সংসার পর্ব-০৬

0
707

#সংসার(০৬)
#তাহরীমা

“কিছুদিন পর ই তনুর শশুড়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়,তনুর মতো তিনি ও ধুলাবালি,ধোয়া একদমি সহ্য করতে পারতেন না,যেহেতু তনু সে রোগ সম্পর্ক এ বুঝে তাই সে শশুড়ের সব দেখাশুনা করতো আর সেবা করতো।শশুড়ের সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতো।আস্তে আস্তে শশুড় তনুকে পছন্দ করতে শুরু করে,আর বলে-“আমি দুহাত তোলে দোয়া করছি তুই বড় হ”

“তনুর বর দেশে ফেরার সাথে সাথে বাবার অসুখের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।কিন্তু তনুর শাশুড়ি তনুর শশুড়ের ঔষধ খাওয়াটা একদমি পছন্দ করতেন না।

সারাক্ষণ বলতেন-“টাকা খরচ হচ্ছে এই হচ্ছে সেই হচ্ছে।ঝগড়া লাগিয়ে দিতো।তনুর বর তাই চুপিচুপি বাবাকে ঔষধ কিনে দিতে,এতে বাবার খুশিতে চোখে পানি চলে আসতো।আর দুহাত তোলে দোআ করতো।

অন্যদুই ছেলেকে যদি বাবা কখনো ডাকেন তারা ফিরে ও তাকাতো না। এতে তিনি তনুকে বলতেন-“দেখেছ বউ আমার ছেলে আর সাথে কেমন ঘাড়বাকা করে হাটছে?

তনু এতে কিছুই বলতো না,কি বা বলবে?তার তো কিছু বলার অধিকার নেই শুধু কাজ করার অধিকার ই আছে।অনেক সময় প্রতিবাদ শব্দটা সব জায়গায় মানায় না।কিছু ক্ষেত্রে চুপ থেকে ও নিরব প্রতিবাদ করা যায়,

কথায় আছে-“চুপ থাকে যে মুক্তি পায় সে”।চুপ থেকে যদি ঝগড়া আর নিন্দা থেকে বাচা যায় তাও ভালো।আল্লাহ ধর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন যে।

“তনুর বর তনুর জন্য স্বর্নের চুড়ি নিয়ে আসে বিদেশ থেকে।শাশুড়ির তো ছিলই অনেক তারপর ও বউয়ের পরা টা পছন্দ নয়,কিভাবে এ চুড়ি বউ থেকে নিবে সে চিন্তায় খালি মাথায় ঘুরে।তনুর ছোটদেবর বিদেশ যাওয়ার জন্য মনস্থির করলে শাশুড়ি বলে চুড়ি গুলা দিতে যাতে সেগুলো বিক্রি করতে পারে।তানি চুড়ি গুলা দেয় সাথে তনুর বর ও ৬০০০০ টাকা দেয়,বলে রাখা ভালো তখনকার ১টাকা আজকের ১০ টাকার সমান।
তানিকে ও তার আব্বু একটা চেইন দিয়েছিল।ছোট তাই গলাতে পরতে পারেনি।

তনুর শাশুড়ি একটা বিয়েতে তানির চেইন পরে যায়,সেখানে গিয়ে চেইন টা হারিয়ে ফেলে,হয়ত হারায় নি মিথ্যা বলেছে কারণ তানি দিয়ে ফেলবে,হারায় ফেলেছে বললে তনু যে বোকা এসব খুঁজবে ই না।কিন্তু তনুর জা খুব চালাক সে কৌশলে শাশুড়ি থেকে তনুর চুড়ি গুলো নিয়ে দেবরের দিয়ে বিক্রি করিয়ে ফেলে এতে শাশুড়ি সে ছেলের উপর কথা বলেন না।ছেলেকে খুব ভয় পায় তো,মেজাজি ছেলে বলে কথা।সেবার ছোটদেবর তো বিদেশ যায় ও নাই, টাকা গুলা ও উধাও হয়ে গেছে,তনুর বর হিসাব চাইলে বলে-” তোর বউ খরচ করেছে আমরা কিছুই জানিনা”।

তনুর বর ভাল ই জানে তনু এমন মেয়ে ই নয় তাই সে তনুকে কিছুই বলেনা।

“সেবার তনুর খুব অসুখ হয়।এতই অসুখ যে কাজ ই করতে পারছিল না(কি অসুখ বলতে চাচ্ছিনা),শুয়া থেকে উঠতে ই পারেনা।কিন্তু শাশুড়ি ডাক্তার ও দেখাচ্ছে না।এদিকে তনুর বর তনুর বড় আপাকে বললে বড় আপা তাড়াতাড়ি এসে বোনকে নিয়ে যায় ডাক্তারের কাছে,ডাক্তার বলেছিল একমাস লাগবে সুস্থ হতে,তনুর বড়বোন একমাস সেবা করে তনুকে ভাল করে এবং নিজের কাছে রাখে।

এদিকে শাশুড়ি রেগে বোম,সংসার ছেড়ে এতদিন বোনের বাড়িতে কেন থাকবে?নিশ্চয় এসবি নাটক,নিশ্চয় আলাদা হওয়ার ফন্দী আঁটছে। এসব ভেবে শাশুড়ি মনস্থির করে যে,বউ বাড়ি আসলে এর বিহিত করতে ই হবে।

“তনু যখন শশুড় বাড়ি আসে,বোনের ছেলেকে দেখে শাশুড়ি আজেবাজে কথা বলতে লাগলো।শাশুড়ি বলে-

–হয়ত ভাগ্নে নয়তো দুলাভাই এর সাথে লাইন আছে নইলে এতদিন সংসার ছেড়ে কেমনে থাকে?

“তনুর চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরে পরে,তনুর শশুড় হাজার বলেও শাশুড়ির বাজে কথা থামাতে পারেনা।পরে তনু ও দু চারটা কথা বলে-

–এতদিন আমি অসুস্থ ছিলাম,একটা দিন তো দেখতে ই যান নি,দায়িত্ব সব বউয়ের আপনাদের নেই।আমি এতদিন সুখে ই ছিলাম।

–ও যা ভেবেছি,আলাদা হতে চায় বউ।

বাড়ির মহিলা রা ও এতে তাল মেলায়।

–ছিঃ শেষমেশ হাড়ি আলাদা করতে চায় এই বউ?আগেই বলেছিলাম মেয়েটা বিয়াদব সংসার ভাঙ্গতে চায়।

“তনু এসব সহ্য করতে না পেরে তার বর কে বলে-“হয় আমি আলাদা থাকবো এদের থেকে,নয় যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবো”।

তনুর বর এতদিনে বুঝতে পারে মায়ের ব্যাপার টা,কারণ সেদিন সবার ভাত খাওয়া শেষে যখন তনুর বর হাড়ি দেখতে গেছিলো দেখলো ভাত একমুঠ কি দুমুঠ আছে,সে চুপিসারে সরে গিয়ে দেখলো তনু উপোস থাকে।অতচ তনুকে জিজ্ঞেস করলে বলে-খেয়েছি তো।

আর তনুর জা যে কাজ করে না সেটা ও লক্ষ্য করেছে,সবমিলিয়ে তনুকে নিয়ে বের হয়ে যায়।আলাদা বাসা নেয়,কয়েকদিন ভাড়া বাসায় থেকে বাড়ির উঠানে ছোট ঘর বেধে তনুকে নিয়ে আসে।

তখন বাড়ির লোকে রা সবাই তনুকে যা ইচ্ছা তাই বলতো,শুরু হলো অন্য এক যুদ্ধ।দুইটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে কিভাবে কি করবে।এদিকে তনুর বর সংসার খরচ দেয় খুব অল্প,বেশিরভাগ টাকা মা কে ই দিতে হয়।

তনুকে শাশুড়ি আলাদা করিয়ে মনে মনে খুশি ই হয়,কারণ তনুর গুছিয়ে গড়ে তুলা রুমটা জা কে দেয়।আর তনুকে পাশে উঠানে একটা ছোট্ট ঘরে জায়গা দেয়।সংসারে যত টাকা লাগবে তার চেয়ে অল্প টাকায় সব কিনতে হিমশিম খেতে হয় তনুর,গাছের পাতা কুড়িয়ে ভাত রান্না করতো,অল্প তেল দিয়ে তরকারি রাঁধত,মাঝেমাঝে ছোট বাচ্চাগুলা কে মরিচ দিয়ে ভাত মেখে খাওয়াত।আর চোখ দিয়ে পানি পরতো।

গাছের আম পেঁপে যদি দাদু কে পাড়তে দেখত দৌড়ে মা কে এসে বলতো-“আম খাব পেঁপে খাব”

দাদু থেকে খুঁজতে গেলে দাদু দিত ই না।তখন তনু বাচ্চাদের সান্তনা দিত-“তোমাদের গুলা বড় হোক।

পুকুরে এত এত মাছ পেলেও শাশুড়ি একমুঠ মাছ দিত না।সব মাছ বিক্রি করতো নয়তো খেত।আহা কত যে দূঃখের ছিল দিনগুলো।যে এমন অবস্থায় থাকে সে বুঝে কত কষ্ট লুকিয়ে ছিল।তনু মুরগি পালা শুরু করলে অল্প কয়েকদিনে অনেক মুরগি হয়,কিন্তু শাশুড়ি শশুড়কে না দিয়ে একটা গোশত ও সে খায়নি।তরকারি একটু মজা হলে শশুড়কে দিয়ে আসত,এতে শাশুড়ি খুশি না হলেও শশুড় তৃপ্তি করেই সব খেত।শাশুড়ির তো মজা ই লাগত না তনুর রান্না।সব ভাল জা এটা।

“কিছুদিন পর তনুর শশুড় মারা যায়।এদিকে তেমন টাকা ও নাই তনুর হাতে,তনুর বর যখন মেজবান দেয়ার জন্য সে তনুর চুড়িগুলার খুজ করে,সবাই তখন একসাথে ঝগড়া শুরু করে,শাশুড়ি ই আমতাআমতা করে বানিয়ে কয়েকটা মিথ্যা বলে,শেষে আসল কথা বলে ফেলে যে- মেজবউ এটা বিক্রি করে ফেলেছে,কারণ তার বাপকে দিতে হয়েছে টাকা।

হায়রে বিচার কার স্বর্ন আর কে বিক্রি করে?সেইবার তনুর বর কোনোমতে ধার করে অনেক বড় মেজবান দেয়।তনুর শশুড় মারা যাওয়ার আগে তনুকে বলেছিল-আমার ছোট মেয়েটাকে দেখিস তোরা।তনুর বিয়ে যখন হয়েছিল ছোট ননদ তখন খুব ছোট ই ছিল।বড়ভাইয়ের হাতে সে বড় হয়েছিল।

“তনু যখন আলাদা হয় শাশুড়ি একটা হাড়ি পর্যন্ত দেয়নি।এমনকি তনুর বাপের বাড়ির এবং নিজে বানানো অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস সব শাশুড়ি রেখে দিয়েছিল।অতি ভাল জিনিস তো ননাসের প্রাপ্য।তনুর সংসারের প্রায় জিনিস বড়বোন থেকে নেয়।সেক্ষেত্রে বড়বোন অনেক সাহায্য করে তনুকে।

আর ঘরের বেড়া,ছাল সব বাবা পাঠায়।তনুর বড় আর ছোট ভাই তখন বিদেশে থাকতো,তারা ভাল আয় ও করতো।তাই বেশিরভাগ সাহায্য তারা ই করে।তনুকে শাশুড়ি কিছু না দিলেও তনুর থেকে কিছু নিতে দ্বিধাবোধ করতো না।

“রাত হলে দুইটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে থাকতে তনুর ভীষণ ভয় করতো,তখন ডাকাত ও ছিল অনেক,বাড়ির মানুষ রা চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলতো -আজ তানির মা কে খাবে ডাকাত রা।

এই বলে অট্টহাসি দিত।তনু সারারাত আল্লাহ কে ডেকে পার করতো।শাশুড়ি থেকে আলাদা হওয়া মানে তখন বিরাট লজ্জার বিষয় ছিল।তনু লজ্জায় বাইরে যেতো না।এত অভাবের মাঝেও বাড়ির মানুষেরা তনুর থেকে আলাদা চাঁদা নিতে ভুলতো না।রাস্তার চাঁদা,মসজিদের চাঁদা।শাশুড়ি আরো বলতো-” ছেলেকে যখন কেড়ে নিছে আমার থেকে,সব রাজত্ব তো এখন ওর ই।

“তনুর খালাশাশুড়ি একবার বেড়াতে আসলে তনুর কাছে ই থাকতো কারণ তনু মেহমান বেশি পছন্দ করতো,তাদের যত্নের ত্রুটি রাখতো না,সে যেমন ই হোক ঘরে যা আছে তা যত্ন সহকারে দিতো।

খালাশাশুড়ি তনুকে কে একদিন বলল-“তোর অনেক শত্রুরে,ছেলেমেয়েদের সবসময় দেখেশুনে রাখিস।আর রাতে ঘর চেক করে দরজা বন্ধ করিস।বলা তো যায় না আজকাল পরিস্থিতি খুব খারাপ।মানুষ স্বার্থের জন্য সব করতে পারে।

তারপর থেকে তনু ঘর চেক করে ই ঘুমাতে যেত।কিন্তু একা ভয়ে আর ঘুম হতো না।মাথায় একটা চিন্তা থাকত কিভাবে বাচ্চাগুলাকে মানুষ করবে।পড়াবে।তানিকে স্কুল থেকে মাদ্রাসায় দেয়ার চিন্তা করে তনু।বাচ্চারা সুন্দর সুন্দর গজল করে এসব তার খুব ভাল লাগে,তানি মাদরাসা পড়ে সুন্দর গজল শিখে তাকে শুনাবে,কি আনন্দ..!!

তনুর মেয়েটা ছোট বয়সে দূরের মাদরাসায় ভর্তি হয়,কারণ তনুর যখন বাচ্চা হচ্ছিল না তখন মানত করেছিল-আমার সন্তানকে মাদরাসা পড়াবো।

তো যেহেতু মানত করেছিল তাই মাদরাসা ই ভর্তি করিয়ে দিলো,ছোট তানি একা ই অনেক দূর হেটে মাদরাসায় যেত।ঘরে চাচা,দাদু,ফুফু থাকতে কেউ সাহায্য করত না।

তানির মেজচাচা তার পাশ দিয়ে রিক্সা নিয়ে চলে যেত তানিকে তুলতো না।তানি চাচাকে দেখে খুশি হলেও চাচা চিনতো ই না তানিকে,একা একা তানি একটা কুকুর দেখলে দাঁড়িয়ে পরতো ভয়ে,তারপর বড় কাউকে দেখলে তার পিছন পিছন হেটে চলে যেত,আর কাছে কোনো মাদ্রাসা ও ছিল না,সংসারের কাজ ছেড়ে তনু ও মেয়ের সাথে যেতে পারত না।

যতদিন মেয়ে বড় হয়নি ততদিন তানিকে বিদায় দেয়ার পর তনুর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরতে থাকতো….

চলবে……

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে