রাঙাবউ পর্ব -০২

0
912

#রাঙাবউ
অলিন্দ্রিয়া রুহি
পর্ব-০২

-আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে৷ এই জীবন রেখেই বা লাভ কী! এখন আমি কোথায় যাব? না ওই ভদ্রলোকের কাছে ফিরতে পারব, আর না মামা-মামীর কাছে। তিনটি বছর সম্পর্ক, অথচ মানুষ চিনতে এতবড় ভুল আমি কী করে করলাম! জীবন দিয়ে দেওয়া সত্যিই কী খুব সহজ? আমার যে সে সাহসটুকুও নেই…

আনমনে স্বগতোক্তি করছে মিঠি। নোনাধারার সাথে সাথে তার বুকটাও চিঁড়ে যাচ্ছে। ভেতরটা রক্তাক্ত, কিছুই মাথা আসছে না। মাথার উপর একটি ছাদ চাই, পেটে চাই খাবার। সে কোনো চাকরিও করে না, সঙ্গে তিন হাজার টাকা রয়েছে শুধু৷ যা পেয়েছিল বিয়ের সময়ে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে৷ এই টাকা দিয়ে কীইবা করতে পারে সে! কপালে হাত চাপড়ে ধূলো মাটিতেই বসে পড়ল মিঠি। শরীরটা থরথর করে কাঁপছে একই সঙ্গে। ভবিষ্যৎ কী, সবটাই অস্পষ্ট। অজানা এক ভয় জেঁকে বসেছে…

ভীষণ বিরক্তি নিয়ে একদলা থুতু ফেলল সজল পথের উপরে। সকাল সকাল মুডটাই নষ্ট। জীবনে অনেক মেয়ে দেখেছে কিন্তু এরকম সাহসী মেয়ে তার বাপের জন্মেও দেখেনি। একবার শুধু সজলের মুখ থেকে তার গ্রামের বাড়ির ব্যাপারে বৃত্তান্ত শুনেছিল, ঠিক খুঁজে খুঁজে চলে এসেছে! বেচারা সজল। সে কী করে জানবে প্রেমে পড়লে মানুষ ভয়ংকর সাহসী হয়ে ওঠে। তবে প্রেমটা হতে হয় সত্য। তার মতো ঠুনকো ভালোবাসার মানুষ তা বুঝতে না জীবনেও!

-এই সজল… এই…

বাদল ডেকে ওঠে। সজল পথের মাঝে দাঁড়াল। দূর থেকে বাদল, অভি, তমাল আসছে। এরা তিনজনেই সজলের কাছের বন্ধু। বলতে গেলে সজলের সব শয়তানির পার্টনার। বাদল বাদে বাকী দু’জনেই গ্রামে থাকে৷ পড়াশোনা তাদের দ্বারা হয়নি। একমাত্র বাদল এবং সজলই ঢাকায় পড়াশোনা করে।

সজলের কাছাকাছি এসে বাদল বলে উঠল,

-কীরে মামা, মেয়েটা কে রে? দেখে তো এই গ্রামের মনে হচ্ছে না।

-আমাদের থেইকা লুকাইয়া ভালোই কাম করতাছোস দেখি।

বলে খ্যাকখ্যাক করে হাসে তমাল। অভিও সায় দিলো। সজলের কপাল কুঁচকে আসে। মাছি তাড়াবার মতো হাত নাড়িয়ে সে বলে উঠে,

-একটা বিষ মামা!

মিঠির ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলল সজল। যা শুনে বাকী তিনজনের চোখজোড়া চকচক করে উঠল। বাদল চাপা স্বরে বলল,

-এরকম একটা মেয়েকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস? মনে হয় মজা শেষ মামা তোর…

-রাখ তোর মজা। আজ পর্যন্ত হাত ছাড়া আর কিছু ধরতে দিয়েছে নাকী আমাকে! সবসময় ন্যাকা সেজে বসে থাকত। বিয়ের আগে প্রেম করতে পারবে অথচ অন্যকিছু করা যাবে না। করলে তাকে পিপড়েতে কামড়াবে। যত্তসব!

সজলের বিরক্তির পাল্লা বাড়ছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিঠির ব্যাপারে কথা বলতেও অস্বস্তি লাগছে। অভি বাঁকা ঠোঁটে বলল,

-বলিস কী! এত বছরের রিলেশন, আর কিছুই করতে পারলি না ব্যাটা? তোর তো মইরা যাওয়া উচিত।

অভি হাসে। সজল মুখ দিয়ে ‘চ’ কারান্ত বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করল।

-বাদ দে তো। এখন যেটারে বিয়ে করব,সেটা এটার চেয়েও সুন্দর। তোরা তো দেখিস নাই। দেখলে বুঝতি..

-আমাদের আর বুঝাতে হবে না মাম্মাহ… মেয়েটাকে কী বলে আসছিস?

-বলছি ঢাকায় চলে যেতে।

-নাহ, এত তাড়াতাড়ি এত সুন্দর পাখিটাকে ছাড়া উচিত হয় নাই। আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে। যদি তুই রাজী হস, কয়েকটা দিন মজা করতে পারি আমরা…

বাদলের কী বুদ্ধি জানার জন্য উপস্থিত তিনজনকেই বেশ উৎসুক দেখা গেল। দূরে দাঁড়ানো মিঠির দিকে এক নজর চেয়ে বাদল বলতে লাগল তার বুদ্ধির কথা। যা শুনে সবার ভেতরেই উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র সজলের পিঠ দিয়ে একটা শীতল ঘাম ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল। সে কিছুতেই রাজী হলো না। অভি, তমাল দু’জনেই রাজী। তাদের জোরাজুরিতে এবং ভরসার কথা শুনে শেষমেশ সজলকেও রাজী হতে হলো।

____

বাদল বুঝালো, দেখ দোস্ত, খাচায় নিজ থেকে আসা পাখিকে তুই কেন ঠেলে বের করে দিবি,বল? এই বয়সে একটু মজা টজা না করলে কী বুড়ো বয়সে করবি? ওই মেয়ে যে এখানে এসেছে সেটা কী কাউকে বলে এসেছে? আসেনি তো! তাহলে আমরা ওর সাথে কী করলাম না করলাম,সেটা কে জানবে? আর ওকে একদম মেরে ফেলব না তো। কয়েকটা দিন একটু আনন্দ ফুর্তি করব তারপর যে যার পথে।

সজল শুকনো ঢোক গিলে বলল,

-কিন্তু ও যদি কাউকে বলে দেয়?

-দেলে দেবে। কী প্রমাণ থাকবে তার কাছে? আর আমরা কী তুলে নিয়ে এসেছি নাকী, মেয়ে নিজেই এসেছে! আমার কী মনে হয় জানিস, এই মেয়ে কাউকেই কিছু বলতে পারবে না। বললে তো নিজেই নিজের বেঁচে থাকা সম্মানটুকু নষ্ট করবে।

-আর যদি আত্মহত্যা করে?

-ধ্যাৎ! আত্মহত্যা করতে যাব কেন? আর করলে তো এখনও করবে। এই যে তুই ওকে ফিরিয়ে দিলি, ওর কী যাওয়ার কোনো জায়গা আছে এখন আর? আর না আছে কোনো মুখ দেখানোর উপায়! শোন, এখানে তুই একা না, আমরা সবাই আছি। যা হবে,ভেবে দেখব। কিন্তু হ্যাঁ, সুযোগ পেয়েও মূর্খের মতো হেলায় হারাতে আমি রাজী নই। কীরে অভি,তমাল- তোরা কিছু বলিস না কেন? তোরা রাজী আমার সাথে?

অভি,তমাল দু’জনেই মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালো,তারাও বাদলের দলে।

প্ল্যান মোতাবেক সজল উদগ্রীব মন নিয়ে মিঠির দিকে এগিয়ে গেল। মিঠি দূর থেকেই দেখেছে,সজলের সঙ্গে মিলে আরও তিনজন ছেলে কিছু একটা ফিসফিস করছে। তবে সেটা কী,সে টের পায়নি। কিন্তু সজলকে পুনরায় তার দিকে ফিরে আসতে দেখে খানিকটা হকচকিয়ে গেছে সে। কান্না ভুলে সজলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। মিঠির মুখপানে দাঁড়িয়ে সজল ইনিয়েবিনিয়ে বলল,

-আমি সরি মিঠি। আসলে আমি খুব শকড হয়ে গেছিলাম। তাই কী বলতে কী বলেছি, জানি না। আমার বন্ধুরা আমাকে বুঝিয়েছে তোমাকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়াটা উচিত না। সত্যিকারের ভালোবাসা নাকী সহজে পাওয়া যায় না। আর আমি পেয়েও কেন অবহেলায় হারাবো।

মিঠি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,

-এটা তোমার অভিনয় নয়তো সজল? তোমাকে কীভাবে বিশ্বাস করি আমি?

-দারুণ বোকা মেয়ে তো আপনি! এত কষ্ট করে ওকে বুঝালাম আর আপনি কীনা বিশ্বাস করতে চাইছেন না। ঠিক আছে, আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে না। আমরা চেয়েছিলাম, আজকেই আপনাদের বিয়ে দিয়ে তারপর সজলের বাসায় উঠিয়ে দিব। যত যাইহোক, ছেলেকে তো আর রাস্তায় ফেলতে পারবে না ওর বাবা-মা। কিন্তু আপনি যখন বিশ্বাস করতে চাইছেন না তখন কী করার আর? এই সজল, চলে আয়…

পেছন থেকে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো বাদল। সজলও একটা ইনোসেন্ট দুঃখী দুঃখী লুক দিয়ে বাদলের সঙ্গে হাটা দিলো। সাতপাঁচ ভাবার সময় পেল না মিঠি। দ্রুতই সজলকে থামালো এবং রাজী হয়ে গেল। এছাড়া আর কীইবা করার আছে। কোথায় যাবে সে? তার চেয়ে সজলের সঙ্গে থাকলেও একটা নিরাপদ ছাদ তো পাবে! তবে সজল তাকে যেসব বলেছে,তা এখনো ভুলে যাইনি মিঠি। শকড হয়ে করুক আর যেভাবেই করুক, মিঠির সঙ্গে বাজে আচরণের জন্য তাকে একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে মিঠি। একবার বিয়েটা হোক, তখন দেখে নেবে।
মিঠি নরম গলায় বলল,

-এখন আমরা কোথায় যাব তাহলে?

প্রত্যুত্তরে উপস্থিত চারজন কুমারের অধরে কুটিল হাসি ফুঁটে উঠল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে