দেখার ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারল না ওরা। সময় নেই একদমই। তবু ঝিলের নেই কোনো অভিযোগ। সে আজ দারুণ উপভোগ করেছে। এত গুলো মাস ঘরে থেকে শরীর কেমন যেন হয়ে এসেছিল। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। শরীর ক্লান্ত থাকলেও ঝিল বসে পড়ল গল্প করতে। সে পুরো দিনের ঘটনা বর্ননা করল। ইহরিমা কেবল হাসছে। ঝিল অনেকটা মিশে গেছে ওনার সাথে। অভিনবর কেয়ার গুলোও বলে যাচ্ছে দ্বিধাহীন ভাবে। গল্প করতে করতে ঝিল প্রায় ঘুমিয়ে পড়ল। মাথাটা শাশুড়ির কোলে। অভিনব ফ্রেস হয়ে এসে এ দৃশ্য দেখতে পেল। একদিকে যেমন ভালো লাগল অন্য দিকে রাগ ও হলো। মেয়েটি এখানে কেন শুয়ে আছে?
“ঝিল,উঠে এসো। মম ঘুমাবে।”

মাথাটা তুলে তাকাল ঝিল। অভিনবর লম্বাটে দেহটাকে আবছা দেখল সে। ছেলেটার শরীরে পাতলা একটা গেঞ্জি। গোসল করেছে বিধায় চুল গুলো সিক্ত। হাতে তোয়ালে।

“পরে যাব।”

“না এখনি আসো। অনেক রাত হয়েছে।”

উঠতে গিয়েও পারল না। ঘুমের চোটে মেয়েটি দিক হারিয়ে ফেলছে। মস্তিষ্ক নিতে পারছে না বিষয়গুলো। অভিনব বড়ো বিষণ্ণ অনুভব করল।
“আজ আমার কাছেই থাক। তোমার পাপাও কাজের জন্য ব্যস্ত।”

মায়ের এমন প্রস্তাব মোটেও ভালো লাগে নি অভিনবর। সে এদিক থেকে কিছুটা হিংসেই করল বটে। ইনিয়ে বিনিয়ে কত ঘটনা বলল। অবশেষে ঝিলকে কোলে করেই নিতে হলো অভিনবর। নরম তুলতুলে বিছানা পেয়ে আরও বেশি ঘুম এসে পড়ল। দু হাত জড়ো করে মুখের কাছে এনে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। এত সুন্দর দেখতে লাগছে। এই মুহূর্তে ওকে জ্বালাতেও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু মন আর মস্তিষ্ক একে অপরের বিরোধীতায় মেতেছে। অভিনব হেসে ফেলল। মেয়েটি বুঝি ওকে বাঁচতে দিবে না। একটা মানুষকে কত ভাবে পাওয়ার ইচ্ছে হতে পারে!

শেষ রাতে ঝিলের ঘুম আলগা হলো। পেটের কাছটা ভারী মনে হতেই চোখ মেলল সে। অভিনবর শক্ত পোক্ত থাবাটা পেটের কাছে এলানো। মুখটাও ঘাড়ের নিকটে। তপ্ত নিশ্বাস গুলো কেমন শিহরণ জাগায়। ছেলেটার চুলে হাত বুলিয়ে দিল ঝিল। এতে আরাম বোধ করল অভিনব। আলগা ঘুমের মাঝেই বলল,
“আজ বড্ড যন্ত্রণা দিলে প্রজাপতি। তোমায় সব ভাবে পেয়েও আমার লোভ যে শেষ হয় না।”

চোখ দুটো ইষৎ বড়ো করে তাকাল ঝিল। ছেলেটা আধঘুমের মধ্যেও রোমান্সের মুডে থাকে! অভিনব মাথা তুলে আবছা দৃষ্টি মেলে ঝিলকে একবার দেখে নিল। তারপর গলার কাছে এসে মুখ ডুবিয়ে দিল। এত অনুভূতি কেন ভালোবাসায়?

ট্যুর শেষ হওয়ার প্রায় পনেরো দিন পেরিয়ে গেছে। এদিকে অভিনবর বাবা মা চাইছেন তার সন্তানরা নিজ বাড়িতে অবস্থান করুক। তাই ঝিলের জন্য আমেরিকার ভিসা বানানোর প্রসেস চলছে। অনেকদিন পর তরুণ কল করল। সংবাদটি এত বাজে যে অভিনবর শরীরে কম্পন ধরে গেল। ঝিলের বাবা জাফর মির্জা স্টোক করেছেন। এমতাবস্থায় কি করা উচিৎ বুঝতে পারছে না সে। ঝিলের ভাইয়ারা কিছু জানায় নি হয়ত চিন্তা করবে ভেবে। কিন্তু এটা তো ঠিক হচ্ছে না। বাবার অসুস্থতায় সন্তান যদি পাশে না থাকে তবে কতটা অমানবিক হয় বিষয়টা। বাবা মায়ের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করল সে। তারাও একই কথা বলল। ঝিলকে নিয়ে সেদিন রাতের ফ্লাইটেই রওনা হলো অভিনব। মেয়েটি অনেক প্রশ্ন করেও উত্তর পেল না। তবে এটা ভেবে খুশি হলো সে বাংলাদেশে যাচ্ছে।

নিজের বাড়ির কাছে এসে ঝিলের সবটা যেন বদলে গেল। শরীর কেঁপে উঠল। মাথার উপর টেউ উঠে গেল। আকাশ ডেকে উঠল। দুটি চোখ সুখে সিক্ত হয়ে উঠল। বাড়ির কর্মচারীরা উঠে পড়ে লাগলেন। শুরুতেই সজলের সাথে দেখা হলো। বোনকে দেখে রাগ করার কথা থাকলেও সে রাগ করল না। বরং আদর ভালোবাসায় জড়িয়ে নিল।
“কেমন আছিস বনু?”

“তোমাদের ছাড়া যেমন থাকা যায়।”

সমানতালে কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটি। একে একে মাহিন আর রাফাতের সাথেও দেখা হলো। তাদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। কেউ মেয়েটার প্রতি অভিযোগ রাখল না। বরং ভালোবাসায় জড়িয়ে নিল। এত ভালোবাসার কথা স্মরণ করে ঝিলের বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছিল পাপারা বুঝি রেগে থাকবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। পুরো বদল ঘটে গেল। এমনকি অভিনবর সমাদর করতেও দ্বিধা করছেন না কেউ। এই মুহূর্তে নিজের ভেতর থেকে অপরাধ বোধ কাজ করছে অভিনবর। এত গুলো ভালোবাসার মানুষের থেকে বঞ্চিত ছিল ঝিল। তাছাড়া তাদের চোখের মনিকে আড়াল করে রেখেছিল সে। সবটা কেমন হতে শুরু করল। জাফর মির্জা কিছুটা রোগা হয়ে গেছেন। চাপা ভেঙে গেছে অসুস্থতায়। ঝিল দরজার কাছ থেকেই মেঝেতে বসে পড়ল। ওর এত কষ্ট হচ্ছে। অথচ এই মানুষটিকে ছাড়ার সময় একবারও ভাবে নি। জাফর মির্জা মেয়ের প্রতি অভিমান ধরে রাখতে পারলেন না। হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন।
“পাপা আই এম স্যরি। ভেরি স্যরি পাপা।”

মেয়ের এই ভেজা চোখ মুখ ওনার হৃদয়ে শান্তি এনে দিল। তার মেয়েটা বদলে যায় নি। এখনো বাবার প্রতি বুকে ভালোবাসা ধরে রেখেছে।
“কান্না করো না মামুনি। তোমাকে এভাবে মানাচ্ছে না।”

“তোমার কি হয়ে গেল।”

“ঠিক আছি আমি। ছোট্ট একটা স্টোক। বয়স বেড়েছে কীনা।”

ভদ্রলোকের কণ্ঠ কাঁপছে। অভিনব দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। ভেতরে যেতে পারছে না সে। ভীষণ লজ্জা কাজ করছে। মনিরুল মির্জা এসে আশ্বস্ত করলেন। ভরসা পেয়ে ভেতরে এল ছেলেটা। বছর খানেক আগেও এই বাড়িতে এসে হুংকার তুলেছে অভিনব। আজ সেই জায়গায় দাঁড়িয়েই অপরাধবোধ কাজ করছে। বাবার থেকে মেয়েকে আলাদা করার অপরাধবোধ।

মানুষ যখন শারীরিক আর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায় তখন তার অতীতের ভুল গুলো খুব করে বুঝতে পারে। মেয়ের শূন্যতা আর ক্ষমতার লড়াইয়ের দ্বন্দ্বে আজ ভীষণ ক্লান্ত জাফর মির্জা। তাছাড়া যেখানে তার মেয়ে সুখী সেখানে দ্বিমত করাটাও ঠিক না। এইটুকু বোধ করতে পেরেছেন ভদ্রলোক। ভাইয়ের সাথে আলোচনা করেছেন বেশ কিছু দিন আগেই। ইকবাল মির্জা অভিনবর প্রতি ভীষণ তুষ্ট। ছেলেটার সাথে প্রথম দিনের কথা গুলো এখনো মনে আছে ওনার। অভিনবর সেই আচারণে তিনি খুব ভালো করেই বুঝেছিলেন ছেলেটার ক্ষমতা। তরুণের খোঁজ খবর নেওয়ার সময়ই অভিনবর কথা জানতে পারেন নি। তিনি কখনোই চান নি ঝিলকে পুনরায় বিয়ে দিতে। বিয়েটা যেভাবেই হয়ে থাকুক না কেন হয়েছে তো। অথচ তার ভাই এই বিষয়ে দ্বিমত করলেন। সেই সময়েই প্ল্যানটা করেছিলেন ভদ্রলোক। তবে ঠিকঠাক কাজ করেনি। কিন্তু যা হয়েছে এতে ঝিলের ভালো হয়েছে। সেদিনের আলোচনার শুরুতেই তিনি অভিনবর দিকে প্রশ্ন ছুড়েছিলেন। “যদি কখনো তোমার পরিবার আর ঝিল অপশন হয়ে যায় তখন কাকে বেছে নিবে তুমি?”

বুদ্ধিমান অভিনব হেসে জবাব দিয়েছিল।
“দু পথকেই জয় করব আমি।”

এই একটা উত্তরই ভদ্রলোকের মন মস্তিষ্কে ভরসা এনে দেয়। ওনার প্ল্যান অনুযায়ী চলছিল সব। কিন্তু নানান ঝামেলা হয়ে গেল মাঝ পথে। একটা সময় অভিনবর উপর ছেড়ে দিলেন সব। যার সুফল আজ চোখের সামনে। অতীত স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। হঠাৎ করেই অভিনবর কণ্ঠটা শুনতে পেলেন। “আপনাকে ধন্যবাদ। আমার সমস্ত কিছুতে সাহায্য করার জন্য। এবার আমার ওয়াদা পালনের সময় এসেছে। অতি শীঘ্রই আমার পরিবার আপনার বাড়িতে আসবে আপনাদের নিকট থেকে আমার স্ত্রীর হাত চাইতে।”

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে