সংসার পর্ব-০৭

0
838

#সংসার(০৭)
#তাহরীমা

“কয়েকদিনের মধ্যে তানি পড়ালেখায় অনেক ভালো করে,সাথে বান্ধবী ও করে নিয়েছে,তানির বান্ধবি তিন্নি অনেক ভালো,আসার সময় একসাথে আসে,আর যাওয়ার সময় একসাথে যায়।যদিও পাশাপাশি বাড়ি না তাও দাঁড়ায় তানির জন্য।তানি ছোট বেলা থেকে গুলুমুলু চেহারার মেয়ে,মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় কেউ না কেউ আম্মু ডেকে ডেকে আদর করতো,এতে তানির ভয় ও লাগতো।অচেনা মানুষ আম্মু কেন ডাকবে?

একদিন তানি মাদ্রাসা যাওয়ার সময় একটা বড় ছেলে তানিকে দেখে বলল-

“হেয় কিউট পিচ্চি,বড় হলে তোমাকেই বিয়ে করবো”

বিয়ে শব্দটা তানি বুঝলো না তাই সে চুপচাপ মাদ্রাসায় যেত।যতদিন ছেলেটা তানির সামনে যেত-“এই বউ”বউ বউ করতো।বউ কি তানি বুঝলো না।তাই মাদ্রাসা থেকে ফিরে মা কে জিজ্ঞেস করলো বউ কি?বিয়ে কি?

“তনু অবাক হয়ে গেলো এত ছোট মেয়ে বিয়ে,বউ কেন বলছে?তানির থেকে সবটা জেনে মেয়েকে বলল-অচেনা কারো সাথে কথা বলবে না,তাদের দিকে তাকাবেনা,তাদের কিছু দিলে নিবে ও না।কারণ তোমার আপনজন ব্যতীত অন্য কারো জিনিসে তোমার হক নেই,বড় হলে হক অথবা অধিকার সম্পর্কে বুঝবে,কিন্তু এখন আম্মুর কথা মনে রাখবে ঠিক আছে?

“তানি মাথা নাড়ালো,তানির আব্বু ছেলেটির খুজ নিয়ে তাকে কি বলেছিল তানির জানা নেই তবে সেদিনের পর থেকে ছেলেটাকে আর দেখেনি কোথাও।
————-

“মেজো বউয়ের বিয়ের সাথে সাথে দুইটা মেয়ে বাচ্চা হয়ে যায়,শাশুড়ি এদের কে খুব ভালবাসে,এদের গায়ে একটা ঠুকা ও লাগতে দেয় না।

তাওহীদ চায় সবসময় দাদুদের ঘরে থাকতে,তার মতে ওদের যেমন দাদু তার ও দাদু তাকে ওতো ওদের মতো আদর দেয়া উচিৎ,তাকে কেন তাড়িয়ে দেয় এটা মাথায় আসেনা।সে মায়ের বকা খেয়েও দাদুর ঘরে যায়।

কাজিনদের তাওহীদ খুব আদর করে,তানি ও আদর করে,কাজিন রা নানুবাড়ি গেলে অপেক্ষা করতো কবে ফিরবে।কিন্তু দাদু একদম পছন্দ করেনা তানি তাওহিদ ঘরে আসুক সেটা।

মাঝেমাঝে তাওহীদ কাজিনদের আদর করতে করতে করতে বিরক্ত বানিয়ে ফেলে,তখন তারা তাওহিদকে মারে,আর তারা কাদে ও।দাদু মনে করতো তাওহিদ মেরেছে সেজন্য কাঁদছে,তারপর তনুকে বিচার দিতো-“তোর ছেলে মেজবউ কে আগে মারতো,এখন তার বাচ্চাগুলা কে মারছে।”

সেদিন তনু ছেলেকে খুব মারে।তারপর ও দাদু বলে-“এগুলা কোনো মাইর হলো,জোরে জোরে মার”

ছেলেকে মেরে নিজেও কাদে।একবার কাজিন(মেয়ে) একটা খেলার ছলে তাওহিদ কে পেটে লাতি মারে,সে পেটব্যথা নিয়ে একমাস খাবার খেতে পারেনি।তাও তনু বিচার পায়নি,আরো শুনতে হয়েছে দুষ্টু ছেলের এমন হওয়া উচিৎ।

“তাওহীদ একবার দুষ্টুমি করে মেজাম্মু কে মেরেছে,ছোট হাত দিয়ে মেরেছে কত ই বা ব্যথা পাবে?কিন্তু মেজাম্মু তাকে ইটের কঙ্কর নিয়ে মেরে কপাল ফাটিয়ে দেয়।তবে তনুর দেবর খুব প্রতিবাদ করে সেদিন,বউ কে আচ্ছামত বকা দেয়,কারণ দেবর রা তাওহিদ কে ভালবাসত।
———–

আস্তে আস্তে তনুর ননদ বড় হয়ে যায়,কিন্তু শাশুড়ি তার বিয়ের কথা ভাবেনা,তনুর বর বিয়ের কথা তুললেই।আরো বলে-

–কত মেয়ে বুড়ি বুড়ি হয়ে যাচ্ছে দেখিস না?আমার কচিমেয়ের দিকে নজর পরলো?

তনুর বর বুঝায়-মেয়ে বড় হলে বিয়ে দেয়ায় ভালো,তাছাড়া সে পড়ালেখা করেনা।বেকার বসে থাকলে পরে পাত্র ই খুঁজে পাবেনা।তখন তনুর ননদের বয়স ছিল ১৯/২০ বছর।

শাশুড়ি,ননাসের জামাই,দেবর সবাই তখন তনুর বরকে বলে-তোর বোন তুই বিয়ে দে গা,তোর হাতে ই তো তুলে দিয়েছে বাবা,আমাদেরকে এসবে টানিস না।

“তনু বর বিদেশ থেকে তো আর পাত্র দেখাশুনা করতে পারেনা।তাই তনু ই তার দুলাভাইকে নিয়ে বিভিন্ন পাত্র দেখতে শুরু করে,তাদের দেখা অথবা যত খরচ সব তনুর বর ই করত,শাশুড়ি অথবা অন্যরা এসবে মাথা ও দিত না।

তনুর মেজো দেবর শাশুড়ি কে বলতো-মা তোমার অনেক সম্পত্তি কিছু বিক্রি করে দাও না?অনেক টাকা পাবে হাতে।শাশুড়ি ও লোভ সামলাতে না পেরে একে একে তিনবার জমি বিক্রি করে।বিক্রির টাকা কিছু দেবরে নেয়,কিছু ননাসের জামাই নেয়,কিছু নিজে খরচ করে।অথচ মেয়ের বিয়ের টাকা এখন তার কাছে নেই।যে যার মতো স্বার্থপরের মতো চলে।তনুর ননদ তনুর কাছে এসে কাদে-“ভাবি তুমি যেমনে পারো এ নরক থেকে আমায় বিদায় দাও।

“তনু সকালে পাত্র দেখতে যেত,দুপুরে এসে ভাত রেধে বাচ্চাদের খাওয়াত,এভাবে অনেকদিন পর একটা ভাল পাত্রের খুজ পায়,অবশেষে তনুর বর দেশে আসলে বিয়ে ঠিক হয়।পাত্র তনুর ব্যবহার খুব পছন্দ করে।সব দায়িত্ব এখন তনুর বরের কাধে এসে পরেছে,বিয়ের বাজার থেকে শুরু করে মানুষ কে দাওয়াত দেয়া,এদিক সেদিক টুকটাক কাজ এমনকি বিয়ের সব আয়োজন বর ই করে,আর বাড়ির কাজ তনু একাই করে,পাশাপাশি বাড়ির অনেক মহিলা ই সাহায্য করেছে।তনুর কে পছন্দ না করলে তনুর ননদকে তো পছন্দ করে তাই কাজ করে দিছিলো।

বিয়ের এক সপ্তাহ ধরে এত ব্যস্ততায় তনু আর তার বর ঘুমাতে ই পারেনি ঠিক।তার মাঝে তানির কর্ণছেদন ও করে।তানি ও বউয়ের মতো সাজবে ফুফুর সাথে।

।তনুর বাপের বাড়ির লোকেরা অবাক হয় তনু আর তার বরকে দেখে,এত ধর্য্য এদের?তনুর বড়বোন সবসময় তনুকে সাপোর্ট দেয়।এত কষ্ট পেয়েও যে শাশুড়ি কে সম্মান করে,শশুরের কথা মনে রাখে।

“গায়ে হলুদের দিন তানি খুব সুন্দর করে বউয়ের মতো সাজে,তানির জন্য ও কেক আনে তার আব্বু।সেদিন অনেক খুশির দিন ছিল তার কাছে।

“অবশেষে বাবার দেয়া দায়িত্ব তনু আর তার বর পালন করলো,ছোট ননদ কে ছোট থেকে বড় করে নিজ হাতে বিয়ে দিলো।বোন কে বিয়ে দিয়ে তনুর বর অনেক কাদলো।যেন মেয়ে বিয়ে দিচ্ছে,কারণ এতই ভালবাসত বোনকে যে, কাজে যাওয়ার আগে বোনের কপালে চুমু দিয়েই যেত।মোটকথা মা বাবা ভাইবোন সবাইকে ভালবাসত।কেউ তার ভালবাসার দাম দেয় নি।তারপর ও তনু আর তার বর তাদের জন্য সারাজিবন করে গেছে।

“আস্তে আস্তে তাওহীদ আর তানি বড় হয়,দাদু যে তাদের পছন্দ করেনা সেটা ও বুঝতে শিখেছে।গাছের কোনো ফল ও যে তাদের না সেটাও বুঝতে শিখেছে তাই তনুর কথামত তাদের ভাগের সব বড় হওয়ার দিন গুনে।

“তনুর দেবরের আবার টাকার প্রয়োজন হলে তনুর শাশুড়ি জমি বিক্রি করবে ভাবে,জমি নেবে বাড়ির ই এক পরিবার।কিন্তু এভাবে বাড়ির মানুষের কাছে জমি বিক্রি করতে চায়না তনুর শাশুড়ি।

তনুর দেবর এসে তনুকে বলে-“তোমার ভাইগুলা তো এখন যতেষ্ট বড়লোক,তাদের বলো জায়গাগুলা কিনে নিয়ে আমাদের টাকা দিতে”?

“তনু সেটা ভাইদের শেয়ার করে,ভাইরা সেটা শুনে বলে-“তোর শশুড় বাড়ির জমি দিয়ে আমরা কি করবো,বরং আমরা তোকে ধার দিচ্ছি জমিটা তোর জামাইয়ের নামে করে ফেল।

“তনু সেটা শাশুড়ি কে জানালে সে রাজি হয়,কিন্তু যেদিন রেজিট্রি হয় সেদিন তনু কিংবা তার বর কেউ ই উপস্থিত ছিল না,ছিল তনুর শাশুড়ি আর দেবর,তারা ই সাইন করে জায়গাটা তনুর বরের নামে লিখে দেয়।

কিন্তু আল্লাহর চাওয়া অন্যকিছু ছিল,শুধু দেয়ার কথা ছিল জমি,কিন্তু কাগজে পুকুর,বিল,যতকিছু আছে সব উল্লেখ হয়ে গেছে তনুর বরের নামে।এমনকি যে রেজিট্রি করেছে সে ই বলছে-“সাইন করার আগে তিনবার তনুর দেবর আর শাশুড়ি কে পড়ে শুনিয়েছে।”

“কি থেকে কি হয়েগেলো তনু বুঝলো ই না।তবে এটা বুঝেছে তারা টাকা পেয়েছে হয়েছে,এত জমির প্রতি খেয়াল ছিল না হয়ত,ভাগ্যিস জায়গা তারা কিনেছে,বাড়ির মানুষ এ কিনলে তো টাকার লোভে বাড়ি টাও দিয়ে দিতো।

“তারপর সংসারে কম খরচ করে টাকা জমিয়ে,আর ভাইয়েদের সাহায্য তনু পাকা বাড়ি বানায়।বাড়ির সামনে বিভিন্ন ফলের গাছ রোপন করে।

আম,লেবু,জাম্বুরা,পেয়ারা,আমড়া,পেপে সব গাছ ই রোপন করে।তনুর শাশুড়ি পেপে গাছ রোপন করলে ও তেমন ধরতো না।কিন্তু প্রথম তনুর পেপে গাছে এত বড় ফল আসে যে মানুষ দেখে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতো।আর অনেক মিষ্টি ও ছিলো ফলগুলো তে।প্রথম গাছের পেপে ফল টা অনেক বড় ছিল,তাই সেটা মাদ্রাসায় দান করে।পাশাপাশি তানি ও তাওহীদ ও খায়,এত এত পেঁপে ফল খেতে খেতে আর খেতে ই ইচ্ছে করেনা ফল।আম,আর পেয়ারা গাছ ও বড় হচ্ছে,পেয়ারা গাছে অনেক ফুল এসেছে।

অথচ এমন এক সময় ছিল তাওহিদ দাদুর পিছে পিছে কান্না করতো একটা আম এর জন্য।

———–

তনুর শাশুড়ি দেবরের কথামত জমি বিক্রি করতে করতে জমি তার কাছে নেই বললেই চলে,তাই এখন স্বার্থ নেই দেবর তাকে একদমি সহ্য করেনা।আর মেজো বউ তো ঝগড়া করে কথায় কথায় তাই এখন শাশুড়ি নিজেই চুপ থাকে,বুড়ি বয়সে ঝগড়া কি ভাল লাগে?তাই চুপ থেকে থেকে কোনোমতে মানিয়ে নেয়।
———-

ছোট ছেলে বিদেশ যায়,আবার এসে বিয়ে করে,কিন্তু বউ ভাড়াবাসায় থাকে,সে ও তেমন পাত্তা দেয়না।তনু মাঝেমাঝে খাওয়ায় শাশুড়ি কে,কিন্তু শাশুড়ি কষ্ট পেলেও তার কাছে আনবে না।কারণ একসাথে না থাকার কথা শাশুড়ি ই একদিন নিজেই তুলেছিলেন,আজ কিভাবে খারাপ বউওয়ের সাথে থাকবে?

মেজবউ কে নিয়ে তার নামে নিন্দা করতো, আর আজ মেজবউ ই ঝগড়া লাগলে শাশুড়ির কুকীর্তি পাস করতে দুইবার ভাবেনা।আর ছোট বউ বলে-” বড় বউরা করেনি কাজ আমি কেন শাশুড়ি ননদ কে দেখবো?

প্রতিবন্ধী ননদকে নিয়ে শাশুড়ি অহংকার করে তনুকে চিল্লিয়ে বলতো -“এটা আমার বুড়া বয়সের সঙ্গি”হ্যা আজ সঙ্গি হয়েছে।মেয়েটা একটা কাজ ও করেনা,বুড়ি বয়সে কাজ করে খাওয়াতে হয়।

কিন্তু তনু বরকে বলেছে-“উনি মা,মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত,তোমার দায়িত্ব অধিকার তুমি পালন করে যাও।শাস্তি দেয়ার মালিক আল্লাহ……তাই তনুর বর মাসের টাকা মাসে দিয়ে দেয়,সংসারে যতই টানাপোড়ন থাকুক মা কে কখনো অবহেলা করেনি,ঔষধ আর খাওয়ার খরচ দিয়ে দেয়……আর তনুর শাশুড়ি মেজবউয়ের মুখে কোনোমতে নাম করে করে ভাল থাকে,আর মেজবউয়ের সাথে ই থাকে……….
——-

“তানিদের এখন নিজেদের পুকুরেই বড় মাছ পায়,তাই দাদুর সুযোগ থাকেনা সব নিয়ে নেয়ার।তনুর ননাসের ছেলেরা তনুর বরের টাকায় পড়ালেখা করে বড় হয়ে গেছে,তাই ননাস আর তেমন কিছু বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে যায় না।

তানি আশেপাশে বাচ্চা দেখে মা কে বলে তাদের জন্য একটা বাবু আনতে হবে।তনু বলে-“বাবুর সব কিন্তু করতে হবে,পায়খানা ও পরিষ্কার করতে হবে কিন্তু?তানি মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।

তাওহিদ আর তানির চিল্লাচিল্লি তে তনু আরো একটা বাচ্চা নেয়।আরো একটা মেয়ে হয়।মেয়েটা হওয়ার পর তনুর বরের ও প্রমোশন হয়,বিদেশে ভাল জব করে।

তনুর এখন রাতে আর ভয় করেনা।সেই ছোট্ট তনু যে সংসার মানে কি ই বুঝতো না বিয়ের আগে,সে আজ কত বড় হয়ে গেছে,একসময় তার কিছুই ছিল না।আজ সব আছে….তনু ই বলে ধর্য্যের ফল অনেক মিষ্টি…

কিন্তু আজ সব থেকে ও সেই যৌবন বয়সে যে ইচ্ছে গুলা ছিল তা সব মরে গেছে,ইচ্ছে ছিল সোনালি ঘড়ি পরার,আজ টাকা আছে কিনার কিন্তু ইচ্ছে নেই,ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা করার আজ সে বয়স নেই,সুন্দর কবিতা লিখতে ইচ্ছে হতো,আজ ছন্দ মনে পরে না।ইচ্ছে ছিল বরকে নিয়ে নতুন শাড়ি পরে বেড়াতে যাওয়ার,তনুর বর তনুর জন্য শাড়ি কিনে আনলে হয় শাশুড়ি নয় ননাস ঝগড়া করে নিয়ে পরে ফেলতো।

আজ শাড়ি কিনার সামর্থ্য থাকলে ও শাড়ি সামলানোর শক্তি নেই।সব থেকে ও আজ মন মরে গেছে😊,মাঝেমাঝে সংসারের ঝামেলা গুলোই খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায়,সব ছেড়ে দিতে মন চায়,বয়স বাড়ছে,মনের রোগ বাড়ছে,সাথে দেহের রোগ..!!

চলবে…..

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে