সংসার পর্ব-০৪

0
656

#সংসার(০৪)
#তাহরীমা

“তনুর বর দুইবার দেশে এসে চলে গেছে,বাচ্চা না হওয়ার কারণে শাশুড়ির কথার কোনো শেষ নেই।

“কিন্তু তনুর বর তনুকে কখনো খারাপ কথা বলে নি,এমনকি যতেষ্ট সম্মান দিয়ে কথা বলতো, তনুকে ধর্য্য ধরতে বলতো,পাশাপাশি তনুর মা বাবাকে ও সম্মান করতো,সাহায্য করতে চাইতো তাদের বিপদে,কিন্তু মায়ের কারণে একটু আধটু যা দেখতেন সবটা মেনে নিতেন,মা যাতে কষ্ট না পায়।মা কে সে খুব ভালবাসতো তাই প্রতিবাদ করতো না কোনো বিষয়ে।কারণ তনুর দিকে কথা বললে কান্নাকাটি করে পাড়ার লোক জড়ো করতে ও ভাববেনা।

তনুর বর প্রবাসী দেশে আসলে দুই কি তিনমাস থাকেন,মায়ের এতসব কিছু তার অগোচরে ই হতো,আর তনু ও কিছুই বলতো না।কারণ তনু বললে ও তার বিশ্বাস হবেনা,সে যে সামনাসামনি কখনো এতসব দেখেনি।তার মা ভাল সে শুধু সেটায় জানে।তাই শুধু শুধু ঝগড়া বাধিয়ে লাভ কি?পরে তনুকে ই দোষারোপ করবে সবাই। তনুর মা ও বরাবর ই মেয়ে কে বলতেন ধর্য্য ধরতে আল্লাহ চাইলেই সব সম্ভব।বাচ্চা একদিন হবে ই আল্লাহ চাইলে।

“তনুর বিয়ের কিছুদিন পর তার বড় ভাই বিয়ে করেন,এবং ছোট ভাইয়ের জন্য ও বউ দেখে যাতে বিয়ে করিয়ে দিতে পারে,কারণ তনুর মায়ের ইচ্ছে মরার আগে বউদের দেখে যেতে চান,মানুষের মৃত্যুর যে ঠিক নেই।

বড়ভাইয়ের এখন দুইটা বাচ্চা ও হয়ে গেছে।তনুর এতে অনেক খুশি ও লাগে।বরাবর ই বাচ্চা ভালবাসত তনু।শুধু শাশুড়ির ব্যবহারে মন ভেঙ্গে যেতো।

তনু প্রতি নামাজ এ কান্নাকাটি করতেন যেন সুস্থ আর জ্ঞান সম্পন্ন তাকে যেন বাচ্চা দেন।বিয়ের পাচ বছর পর শেষের বার তনুর বর যাওয়ার কিছুদিন পর তনুর মাথা ঘুরায় বমি আসে,কিছুই খেতে পারেনা সব গন্ধ লাগে।বিয়ের প্রায় পাচ বছর পর এ অনুভূতি হচ্ছে।তাই সে ডাক্তারের কাছে গেলো মা কে নিয়ে।তারপর জানতে পারে সে মা হতে চলেছে।দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি খুশি হয়ত সেদিন ই হয়েছিল।দিন যত যায় পেট ভারি হয়ে আসে,কিন্তু কাজের কোনো কমতি নেই।নেই কারো সাহায্য নেই কোনো সেবা,নেই পুষ্টিকর খাবার।তার উপর নলকূপ চেপে পানি ব্যবহার করা কত যে কষ্টের ছিল।নলকূপ এ তেমন পানি ও পরতো না,অল্প অল্প পানি দিয়ে বাসনকোসন ধোয়া,কাপড় ধোয়া,গোসল করা সব করতে হতো।

অতি কষ্টের জন্য একদিন তনু শশুড় বাড়ির সামনের পুকুরে কাপড় ধোতে যায়,পুকুর দশজনের হলেও ঘাট টা একজনের।তনু কে নামতে দেখে যাদের ঘাট সে মহিলা চিৎকার করে বলে উঠলো –

–এই মেয়ে তোমার শাশুড়ি কে বলিও বউ যেমন এনেছে তেমন পুকুরে ঘাট দিতে একটা,যাতে অন্যের কিছু ব্যবহার করতে না হয়।

এমন নিচু মনের মানুষ দেখে তনু অবাক হয়,এরপর আর কখনো পুকুরে যায়নি,কষ্ট হলেও নলকূপ এ সব কিছু ধোয়েছে।তনুদের বাড়িতে দুইটা পুকুর একটা সবাই ব্যবহার করে আরেকটা তনুরা।কই তার বাবা মা তো এমন ব্যবহার করেনা তাদের সাথে?

“এভাবে দশমাস কেটে যায়।বাড়িতে ধাত্রী আনা হয়।সন্ধ্যার দিকে তনুর একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়।তনুর আরেক ছোটবোনের ও একই দিনে সকালে কন্যাসন্তান হয়েছিল,তনুর মা সেখানে গিয়ে জানতে পারে তনুর ও বাচ্চা হয়েছে তাই তিনি ছুটে আসেন মেয়েকে দেখতে।

তনুকে বাচ্চা কোলে দেয়া হয় এ যেন অন্যরকম সুখ।তনুর মেয়েটা যেমন সুন্দরী তেমন আদুরে চেহারার হয়েছে,সবাই মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ বলে উঠলো।তবে মেয়ে হওয়াতে পরিবারের অনেক কেই তেমন খুশি হন নি যেমন তনুর শশুর,দেবর,বিশেষ করে জামাই ও একটু মন খারাপ করেছিলো প্রথমে।

“তবে তনুর দেবর যেটা মেজাজি ছিল বাচ্চা হওয়ার পর আর তনুর সাথে মেজাজ দেখাতো না।বাচ্চা হওয়ার পর কাজ আরো বেড়ে গেলো কাথা ধোয়া, বাচ্চাকে খাওয়ানো।

প্রথমে তনুর বাচ্চা কে কোলে দিলো তনুর মা কে।কিন্তু অপরিষ্কার কাথাগুলা কেউ ধুয়ে দিচ্ছে না।শাশুড়ি তনু কে বলল-

–তোমার মা কে ধোতে বলো?

“তনুর এতে খুব অপমান লাগলো। কেন আমার মা ধোবে?তাই সে কষ্ট করে গিয়ে কাথা ধোতে বসে পরলো।এদিকে এরকম বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথে রেস্ট নিতে হয় তনুকে এমন অবস্থায় দেখে তনুর এক ফুফুশ্বশুরি ননদ বলে উঠলো-

–একি ভাইয়ের বউ তুমি মরতে চাও,ছিঃ ছিঃ আমরা থাকতে তুমি এখন এ অবস্থায় এসব করছো?আমি ধোয়ে দিচ্ছি।

“তারপর সে জোর করে তনুকে তুলে দিলো।তারপর তনুকে বাচ্চাকে গোসল করিয়ে বাচ্চাকে দুধ পান করতে দিলো।

তনুর শাশুড়ি বলতে লাগলো-“বাচ্চা হলেও অনেক কিছু নানাবাড়ি থেকে দিতে হয়।কম জিনিস দিলে চলবে না”

তনুর বাবা যথাসাধ্য দিয়েছেন।তাও শাশুড়ি সন্তুষ্ট হননি।

“তনুর মেয়ে টা যত বড় হচ্ছে জান্টুসে পরিণত হচ্ছে,নাম রাখে তানি(ছন্দ্মনাম)।তানি মা ছাড়া কিছুই বুঝেনা।বাবা কে তো কখনো দেখে নি।সারাক্ষণ কোলে থাকতে চায়,কারোর কোলে যায় ও না।

তানি খাবার খাওয়ার সময় কেউ টু শব্দ ও করতে পারেনা।তার উপর আওয়াজ শুনলে বাইরে চলে যেতে যায়।যত বড় হয় তত মোটাসোটা আর আদুরে বাচ্চা হয়ে উঠে,কখনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে কোনো মানুষ নেই যে তাকে আদর করে নাই।কিন্তু সে মা ছাড়া কারো কাছে যাই ই না।চাচারা তাকে আদর দিলে সেগুলো ছোট্ট হাত দিয়ে মুছে ফেলতো।কাজের সময় ও মেয়েকে কোলে নিয়ে সব কাজ শেষ করতে হতো।

পরিবারের সবার ঘুম আর খাবার ঠিক রাখতে হতো একটু উল্টাপাল্টা হলেই শাশুড়ির বকা শুরু হয়ে যেত।

“তানি আস্তে আস্তে বড় হয়ে ভাত খাওয়া শিখে।কিন্তু ভাত খাওয়ার সময় বিভিন্ন কবিতা,পশু পাখি দেখিয়ে ভাত খাওয়াতে হতো।এদিকে রাতে ও জ্বালাতো আবার দিনের বেলাও সেইম।কিন্তু কখনো তনু মেয়েকে মারতো না।কত সাধনা কষ্টের পর মেয়েকে পেয়েছে সে।তানিকে দাদা তেমন পছন্দ করতো না।তানি জানতো ই না বাবা নামক একটা শব্দ আছে সেটা।তানি কারোর ব্যবহৃত জিনিস অন্যকাউকে ধরতে দিতো না।একজনের জুতা অন্যজনে পরলে টেনে নিয়ে ফেলতো।একটু ও ময়লা ধরতো না।যখনি তানি হাটতে শিখেছে বাইরে যাওয়ার আগে আম্মু কে বলে যেত-

–আম্মু আমি আসি?

আবার কিছুক্ষণ পর পর মা কে দেখতে আসতো।প্রতিদিন একটা কথা ই বলতো-

–আম্মু আমি আসছি।

“তনু মেয়ের কান্ডে হেসে বলতো-ভালো করেছো।

“তানি যখন একবছর পার হয়ে যায় তখনি তার বাবা দেশে আসে।ইয়ারফোর্টে তানিও দাদুর সাথে যায়।তানির বাবা বের হয়ে প্রথমে মেয়েকে কোলে নিতে চায়,কিন্তু যখনি তানি দেখে অন্য একটা মানুষ তাকে কোলে নিতে চাচ্ছে সে কান্না করে মারতে থাকে হাত দিয়ে,শেষে আর কোলে নেয়না।সারা রাস্তা সে অন্যদিকে ফিরে ছিলো,অথচ মেয়েরা নাকি বাবার আদুরী বেশি হয়,তানি ই একমাত্র যে এমন টা করলো।

বাড়ি এসে সে মায়ের কোলে উঠে পরলো।তানির বাবা যখন রুমে ডুকলো তার কি কান্না,কেন তাদের মা মেয়ের মাঝে আবার অন্যকেউ ডুকবে?ছোট মাথায় এটা বুঝা আসছেনা।তখন তো ফটো ছিল না অথবা মোবাইল ছিল না যে বাবা কে দেখবে হঠাৎ দেখাতে যেকোনো বাচ্চা এমন বিহেভ করবে স্বাভাবিক।রাতে তানি এক হাতে কোল বালিশ এক হাতে কাথা নিয়ে দাদুর পাশে শুয়ে পরলো-

–আমি তোমার সাথে থাকবো দাদু।

“তনু মেয়ের কান্ডে হেসে দিলো।তনুর বাবা ও হাসলো,তানির জন্য অনেক পোশাক চকলেট নিয়ে আসলো।তানি ছোট থেকে ই কোনো জিনিসে আগ্রহ দেখাতো না,শুধু মা কে পেলেই হলো,জ্বালাবে,হাসাবে,কাঁদাবে,সব মা কে ঘিরে।

“কিছুদিন পর তনুর মায়ের ক্যান্সার ধরা পরে।তাই ছুটে যায় মায়ের কাছে,তনুর বারবার মনে হচ্ছে,না তার মা তাকে ছেড়েই যেতে পারেনা।দুনিয়াতে একমাত্র মা ই সন্তানকে সাপোর্ট করে,তানিকে নানা নানু পছন্দ আদর করতো।অনেক আদর লাগতো নাকি তাকে।

তনু যখন মাকে সেবা করতো তানির বাবা তানিকে এটা ওটা দিয়ে কোলে রাখতো।তনুর শাশুড়ি কিছু বলবে বলে দিনে এসে দেখে আবার শশুড় বাড়িতে চলে যেতো।

“এভাবে অনেকদিন অসুখের সাথে লড়াই করে তনুর মা,তখন তনুর ভাইদের ও তেমন আয় ছিল না যে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবে।কিন্তু সেবার কোনো ত্রুটি রাখেনি ভাই বোন মিলে।এ মানুষ টা ও সংসারের জন্য কম কষ্ট করেনি,১১ টা ছেলেমেয়ে মানুষ করা তো চারটেখানি কথা না?তারপর ও তনুর মন মানে না।এত তাড়াতাড়ি মা তাকে ছেড়ে যাবে ই না।

“যেদিন তনুর মা মারা যাবে সেদিন তানি খালি কান্না করতেছে সকাল থেকে,তনু বিরক্ত হয়ে প্রথম মেয়েকে থাপ্পড় বসায় গালে।তানির বাবা বাইরে উঠানে বসে ছিল,সে দৌড়ে এসে তাড়াতাড়ি মেয়েকে কোলে নিয়ে দোকানে হাটা দেয় চকলেট কিনে দেয়ার জন্য।তানি ও বাবার কোলে চলে যায়,হয়ত ছোট্ট তানি বুঝেছে মায়ের মন ভাল নেই।

“মেয়েকে তার বাবার কাছে দিয়ে আসতেই তনু গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়,কারণ তনুর মা ই বলেছিল মেয়েদের চিৎকার করে কাঁদলে গুনাহ হয়।তাই বোনেরা মুখ চেপে কাঁদছে।

তনু বুঝে গেল তার ধারণা মিথ্যা,সে ও তাদের দলে নাম লিখালো আজ থেকে,সে ও মা হারা মেয়ে হয়ে গেলো।আজ থেকে তার মন বুঝার মত কেউ রইলো না।চোখ দিয়ে অনবরত বৃষ্টি পরতে লাগলো আর শেষবারের মতো মায়ের চাদের মতো মুখটা দেখতে ছুটে গেলো ঘরে…….

চলবে……….

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন,ধন্যবাদ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে