শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় পর্ব-১৬

0
731

#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ষোল

“কারোর বিশ্রি ছোঁয়ায় আমার শরীর’টা যখন পঁচে যাচ্ছিলো। তখন আমার জীবনে শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে আসে ওমর। ওই অন্ধকার নরকের থেকে আমাকে মুক্ত করে ছিলো। নরম, ভোলাভালা, দূর্বল তারিনকে পাথর বানালো। যে আগে প্রতিবাদ করতে ভয় পেতো সে আজ অনায়াসে গু-লি চালাতে এক সেকেন্ড ও ভাবেনা। ভয় জিনিসটা তার নেই বললেই চলে। নিজেকে অপবিত্র মনে হতো আগে। এখন আর মনে হয় না। আমি আমার মাকে কোনোদিন তার দ্বিতীয় স্বামীর এই রুপ দেখাতে পারিনি। কি করে পারব? বাবা চলে যাওয়ার পর ওই মানুষটাকে মাকে এক প্রকার বশ করে নিয়েছিলো। মায়ের দুঃখের সময় ঢাল হয়ে দাড়িয়েছিলো। ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। ওই মানুষটার হাত ধরে মা একটু শান্তি খুঁজে পেয়েছিলো। আমি কি করে মায়ের সেই শান্তি কেড়ে নিতাম? শান্তিতে থাকতে দিয়েছিলাম তাদের। কিন্তু, মাকে কোনোদিন ঘৃনা করতে পারিনি। আমি জানি মা যদি এইসব শুনতো কোনোদিন ওই মানুষটার সাথে সংসার করত না। রায়হানকে বাঁচিয়ে রাখার একটাই কারন ছিলো। মা নিজেই বলেছিলো” মুখের কথায় বিশ্বাস না করে সত্যিটা নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়”। তামজিদের খু-নী আমি নই। ওই রায়হান এটা তোমাদের কাছে প্রমান করার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছি ও’কে। নয়তো কবেই ওই শরীরটা টুকরো টুকরো করে কে-টে কাক-চিলদের খাবার বানিয়ে দিতাম।”

এই কথাগুলোর মাঝে তীব্র রাগ ভেসে উঠলো তারিনের মুখ পানে। উপস্থিত তিনটা মানুষ শোকে স্তব্ধ। রাইমা বেগম ছুটে এলেন তারিনের কাছে। দুই হাতে আগলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তারিন এখন কাঁদছে না। চোখ থেকে পানি পড়ছে না। আজ আবার রাইমা বেগমের মাঝে আগের সেই মায়ের মতো স্নেহ, আদর খুঁজে পেলো। এটা কি শুধু ভালোবাসা নাকি সিমপ্যাথি? উওর খুঁজে পেলো না তারিন। রাইমা বেগম তারিন কে ছেড়ে ওর দুই গালে হাত রেখে প্রশ্ন করলো,,”
“কি করে এতসব কিছু সহ্য করেছিলি রে মা? ওইটুকু বয়সে এতগুলো আঘাত সহ্য করতে পেরেছিলি?”

তারিন স্নান হাসলো। হাসিটা নির্জীব। জীবন নেই এই হাসির। উওর দিলো,,
“আগুনে পুড়ে মানুষ কয়লা হয় তাইনা বড় মা। আমি হয়েছি পাথর। এমন এক পাথর যাকে এখন হাজার আঘাতেও ভেঙে ফেলা যাবে না। যাকে অল্প কথায় দূর্বল করা যাবে না। যে এখন অকারনে চোখের জল বিসর্জন দেয় না। যে এখন কারোর মধুর কথায় ভুলে যায় না। ”

বলে থামলো। তারপর হুট করেই বললো,,
“তোমরা কি ভেবেছো আমি ধর্ষিতা?”

বলে উওরের আশায় সবার দিকে তাঁকালো। তাজওয়ারের দৃষ্টি মেঝের টাইলসের দিকে। তারিনের প্রশ্ন শুনেও তাঁকালো না। জহির সাহেব ও উওর দিলো না। রাইমা বেগম অবাক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে ওর দিকে। সবার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে তারিন উচ্চস্বরে হাসলো। কয়েক সেকেন্ড পর উওর দিলো,,,
“হ্যাঁ আমি ধর্ষিতা।? আমি ধর্ষিতা। আমি..”

আর বলতে পারলো না। তার আগে দরজা থেকে উচ্চ আওয়াজে একজন বললো,,”
“না তুই ধর্ষিতা না। তোর শরীর পঁচে নি।”

মানুষটার কন্ঠস্বর শুনে তারিন সহ সবাইক তাঁকালো সদর দরজার দিকে। দাড়িয়ে আছে ওমর। চোখে তার রয়েছে যন্ত্রনা। এই যন্ত্রনার কারন তারিন জানে। ওমর এগিয়ে এলো। তারিনের সম্মুক্ষে দাড়ালো। শক্ত কন্ঠে বললো ,,,

“সেদিন আমি তোকে মিথ্যা বলেছিলাম। বলেছিলাম তুই ধর্ষিতা। তোকে খুব জঘন্য অবস্থা আমি পেয়েছি। কিন্তু, না। এসব মিথ্যা।”

ওমরের কথায় তারিনের ভ্রু যুগল কুচকে এলো। চোখ দুটো ছোট ছোট হলে এলো। রাজ্যের বিস্ময় ভেসে উঠলো মুখে! তারিন শান্ত কন্ঠেই বললো,,
“তুই জানিস আমি একদমেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলা পছন্দ করি না। তাই যা বলার সোজাসাপটা বল। সময় নষ্ট করিস না।”

তারিনের কথা ওমর কিছু ক্ষন চুপ থেকে বলতে শুরু করলো,,
“সেদিন যখন আমি ওই বাসায় যাই তখন তোর মা বাসায় ছিলো না। রায়হান দেওয়ানকে খোঁজার জন্য উপরে উঠতে হঠাৎ কানে ভেসে আসলো কারোর মৃদ্যু আতৎনাদ। সেই আতৎনাদের খোঁজ করতে করতে যখন ওই রুমটার দিকে গেলাম৷ তখন দেখলাম ওই জঘন্য ব্যাক্তি’টা তোর সাথে বিশ্রি আচরন করার চেষ্টা করছে । তোকে দেখেই মনে হচ্ছিলো তোর দূর্বল শরীর নিয়ে তার সাথে পেরে উঠছিস না। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় তুই জ্ঞান হারালি। আর তখনি আমি রুমে প্রবেশ করি। ওই লোকটাকে এলোপাথাড়ি আঘাত করেছিলাম। মাথায় আঘাত করতেই ওই লোকটা সাময়িক সময়ের জন্য ক্ষান্ত হলো। সেই সুযোগের ব্যবহার করে তোকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম সেখান থেকে। ওই লোকটা আমার পিছু নেয় নি। হয়তো সম্মানের ভয়ে। আমি জানতাম ও তোকে ছাড়বে না তাই তোকে নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলাম চট্রগ্রাম। গা ঢাকা দিয়েছিলাম বহুদিনের জন্য। তোর শরীর এতই দূর্বল ছিলো যে হসপিটালে এডমিট করার দরকার ছিলো। ভেবেছিলাম যদি হসপিটালে এডমিট করলে তোর খোঁজ পেয়ে যায়। তাই বাসাটাকেই হসপিটালের বেড বানিয়ে ফেলেছিলাম। প্রায় এক সপ্তাহ পর তোর জ্ঞান ফিরলো। তোর ভেতরের প্রতিশোধের আগুন জ্বালানোর জন্য সেদিন মিথ্যা বলেছিলাম।”

ওমরের কথাগুলো শুনে তারিনের বুকের ভারী পাথর’টা নামলো। থামলো কিছুক্ষন। বাজখাঁই গলায় বললো,,,
“কিন্তু, প্রতিদিন যে লোকটা বিশ্রি ভাবে ছুঁয়ে দিতো। সেগুলো তো মিথ্যা ছিলো না। জোর জবর দস্তি করতো সেগুলো তো মিথ্যা ছিলো না। বেল্টের আঘাত গুলো তো মিথ্যা ছিলো না। যদি সেদিন তুই ঠিক সময় মতো আমাকে না বাঁচাতি তাহলে তো আমি ধর্ষিতাই হতাম। ”

তাজওয়ার টেবিলটাকে শক্ত করে ধরে দাড়িয়ে আছে। ওর চোখ গুলো ভয়ংকর ভাবে লাল হওয়া শুরু করেছে। ভারী নিশ্বাস ছাড়লো। সইতে পারছে না এইসব কথা। তাজওয়ার তারিনের দিকে একবার তাঁকালো। মেয়েটার মুখে রাজ্যের অসহায়ত্ব। শক্ত পাথরের ন্যায় মেয়েটার বুকে এত কষ্ট জমা ছিলো উপর থেকে দেখে বুঝা যায়নি। তারিন এইবার কেমন যেনো হাসলো। হাসতে হাসতে বললো,,
“এইসব কিছু তো সিনেমাটিক হয়ে যাচ্ছে তাইনা।”
তারিনের কথার পৃষ্ঠে ওমর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,,

“আমাদের পুরো জীবনটাই তো একটা সিনেমার অংশ। জীবন মানেই সুখ, দুঃখ। তুই বাস্তবতা কতটুকু দেখেছিস। কিছু দেখিসনি। অর্ধেক ও দেখিসনি। বাস্তব জীবনের ক্ষুদ্রাংশ নিয়েই সিনেমার গল্প তৈরি হয়। আমরা সিনেমা দেখে ভাবি এমন কি হয় নাকি বাস্তবে। ধুর এটা সিনেমা বলেই সম্ভব। কিন্তু আদৌ তা নয়। সিনেমার থেকেও বাস্তবতা হাজার গুন ভয়ংকর। আবার সিনেমার শেষটা যতটা না সুন্দর হয় তার থেকেও বাস্তবতা মারাত্নক সুন্দর হয়। বোঝাতে পেরেছি।”

ওমরের কথার উওর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলো না তারিন। জহির সাহেব ওমরের সাথে সহমত প্রকাশ করে এবার মুখ খুললো,,
“তুই তখন বললি না বাবার বয়সী মেয়ে কি করে এতটা জঘন্যতম কাজ করতে পারে। তাহলে, পত্রিকায় যখন বের হয় বাবা তার নিজের মেয়েকে ধর্ষনের চেষ্টা করায় গ্রেফতার। তখন ও কি তোর সিনেমা মনে হয়? পৃথিবীটা ভালো-খারাপ মিলিয়ে রে মা। এখানে ভালোর সংখ্যার থেকে খারাপের সংখ্যাই বেশি। এক প্রকার সা’প আছে জানিস তো। দেখতে হুবুহু গাছের রঙের। গাছ আর সা’পের রঙ একই হওয়ায় অনেক প্রানী ধোকা খেয়ে শিকার হয়। তেমনি আমরা ও ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষের রঙ একই হওয়ায় চিনতে পারিনা বলেই ধোকা খেয়ে থাকি। জীবন’টা নাটকের থেকেও নাটকীয় রে মা। ”

বলেই জহির সাহেব স্নেহের হাত রাখলেন তারিনের মাথায়। তারিন চোখের শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুকনা গুলো মুছে নেওয়ার চেষ্টা করলো। তাজওয়ারের দিকে তাঁকানোর সাহস ওর নেই। কোন মুখে দাড়াবে ও এই মানুষটার সামনে? ভালোবাসা দাম দিতে পারেনি ও। কিছুতেই এই মানুষটার সামনে দাড়িয়ে থাকা সম্ভব না আর। ক্ষমা চাইবে কোন মুখে? ক্ষমা করবে তো মানুষটা। নাকি ঘৃনা করবে? ভেবেই তারিনের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো তখনি “জঘন্যতম কীট’টাকে উপড়ে ফেলে সবার থেকে বিদায় নিবে ও। ” তারিন নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো তাজওয়ারের দিকে। তাজওয়ারের সামনে দাড়াতেই দুজনের চোখাচোখি হলো। তারিন সে চোখে তাঁকিয়ে থাকতে পারলো না কিছুতেই। চোখ নামিয়ে নিলো। বসে পড়লো তাজওয়ারের পায়ের সামনে। তাজওয়ারের পা জোড়া ধরে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,,
” পারলে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনার ভালোবাসার দাম দিতে পারিনি। না বুঝেই দিনের পর দিন আপনাকে আঘাত করেছি। শেষ অব্দি আপনাকে মে’রে ফেলার চেষ্টা করেছি। ক্ষমা করবেন।”

তাজওয়ার যেনো শক্ত হয়ে গেলো। ঘটনা বুঝতে কিছুক্ষন লাগলো ওর। মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেছে? কি করছে এসব? দেরি করলো না। তারিনের বাহু ধরে উঠালো। ধমকের স্বরে বললো,,,
“মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোমার। কি করছো এইসব। ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত। আমি তোমার পাশে থাকতে পারেনি৷ ক্ষমা করো প্লিজ।”

তারিন কিছুনা বলে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। সবার দিকে একবার তাঁকালো। ভারী কন্ঠে বললো,,
“অনেক হিসাব আজ সুদে আসলে মিটিয়ে ফেলব। বড়মা। আসচ্ছি।”

বলে দরজার দিকে পা বাড়ালো। তার আগেই তাজওয়ার ওর হাতটা টেনে ধরে বলে উঠলো,,
“আজ তুমি একা না। আমি ও থাকব তোমার পাশে। আমার,তোমার, আমাদের সবার সাথে অন্যায়ের শোধ তুলব তুমি আর আমি মিলে। ”

তারিন হাতটা পূর্নরায় ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে উঠলো,,,
“এতগুলো বছর যখন নিজের কাজ গুলো নিজে একাই করেছি। এবার ও শেষ কাজটা আমি একাই করতে পারব। আমার কাউকে দরকার নেই। ধন্যবাদ।”

বলে বেড়িয়ে গেলো। তাজওয়ার যেনো স্তব্ধ। তারিনের ব্যবহারে প্রতিক্রিয়া করার শক্তি হারিয়ে ফেললো। চোখ গুলো ছলছল করে উঠলো। মেয়েটা কেনো এমন করলো??

#চলবে

[ভুল গুলো ক্ষমা করবেন। ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে