রাঙাবউ পর্ব -১০(শেষ পর্ব)

0
1132

#রাঙাবউ
অলিন্দ্রিয়া রুহি
পর্ব-১০(শেষ পর্ব)
_____
একটা অচেনা নাম্বার থেকে বারবার ফোন আসছে। পকেটে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট করছে খুব। সজলের মেজাজ খিঁচে আছে। গত দুইদিন ধরে খুব চাপে আছে সে। পাত্রীপক্ষ থেকে হুট করে জানানো হয়েছে,মেয়ে কিছুতেই বিয়েতে রাজী হচ্ছে না। তাই তারা এই মুহূর্তে বিয়েটা দেওয়া ভালো মনে করছে না। অথচ আর পাঁচদিন পর বিয়ের তারিখ ছিল। সবকিছু বাজার করা শেষ, একটা বড় নাম্বারের মেহমান দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে। শেষ মুহূর্তে এসে এভাবে কেউ মানা করে দেয়! এটা কী ছেলে খেলা পেয়েছে নাকি? সজল নিজের রাগ থামাতে না পেরে দলবল নিয়ে গিয়ে হবু শ্বশুর বাড়ি ভাঙচুর করে এসেছে। সেই ভাঙচুর সামাল দেওয়ার সময় হবু শ্বশুর মশাই কিছু না বললেও পরবর্তীতে তার আপন শালা যে কীনা পুলিশের বড় অফিসার,তাকে ডেকে এনেছে। তার সামনে সজল ভেজা বিলাই। একদম নুইয়ে গেছে। সজলের বাবা অনেক হম্বিতম্বি করেছে,লাভ হয়নি। মেয়ের বাবা বললেন,

-আমি জানি আমাদের ভুল হইছে। কিন্তু এর জন্য একটা কিছু ব্যবস্থা আমি করতাম তো। কিন্তু আপনার ছেলে যে এভাবে এসে আমার বাড়িতে গন্ডগোল করে গেছে,আমাকে, আমার পরিবারের সবাইকে মারার হুমকি দিয়ে গেছে- এটা কী কোনো ভদ্রতার পরিচয় দিলো? ভাগ্য ভালো,বিয়েটা হয়নি। নইলে জানতাম কী করে আস্তো এক গুন্ডার হাতে মেয়েকে তুলে দিচ্ছি!

সেই মামা ওরফে বড় অফিসার বললেন,

-আপনার ছেলে যে ভুল করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। হয় ও’কে থানায় নিয়ে যাব আর নইলে যেসব জিনিস ভেঙেছে তার ক্ষতিপূরণ স্বরুপ দুই লক্ষ টাকা দিতে হবে। তাও তিনদিনের মধ্যে।

এসব নিয়ে হৈচৈ, হাঙ্গামা করে শেষতক আর লাভ হলো না কোনো। হাজতে ছেলেকে পাঠানোর মতো পাষাণ তো আর বাপ হতে পারে না। তাই শেষ সম্বল টুকুও দিয়ে দিলেন মেয়ের বাপের হাতে। এভাবে একটা মৌখিক মিটমাট হলো ঝামেলার। কিন্তু বাসায় নিয়ে প্রচুর ঝামেলা চলছে। সজলের বাবা সজলকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। এরকম মাস্তান ছেলের মুখটাও তিনি দেখতে চান না।এমনকি এর পড়াশোনা বাবদ আর একটা পয়সাও খরচ করবেন না,বলে দিয়েছেন। সজল গিয়ে মায়ের সামনে এই নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করল কতক্ষণ। সে জানে,মা সবসময় তাকে সাপোর্ট দিয়ে এসেছে এবং এবারেও দিবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মা-ও বললেন,

-বড় তো কম হস নাই। এখনো এরকম পাগলামি করলে চলে? তোর জন্য আর কতদিন নিজের সংসারে আগুন লাগাবো আমি? ভালো হয়,তুই চলে যা এখান থেকে। তর বাপের মাথা গরম। সেই মাথা যতদিন ঠান্ডা না হয়, ততদিন ঢাকায় গিয়ে থাক।

-ঢাকায় গিয়ে কই থাকব? টাকা ছাড়া এক ঘন্টাও চলে না ঢাকায়। টাকা কই পাবো?

-কেন?নিজে কামাই করবি। অনেক তো খাইলি আমাদেরটা, এবার তুইও কামাই করে আমাদের খাওয়া।তোর আরো ভাই-বোন আছে,ওদের কথাও চিন্তা করতে হবে আমাদের,নাকি?

সজলের মুখ দিয়ে অশ্লীল কিছু বাক্য বেরোতে গিয়েও থেমে গেল সে। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তেজী রোদ্দুরে মাঠে বসে রয়েছে দুই ঘন্টা যাবত। এখানেই চান্দি ফেটে মরলে মরুক সে। বাসায় যাবে না আর! একটা তিক্ততা গলায় ভরে উঠেছে। কিন্তু বারবার এই অচেনা নাম্বারটি থেকে ফোন আসায় সমস্ত মনোযোগ নষ্ট হলো। শেষমেশ টিকতে না পেরে,ফোনটা কানে তুলে নিলো সে। ঝংকার তুলে বলল,

-হ্যালো!

ওপাশ থেকে ভেসে এলো, অনেক দিনের পুরোনো, পরিচিত কণ্ঠস্বর।
মিঠি ভেজা গলায় ডাকলো,

-সজল।

সজল বিস্ময়ের চূড়ায়। মিঠি তাকে ফোন দিয়েছে! মেয়েটার কণ্ঠস্বর এমন শোনাচ্ছে কেন? কাঁদছে সে? কিন্তু কেন! আর কাঁদলেই বা তাকে ফোন দেওয়া লাগবে কেন? সজল অস্থিরতা অনুভব করল। তড়িঘড়ি করে বলল,

-মিঠি? মিঠি তুমি?

ওপাশ থেকে সেই ভেজা কণ্ঠ,

-হুম, আমি। চিনতে পেরেছো তাহলে…

সজল এই কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়ে,

-এতদিন পর,আমাকে?কী দরকার?

-সেদিনের জন্য ধন্যবাদ।

ঘামে জবজবে হয়ে উঠেছে তার শরীর। রোদের তীব্রতায় মুখমণ্ডল লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। গলার ভেতরে অসহনীয় তেষ্টা, জিভ জড়িয়ে আসছে। এরকম কঠিন পরিস্থিতিতেও হাসল সে।

-তুমি কিন্তু আমার জন্যই বিপদে পড়েছিলে।

মিঠি বলল,

-আবার তুমিই সাহায্য করেছিলে,তাই একটা ধন্যবাদে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু সেই একই বিপদে আবারও একজন পড়তে নিচ্ছে সজল। এবারও তোমার সাহায্য দরকার আমার। শুধু এই সাহায্যটা করে দাও,এরপর আর কোনোদিন তোমাকে ফোন করব না। কোনোদিন তোমার আর তোমার স্ত্রী’র ভেতর আসবো না। প্রমিস..

সজল ফিসফিস করে বলল,

-আমার বিয়েটাও ভেঙে গেছে মিঠি।

মিঠি শুনতে না পেয়ে শুধালো,

-কী বললে?

-উঁ, না, কিছু না। কীসের বিপদ,আর কী সাহায্য? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

-বলছি, সব বলছি।

বাদল এবং সিথির কথা তুললো মিঠি। খুলে বলল,কীভাবে আরও একটি মেয়েকে ফাঁসাতে চলেছে বাদল। সেদিন সিথির ওই প্রাণখোলা হাসিতেই মিঠি ভালোবাসার গন্ধ পেয়েছিল। সিথি মেয়েটা মন দিয়ে ভালোবাসলেও বাদল বাসবে না। দু’দিন ফূর্তি করে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে। তারপর মেয়েটার কী হবে? গুমরে গুমরে মরবে ভেতরে ভেতরে। ওদের কারণে মুনীফের বিবাহিত জীবনেও নানান সমস্যা তৈরি হতে পারে। কেননা বাদল যে তারই হবু স্ত্রীর আপন ভাই! ভাগ্য কত অদ্ভুত খেলা খেলতে পারে। কোথা থেকে কোথায় এনে দাবার গুটি চেলে দেয়! ভারী অবাক করা বিষয়। কিন্তু এইবার বাদলকে কিছুতেই জিততে দেওয়া যাবে না। ওর মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়ানক চেহারাটা সবার সামনে তুলে ধরতে পারলে,সিথি নিজের পবিত্র ভালোবাসা অপাত্রে তুলে দেবে না। বর্ষাও নিজের ভাইয়ের জন্য প্রাণপ্রিয় স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করবে না। একজন বাবা-মা সাবধান হয়ে যাবে ছেলের বিষয়ে। ছেলের জন্য অন্যকোনো মেয়ের জীবন নষ্ট হতেও দিবে না। কিন্তু কীভাবে প্রমাণ করবে মিঠি? তার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই যে বাদল একটা খুব খারাপ লোক! খুব ভাবার পর,সজলের নামটিই মাথায় এসেছে তার। যদি কেউ সাহায্য করতে পারে,তবে সেটা সজল। সজলও সেদিন উপস্থিত ছিল। সজল যদি সবাইকে সবটা বলে দেয়,তাহলে হয়তো বিশ্বাস করবে সবাই।

সব শুনে সজল মিনিট খানেক চুপচাপ রইলো। ওদিকে মিঠি বলে চলেছে,একটা বেদনায় ভরা কণ্ঠস্বর স্বগতোক্তি করছে,

-মুনীফ আমাকে বিশ্বাস করেননি। উল্টো তার ধারণা,তার বিয়ে ভাঙার জন্য আমি এইসব উল্টাপাল্টা কথা বলতেছি। সে আমার কাছে প্রমাণ চায়! আসলেই তো, আমার মতো চরিত্রহীন মেয়ের কথা কেইবা বিশ্বাস করবে? আমি পালিয়ে এসেছিলাম সবাইকে ফেলে। কারো কথা না ভেবে..আমার মত মেয়ে এই-ই তো ডিজার্ভ করে। বাদল যদি সেদিন আমার কোনো ক্ষতিও করত,তাও ওর কোনো দোষ থাকত না। কারণ ও ছেলে। আর আমি মেয়ে। মেয়ে হয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো দুঃসাহস যখন করতে পেরেছি,তখন তার ফল হিসেবে নিজের সব সম্পদ খুঁইয়ে আসাটা কিছু না। অন্তত এই সমাজের কাছে। এই সমাজে ধর্ষককে নয়,ধর্ষিতাকে কথা শোনানো হয়। নইলে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান,নিজের ঘরে ফিরেও কেন কোনো ধর্ষিতাকে আত্মহত্যার মতো জঘন্য একটা পথ বেছে নিতে হয়,বলতে পারো সজল?

সজল নিঃশ্বাস ছাড়লো।

-কিন্তু,আমি বললেও তারা কেউ কেন বিশ্বাস করতে চাইবে? বাদলের যে রূপ সে সবসময় দেখিয়ে আসে, ওটাকে বিশ্বাস করে সবাই। আর এই বিশ্বাসের গভীরতা অনেক! ওত গভীর বিশ্বাস ভাঙতে পারার সাধ্য আমাদের নেই। উল্টো আমি যদি যেয়ে এসব বলি, তবে সবাই তোমাকেই ভুল বুঝবে আরও। ভাববে,আমার সাথে তোমার সম্পর্ক আছে। তাই আমাকে দিয়ে তুমি এসব কথা বলাচ্ছো। ঘৃণার পাল্লাটা বেড়ে যাবে মিঠি। বাস্তবতা দিয়ে চিন্তা করো। সে যদি বিশ্বাস করত,একদিনের পরিচিত তোমার কথাই বিশ্বাস করত। আমাকে তো সে চেনেই না! আমাকে কেন বিশ্বাস করবে?

মিঠি চুপ করে রইলো। এভাবে সে ভেবে দেখেনি। সজল যা বলছে সত্যি। বাদলকে খারাপ প্রমাণিত করার জন্য চাই শক্তপোক্ত প্রমাণ। একেবারে হাতেনাতে ধরা যাকে বলে। কিন্তু এটা তো বাস্তবতা, কোনো নাটক কিংবা সিনেমা নয়! কীভাবে কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে মিঠি? যেই পরিস্থিতিতে বাদল নিজেই নিজের মুখোশ খুলে ফেলবে? সিথিকে সে এত দ্রুত নয়, ধীরে ধীরে ভোগ করবে। করতেই থাকবে,করতেই থাকবে। যখন বিয়ের প্রসঙ্গ আসবে,তখনই সরে যাবে। বাদল আর যাইহোক, এক নারীতে সন্তুষ্ট ওয়ালা ছেলে নয়। তাই একজনকে বিয়ে করেও সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার মতো চিন্তা সে করতেই পারে না। তবে কী মিঠি হেরে গেল? বাদলের মতো একটা ন-র-প-শু জিতে যাবে? মিঠির হাঁসফাঁস লাগছে। কী করলে,কোন উপায়ে বাদলের আসল চেহারা বের করে আনা যায় সবার সামনে! কেউ কী নেই তাকে সাহায্য করার মতো?
মিঠি চোখ মুদে বার কয়েক ভেবে দেখল,আসলেই কেউ নেই তাকে সাহায্য করার জন্য। ওপাশে সজলের গলা ভেসে উঠল। মিঠি নিস্পৃহ, তরঙ্গহীন গলায় বলল,

-রাখি আমি। ভালো থেকো।

-মিঠি শোনো.. মাঝে মাঝে শয়তানরা জিতে যায়। তোমাকে একটা উপদেশ দিই,এসবের মধ্যে জড়িয়ো না নিজেকে। নিজের ক্ষতি হবে।

মিঠি আনমনে ‘হুম’ বলে ফোন কেটে দিলো। তারপর ডুবে গেল গভীর চিন্তাভাবনায়। ভাবনার অলিগলিতে ঘুরেও শেষমেশ কোনো কিনারা করতে পারল না সে।

____

শহরের বুকে নিস্তব্ধ রাতটাকে ভীষণ একা মনে হয়। তাই হয়তো নিসঙ্গ ব্যক্তিরা রাতটাকে আপন করে নেয়। বারান্দায় নিশ্চুপ বসে নিকষ কালো আঁধারের পানে ড্যাবড্যাবে চোখজোড়া মেলে রেখেছে মুনীফ। তার মনের ভেতর অনেক প্রশ্নের ভীড়,একটারও উত্তর নেই। মিঠির কথাগুলো কানে বাজছে ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। বাদল কত অমায়িক! হাসিখুশি ছেলে। তার নামে এত বড় একটা কলঙ্ক কীভাবে লেপে দিলো মেয়েটা? কিন্তু বাদলকেই বা চিনে কীভাবে সে? মুনীফ নড়েচড়ে বসতেই উত্তর পেল, হয়তো মুনীফের বিয়ে হয়ে যাবে শুনে সে খোঁজখবর লাগিয়ে বাদলের ব্যাপারে জেনেছে এবং এই বিয়ে ভাঙতে এরকম একটি মিথ্যে অপবাদ রটনার চেষ্টা করছে। মেয়ে-ছেলে জড়িত ঘটনা গুলো খুব ভয়ানক হয় কীনা! প্রশ্নের উত্তর গুলো মাথায় আসতেই মুনীফের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কত খারাপ মিঠি! নিজেই তো ছেড়ে চলে গিয়েছে,আবার নিজেই এসে মুনীফের জীবনে জড়াতে চাইছে। যখন জড়াতে পারছে না,তখন মিথ্যে নাটকের মাধ্যমে আরও একটি ছেলের জীবন ধ্বংস করে দিতে চাইছে! মুনীফ যখন সাত-পাঁচ বিষয় গুলো ভাবছিল, ঠিক তখনই ফোন এলো। অচেনা নাম্বার। মুনীফ স্বাভাবিক কণ্ঠে ফোন ধরে বলল,

-আসসালামু আলাইকুম।

ওপাশ থেকে চাপা মিহি কণ্ঠে মিঠি জবাব দেয়,

-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আ…

বাকিটা বলার আগেই মুনীফ প্রায় হুংকারের স্বরে বলল,

-মিঠি!

মিঠি কী জবাব দিবে,ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইলো। মুনীফের রাগ আবারও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। সে কাটাকাটা গলায় বলল,

-মেয়ে তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি! কোন সাহসে আমাকে ফোন দিয়েছো তুমি??

-আমার কথাগুলো একবার বিশ্বাস করুন। আমি সত্যি বলছি। আপনার বোনের জীবন টা..

মিঠির মুখের কথা কেড়ে নিলো মুনীফ।

-আমার বোনের জীবন নিয়ে তোমাকে ভাবতে বলছে কে? আমি বলছি? লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমার জীবনটা আর নষ্ট কইরো না। আমি তোমাকে একবার ছেড়ে দিছি,দ্বিতীয় বার ছাড়বো না।

টুট টুট শব্দে ফোন কেটে গেল। মিঠি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশায় ডুবে গেল। রাতের বেলা মামা-মামী জোর করেও খাওয়াতে পারল না তাকে। একলা নিরবে বসে রইলো জানলার পাশটায়। কিছুতেই বাদলের হাত চেপে ধরার দৃশ্যটি ভুলতে পারছে না। মানসপটে কখনো সেই দৃশ্য উড়ে এসে আবার উড়ে চলে যায়। এরপর আসে সিথির সাথে বাদলের হেসে হেসে কথা বলার দৃশ্যটি। মিঠি নিজেকে কিছুতেই স্থির করতে পারে না। সে কী বেশিই ভাবছে,নাকি তার জায়গায় থাকলে প্রতিটি মেয়েই এমন করত কে জানে। বাদল শুধু তারই নয়,এর আগেও অনেকের সাথে এমন করেছে,এটা নিশ্চিত মিঠি। নইলে হুট করেই কেউ এত সাহস পায় না। আর শুধু সিথিই নয়,সামনে আরও অনেকের জীবন নষ্ট করতে চলেছে এই ছেলে। নাহ, নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না মিঠি। একটা অচেনা সত্তা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে তার মাঝে। পাপ ঘটাতে ইচ্ছে করছে,ভীষণ রকম করে। কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছে না সে। প্রায় মধ্যরাত এখন। মামা-মামী ঘুমিয়ে গেছেন। তাদের বড় মেয়ে,ছোট ছেলে- তারাও ঘুমিয়ে। মিঠি নিঃশব্দে উঠে এলো। একটা বড় কালো ওড়না দিয়ে নিজেকে ভালোমতো পেঁচিয়ে ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। উঠোনে নেমে এক মুহূর্ত থামলো। পেছন ঘুরে একবার তাকাল এতগুলো বছর কাটিয়ে আসা বাড়িটির দিকে। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। জীবনে আর যাই করুক,এই কাজটি না করলে কিছুতেই স্বস্তি মিলবে না। এটি যেন নৈতিক দায়িত্ব তার। একটি জা-নো-য়া-র কে চিরদিনের জন্য মুক্ত করে দেওয়া। তার ছো-ব-ল থেকে আরও অনেক মেয়েকে বাঁচানো। মিঠি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখজোড়া মুছে নিয়ে পথ চলতে শুরু করল।

____
বেশ রাত হয়ে গেছে। মোড়ের দোকানে রাতভর আড্ডা চলে বাদলের মতোই ভবঘুরে ছেলেপেলেদের। একজন আবার ক্যারামবোর্ড বসিয়েছে। জমজমাট আড্ডা। কখন যে রাত বেড়ে যায়,বোঝা যায় না। দুই পকেটে হাত গুঁজে ঠোঁট গোল করে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলছে বাদল। সেই সাথে মাথায় চলছে নানান চিন্তাভাবনা। আজকেও রিনি নামের এক মেয়ের সঙ্গে রুম ডেট করে এসেছে। শরীরটা বেশ চাঙ্গা লাগছে তাই। ক’দিন পর পর নতুন মৌমাছির সন্ধান করা যেন,বাদলের ফরজ কাজ! অবশ্য,তাকে এত বেশি বেগ পোহাতে হয় না। ইনোসেন্ট সাজার নাটকটা বেশ ভালোই রপ্ত করতে পেরেছে। আর মেয়েরাও! তার বাহ্যিক সাদা ত্বকের প্রেমে পড়তে দু-তিন ঘন্টার বেশি সময় নেয় না। বাদল বাঁশি বাজানো থামিয়ে হঠাৎ হেসে ওঠে। সিথি নামের বোকা মেয়েটা ইতিমধ্যেই তাকে নিয়ে আকাশকুসুম কল্পনা যে করে ফেলেছে,সেটাও জানে বাদল। করুক, আকাশকুসুম কল্পনা কখনো সত্যি হয় না। সিথিরও হবে না। মাঝখান দিয়ে বাদলকে কিছুদিনের জন্য তৃপ্তি দিবে,এই-ই…

আশেপাশে কেউ নেই,জনমানবহীন এলাকা যেন। বাদলের কখনো ভয় লাগে না। অন্ধকার পথ ধরেও দিব্যি হেঁটে চলে। আজ কেন যেন এই নির্জন পথটাকে বড় অচেনা মনে হতে লাগলো। একটা গা ছমছমে পরিবেশ। ভয় লাগছে! বাদল হঠাৎ থমকে গেল। পেছন ঘুরে বিদ্যুৎ গতিতে তাকিয়ে কী যেন খুঁজল,তারপর কিছুই নেই দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার পা বাড়ালো। হুট করে একটা বড় ইট তেড়ে এলো। পেছন দিক থেকে,বাদল দেখতেও পেল না। শুধু টের পেল,একটা তীব্র ব্যথা মাথার পেছন দিকটায়। হাত চাপা দিয়েই রক্তে ভরে উঠল। বাদল চমকে পেছন ফিরে তাকাতেই আরেকটা ইট এগিয়ে এলো। এটাও বেশ বড়,বাদলের মুখের একপাশ কিছুটা থেতলে গেল। অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল সে। তার আর্তনাদ কে ঢাকতেই বোধহয় দূরে কয়েকটি কুকুর একত্রে ঘেউঘেউ করে উঠল। সেই চিৎকারের ভেতর তার অস্ফুট আওয়াজ কেউ শুনতে পেল না। আর কেইবা শোনার জন্য বসে আছে এই মধ্য রাতে?

বাদল ভীতি চোখে তাকাল। অবাক হয়ে দেখল, এক মাস আগের আকুতি মিনতি করা সেই মেয়েটি আজ খোলা চুলে রণমুর্তি রূপ ধারণ করে এসেছে তার সামনে। সবচেয়ে ভয়ংকর কথা,ওর এক হাতে বড় সাইজের বটি। ও-ই কী ইট ছুঁড়ে মেরেছে? ঘটনা বেগতিক দেখে বাদল পেছন ঘুরে দৌড় দিলো। বেশি দূর যেতে পারল না। ছোট বেলায় ঢিল দিয়ে গাছ থেকে আম-লিচু মারা দক্ষ হাতের মেয়েটা পুটলির ভেতর থেকে বড় আরেকটি ইট বের করে ছুঁড়ে মেরেছে। এবারেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। বাদলের মাথার পেছনে এমনভাবে লেগেছে যে সে আর্তচিৎকার করে ওখানেই বসে পড়ল। সেই সুযোগে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে এলো মিঠি। একটা পা তুলে দিলো বাদলের পিঠের উপর। বটিটা ঘাড়ের কাছে ধরে জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। বাদল আকুতি করছে,ঠিক সেরকম ভাবে যেভাবে একদিন মিঠি করেছিল তার কাছে!

-মিঠি, আমায় মাফ করো মিঠি। আমি অনেক ভুল করছি, আমি অনুতপ্ত সেসবের জন্য। প্লিজ,আমাকে ছেড়ে দাও তুমি। প্লিজ মিঠি।

মিঠি নিচু হয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। বাদলের কানের কাছে,ফিসফিস করে বলল,

-তোর মতো প-শু কে মাফ করে দিলে আমি যে আমাকে মাফ করতে পারব না। আর তোর অনুতপ্ততা? হা হা হা..! মৃত্যুকে সচক্ষে দেখলে সবারই হুশ ফিরে আসে। কিন্তু আজরাইল কি সময় দিবে? আমিও দিবো না। তোর সময়,এখন,এই মুহূর্তেই শেষ..

বাদল হাউমাউ করে কেঁদে কিছু বলতে নিচ্ছিলো। তার আগেই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে,আগ্রাসী মেয়েটা ভয়াবহ কান্ড ঘটিয়ে ফেলল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো ঘাড় থেকে। মাথার অর্ধেকটা আলাদা হয়ে গেছে। দেহটা বার কয়েক ঝাকি দিয়ে থেমে গেল চিরতরে। মিঠি বসে পড়ল। ওড়নার আঁচল দিয়ে মুখে ছিঁটে আসা রক্ত ফোঁটা মুছে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। একদলা থুতু বাদলের নিথর শরীরটার উপর ফেলে যেভাবে নিঃশব্দে এসেছিল,সেভাবেই নিঃশব্দে যাত্রা করল।

____

তিন মাস পেরিয়েছে এরপর। ভোর বেলায় একজন পথচারী সর্বপ্রথম দেখতে পেয়েছিল বাদলের লাশ। সে-ই পুলিশকে খবর দিলে বাদলের পরিবার জানতে পারে,তাদের আদরের ধন আর পৃথিবীর বুকে নেই। পুলিশ জিজ্ঞেস করেছিল অবশ্য,

-আপনাদের ছেলে রাতে বাড়ি ফেরেনি,আর আপনারা কেউ একবারও খোঁজ করলেন না?

উত্তরে সবাই ইনিয়েবিনিয়ে বলেছে,

-ও প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফিরতো। আবার মাঝে মাঝে সকালে আসতো। এমনিতে ও ভালো, খারাপ কোনো অভ্যাস নাই। কিন্তু আড্ডাবাজ খুব,এই-ই।

সেই উত্তরে পুলিশ বুঝে নিয়েছে,বাদল কতটা ভালো মানুষ ছিল! বাদলের মৃত্যুর সংবাদ মিডিয়া প্রচার করলে ধীরে ধীরে সবাই জানতে পারে। তখন বেরিয়ে আসে আরেক সত্যতা৷ একটি, দুটি নয়, প্রায় জনা বিশেক মেয়ে জবানবন্দি দেয়, ওর মতো ছেলের মৃত্যু হয়ে ভালোই হয়েছে। আল্লাহ আমাদের মনের কথাটা শুনেছেন। মেয়েদের জীবন ধ্বংস করা ছাড়া আর কীইবা যোগ্যতা ছিল এই ছেলের? সিথি প্রথমে মুষড়ে পড়লেও এইসব মেয়েদের জবানবন্দি শুনে নিজেকে সামলে নিয়েছে। উপরন্তু আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছে,তার জীবন টা নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে গেছে বলে। পুলিশ অনেক হদিস করেও কোনো কিনারা না করতে পেরে এবং বিভিন্ন মেয়েদের জবানবন্দি শুনে, শেষে কেসটাই ক্লোজ করে দিলো। একটা খবিশ বিদায় নিয়েছে। তদন্ত দরকার পড়ে তখন,যখন কোনো ভালো মানুষের উপর অন্যায় হয়। এখানে একটা অন্যায়কারীই তার পাপের শাস্তি পেয়েছে,এখানে তদন্তের কিছু নেই!
বাদলের বন্ধুবান্ধবদেরও জিজ্ঞাসা করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। সজল মিঠির নাম একবারও উচ্চারণ করেনি। বলেনি তমাল ও অভিও। তবে তারা মিঠিকে বাঁচাতে বা মিঠির ব্যাপারটা ঢাকতে যে মুখ খুলেনি,এমন না। তারা নিজেদের বাঁচাতে সেই ব্যাপারটা চেপে গিয়েছে। পরে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ না বেরিয়ে যায়!

ধীরে ধীরে সবাই সবকিছু ভুলে,মেনে নিয়ে জীবনে এগোতে শুরু করে। অদ্ভুত সত্য হলো, কেউ কারো জন্য থেমে থাকে না। একজন মানুষ চলে গেলে তার জন্য শূন্যতা তৈরি হয় ঠিক, কিন্তু তাতে কারো জীবন, খাওয়াদাওয়া, নিত্যদিনের রুটিন পরিবর্তন হয়ে যায় না! বাদলকেও ভুলে বর্ষা মুনীফের হাত ধরে নতুন জীবনে পা বাড়িয়েছে। বাদলের বাবা-মাও ছেলের শোক ভুলে থাকার চেষ্টা করেন স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য। শুধু একজনের জীবন একটু থমকে গেছে। আর সে মুনীফ! সে জানে এই হত্যার পেছনে কার হাত, শুধু আফসোস হয়, মেয়েটাকে কেন বিশ্বাস করল না! মাঝে মাঝেই একাকী ফোনে আসা একটি ম্যাসেজের দিকে চেয়ে থাকে। যেদিন রাতে বাদল খুন হয়, সেদিন রাতেই ম্যাসেজটি এসেছিল। লিখা ছিল,

সময় ফুরিয়ে গেছে। অন্যায়ের বদলে অন্যায়কারী হয়েছি,আফসোস নেই তাতে। যে হাত আমাকে অপবিত্র করতে চেয়েছিল,সেই হাত আমি চিরতরে থামিয়ে দিতে পেরেছি,এতেই প্রশান্তি। শুধু একটাই আফসোস রয়ে যাবে। আপনার ‘রাঙাবউ’ হতে হতেও আর হয়ে উঠতে পারলাম না! থাক, বর্ষা ভাবিকে বলবেন, আপনার অন্তরের সমস্ত শূন্যতা যেন ধুয়ে মুছে দেয়। পারলে ক্ষমা করে দিবেন আমাকে..একাকী জীবনের পথে চললাম। আর কোনোদিন দেখা হবে না,জানি। তবে আমি আপনাকে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার আগে একবার দেখতে চাই। এই ইচ্ছেটা পূরণ হবে? জানি না…

মুনীফ শত শত বার ম্যাসেজ আসা নাম্বারটিতে ফোন দিয়ে বন্ধ পেয়েছে। গুগলে লোকেশন ট্র‍্যাক করেও কিছুই পায়নি। তবে এই ব্যাপারে মুনীফ কাউকে কিছু বলেনি। অনেক তো হলো, এবার ওই মেয়েটারও বিশ্রাম প্রয়োজন! কিন্তু মুনীফ ভাবে, মিঠি কোথায় হারিয়ে গেছে? সে কী আদৌও এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে পারছে? নাকি অভিমান করে নিজের জীবনটাও…! ভাবতে ভাবতে হাপিয়ে উঠে সে। তবুও কোনো প্রশ্নের উত্তর মেলে না।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে