বৃন্দাবন বিলাসী

0
967

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০

গল্প: বৃন্দাবন বিলাসী
লিখা: সামিয়া ইসলাম ইভা

‘তারে ধরি ধরি মনে করি
ধরতে গেলাম আর পেলাম না,
দেখেছি রূপ সাগরে
মনের মানুষ কাঁচা সোনা।”

কোকিল কণ্ঠী গলায় ঢেউয়ের মতো ভেসে আসছে গানটি। আমগাছের সাথে হেলান দিয়ে শুভ খুব মন দিয়ে শুনছে সে গান। বন্ধ চোখের কালো পর্দায় সে দেখছে সদ্য বিয়ে হওয়া লাল টুকটুকে বউয়ের হাটিহাটি পায়ে চলা এবং সুর তোলা।

ঝনঝন চুড়ির আওয়াজে বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই সামান্য বিকৃত মুখে কিছুটা জিভ কাটল শুভ। তারপর সে চলে যেতে উঠতেই পেছন থেকে ডাক এলো।

“দাঁড়াও।”

সুন্দর রমণীর মধুমাখা ডাক আজ অবধি কোনো দিগ্বিজয়ী পুরুষ প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছে কি? শুভ মাথা নিচু করে ঘুরে দাঁড়ালো। কোকিল কণ্ঠি আবার বলল, “তুমি জমিদারবাড়ির ছেলে, ছোট জমিদার না?”

এবার সে মাথা তুলে জবাব দিলো কেবল, “হ্যাঁ।”

“তুমি কি করছিলে এইখানে?”

“গান শুনছিলাম।” ইতস্ততবোধ করলেও শুভ আবার বলল, “তোমার।”

মেয়েটি কাজল কালো চক্ষুদ্বয় কিঞ্চিৎ ছোট করলো। “রোজ আসো বুঝি?”

“হ্যাঁ।”

“রোজ শুনো গান!” চোখ এবার বড় করলো মেয়েটা।

“হু।” শুভর ঠোঁটের কোণায় একটু হাসি জমেছে সে মেয়ের অবাক মিশ্রিত লজ্জা দেখে।

তারপর কী যেন আকাশকুসুম ভাবলো সে মেয়ে। শুভ অবাক হয়ে দেখছে। যত দেখছে তত তার চিত্ত পুলকিত হচ্ছে। চোখের পলকবিহীন দেখে যাওয়ার বাসনা হচ্ছে বারবার। তাঁতের শাড়িতে নারীদের কত মহিমান্বিত লাগে তা হয়তো এ মেয়ে দেখার আগে জানা ছিলোনা শুভর। শ্যামলা বর্ণে, লাল টুকটুকে সিঁদুর আর টিপ লাবণ্যময়ী করে তুলেছে সে মেয়ের বদনখানি। হাতে পায়ে লাল আলতার মাধুর্যতা, আর সে মেয়ের চোখে ভাবলেশহীন আবেশ। কতটা জটিলতা!

“আম খাবে ছোট জমিদার?”

এ যেন কোনো পুরুষের মায়ার জগতে ডুবে যেতে যেতে অজ্ঞাত রমণীর বাঁচিয়ে তোলা।

“আমার কাছে নুন আর মরিচ আছে।” কোমরে কাপড়ের ভেতর রাখা একটা পাতার ছোট্ট পোঁটলা আর একটা ছুরি বের করলো সে। তারপর শুভর হাতে সেটা গুঁজে দিয়ে উঠে গেলো আম গাছের নিচু একটা ডালে।
মেয়েটার সবকিছু কেমন শুভকে অবাক করে তুলছে। যা সে ভাবতে পারেনা।
সেই মেয়ে আবার হাতে দুটো কাঁচা আম নিয়ে নেমে এলো। তারপর আমগাছের নিচে বসে শুভকে ডাক দিলো।

শুভর কেমন জানি ঘোরের মতন লাগছে কিছুটা। মেয়েটার পাশে বসে জানতে চাইলো সে, “তোমার নাম কি?”

“আমি? ও আমি মৃণালিনী।” সে যত্ন করে পোঁটলাটা খুলল। সেটা নুন মরিচের মশলায় মাখামাখি হয়ে আছে। এবার আম কাটতে শুরু করলো মৃণালিনী। “তোমরা শুনেছি বেড়াতে এসেছো।” সে তার চোখ হাতের দিকে রেখে জানতে চাইলো।

“হ্যাঁ। তুমি রতন দাদার বউ বুঝি?”

“হ্যাঁ।” আমের একটা অংশ কেটে মৃণালিনী শুভর হাতে দিলো।

“তুমি একা আসো কেন এখানে?”

মৃণালিনী খুব অবাক হয়ে এক ঝলক তাকালো শুভর চোখে। তারপর মলিন হেসে বলল, “আমার তো এখানে সই নেই কোনো। তবে জানো? আগের গ্রামে প্রচুর ছিলো। উনি কাজে যাওয়ার পর একা লাগে তাই এখানে হাটতে আসি।”

“ওহ।”

কাঁচা আমের সাথে নুন লাগিয়ে মুখে পুরে দিয়ে পুনরায় আম কাটতে কাটতে বলল, “তা তোমার বন্ধু নেই কোনো?” বলেই জিভ দিয়ে ঠক করে শব্দ করলো মৃণালিনী।

“না, আমি তো এখানের কিছুই চিনি না। গ্রীষ্মের ছুটি ফুরালেই ফিরে যাবো শহরে।”

“ওহ। শুনো, এই বাগানটার নাম দিয়েছি আমি বৃন্দাবন। কাল এসো এখানে। এখন আমি যাই। উনি আবার খেতে আসবেন।” হেসে পায়ের নূপুর বাজাতে বাজাতে চলে গেলো মৃণালিনী।

শুভ কেবল তাকিয়ে দেখল মৃণালিনীকে। যতদূর দেখা যায়। তারপর ভাবল এই বাগানটা সত্যিই বৃন্দাবন হওয়ার ক্ষমতা রাখে। মুচকি হেসে উঠে চলে গেলো সেও।
.
.
পরদিন শুভ মৃণালিনীর আগে এসে হেলান দিয়ে বসে রইলো গাছের সাথে। চোখ বন্ধ থাকলেও ক্ষণিক সময় পর মৃণালিনীর পায়েলের ঝুমঝুম শব্দে সে টের পেল তার অস্থিত্ব।

“ওহে ছোট জমিদার, দেখ তেঁতুল এনেছি।” বলে বসে পড়লো মৃণালিনী।

শুভ সোজা হয়ে বসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। “আমি যে তেঁতুল খাই না বউদিদি।” শুভর ঠোঁটের কোণায় বাঁকা মুচকি হাসি।

মৃণালিনী তার মুখ থেকে তেঁতুলের বীচি হাতে নিয়ে ডেব ডেব চোখে চেয়ে রইলো।

তারপর কিছুসময় কেউ কিছু বলল না। মৃণালিনী শৈল্পিকতার সাথে তেঁতুল খেয়ে যাচ্ছে। চোখ একবার অর্ধেক বন্ধ করছে তো আরেকবার পুরো। শুভর মুখে মুচকি হাসি আর চোখ জুড়ে তৃপ্তি। মৃণালিনী আর একবারো শুভর চোখে দেখল না। এইখানে যদি কোনো কবি বসতো তবে সে নিশ্চয় আমার মৃণালিনীকে নিয়ে কবিতা লিখতো, ভাবার সাথে সাথেই শুভর বুক ধক করে উঠলো।

তারপর খুব অনুরাগ জড়িয়ে ডাকল সে, “মৃণালিনী।” মৃণালিনী নামের মাধুর্যতা হয়তো সে মেয়ে আগে কখনো উপলব্ধি করেনি। তাই শুভর মুখে সে ডাক শুনে কেমন চোখজোড়ায় বিস্ময় ফুটে চিকচিক করে উঠলো তার।

“কি দেখছো মৃণালিনী এমন করে?”

“কিছুনা।” লজ্জায় মুখ লুকাতে চাইলে, মেয়েটির থুতনি বুকে গিয়ে লাগলো।

“দেখ, তোমার জন্যে আমি কি এনেছি।” হাসি হাসি মুখ করে পাশ থেকে একটা বই নিয়ে এগিয়ে দিলো শুভ।

শুভর পাশে একটা বই ছিলো তা আগে খেয়াল করেনি মৃণালিনী। “এম্মা, বই! আমি পড়তে পারিনা গো।”

“এটা তুমি যত্ন করে রেখো। তোমার স্বামীকে বলো, তোমায় পড়ে শোনাতে।”

মৃণালিনী বইটা নিলো তার হাতে। একবার হাত বুলিয়ে দেখলো। মেয়েটার ডাগর চোখের কৌতূহল খেলা করছে বইয়ের উপর। হয়তো আজ প্রথম সে নিজের পড়তে না পারার অক্ষমতা বুঝতে পারলো। সব মিলিয়ে অনবদ্য হয়ে আছে তার মুখ। আর তা প্রাণ ভরে দেখছে সদ্য যুবকের সীমায় পা দেওয়া পুরুষ।
“জানো মৃণালিনী, তুমি বড্ড মায়াময়। কতো মেয়ে দেখেছি আমি, কিন্তু তুমি অদ্বিতীয়া।”

এই কথা শুনে মৃণালিনীর হৃদয়ে অন্যরকম অনুভব হলো। যেন তার হৃদয় ছুঁয়ে দিলো কেউ। তবে কি বাক দিয়ে হৃদয় ছুঁয়া যায়! ভাবল সে। “আজ চলি।” বলে উঠে দাঁড়ালো মৃণালিনী।

“গান শুনাবে না আমায়?”

পেছনে ফিরে “কাল এসো।” বলে চলে গেলো মৃণালিনী।

শুভ আজ ভিন্ন কিছু দেখলো তার প্রিয় মুখটাতে। মায়াময় লজ্জা ছিলো সেথা। মৃণালিনী আগেও লজ্জা পেয়েছিলো। কিন্তু এবারে সেটায় ভিন্নতা ছিলো।

তারপর বেশ অনেকদিন চলল। একটা মুহূর্ত মৃণালিনী গান করতো। আরেকটা মুহূর্ত শুভ মৃণালিনীর প্রশংসা করতো। সে প্রশংসায় স্থান পেতো মৃণালিনীর রূপ, গান, গুণ সবকিছুই। মৃণালিনী মাঝেমধ্যে রান্না করে খাওয়াতো তার প্রিয় পুরুষকে। তারা কখনো বিকেলেও আসতো। আমগাছের সাথে পিঁড়ি দিয়ে দোলনা বানিয়ে দুলতো মৃণালিনী। শুভ গাছের গায়ে ঠেসে দাঁড়িয়ে দেখতো আর প্রাণ জুড়াত।

একদিন মৃণালিনী পায়ে পায়ে আসার সময় হাতে করে একটা সরস্বতী মূর্তি নিয়ে এলো। কত কাঠখড় পুড়িয়েছে সে তার স্বামীকে দিয়ে এই মুর্তি আনাতে। উপহার হিসেবে শুভর জন্যে সামান্যটুকু আনতে পেরে খুব খুশি সে। শুভ এলো, মুখে একটা বিষন্নতার ছাপ নিয়ে।

“কী হলো তোমার?” মৃণালিনীর ফুরফুরে মেজাজ তার কথায় স্পষ্টত।

“আজ ফিরে যাচ্ছি আমি।” শুভর গলা গম্ভীর হয়ে আছে।

মৃণালিনী খিলখিল করে হেসে উঠলো, “ধুর ছোট জমিদার এমন মজা কেউ করে বুঝি?”

কোনো উত্তর এলো না শুভর কাছ থেকে। মৃণালিনী তার হাসি থামিয়ে নিয়ে শুভর দিকেএ তাকাল। অন্যদিন সে মৃণালিনীর মুখ থেকে চোখ সরাতো না। আর আজ সে একবার ভুলেও তাকালো না মৃণালিনীর মায়াময় মুখে।
মৃণালিনী নির্বাক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুসময় ধরে। অভিমান তার ঠোঁটে, নাকে আর চোখে খেলা করছে। তারপর সরস্বতী মূর্তি এগিয়ে দিলো শুভর দিকে। “এটা তোমার জন্যে এনেছিলাম।” বলার সময় মৃণালিনী বুঝতে পারলো এক অস্পষ্ট জড়তা চেপেছে তার গলা জুড়ে।

শুভ হাত বাড়িয়ে সেটা নিলো। তবুও তার চোখটা নিচ থেকে উঠলো না।

“আমি চিঠি দিবো তোমায়।” রিক্ত বুকের আবেশিত কথাগুলো হালকা হয়ে জড়িয়ে নিলো মৃণালিনীকে। কেমন মায়াময় হয়ে উঠেছে শুভর স্বর। কিন্তু তার চোখ কেন অপরাধীর মতো আচরণ করছে? মৃণালিনীর কথাগুলো সে মনের মধ্যে চাপা দিয়ে কেবল তাকিয়ে আছে। কী বা বলবে সে? বললে যদি আবার বুকের কষ্টটার কথা আবেগ বুঝতে পারে, তবে সে মৃণালিনীকে তার ছোট জমিদারের সামনে না কাঁদিয়ে ছাড়বে না।

শুভ আর মাত্র এক মুহূর্ত দাঁড়ালো। তারপর “বিদায়” বলে মৃণালিনীকে পেছনে ফেলে রেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলল। তাকে বহুদূর যেতে হবে এখনো। মায়ার বাঁধনে জড়ালে তো আর চলে না। শুভ কাঁদলো না। কিন্তু তার চোখের কোণা ভিজেছে। সে চায় নি, শেষ সময়ে প্রিয় মানুষের চোখের সামনে দুর্বল হতে কিংবা কষ্ট উগরে দিতে।
মৃণালিনী আজ শুভর অস্থিত্ব টের পাচ্ছে তার বুকে। মাত্র কিছুদিনের মধ্যে কেমন বেশিরভাগ জায়গার দখল নিয়েছে সে পুরুষ। মৃণালিনীর মায়া বেরিয়ে আসতো কেবল তার সামনে। আজ তার সকল ঐশ্বর্য নিয়ে চলেছে শুভ নিজের সাথে। শুভর চলে যাওয়া আর দেখা হলো না মৃণালিনীর। ঝাপসা হয়ে গেলো মুহূর্তেই সবকিছু। কিছু কান্না জড়িত অস্পষ্ট শব্দ বেরিয়ে এলো তার মুখে, “নারীর সৌন্দর্য কেবল পুরুষের চোখেই। আর সর্বদা নির্দিষ্ট থাকে সে পুরুষ।”

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে