শূণ্যতা

0
1174

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
ছোটগল্প:#শূণ্যতা
লেখনীতে: অনিন্দিতা

অফিস থেকে কাজ শেষ করে কপালের ঘাম আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে বাসায় ফেরার জন্য রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানটার সামনে সোজা হয়ে রিক্সার জন্য দাঁড়াতেই মুগ্ধর থেকে খানিকটা দূরে চোখে পড়লো একটা পঁচিশ অথবা ছাব্বিশ বছর বয়সী লাল শাড়ী পরা মেয়েকে আর সাথে দুই অথবা তিন বছরের একটা মিষ্টি বাচ্চা মেয়েকে।ছোট্ট মেয়েটা একটা সাদা রংয়ের ড্রেস পরে আছে।সাদা রংয়ের শুভ্রতায় মিশ্রিত থাকায় তাকে যেন আরো মিষ্টি লাগছিলো।পিচ্চি মেয়েটা আধো আধো কথা বলা শিখেছে হয়তো কিংবা শিখে নি।লাল শাড়ীর মেয়েটা তার চেনা তবে গত চার বছরেও যোগাযোগ হয়নি তার সাথে। পিচ্চি মেয়েটা হয়তো তারই মেয়ে।ছোট্ট মেয়েটার দিকে মনভরে তাকাতেই তাদের পেছন পেছন একটা কালো রংয়ের পাঞ্জাবী পরিহিত ছেলেকে চোখে পড়লো তার। ছেলেটা তার খুব পরিচিত ও বলা যায় আবার নিজের প্রাক্তন ও বলা যায় বটে।হঠাৎ তাদের চোখে পড়তেই মুখটা নিচু করে নিলো মুগ্ধ ।নিজেকে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় ব্যস্ত হয়েই অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো সে।অস্বস্তিতে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো।কেমন যেন এক দমবন্ধকর অবস্থা।যেন তাকে না দেখলেই হয়তো সে রেহাই পাবে। সত্যিই কী তাই? কেন এই লুকোচুরি?সে কী অন্যায় করেছে তার প্রাক্তনের সাথে?একমুঠো সুখ নিজের প্রিয় মানুষটাকে এনে দেওয়া কী অন্যায়?ভাবনার মাঝেই নিজের মুখ লুকানোর চেষ্টাকে ব্যর্থ প্রমাণিত করে পিচ্চি মেয়েটা তার হাত জড়িয়ে বলেই উঠলো,

– এই যে আন্তি তোমার কাগজ পড়ে গেলো তো।

নিজের ফাইলের কাগজপত্র পড়ে গেছে ভেবেই উল্টো ফিরে তাঁকালো সে।নিচে পড়ে থাকা কাগজটা ব্যাগে নিলো।ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আরো এক ধাপ অবাক হলো সে।কথাটা যে ছোট মেয়েটার তা আর বুঝতে দেরি হলো না। তার ধারণা ভুল।মেয়েটা অাদৌ আদৌ নয় পুরোপুরিই কথা বলতে পারে।মুখে হাসি ফুঁটিয়ে ছোট মেয়েটার গালে হাত দিয়ে বলে উঠলো মুগ্ধ,

– থেংকিউ মামনি।

কথাটা শুনেই খিলখিল করে হেসে উঠলো বাচ্চা মেয়েটি।সেও বললো,

– ওলকাম আন্তি।

মেয়েটির মুখে ” ওয়েলকাম” শব্দটিকে “ওলকাম” শুনে হাসি ফুটলো তার কথিত অান্তির মুখে ও।সেও বাচ্চা মেয়েটাকে সাথে সাথেই কোলে নিয়ে ব্যাগ থেকে কয়েকটা চকলেট বের করে বলে উঠলো মুগ্ধ,

– চকলেট নিবে?

বাচ্চা মেয়েটি চকলেট গুলো হাতে নিয়েই বললো,

– হ্যাঁ,চকলেত তো আমার খুব প্রিয় তাই না মাম্মাম?

বাচ্চাটার কথা শুনেই তার দৃষ্টি অনুসরন করে তার মায়ের দিকে তাকালো মুগ্ধ।তার মা আর বাবা দুজনই যে মুগ্ধকে দেখে খানিকটা অবাক আর অস্বস্তিতে পড়েছে তা মুহুর্তেই তাদের চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারে মুগ্ধ।তাই নিজে থেকেই বলে উঠে,

– নীলাদ্রী কেমন আছিস?

লাল শাড়ীর মেয়েটাই নীলাদ্রী।সে মুখে বৃথা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বলে উঠলো,

– ভালোই,তুই?

– যেমনটা দেখছিস।

কথাটা বলেই মৃদু হাসি ফোঁটালো নিজের ঠোঁটের কোণে।আর এই হাসিটা হয়তো সুদর্শন পুরুষ মানুষটির হৃদয়টাকে টুকরো টুকরো করার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
মুহুর্তেই তার প্রাক্তন নামক পুরুষটি বলে উঠলো,

– তুমি ভালো নেই মুগ্ধ?

– তাই মনে হচ্ছে বুঝি সায়ন?

হ্যাঁ তার প্রাক্তনের নাম সায়ন।শুধু প্রাক্তন বলা যায় না তাকে তো মুগ্ধ এখন ও ভালোবাসে।সব ভালোবাসাতো পূর্ণতা পায় না।কিছু কিছু অপূর্ণতার মাঝেও থাকে হৃদয় ভরা ভালোবাসা।তাই আজও একাকীত্বকে সঙ্গী করে বেশ আছে মুগ্ধ।অন্য দিকে সায়ন নিজের প্রিয় মানুষটার এমন ক্লান্ত মাখা মুখ দেখে বুঝেই নিলো ভালো নেই সে।মোটা ফ্রেমের চশমার ভিতরের চোখজোড়ায় যেন অনেক কথা লুকায়িত ছিলো।কচু পাতা রংয়ের শাড়ীতে যেন অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো মুগ্ধকে।কিছুক্ষন তার উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটা,কালো লম্বা চুলের বেনুনি আর কাজল দেওয়া চোখগুলোকে গভীর নয়নে দেখেই বলে উঠলো সায়ন,

– অনেক সময় তো মনই সত্যি কথা বলে।

কথাটাকে ঘোরানোর জন্যই মুগ্ধ নীলাদ্রীকে উদ্দেশ্য করেই বলে উঠলো,

– নীল তোর মেয়েটা তো ভারী মিষ্টি।পুরো সায়নের মতোই দেখতে হয়েছে বল?নাম কী ওর?

– মুসকান আহমেদ স্নিগ্ধ।

নামটা শুনেই একধাপ চমকে উঠলো মুগ্ধ।এই নামটা সে আর সায়ন চারবছর আগে যখন একে অপরকে ভালোবাসতো তখন তাদের ভবিষ্যৎ এ যদি কন্যা সন্তান হয় তার জন্যই ঠিক করেছিলো।কিন্তু সে নামটাই সায়ন আর নীলাদ্রীর মেয়ের নাম হবে সে ভাবেই নি।পুরোনো স্মৃতি গুলো আবার ঝাপসা হয়ে চোখের সামনে ভাসতে লাগলো।চারবছর আগে সে নিজেই নিজের ভালোবাসাকে নিজের সবথেকে কাছের বান্ধবীর হাতেই তুলে দিয়েছিলো শুধু সে কখনো মা হতে পারবে না বলে। না শুধু সে কারণ নয়।সায়নের প্রতি নিজের বান্ধবীর দুর্বলতাটা জানাও ছিলো একটা কারণ।আর তারপর থেকে তাদের থেকে দূরে, তাদের স্মৃতি ভুলে থাকার চেষ্টাতেই জীবন কাঁটছে তার। কিন্তু চাইলেই কী সবকিছু ভোলা যায়?সায়ন অনেকবার বলেছিলো আমার সন্তান চাই না শুধু তোমাকে চাই তবুও আজ নীলাদ্রী তাকে কন্যা সন্তান দিয়ে যে সুখ দিয়েছে তা কী আদৌ মুগ্ধ দিতে পারতো?নাহ তো।নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য এটুকু ত্যাগ আর কীই বা?কথাগুলো ভাবতেই চোখের পানিটা চোখের কোণে খুব করে জমতে লাগলো।যেন এখনই বৃষ্টি আকারে ঝরে পড়বে গাল বেয়ে। তাও নিজের কান্নাকে লুকানোর চেষ্টা করেই বলে উঠলো,

– আমাকে একবার ফোন করে বলতে পারতি।তোদের মেয়েকে দেখার অধিকার কি নেই আমার?

– ওর আকিকার অনুষ্ঠুানে তোকে বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু সবাই বললো যে তোর মতো মেয়েরা নাকি শুভ অনুষ্ঠানে আসলে খারাপ কিছু হয় তাই।আসলে তুই যে স্নিগ্ধকে কোলে নিলি এটাও নাকি ওর জন্য খারাপ।

এই কথাটা শুনে সে আর কান্না চেপে রাখতে পারে নি।বাচ্চা মেয়েটাকে মুহুর্তেই
কোল থেকে নামিয়ে বলে উঠলো,

– স্যরি রে, আমি বুঝতে পারিনি আমি ওর জন্য অশুভ তাই ভুল করে কোলে নিয়ে পেলেছি।তাছাড়া এটা তো আমার ভুল না নীল।আমার প্রবলেমের কথা তুই জানতি তো।পিরিয়ড়ের সময় এতো পেট ব্যাথার জন্য অপারেশনটা করতে বলেছিলো ডক্টর।কিন্তু আমি যে অপারেশনের পর মা হওয়ার ক্ষমতাই হারিয়ে পেলবো কে জানতো?শুধু ঐ অপারেশনের পর থেকে আমি শূণ্য হয়ে গেছি।একদম শূণ্য।

মুগ্ধর চোখের পানিতে হয়তো ভিতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো সায়ন।কেন জানি তার নিজেকেই মুগ্ধর এই অবস্থার জন্য দায়ী মনে হয়।নীলাদ্রীকে বিয়ে না করলে হয়তো আজ মুগ্ধর জীবনটা অনেক আনন্দের থাকতো।কিন্তু মুগ্ধই তো সেদিন তাকে রাজি করালো অাত্মহত্যা করবে বলে।নিজের প্রেয়সীকে বাঁচানোর জন্যই তো সে অন্য একজনকে আপন করে নিয়েছিলো।সত্যিই কী আপন হতে পেরেছে নীলাদ্রী?নাহ তো।নীলাদ্রী তার কামনায় জড়ালেও ভালোবাসায় জড়াতে পারে নি।কেন?তার উত্তর তো কারো কাছেই নেই।মুগ্ধর চোখের পানি দেখেই সায়ন নীলাদ্রীর দিকে তাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

– নীলাদ্রী, এসব না বললেও তো হতো।তোমার তো একসময়ের ব্রেস্টফ্রেন্ড ছিলো।তাকে কষ্ট দিতে ভালো লাগছে তোমার?

– তোমার তো প্রাক্তন ভালোবাসা!তো এই জন্য জ্বলছো?

– প্লিজ স্টপ। সবসময় এই কথাটা ভালো লাগে না।

মুগ্ধর দিকে তাঁকিয়েই বলে উঠলো সায়ন,

– মুগ্ধ নীলাদ্রী এমনটা বলতে চায় নি ঠিক।স্যরি তোমায় কষ্ট দেওয়ার জন্য।

– কষ্ট?কে কষ্ট পেয়েছে?আমি সবসময় সুখী।আমার জীবনে কোন কষ্ট নেই সায়ন।

– মুগ্ধ তুমি চাইলে আবার জীবনটাকে শুরু করতে পারো।শুধু কী সন্তানের জন্যই মানুষ বিয়ে করে?কেউ একজনকে জীবন সঙ্গী করে নাও।

– চাইলে তো চারবছর আগেও জীবনটাকে আরো সুন্দর করে শুরু করতে পারতাম।আমি এই বিষয়ে আর বলতে চাই না।আমায় বাসায় ফিরতে হবে।এমনিতেই বাসায় অনুষ্ঠানের জন্যই ছুটি নিয়েছিলাম কিন্তু সেই দেরি হলো।

– স্যরি তোমার সময় নষ্ট করার জন্য মুগ্ধ।

– তেমন কিছু না।আসি সায়ন,নীলাদ্রী।মামনি বাই বাই।

বাচ্চা মেয়েটি মুচকি হেসে বললো,

– টা টা আন্তি।

মুগ্ধ তখন মুখে হাসি ফুটিয়ে সেখান থেকে সরে আসলো।আর ওরা তিনজন তখন পথ বাড়ালো।মুগ্ধ পেঁছন ফিরে একবার তাদের যাওয়ার পথে তাকালো।তারপর আবার সামনে ফিরে একটা রিক্সা ডেকে নিয়ে উঠে বসলো সে।আজ সে শূণ্য।শূণ্যতায় ঘিরে রেখেছে চারপাশটা।এভাবে কতশত কারণে প্রতিদিন হাজারো ভালোবাসার পরিণতি হয় অপূর্ণ্যতা আর শূণ্যতা।হ্যা তার জীবনটা ভালোবাসার অার সন্তানের শূণ্যতায় কাঁটবে।রাতের আঁধারে তাকে যে হাজারো শূণ্যতা ঘিরে ধরে। এই শূণ্যতার শেষ হয়তো কখনোই হবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে