শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় পর্ব-১৭

0
832

#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সতেরো

দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। তার বেশ কিছু’টা উপরে রায়হান দেওয়ান’কে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আগুনের উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে রায়হান চিৎকার করছে। কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। ওর মুখটা বাঁধা। আগুনের উত্তাপের জন্য তার সমস্ত শরীর বেয়ে পানির ন্যায় ঘাম ঝড়ছে। পুরো শরীর ভিজে একাকার। চোখ দুটো দিয়ে বাঁচার আতৎনাদ করছে। কিন্তু সেদিকে ওমর বা তাজওয়ার কারোর নজর নেই। ওমরের বুকের ভেতরে চিনচিন ব্যাথা করছে। কারন, মানুষ’টা ওর বাবা। হ্যাঁ, রায়হান দেওয়ান ওমরের বাবা। ওমরের মা ব্রেন টিউমারে মা-রা গেছে। তখন ওমরের সবে মাত্র দশ কি এগারো বছর হবে হয়তো? তখন এই বাবা নামক মানুষ’টা ওইটুকু বয়সে ও’কে পাঠিয়ে দিলো বাইরের এক দেশে। ওইটুকু বয়স থেকে ছেলেটা একা একা বড় হয়েছে। একা লড়াই করে বেঁচে আছে। কেউ এগিয়ে আসেনি ওর বিপদে। অসুস্থ শরীরে নিজেই নিজেকে সামলে নিয়েছে। বাবার দায়িত্ব পালন করেনি কোনোদিন। খোঁজ নিয়েও দেখেনি ছেলেটা কেমন আছে? মাঝে মাঝে হয়তো মনে পড়লে কয়েক মিনিটের জন্য ফোন দিতো৷ সেই ছোট থেকেই ওমরের চাপা অভিমান, অভিযোগ রয়েছে ওর বাবার উপর। অনেক বছর পর যখন নিজের অধিকার আদায় করে নেওয়ার জন্য দেশে ফিরলো। তখনেই বাবার আরেকটা জঘন্য রুপ’টা দেখেছিলো চোখের সামনে। তাই তারিন’কে নিজের মনের মতো গড়া তুলেছিলো। বিড়াল থেকে হিংস্র বাঘ গড়ে তুললো। যাতে করে মেয়েটা নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে পারে। কেনো যেনো সেদিন তারিনকে দেখে মায়া জন্মেছিলো ওর প্রতি। নিজের বোনের মতোই আগলে নিয়েছিলো ও’কে। এত বছর ধরে আগলে রেখেছে বড় ভাইয়ের মতো। একদিনের জন্য ও বুঝতে দেয়নি ও তো সত্যিই ওর ভাই। হতে আরে সৎ কিন্তু ভাই তো। তারিন এই সত্যি’টা জানেনা। বাবা’র দিকে অসহায় চোখে তাঁকিয়ে এইসব ভাবছিলো ওমর। কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে হকচকিয়ে উঠলো ওমর। পেছন ফিরে তাজওয়ার’কে দেখে মুখে হাসি টানার চেষ্টা করলো। প্রশ্ন করলো,,
“কিছু বলবে?”
তাজওয়ার সীমিত হাসলো। গলা ঝেড়ে বললো,,
“কি ভাবছো? আর তোমার লেডি কিলার বোন কোথায়? যদি এসে দেখে আমি এখানে তাহলে, আমাকেও উল্টো করে ঝুলিয়ে দিবে।”
তাজওয়ারের কথায় ওমর না হেসে পারলো না। হাসতে হাসতে হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শব্দ করে। আনমনে বললো,,
“মেয়েটা কত কিছু সহ্য করেছে বলো তো? এত কিছুর পর এতটা স্ট্রং থাকা যায় ও’কে না দেখলে জানতাম না।”
তাজওয়ার কথার পাল্টা জবাবে বললো,,
“তুমি নিজেই ও’কে স্ট্রং করেছো। এতবছর ওর পাশে থেকেছো। আগলে রেখেছো। আমি তোমার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। কোনো দিন তোমার ঋন শোধ করতে পারব না। তুমি না থাকলে কি হতো? ভাবতেই আমি ভয়ে আতঁকে উঠছি। সবটা দুঃস্বপ্ন লাগছে আমার।”

কথাগুলো তাজওয়ার ওমরের হাত জোড়া আকড়ে বললো। তাজওয়ারের কথায় ওমর ওর কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা বানীতে বলে,,
“ও আমার বোন। আর বোন’কে আগলে রাখা ভাই এর দায়িত্ব। আমিস শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি। ”
ওমরের কথায় তাজওয়ার মাথা ঝাঁকালো। ওমর’কে হালকা করে জড়িয়ে ধরে বললো,,
“পর হয়েও তুমি বুঝিয়ে দিলে পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বড় সম্পর্ক আছে।”
তাজওয়ার ছাড়তেই ওমর বেশ গম্ভীর কন্ঠেই বলে উঠলো,,
“তারিন আমার পর ও সত্যি আমার বোন হয়।”
কথাটা শুনে তাজওয়ারের কপাল কুঁচকে এলো। অবাক না হয়ে পারলো না। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাঁকিয়ে রইল ওমরের দিকে। ওমর ওর চোখের চাহনী বুঝলো। শান্ত কন্ঠেই থেমে থেমে তাজওয়ার’কে ওর পরিচয় দিলো। ওমরের পরিচয় পেয়ে তাজওয়ারের চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে যায়। অবাক দৃষ্টিতে একবার রায়হান দেওয়ানের দিকে আরেকবার ওমরের দিকে তাঁকালো। বিস্ময় ভরা কন্ঠে কিছু বলতে যাবে। তার আগেই ওমর বলে উঠে,,
“আমি জানি তুমি কি ভাবছো? কিন্তু এই মানুষ’টা যেই জঘন্য কাজ করেছে। আমি তাকে কোনোদিন ক্ষমা কররে পারব না। তাহলে, আমার বোনের সাথে অন্যায় করা হবে। আমার বোন’টা অন্তত ওর সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ তুলুক। যদি খানিক’টা শান্তি পায়। মেয়েটা এতগুলো বছর ধরে অনেক কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রনা সহ্য করেছে। যদি এইবার একটু সুখ পায়। আমার বোনের সুখ এখন থেকে তোমার হাতে তাজ। প্লিজ আমার বোনটা’কে আর কষ্ট দিও না।”

তাজওয়ার নিজেকে সামলাতে পারলো না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওমর’কে। কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,,
“আমার ভাই’কে হারিয়েছি তো কি হয়েছে? তুমি আজ থেকে শুধু তারিনের ভাই না। আমার ও ভাই৷ আল্লাহ হয়তো আমার ভাইয়ের অভাব পূরণের জন্য তোমাকে পাঠিয়েছে।”
তাজওয়ারের এহেতুক কথায় ওমরের চোখ ছলছল করে উঠলো। তাজওয়ার’কে জড়িয়ে ধরে স্তব্ধ হয়ে রইলো। এর মধ্যে বাইকের শব্দ পেতেই দুজনেই সরে দাড়ালো। চোখের পানি মুছে দুজন দুজনের দিকে তাঁকিয়ে হেসে দিলো। তাজওয়ার ভয় পাওয়া মুখ করে বলে উঠলো,,,
“এসে গেছে আমার লেডি কুইন। ভাই, তুই আমার শেষ ভরসা। ওর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখিস।”
ওমর হেসে দিলো। দুজনের একসাথে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। তাজওয়ার দরজার দিকে এগিয়ে সামনে তাঁকাতে থমকে গেলো। চোখের পাতা ঝাপটালো বার কয়েক। তারিনের পড়নে সাদা লেডিস টি-শার্টের উপরে কালো জ্যাকেট। গলায় স্কাফ প্যাঁচানো। কালো জিন্স এর সাথে সাদা কেড’স। বাম হাতে প্যাচানো, প্যাচানো এক ধরনের ব্রেসলাইট। খোলা চুল গুলো বাতাসের দাপটে উড়ছে। চোখের কালো সানগ্লাস। হেলমেট’টা এখনো মাথায়। তাজওয়ার আর ওমর দুজনেই দুজনের দিকে চোখাচোখি করছে। ওমর যেনো বিস্ময়ের চরম পর্যায়। মেয়েটা এই গরমে জ্যাকেট পড়েছে কেনো? আর এমন রুপে তারিন’কে এই প্রথম দেখছে। তারিন হেলমেট’টা মাথা থেকে খুলে নিয়ে রাখলো বাইকের উপর। সানগ্লাস’টা নাকের ডগায় এনে চোখ মা’রলো ওদের দিকে তাঁকিয়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় তাজওয়ার কেশে উঠলো। আর ওমর ঠোঁট চেপে হাসলো। তারিন সানগ্লাস’টা খুলে রাখলো। বাইক থেকে নেমে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। সামনে আসায় তারিনের ঠোঁটের হালকা গোলাপি লিপস্টিক চোখে পড়লো। তাজওয়ার ভেবে পেলো না। আজ হঠাৎ কি হলো মেয়েটার? কেনো যেনো তারিনের এই রুপ সহ্য হলো না তাজওয়ারের। কি চলছে ওর মনে মনে? বুঝতে পারলো না। কেনো যেনো বুকের ভেতর’টা ধক করে উঠলো। তারিন’কে এত শান্ত দেখাচ্ছে কেনো? ভিন্ন কিছু হবে নাতো? তারিন’কে দেখা মাত্রই ওমর প্রশ্ন করলো,,
“তুই হঠাৎ এই রুপে?”
তারিন বেশ ভাবসাব নিয়ে জবাব দিলো,,
“আমার জীবনটা তো সিনেমার থেকে কোনো অংশে কম না তাইনা। তাই আমিও একটু লেডি কি’লার সাজার চেষ্টা করলাম। কেমন লাগছে বলো তো হিরো? ”

তারিনের কথায় ভ্যাবাচেকা খেলো তাজওয়ার । উওর দিতে পারছে না। বার বার মস্তিষ্ক প্রশ্ন করছে। মেয়েটা এত শান্ত কেনো? তাও কোনো রকম উওর দিলো,,,
“একদম লেডি কি’লারের মতোই লাগছে।”
উওর শুনে তারিন হাসলো। ওদের সাইড কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। ওমর গেলো তারিনের সাথে সাথে। কিন্তু তাজওয়ারের কেনো যেনো অস্বস্তি হচ্ছে। ভয় লাগছে। বুকের ভেতর হাহাকার বাড়ছে। শূন্য লাগছে সব কিছু। হঠাৎ কেনো এই অনুভূতি হচ্ছে বুঝতে পারছে না? আমাকে এখানে দেখেও কোনো রিয়েক্ট করলো না কেনো? এইসব প্রশ্নের উওর খুঁজে পেলো না। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করলো। তারিন ভেতরে এসে একটা চেয়ারে বসে ওমর’কে ইশারা করলো কিছু। ওমর সেই ইশারা বুঝে অন্য কয়েক’টা ছেলেকে হুকুম করলো। রায়হান দেওয়ান’কে নামানোর জন্য। ওরা ওমরের কথামতো রায়হান দেওয়ান’কে নামিয়ে একটা বড় খন্ডের বরফের উপর রডের সাথে বেঁধে দিলো। এতক্ষন আগুনের উত্তাপে রায়হান দেওয়ানের মুখ কিছুটা পুড়ে গেছে। শরীরের বেশ কিছু জায়গা কালচে হয়ে আছে। এই ঠান্ডা টুকু এখন প্রয়োজন ছিলো তার। ঠান্ডা পেয়েই হাফ ছেড়ে বাঁচলো রায়হান দেওয়ান। কিন্তু একটা মানুষের পক্ষে কখনোই বরফের উপর খালি পায়ে দীর্ঘসময় দাড়িয়ে থাকা সম্ভব না। তেমনি তার পক্ষেও সম্ভব হয়ে উঠলো না। ঠান্ডায় শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো। বেশ কিছু সময় কেটে যাওয়ার পর তারিন এইবার উঠে দাড়ালো। রায়হান দেওয়ান ভীষন ভাবে করুন চোখে তাঁকালো তারিনের দিকে। তারিন সামনে যেয়ে রায়হান দেওয়ানের মুখ’টা খুলে দিলো। মুখ খোলা পেয়েই রায়হান দেওয়া বলতে লাগলো,,
“প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমার পা ধরে ক্ষমা চাইব। আমাকে ক্ষমা করে দাও। ”
রায়হানের ক্ষমা চাওয়া বাক্য শুনে তারিন শব্দ করে হাসলো। তারপর বললো,,
“তিন তিন’টে জীবন কেড়ে নিয়েছিস তুই। ক্ষমা করে দেওয়া তো দূরে থাক। ক্ষমা শব্দটাই তোর মুখে যায় না।”
এইটুকু বলে থামলো। তারপর পূর্ণরায় বললো,,
“আজ তোর সমস্ত অন্যায় তুই নিজের মুখে স্বীকার করবি। যদি স্বীকার করে নেস তাহলে মৃ’ত্যু’টা সহজ হবে। আর না হয়…….।”
সম্পূর্ন কথা শেষ করার আগেই রায়হান চিৎকার করে বললো,,
“নাহ! আমি বলছি। বলছি আমি।”

বলে থামলো কিছুক্ষন। তারপর কাঁপা গলায় বলতে শুরু করলো,,
“সেদিন রাতে রাহা আমার বাসায় যাওয়া
আর পর ওর খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। খাবারের কিছুক্ষন পর রাহার শরীর দূর্বল হয়ে পড়ায় রাহা বাসায় ফিরতে চেয়েছিলো। কিন্তু তখন প্লান করে কিছু কাজের বাহানায় তোমার বাবা-মা’কে আমি আটকে দেই। আর নিজেই রাহা’কে পৌঁছে দেওয়া নাম করে তোমাদের বাসায় চলে আসি। বাসায় ফেরার সাথে সাথে রাহা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। কিছুক্ষনের ব্যবধানে যখন ও অতল ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। তখন রাহা’কে আমিই বালিশ চা’পা দিয়ে শ্বাসরোধ করে মে’রেছিলাম। তারপর তোমাদের বাসার সার্ভেন্টের সাহায্যে ওর লাশ’টা ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট’টাও আমি ডাক্তারের সাহায্যে বদলে দিয়েছিলাম। এইসব কিছুর পেছনে আমিই দায়ী। আমিই খু-নী।”

#চলবে

[ভুল গুলো ক্ষমা করবেন। এর সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে