শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় পর্ব-১৫

0
715

#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পনেরো

“খু-নের অপবাদ মাথায় নিয়ে এত বছর বেঁচে থাকা যায়? ”

প্রশ্নটা করেই বসলো তাজওয়ার। তারিন জলে টইটম্বুর চোখে তাঁকালো। উওর দিলো না। চেহারায় স্পষ্ট ভেসে উঠলো কঠিন অসহায়ত্ব। মাথায় তীব্র ব্যাথা হচ্ছে। তাজওয়ারের প্রশ্নে রাইমা বেগম অবাক হলো। জহির সাহেব বসে পড়লো আচমকা সোফার উপর। তাজওয়ার বলতে শুরু করলো,,
“আমি তোমাকে ঠকাই’নি। তোমাকে ছেড়ে যাই’নি। তোমার বাবা’কেও খু-ন করিনি। এইসব কিছুর পেছনে রয়েছে অন্যএকজন। যে আমাদের সবার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে দারুন ভাবে খেলা’টা খেলেছে এত বছর ধরে।”

বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পিন পতন নিরবতা চললো কিছুক্ষন। নিরবতা ভেঙে জহির সাহেব কেশে উঠলেন। আধ ভাঙা স্বরে বলতে শুরু করলেন,,

” তামজিদ কে হারিয়ে রাইমা একদম ভেঙে পড়েছিলো। দূর্বল শরীর নিয়ে বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলো। তাহমিদ রাহা’র সব ফ্রেন্ডদের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছিলো যে “রাহা সত্যি আমাদের তামজিদ’কে ভালোবাসতো। আর তামজিদ ওর সাথে প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহার, অপমান করতো”। এইসব শোনার পর তাহমিদ ভেবেই নিয়েছিলো রায়হানের বলা কথা গুলোই হয়তো সত্যি। রাহা বোধহয় তামজিদের জন্য’ই সুই’সাইড করেছে। নিজের ভেতর অপরাধ বোধ জেগে উঠেছিলো ওর। কিন্তু, ও তোকে অবিশ্বাস করেনি। ও বিশ্বাস করেছিলো তুই তামজিদ’কে খু-ন করতে পারিস নি। ভেবে নিয়েছিলো রাহার বিষয়’টা জানতে পেরে হয়তো তোদের মাঝে তর্কাতর্কি হয়েছিলো। আর এক্সিডেন্টলি হয়তো কোনো কারনে তামজিদ নিচে পড়ে যায়। কিন্তু ওই যে নিজের ভাইয়ের জন্য তুই তোর বোন’কে হারিয়েছিস সেই বিষয়’টা ও মানতে পারেনি। একদিকে ভাইকে হারানো শোক। অন্যদিকে তুই। সব মিলিয়ে আমার ছেলেটা পা’গলের মতো হয়ে গিয়েছিলো। দাড়াতে পারেনি তোর সামনে গিয়ে। তোকে স্বান্তনা দিতে ও পারেনি। তোকে এরেস্ট করা হয়েছে শুনে তাহমিদেই আমাকে থানায় পাঠিয়েছিলো। তোকে ফিরিয়ে আনার জন্য। সেদিন থেকে দুইদিন রুম বন্দি ছিলো আমার ছেলেটা। এই দুইদিনে রাইমার শরীর টাও মারা’ত্নক খারাপ হয়ে গেলো। হসপিটালের ভর্তি করাতে হলো ইমার্রজেন্সী। যখন আমরা দুজন রাইমা’কে নিয়ে হসপিটালে ব্যস্ত। ঠিক তখনি তোর বাবা হসপিটালে গিয়ে আমাদের হু’মকি দিয়ে আসে। ওর কথাগুলো অনেকটা এমন ছিলো,,” তোর ছোট ছেলের জন্য আমি আমার প্রানের টুকরা মেয়েকে হারিয়েছি। এখন তোর বড় ছেলের জন্য আমি আমার বড় মেয়েকে হারাতে পারব না। আমার টাকা পয়সা হাতানোর ধান্দায় তোরা বাপ-ছেলে মিলে আমার মেয়ে দুটোর জীবন নষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস। এক মেয়েকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েও শান্তি হয়নি। আরেক মেয়ের দিকে নজর দিচ্ছিস। নিজের ছেলেকে সামলে রাখিস নয়তো এই ছেলেকেও হারাতে হবে। ” ওর কথা শুনে সেদিন আমি অবাক হয়ে চেয়ে ছিলাম। আমার প্রানের প্রিয় বন্ধু আমাকে এইসব বলেছিলো ভাবতে পারিনি। অবাক হয়ে চেয়ে ছিলাম শুধু। তাহমিদ ও সেদিন কথা বলতে পারেনি তোর বাবার মুখের উপর। তোর বাবা হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই। তাহমিদ ও বেরিয়ে গেলো। তার ঘন্টা খানেক পর আমার কাছে ফোন আসলো তাহমিদ এক্সিডন্ট করেছে। দিশেহারা হয়ে পড়লাম মূহূতে’ই।”

কথাগুলো বলে থামলো জহির সাহেব। পুরো রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা। তারিন চোখ দুটো খোলার শক্তি পাচ্ছে না। তাও নিজেকে সামলে রাখছে। অস্পষ্ট স্বরে বললো,,
“থামলে কেনো বড়বাবা। বলো? শেষ করো।”
তারিনের কথার প্রতিউওরে জহির সাহেব উঠে দাড়ালেন। তাজওয়ারের সামনে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে সাহস দিয়ে। ঘুরে দাড়ালো পেছন ফিরে। পূর্নরায় বলতে শুরু করলো,,
“আমি কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একদিকে হসপিটালে ভর্তি রাইমা অন্যদিকে তাহমিদ। ছুটে গিয়েছিলাম ঘটনাস্থলে। চোখের সামনে দ্বিতীয় বারের মতো ছেলের রক্তাক্ত দেহটা দেখেছিলাম। একটা বাবা হয়ে আমার সেদিন কি অবস্থা হয়েছিলো ভাবতে পারছিস? নিজেকে বুঝালাম ভেঙে পড়লে হবে না। সামলাতে হবে। শক্ত হতে হবে। রাস্তার মানুষের সাহায্যে হসপিটালে নিয়ে আসলাম ও’কে। ডাক্তার’রা প্রানপন চেষ্টা করেও আমার ছেলেটাকে সুস্থ করতে পারলো না। কোমায় চলে গিয়েছিলো ও। সেদিন আর সামলাতে পারিনি নিজেকে। ভেঙে গিয়েছিলাম পুরো। ভেতর থেকে চূর্ন-বিচূর্ন হয়ে গিয়েছিলাম। রায়হানের কাছ থেকে খবর পেলাম তাহমিদের এক্সিডেন্ট’টা তোর বাবা করিয়েছে। ভেঙে যাওয়া শরীর’টা আরো ভেঙে গেলো। রাইমা খানিক সুস্থ হতে’ই ও ওদের দুজন’কে নিয়ে চলে গেলাম দিল্লি। নিজের বাড়িটুকু ও সেদিন বিক্রি করে দিতে হয়েছে আমাকে। এত সব কিছুর মধ্যে তোর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। কি করে করব? তোর বাবা যে আমার সেই উপায় রাখেনি। দিল্লি’র হসপিটালে তাহমিদ ছয় মাস কোমায় ছিলো। যেদিন ওর জ্ঞান ফিরলো ডাক্তার জানালো ওর সমস্ত স্মৃতি শক্তি মুছে গেছে। নিজের নাম’টা অব্দি মনে ছিলো না ওর। আমি রাইমা প্রায় পা’গলের মতো করেও তাহমিদ’কে বিশ্বাস করাতে পারিনি আমরা ওর বাবা-মা। প্রথম প্রথম ও আমাদের দেখতেই পারতো না। পরে আস্তে আস্তে আমাদের মা-বাবা ডাকতে শুরু করলেও আমাদের পুরানো তাহমিদ’কে আমরা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললাম। সেই থেকে আজ অব্দি তাহমিদ আমাদের মন থেকে বাবা-মা ডাকতে পারেনি। দূরত্ব বজায় রেখেছে সব সময়। মনে হয়েছিলো আমি আমার দুই ছেলে’কেই হারিয়ে ফেলেছি। তারপর প্রায় এক বছরের মাথায় বাংলাদেশে ফিরে আসি। তাহমিদের কিছু মনে নেই। রাইমা তোদের নাম অব্দি শুনতে পারেনি। বাংলাদেশে ফিরে ছেলেটার ইচ্ছে হলো অভিনয় করবে। না করিনি। বাধা দেইনি। সবি তো হারিয়েছে ছেলেটা। নিজের এই ইচ্ছাটাকে আকড়ে না ধরে বেঁচে থাকবে। বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়’নি ও’কে। অভিনয়ে চান্স পাওয়ার পর ওর প্রথম ছবিটাই হিট হয়। আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হলো না ও’কে। আজ আমার তাহমিদ সুপারস্টার। ওরা তোদের ভুলে গেলেও আমি পারিনি। তোর জন্য মন’টা যে খুব কাঁদতো রে মা। তোকে তো নিজের মেয়ের চোখেই দেখেছিলাম। ওদের লুঁকিয়ে। সব পুরনো ক্ষত বুকে চা’পা দিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম তোদের কিন্তু পাই’নি। জানতেও পারিনি তোরা কোথায় আছিস? কেমন আছিস? আদৌ বেঁচে আছিস কিনা? মনে মনে বিশ্বাস ছিলো তুই আসবি। সবার ভুল ভেঙে দিবি। আমার তাহমিদকে নতুন জীবন দিবি। আর আজ এত বছর তুই ফিরে এসে আমার শেষ সম্বলটা’কেই কেড়ে নিতে চাইলি রে মা? কেনো?”

জহির সাহেবের বুকটা কেঁপে উঠলো। উনার চোখে পানি। রাইমা বেগম শব্দহীন কান্নায় ব্যস্ত। তাজওয়ার নিস্তব্দ। শক্তিহীন শরীরটাকে সামলালো টেবিল আকড়ে ধরে। চোখ থেমে টপ টপ করে পানি পড়ছে। তারিন কিছু বললো না। কেমন যেনো চিৎকার করে আতৎনাদ করে উঠলো। ওর আতৎনাদে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলো। কান্নায় ভেঙে পড়লো। থামলো না। চেঁচিয়ে কান্না করতে করতে বলতে লাগলো,,

“তোমরা সবাই স্বার্থপর। কেউ আমার কথা ভাবো’নি। কেউনা। প্রথমে বোন কে হারালাম। তারপর ভালোবাসার মানুষগুলোকে হারালাম। তারপর শেষ সম্বল আমার বাবা’কে হারালাম। সব হারিয়ে যখন আমি নিঃশ্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার এই জীবন্ত লা’শের ন্যায় শরীরের দিকে শ’কুনের নজর পড়েছিলো। খু-বলে খেতে চেয়েছিলো আমার শরীরটাকে। খুব চেনা মানুষ’টার বিশ্রি নখরের আঁচড়ে রক্তাক্ত হয়েছিলো আমার শরীর। যেই মানুষ’টা আমার শরীরের স্বাদ নেওয়ার জন্য মগ্ন থাকতো। কাছে পাওয়ার লোভে আমাকে প্রত্যেক’টা মুহূত আঘাত করতো। দিন শেষে সেই জঘ’ন্য, নর-পিশা’চ মানুষটার সাথে নতুন ঘর বাধলো আমার মা। আগে আমাকে যতটুকু সহ্য করতে পারতো নতুন ঘর বাঁধার পর তার থেকেও বেশি অবহেলা করতে লাগলো আমাকে।”

কান্নার বেগ বেড়ে গেলো তারিনের। তাও থামলো না। কান্নার বেগ কমানোর বৃথা চেষ্টা করলো। পারলো না থামাতে। আবারো বলে উঠলো,,

” জানো বড়-বাবা? আমি ক্ষুধার্ত কাকের মতো পড়েছিলাম।কেউ খাবার দেয়নি। কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ বুকে টেনে নেয়নি। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি। দিয়েছে শুধু যন্ত্রনা। দুই হাতে খুবলে খেতে চেয়েছিলো। সেদিন আমার বদ্ধ ঘরের চিৎকার আমার নিজের মাও শুনেনি। নিজের মৃ’ত্যু কামনা করতাম সারাক্ষন। দুইবার সুই-সাইড করতেও বেঁচে গিয়েছিলাম। বেঁচে গিয়ে শান্তি পাইনি। সইতে হয়েছিলো বেল্টের আঘাত। বেল্টের আঘাতে আমার রক্তাক্ত শরীর’টাকে যেদিন বাবার বয়সী একজন খুবলে খেলো। তীব্র যন্ত্রনায় যখন আমি জ্ঞান হারালাম। আমি তো সেদিনেই ম’রে গিয়েছিলাম বড়-বাবা। এখন আমার শুধু দেহটাই আছে। আর কিছু নেই। আমি জীবন্ত লা’শ বড়-বাবা। জীবন্ত লা’শ।”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে