সংসার পর্ব-০৫

0
674

#সংসার(০৫)
#তাহরীমা

“চারদিকে কোরআন শরীফ পড়ার আওয়াজ ভেসে উঠছে,১১ ভাইবোন যেভাবে পারছে কোরআন খতম করার চেষ্টা করছে।তনুর চোখ অনবরত ভেসে যাচ্ছে।তার এরকম কঠিন সত্য মানতে ইচ্ছে করছে না।

মা যাওয়ার আগে তনুকে বলে গেছে-“তোর কখনো মন খারাপ হলে বোনেদের কাছে যাস,আমার দুইটা ছেলে মাত্র তাদের কাছে আসিস না।”

“তনু এ কথার মানে বুঝলো না।হয়ত তনু এভাবে যখন তখন টাকার জন্য আসতো যে মায়ের খারাপ লাগতো,তাই তনু যাতে অবহেলিত না হয় ভাইদের কাছে তাই আসতে নিষেধ করেছে হয়ত।

মায়ের মৃত্যুর কথা শুনে শাশুড়ি আসলো।সেখানে ও তাকে আপ্যায়ন করতে হলো তনুর বোনদের,তনু চুপ করে এক জায়গায় বসে রইল।
মাকে দাফন করা হয়ে গেলে তনু শশুড় বাড়ি চলে আসলো।

“কিছুদিন পর তনু অনূভব করলো তার মাঝে আরো একটা প্রাণ বড় হচ্ছে।তনুর বর বিদেশে চলে গেলো।

সংসারের সব কাজ সামলানো,বাচ্চা সামলানো সব মিলিয়ে অনেক কষ্ট হচ্ছিল।তনুর শাশুড়ি প্রায় সময় বাইরে থাকে,বাইরের মহিলাদের সাথে রাত দিন আড্ডা দেয়,সাথে তনুর নামে নিন্দা তো রয়েছে,সবাই তাই মনে করে তনু কোনো কাজ করেনা,আর শশুড় শাশুড়ি কে পছন্দ ও করেনা।কিন্তু আসল কাহিনী কেউ জানে ই না আদৌ,কত কষ্ট সহ্য করতে হয় একটা মেয়েকে,তনুর ছোট ননদের মায়া হয়।সে ভাবি কে একটু সাহায্য করতে গেলেই শাশুড়ি ডাক দেয়-“এই তুই কেন এত কাজ করছিস?বউ কি বসে বসে খাবে নাকি?

তাই তনুর কাজে কেউ সাহায্য করেনা।শাশুড়ি ভাত খাওয়ার সময় যদি ঘরে আসে সেখানে ও নিন্দার শেষ থাকে না।শুনিয়ে শুনিয়ে বলে-
–ঘর টা ঝাড়ু দেয়া হয়নি,এটা এরকম ঠিক হয়নি,ওটা ওরকম ঠিক হয়নি।

তনুর বর ছাড়া আর বাকি দেবর, শশুড় পানির গ্লাস টাও নিজে নিয়ে পানি খেত না বাকি কাজ না হয় বাদ ই দেয়া হলো।তারপর ও সবার অভিযোগ এর শেষ নেই।তনু বিরক্ত হয়ে দুচারটা কথা বলতো কিন্তু যেদিন বলতো সেদিন সারাদিন আর রক্ষা নেই।শাশুড়ি সারাদিন মানুষ ডেকে বদনাম করতো।এক্ষেত্রে নিরবে সহ্য করা ছাড়া উপায় ছিল না।

তনু বাপের বাড়িতে গেলে সব কাজ শাশুড়ি তনুর জন্য রেখে দিতো।তনু আবার ফিরে এসে মাজাঘষা সব সামলাতো।মা মারা যাবার পর তনুর বর বিদেশে চলে যায়,তখন তনু আবার যায় বাপের বাড়িতে সবাইকে দেখতে।

তানির বয়সী একটা মামাতো ভাই আছে,তনুর বড় ভাইয়ের দ্বিতীয় ছেলে,নাম রায়হান।মোটামুটি তানির সাথে সে বেশ জমে,তানি যখন একটু আধটু কথা বলা শিখেছে তখন বলতো-
–নায়ান এ নায়ান।

“তানির ডাকে রায়হান ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো,নানুবাড়িতে দুজনে একসাথে খেলত।রায়হান আবার গান পছন্দ করতো,তখন রেডিও তে যদি গান বাজতো সে একটু একটু লাফাতো,বিশেষ করে “ও প্রিয়া ও প্রিয়া তুমি কোথায়?”এ গানটা।তানি ও চেয়ে থাকতো।

তনু একদিন থেকে আবার শশুড় বাড়ি চলে আসতো।

কয়েকদিন পর রায়হান রা ও তার নানুবাড়িতে চলে যাবে।তনুর বড় ভাবি ও তনুদের সবাইকে খুব ভালবাসতো।ছোট ভাইয়ের বউ ও ভালো।তারপর ও মা নেই যে কিছুই তার ভাল লাগছে না,তাই চলে আসে তাড়াতাড়ি।

“রাতে তনু একটা স্বপ্ন দেখে,একটা সুন্দর বাগানে তনু বসে বসে কচি ফল গুলা ছিঁড়ে নিচ্ছে।এ স্বপ্নের অর্থ সে বুঝলো না।তার কিছুদিন পর রায়হান মারা গেলো,ওর নাকি জ্বর আসছিলো।প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এটা শুনে তনু হেটে বাপের বাড়ি চলে যায়।তখন মানুষ হেটে এখানে সেখানে যেত। অতি বড়লোকেরা রিক্সায় চড়তো।যেখানে শাশুড়ি খাবার খাওয়া পছন্দ করেন না সেখানে রিক্সা চড়ার টাকা দিবেন না।তাই হেটে ই যায়।সেইবার আরেকবার মনে হয়েছিল তনুর কলিজা কেউ ছিঁড়ে নিয়েছে,কারণ রায়হান কে খুব ভালবাসত তনু,আর বাচ্চা মারা যাওয়ার কষ্ট যেকোন মায়ের আঘাত লাগা বাধ্য।তনু কান্নায় ভেঙ্গে পরে।সবাই তনুকে বকে বিশেষ করে বড়বোন রা।এ অবস্থায় রেস্ট না নিয়ে হেটে এখানে কেন এসেছে তাই।

“পর পর দুইটা শোকে তনু নিরব হয়ে যায়।শাশুড়ি যা বলে চুপচাপ কাজ করে।কিছুদিন পর তনুর ছেলে হয় একটা।ছেলে হওয়াতে শশুড় দেবর সবাই খুশি হয়,শুধু শাশুড়ি ব্যতীত।তার আস্তে আস্তে কর্তৃত্ব কমে যাবে বলে।তনুর ছেলে ও একদম চাদের মতো সুন্দর হয়।কেউ তনুর বর কে দেখে বলবে না এরা ওর সন্তান।এতটায় সুন্দর হয়েছিল।

“সংসারে সব ঝামেলা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে তনুর মেজো দেবর জেদ করে বসে সে বিয়ে করবে।অথচ তনুর ই ভাল একটা রুম দিতে পারেনি শাশুড়ি,আর দেবর ও তেমন কাজ করে না।তনুর বরকে ই দেবরের বউকে খাওয়াতে হবে ল।এদিকে দেবর বলছে রিক্সা চালিয়ে হলেও সে তার বউকে খাওয়াবে অথচ এতদিন একটা কাজ ও করত না হিংসায়।বড়ভাই বিয়ে করে বাচ্চা হয়ে গেছে অথচ সে কেন একা থাকবে।অতিরিক্ত রাগি হওয়ায় শাশুড়ি ও এ ছেলেকে ভয় পায়,শুধু তনুর বরের ক্ষেত্রে যত আবদার আর শাসন বাকি দুই ছেলে তাকে পাত্তা ও দেয় না।তবুও এদের বেশি ভালবাসে।মেয়ে দেখা হলো,তানি সহ গেলো মেয়ে দেখতে,তানিকে জিজ্ঞেস করলো দাদু-” বউ পছন্দ হয়েছে কিনা?

তানি দেখলো মেয়েটা সুন্দরী,তার পছন্দ হয়েছে।বিয়ে ফাইনাল।তানির তখন ৪ বছর বয়স।

“অবশেষে রান্নাঘরের একপাশে রুম করা হয় দেবরের জন্য,রান্নাঘর টা বড় ছিল।

তারপর বিয়ে হয়ে যায়।তানি ৪ বছর বয়সে ই ক্লাস ওয়ান পড়া শুরু করে।হ্যা অতি ছোট ই পড়ালেখা করছে,বাড়ির সামনে স্কুল হওয়ায় দাদু গিয়ে দিয়ে আসতো,কিন্তু তার কান্নাকাটির শেষ নেই অবশেষে কয়েকদিন দাদু আর ফুফু ওর সাথে ক্লাস করেছিল।আস্তে আস্তে সে যখন স্কুলের বন্ধু পায় আর ভয় করে না কান্না ও করতো না।নিজে নিজে স্কুলে যেতো।
————-
“নতুন মেজো আম্মু তানিকে খুব ভালবাসতো।তানির ভাই ও আস্তে আস্তে বড় হয়,কিন্তু তানি যেমন দুষ্টুমি করতো না তার ভাই ডাবল দুষ্টুমি করতো,এতে দাদুর পছন্দ না নাতি কে।তানির ভাই তানির সব খেলনা নিয়ে ভেঙ্গে ফেলতো তানি কিছুই বলত না।তখন তাওহিদ(তানির ভাই) একটু একটু হাটতে পারে।

তানি যদি মাকে প্রশ্ন করতো সেখানে ও সবার আপত্তি ছিল,তানিদের বাড়ির সামনে এতবড় উঠান ছিল সেখানে তানির দাদু বিভিন্ন শাকসবজি রোপন করতো,তানি মায়ের থেকে এসব জানতে চাইতো-

–আম্মু এটা কি?এটা কি চিচিঙ্গা?

–হ্যা।

“চিচিঙ্গা শব্দটা বইয়ের ভাষায় হলেও গ্রামের মানুষ এটাকে অন্যনামে চিনে।তাই পাশের ঘরের মহিলা ব্যঙ্গ করে বলতো-

–এহহ চিচিঙ্গা,ইংরেজি শেখাচ্ছে মেয়েকে,আমরা জানিনা তো?

মহিলাটির ভুল ধারণা ভাঙ্গার জন্য তনু কথা বলে,নয়তো এদের থেকে সবসময় এড়িয়ে চলতো,তনু বলে-

–চাচিমা এটা ইংরেজি ভাষা না।

“তখনি মহিলাটি বলে-জানি জানি মুখে মুখে তর্ক করাটায় তোমার স্বভাব,প্রতিদিন শাশুড়ির সাথে কেমন বিহেভ কর শুনিনা?বেয়াদব মেয়ে।

তনুর কান্না চলে আসে এদের কথায়।মেয়েকে নিয়ে ঘরের ভিতরে চলে যায়।এখন তো নতুন জা আছে,নতুন জা কে তনু নিজের ছোটবোনের মতো ভালবাসে,কিন্তু জা তনুকে পাত্তা দেয় না।কারণ তনুর নামে যত নিন্দা সব শাশুড়ি আর ননাসের জামাই থেকে শুনেছে।এমনকি শাশুড়ি বলেছে তনু তেমন কাজ ই করে না সংসারে।তানির নতুন জা ভেবে নিয়েছে সে বড়বউ হয়ে কাজ না করে থাকতে পারলে আমি নতুনবউ হয়ে কেন কাজ করবো?তাই সে রুমে সারাক্ষণ বসে থাকে তনুকে এড়িয়ে চলে।তনু সারাদিন কাজ করে,আর নতুন জা খালি খাবার খাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়,তবে হ্যা শাশুড়ির মাথা আছড়াতে ভুলে না।শাশুড়ি তো খুব খুশি। তনুকে শুনিয়ে বলে-

–মনের মতো বউ পেয়েছি একটা,আমার কত সেবা করে।বড়টার মতো বেয়াদব না।

এতে নতুন জা ও খুশি হয়।তাকে দেখে মনে হয় সে ভাজা মাছ উলটে খেতে জানেনা।কিন্তু ননাসের জামাইকে নিয়ে নিন্দা করতে দুবার ভাবেনা।নতুন বউ হওয়া সত্ত্বেও সবার প্রিয় বউ হয়ে গেলো কারণ সে মিষ্টি কথা বলে শাশুড়ির মাথা আছড়ায়,দুলাভাই কে ও ভাই ভাই করে।

ছোটকাল থেকে তনু মনে যা মুখে ও তা,অতিরিক্ত আধিখ্যেতা পছন্দ নই কিন্তু কাজের ত্রুটি নাই,আর এটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো।সবাই তনুকে অপছন্দ করতে শুরু করলো,এখন কারোর তনুকে ভাল ই লাগেনা।আর তনুর বাচ্চাদের তো আরো ভাল লাগেনা।কতটুকু অবহেলিত হলে এরকম নিষ্পাপ বাচ্চাদের মানুষ ঘৃণা করে,তাদের যে অপরাধ নেই।

বিয়ের পর আসার পর থেকে শাশুড়ি তনুকে পছন্দ না করার একটায় কারণ তনু শাশুড়ির বিপরীত,তনু নামাজি কালামি,পরিষ্কার মেয়ে,অযতা আড্ডা দেয়া,ঘরের বাইরে থাকা একদমি পছন্দ না।কিন্তু শাশুড়ি এসব ই করে,কেন তনু তার মতো নয় সেজন্য তিনি তনুকে এত অবহেলা করেন,কিন্তু নতুন বউ একদম তার মতো যেমন গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে তেমনি আড্ডা তে পারদর্শী,আর কাজের ফাঁকি তো আছেই।

“তনু আনমনে ভাবে আর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝড়তে থাকে,এর শেষ কোথায়?তনুর চাচা মারা গিয়েছে,নইলে চাচা কে বলতো,জমিজমা আর টাকা দেখে যে তুমি মেয়ে বিয়ে দিলে,ভাল শাড়ি আর খাবার তো দূর ভাল ব্যবহার টা ও তো পাওয়া যায় না।এত কিছু করেও মানুষ গুলোকে সন্তুষ্ট করা যায় না?

তনুর বাবার কথা মনে পরে।বাবা বলতো-দশজন মূর্খ মানুষের সাথে বেহেশতে থাকার চেয়ে,দশজন শিক্ষিত মানুষের সাথে দোজগে থাকা উত্তম।

তনুর শাশুড়ির জমি টাকার অভাব নেই,কিন্তু মানসিকতা আর বিবেকের বড় অভাব,কারণ এটা ভাবে না যে আমার ও তো মেয়ে আছে,আমি যে তাদের কষ্ট করে বড় করেছি,বউ আনছি যে ওটাও অন্যের মেয়ে তাদের ও কষ্ট হয়েছে।বউ রা কি মানুষ না?

কথায় আছে,”তরবারির আঘাতের প্রতিষেধক আছে কিন্তু মুখের আঘাতের কোনো প্রতিষেধক নেই”।

“তনুর ছেলে যত বড় হচ্ছে তত দুষ্টুমি বাড়ছে,তেমন কিছু না,সে নতুন বউয়ের কাছে গিয়ে কোলে উঠতে চায়,ধাক্কাধাক্কি করে,নতুন বউ কিছু না বল্লেও দাদুর এসব পছন্দ না,সে চিৎকার করে বলে-

–দেখো তানির মা তাওহিদ নতুন বউ কে কেমন জ্বালাচ্ছে,অসভ্য ছেলে।

“তনু সব রাগ ছেলের উপর ঝাড়ে,ছেলে কে ধরে এসে ইচ্ছেমত মারে,ছোট বাচ্চা বুঝেনা, কি দোষ করে মা তাকে মারছে মাথায় আসেনা।সে মা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে,তনুর চোখ দিয়ে বৃষ্টি ঝরে পরে,শশুড় এ নাতিকে খুব ভালবাসে,তিনি মারাটা একদম পছন্দ করেন না,তাই তনুর উপর রাগ করলেও, শাশুড়ি খুব খুশি ই হয়……..

চলবে…….

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ,বানান ভুল হলে কষ্ট করে পড়ে নিবেন,রিচেইক করার সময় ছিল না।ধন্যবাদ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে