রক্তিম প্রান্তরে | কষ্টের গল্প

0
1294

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০

গল্প: রক্তিম প্রান্তরে
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
ক্যাটাগরি: কষ্টের গল্প
শব্দ সংখ্যা:১৯৯৪

শীতের প্রকোপে গ্রামগুলোতে জনজীবন বিপর্যস্ত। দিনের আলো কমে আসতেই ঝুপ করে নেমে আসে সন্ধ্যারানী। রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে শীতের প্রকোপ। বেড়ার ফাঁক গলে হু হু করে হিমেল হাওয়া ঢুকে পড়ে জীর্ণ, শীর্ণ মানুষগুলোর হাড়সুদ্ধ কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর উপর দিয়ে কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে বহমান হিমেল হাওয়ার উন্মত্ততায় হঠাৎ করেই গ্রাম্য কুটিরগুলো যেন থরথর করে কেঁপে উঠে।

এমনই এক হাড় কাঁপানো শীতের রাতে একটা ছেঁড়া পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে কুপির টিমটিমে আলোয় বারান্দায় বসানো মাটির চুলোয় রাতের রান্না বসিয়েছে শিউলি। গ্রামের বাজার থেকে কই মাছ কিনে এনেছে আলম। চুলোয় ভাত বসিয়ে দিয়ে, পিড়িতে বসে সেই মাছগুলোই কুটছে শিউলি। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। তাই পিড়িতে বসে কাজ করতে কষ্ট হয় তার। সকালে কাজে বেরোনোর আগে আলম আবদার করে বলেছিল, ‘বউ, কতদিন কই মাছ খাই না, আইজকা কই মাছের ঝোল দিয়া ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খামু।’

শিউলি নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকিয়েছিল, স্বামীর ছেলেমানুষিতে মনে মনে হাসে সে, তার স্বামী নামক মানুষটা যে বড্ড সরল।

মাছ কুটা-বাছা শেষে রাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে শিউলি।
গায়ে জড়ানো পাতলা চাদরটা আরও একটু টেনেটুনে আরাম করে বসে সে। মশালের মত জ্বলতে থাকা কুপির আলোয় শিউলিকে হঠাৎ স্বপ্নপুরীর কোন এক রহস্যময় মানবীর মত মনে হলো আলমের কাছে! যে রহস্যময় মানবীর প্রেমে বারেবারে উন্মত্ত হয়ে পড়ে আলম।

এই রহস্য মানবী যখন রাঁধতে ব্যস্ত তখন আলম অতীত স্মৃতি রোমন্থনে মশগুল হয়ে পড়ল।

বিত্ত-বৈভব আর ক্ষমতার বদৌলতে এই গ্রামে প্রচুর নাম ডাক আছে মির্জা ব্যাপারীর। এহেন কোনো খারাপ কাজ নাই, যা মির্জা সাহেব করেন না। ইয়াবা,মদ-গাজা থেকে শুরু করে মেয়ে মানুষের সঙ্গ লাভে মাতাল হওয়া সবটাই তার জন্য চাট্টিখানি ব্যাপার। আলম এই কুখ্যাত লোকের হয়েই কাজ করত।

শীতকালে এই এলাকায় বেশ জম-জমাট ব্যবসা হয়। গ্রামের গরিব মানুষগুলো একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরোয় না। কাছেরই একটা গ্রাম, সদ্য শহরে পরিণত হওয়ায় মাদক ব্যবসার রমরমা অবস্থা। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোও এই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ছিল।

মির্জা ব্যাপারীর মেয়ে মানুষের শরীরের গন্ধ না হলে ঠিক মতো ঘুম হয় না। তাই ঘরের বউ ফেলেও সে নিত্যনতুন নারী শরীরে সন্ধান করতে থাকে। মাদক বেচা-কেনার পাশাপাশি এই কাজটাও করে দিত আলম। এরকম কত শত মেয়ে মানুষ যে সে মির্জা ব্যাপারীর হাতে তুলে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তবে শিউলিকে তুলে দিতে পারেনি। শিউলির মায়া ভরা চোখ, কন্ঠে উপচে পড়া কাকুতি-মিনতির কাছে হার মেনেছিল তার পুরুষ হৃদয়, সেখানে বেজে উঠেছিল প্রণয়ের গীত।

আলমের বুকের ভেতর হঠাৎ করে জেগে ওঠা সেই প্রণয়ের জোরেই হয়তো মির্জা ব্যাপারীসহ সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিরাপদে বের করে এনেছিল শিউলিকে। এক অদম্য মায়ার জালে আটকে গিয়েছিল শিউলির সাথে, প্রথম দর্শনেই। তাই তাকে বসিয়েছে নিজের হৃদয়ের সিংহাসনে, বানিয়েছে মুকুটহীন রানী।

বুকের ভেতর সদ্য জাগ্রত উত্তাল প্রেমের অঞ্জলি, গ্রামের পাশ দিয়ে সর্পিল গতিতে বয়ে চলা নদীর বুকের অশান্ত জলে বিসর্জন দিয়ে আলম অবশ্য শিউলিকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সভ্য সমাজ তাকে গ্রহণ করেনি, না গ্রহণ করেছে তার পিতা-মাতা। ততদিনে শিউলির নামের সাথে জুড়ে গিয়েছিল নষ্টা উপাধি। যে উপাধি তাকে সমাজে অচ্ছুত করেছে, করেছে বর্জনীয় সকল আত্মীয়-স্বজনের কাছে। অথচ এই ষোড়শী মেয়েটিকে তার আপন চাচা নিজের নেশার খোরাক মেটাতে বিক্রি করে দিয়েছিল মাত্র দশ হাজার টাকার বিনিময়ে! তাই শিউলি নামের ষোড়শী মেয়েটি ফিরে এসেছিল আলমের হাত ধরে, অন্ধকার জগতের মাঝেই আলোর সন্ধান করতে, ধরা দিয়েছিল আলমের বুকে সদ্য জাগ্রত প্রণয়ের তরে। অবশেষে নদীর তীরে এক ছোট্ট কুটিরে গড়েছে নিজেদের সোনার সংসার। শিউলির মায়ায় জড়িয়ে আলম ছেড়ে দিয়েছিল সমস্ত অপকর্ম। তবুও পাপ পিছু ছাড়ল না।

হয়তো তাই আলম আর শিউলির সোনার সংসারেও নজর পড়েছে শকুনের। এই শকুন যে বড্ড ভয়ংকর। আলমের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে বারেবারে। অবশেষে সে তার প্রিয়তমা আর অনাগত সন্তানকে রক্ষা করতেই মির্জা ব্যাপারীর দেওয়া প্রস্তাবে রাজী হয়েছে।

শিউলির হাতের আলতো স্পর্শ পেয়ে আলম অতীত স্মৃতির ডালপালা গুটিয়ে নেয়। রাত গভীর হতেই খাবার শেষ করে উঠে বসল সে। তার কাজটা যে শীঘ্রই শেষ করতে হবে। শিউলি আলমের দু’হাত শক্ত করে ধরে রাখে, এক অজানা ভয়ে।

আলম সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে আদুরে গলায় বলল,
‘ও বউ, আইজকাই শেষ। আমাগো রাজ কইন্যার ভবিষ্যতের লাইগা এইডাই শ্যাষ কাম। তুই আমারে হাসিমুখে বিদায় দে, বউ।’

শিউলি ভয়ার্ত গলায় কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
‘আমার ডর করতাছে। তুমি কিন্তু আমারে কথা দিছিলা, এই কাম আর করবা না।’

‘হ, বউ। কথা দিছিলাম। তয়, তোর প্যাডে যে আমাগো সন্তান আইছে, তার লাইগা এই শেষ কামডা করনের অনুমতি দিয়া দে।’

শিউলি মুখ ভার করে রাখে। তার মন কু ডাকছে। কিন্তু তার স্বামী আলম তাকে বারংবার অনুরোধ করে যাচ্ছে। অভাবের সংসারে নতুন একজন অতিথি আসবে, সেই অতিথির জন্যই আলমের এই কাজে যাওয়া। তারপর তারা দু’জন বহুদূরে কোথাও গিয়ে নিজেদের টোনাটুনির সংসার পাতবে। যদিও শিউলি জানে, এইটা বাহানা মাত্র, তার স্বামী এই কাজটা বাধ্য হয়ে করছে।

আলম শিউউলির চিবুক ধরে মুখটা তুলে আলতোভাবে তার পেটে হাত রেখে বলল, ‘এই ল, আমাগো মাইয়্যারে ছুঁইয়া কইতাছি, আইজকাই শ্যাষ।’

আচমকা স্পর্শে শিউলি কেঁপে উঠে, লজ্জাবনত হয়ে অভিমানে কিছুটা দূরে সরে যায়। আলম শিউলিকে দূরে যেতে দেয় না, নিজের কাছে টেনে নেয়।

শিউলি আলমের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল, ‘মাইয়্যা হইব কেডায় কইছে? পোলাও তো হইতে পারে?’

‘না, আমার পরীর লাহান একটা মাইয়্যা হইব। বউ, তুই দেইখা লইস।’ আলমের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস।

‘হ, আপনেরে কইছে।’ শিউলি আবারও লজ্জা পায়। মুখ লুকায় আলমের প্রশস্ত বুকের মাঝে।

আলম শিউলিকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘চিন্তা কিয়ের বউ, আমি আছি তো।’

আলমের ভালোবাসাময় স্পর্শ পেয়েও শিউলির ভয় কাটে না। তার বুকে হাতুড়ি পেটা শব্দ অনুভূত হতে থাকে। এক অজানা আশঙ্কায় তার মন ক্রমে ভারাক্রান্ত হতে থাকে। অবশেষে বুকে পাথর চাপা দিয়ে মুখে অনিচ্ছাকৃত হাসি এনে সে আলমকে বিদায় দেয়। হারিকেনের মৃদু আলোয় শিউলির মুখখানা দেখে আলম তার প্রিয়তমার কপালে ভালোবাসার স্পর্শ না ছুঁইয়ে দিয়ে নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। আলমের স্পর্শ পেতেই শিউলি লজ্জাবতীর ন্যায় মাথা নিচু করে ফেলে, তার মুখে লজ্জারা ভর করে মুহূর্তেই। আলম তার এই লাজুক লতাকে শেষবারের মতো গভীর আলিঙ্গন করে বেরিয়ে পড়ে।

শৈত্য প্রবাহ চলছে। চারিদিকে হাড় কাঁপানো কনকনে শীত। কুয়াশার ঘন চাদরে ঢাকা পড়েছে যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত। আলম তার একমাত্র ছেঁড়া সোয়েটারটা গায়ে দিয়ে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

নৌকার গলুইয়ে বসে একটা সিগারেট ধরাল আলম। সিগারেটে সুখটান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অপেক্ষা করতে থাকে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্য। মদন মিয়া হাতে কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে আলমের নৌকার দিকে এগোতে এগোতে বলল,
‘ওই আলইম্যা, কাম ছাইড়া দিছস কিল্লিগা? বিয়া কইরা বউ পাগলা হইয়্যা গেছস! তয়, বউয়ের শাড়ির আঁচলের তলায় লুইক্যা থাকলে খাইবি কী?’

আলম বড়ো মুখ করে বলল, ‘এই নদীতে মাছের অভাব নাই, মাছ ধইরা খামু নাইলে শহরে যাইয়্যা কুলিগিরি করমু। তবুও আমি আর এই কামের মইধ্যে নাই। আইজকা বড়ো সাবের চাপে পইড়া কামডা করতাছি।’

‘বিয়া কইরা মুখে তো তর বুলি ফুটছে দেখতাছি। বড়ো সাবের সামনে এমুন পটর পটর করিছ না, নাইলে খবর আছে তর। এমনেই তর উপরে বড় সাবে খেইপা আছে।’ মদন মিয়া সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আলমকে সতর্ক করার ভঙ্গিতে বলল।

মদনের কথা পাত্তা দেয় না আলম। সে তার বউকে পাগলের মত ভালোবাসে। সেই ভালোবাসার জন্য, তার অনাগত সন্তানের মঙ্গলের জন্য তাকে এইসব খারাপ কাজ ছাড়তেই হবে। সে চায় না তার পাপের ছায়া তার অনাগত সন্তানের জীবনে পড়ুক।

হঠাৎ মদন মিয়া নিচু স্বরে বলে উঠল, ‘নদীর পাড়ে তিন চারডা ছোকরা মতন পোলা দ্যাখবি, ওগো হাতে হাতে এই প্যাকেট গুলান ধরাইয়া দিবি। তারপর আইয়া টেহা লইয়া যাইবি। আর বড় সাবের লগেও দেহা কইরা যাবি। এইডা বড়ো সাবের অর্ডার।’

আলম মাথা ঝাঁকায়। রাতের অন্ধকারে মদন তা দেখল কি না সেই জানে। আলম বৈঠা হাতে নৌকা চালায়। পাশের সদ্য গড়ে ওঠা শহরটাতে গেড়ে বসেছে নানান অপকর্মের আস্তানা। প্রশাসনের কড়া নজর আছে শহরের অলিতে-গলিতে। তাই এই শীতের রাতেও কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরাম না করে পুলিশ টহল করার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবুও আলম এই ঝুঁকিটা নিতে বাধ্য হয়েছে। নদীপথে যাত্রা শুরু করে।

আলমকে বিদায় দিয়ে মদন মিয়া আলমের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। এখন আসল কাজটা সেরে ফেলতে হবে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে সে বলল, ‘মির্জা ব্যাপারীর চোখ একবার যে মাইয়্যার উপর পড়ছে, তার আর রক্ষে নাই। এই লোক বড়োই নির্দয়।’ মনে মনে কথাগুলো আওড়িয়ে সে আপনমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

লুঙ্গির গোছ থেকে মোবাইল বের করে কল দেয় তার সাঙ্গপাঙ্গকে। শিউলির চোখে ঘুম নেই। একটু চোখ লেগে এলেই, কোনো না কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। নাম না জানা নিশাচর পাখিরা হঠাৎ করেই করুণ স্বরে ডেকে উঠে বারেবারে। আধো ঘুম আধো জাগরণে খুপড়ির বাইরের শুকনো পাতার মর্মর আওয়াজ পেয়ে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে শিউলি। তার মনে বড্ড ভয়। হঠাৎ দরজায় করাঘাত হলো। অবিকল আলমের মতো করে কেউ দরজায় করাঘাত করল। আর তাতেই শিউলি ভাবল, ‘এই বুঝি আলম এলো।’

হাতে হারিকেন নিয়ে দরজা খুলতেই মদন মিয়াকে একবার দেখে সে বলে উঠে, ‘আপনে কেডা? কারে চাইতেছেন?’

উত্তর জানা হলো না শিউলির, তার আগেই তার পৃথিবী জুড়ে অন্ধকার নেমে এলো।

আলম দ্রুত বৈঠা চালায়। একসময় দূর থেকেই কয়েকটা অবয়ব দেখতে পেল সে। মদনের দেওয়া বর্ণনার সাথে মোটামুটি মিলে যাচ্ছে বলে মনে হলো তার। আলম ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে দিতেই ওরা তার দিকে টর্চের আলো তাক করল। এতক্ষণ অন্ধকারের সাথে সয়ে আসা চোখ জোড়া আচমকা ফকফকা আলোতে যেন ঝলসে গেল। আলম চোখের সামনে ডান হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল। ঠিক তখনই চার-পাঁচ জন লোক নৌকা সার্চ করতে শুরু করল। কোনো প্রকার কসরত না করে পেয়েও গেল প্যাকেটগুলো। আলমের কাছে ব্যাপারটা তখন পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেছে। এটা পুরোটাই মির্জা ব্যাপারীর কারসাজি।

ঘটনা বুঝতে পেরেই সে তৎক্ষণাৎ নৌকা উল্টা দিকে ঘুরিয়ে দ্রুত হাতে নৌকা বাইতে লাগল। তার মাথায় একটা কথায় ঘুরছে, ‘পুলিশের হাতে ধরা পড়ন যাইত না, শিউলিরে লইয়্যা বহুত দূরে চইলা যামু।’

ভাগ্য সহায় হয়নি আলমের। পুলিশের গুলি তার শরীরে সগর্বে স্থান করে নেয়। তবুও আলম থামে না, শিউলির কাছে ছুটে যায় দুর্বার গতিতে।

শিউলির যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে নিজেকে
একটা সজ্জিত কুটিরে আবিষ্কার করল। বিছানায় একটা ধবধবে সাদা চাদর বিছানো। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল শিউলি।

মির্জা ব্যাপারী শকুনের চোখে তাকিয়ে আছে অন্তঃসত্ত্বা শিউলির দিকে। কয়েক প্যাক গিলেই তার নেশা যেন চড়ে গেল। লোভাতুর দৃষ্টি সংবরণ করা দুঃসহ ঠেকছে তার কাছে। শীতের এক ভোরে এই অষ্টাদশী রমণী মির্জার নজর কেড়েছিল, আলমকে টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়েও কোনো লাভ না হওয়ায় সে এই পথ বেছে নিল। পেট কিছুটা ফুলে আছে শিউলির। তার ভেতরে অন্য একটা প্রাণের অস্তিত্বের উপস্থিতির কথা বোঝা কঠিন কিছু নয়।

মির্জা ব্যাপারী শিউলির দিকে লালসার দৃষ্টি রেখেই আর এক প্যাক গিলে ফেলল। ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে গেল শিউলির দিকে। শিউলি আর্তনাদ করে বলে উঠল, ‘আল্লার দোহাই লাগে ভাইজান, আমার উপরে এই অবিচার কইরেন না। আমি পোয়াতি, আমার বাচ্চার লাইগা হইলেও আমারে ছাইড়া দেন।’

মির্জা ব্যাপারী দাঁতে দাঁত ঘষে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘চুপ কর শা***! আমি তর কোন জন্মের ভাই লাগি? ওই দুই ট্যাহার আলইম্যা আমার মুখের খাওন কাইড়া লইয়া সুখে ঘর করব আর আমি চাইয়া চাইয়া দেহুম। এইডা সে ভাবল কী কইরা?’
কথাগুলো বলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল শিউলির উপর।

শিউলির আর্তনাদ গুমড়ে মরে গেল তার ভেতরেই। মির্জা ব্যাপারীর হৃদয়ে তার ব্যথাতুর আর্তনাদের বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি। বিছানার ধবধবে সাদা চাদরখানি রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। সেই রক্তিম প্রান্তরে নিথর দেহে পড়ে আছে শিউলি, প্রাণপাখি বেরিয়ে গেছে নিঃশব্দে!

আলম পড়িমরি করে বাসায় এসে শিউলিকে খুঁজে না পেয়ে মরিয়া হয়ে উঠল। ঘরের অবস্থা দেখে তার আর বোঝার বাকি থাকল না শিউলি কোথায়। তার শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পড়তে চাইছে, চোখ দুটো চিরতরে বুজতে চাইছে, তবুও প্রাণপণে ছুটল সে, তার পরান পাখিকে খাঁচা থেকে মুক্ত করার তাগিদে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে বানানো সেই কুটিরের সামনে এসে যখন সে পৌঁছাল তখন শীতের কুয়াশার চাদরকে ভাঁজ করে তুলে রেখে সূয্যিমামার উদয় হয়েছে। অথচ আলমের শরীরটা আর চলতে চায় না। মুখ থুবড়ে লুটিয়ে পড়ল সেই কুটিরের দরজার সম্মুখে। বুকে ভর দিয়ে একটু একটু করে এগুলো সে। দূর থেকেই দেখতে পেল তার প্রিয়তমার মুখখানি। ভোরের মৃদু সোনালি আলো পড়েছে শিউলির মুখের উপরে। কী নিষ্পাপ দেখাচ্ছে তাকে! রক্তের তাজা স্রোত এখনও বয়ে যাচ্ছে।

পুলিশের গুলি খেয়ে এই এতদূর পথ এসেও তার প্রিয়তমার কাছে পৌঁছাতে পারবে না, এই অন্যায় হতে পারে না। আলম নিজের শরীরটাকে টানতে টানতে হামাগুড়ি দিয়ে বহু কষ্টে শিউলির কাছে গিয়ে বসল। নিজের কম্পিত হাত দিয়ে শিউলির মুখের উপর এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা চুলগুলোকে ঠিক করে দিল। ধবধবে সাদা বিছানার লাল রক্তের স্রোতে পরম মমতায় থরথর করে কাঁপতে থাকা হাত বুলিয়ে দিল একবার। পর মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ল শিউলির নিথর দেহের উপর। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘বউ, আমারে মাপ কইরা দে।’

আলমের প্রিয়তমা আজ রক্তিম প্রান্তরে চিরনিন্দ্রায় শায়িত…এই রক্তিম প্রান্তরে তার অনাগত সন্তানও নিঃশেষ হয়ে গেছে! জিতে গেছে ক্ষমতা, অর্থ আর অন্যায়কারীর লালসা। ক্ষমতার জোরে ওই নরকের কীট চরিতার্থ করতে সক্ষম হয়েছে নিজের অশুদ্ধ, নোংরা খায়েশ।

সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক মাটি দিয়ে তৈরী বিশেষ খাঁচা থেকে প্রাণপাখি উড়ে যাবার মুহূর্তে আলমের মনে হলো অন্তরালে মির্জা ব্যাপারী রুদ্ধশ্বাসে হেসে বলে উঠল ‘সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না।’

এভাবেই যেখানে ক্ষমতার কাছে সত্য হেরে যায়, বিচার সেখানে প্রহসন বৈ কিছুই নয়। রক্তিম প্রান্তরে বয়ে যায় এমন সহস্র রক্তিম স্রোতের ধারা…

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে