মিষ্টার লেখক পর্ব-০৫

0
830

#মিষ্টার_লেখক(৫)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
[কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ]

নিজের সাথে নিজে এক প্রকার যুদ্ধ করে মহিন মেসেজটি সেন্ড করলো। এখন যেন একটু হালকা লাগছে নিজের কাছে নিজের‌ই। নিজের ফ্যামিলি মেম্বার ছাড়া অন্য কারো সাথে মনমালিন্য হলে সে কখনোই আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। ছোট থেকেই তার প্রচুর ইগো প্রবলেম আছে।যাকে বলে দাম্ভিকতা সম্পূর্ণ মানুষ।মহিন নিজেও জানে তার সবকিছুতেই ইগো বেশি।আর তাই আজো সে একজন পিউর সিঙ্গেল মানুষ।
এই কয়েকদিন প্রচুর পরিমাণে রেগে ছিল ইমা’র উপর।তাই ইমার সাথে কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। অবশ্য এর আরেকটি কারণ বিসিএস রিটেন এক্সাম।গতকাল মহিনের বিসিএস রিটেন এক্সাম হয়েছে। সবকিছু ভুলে পড়াশোনায় ফোকাস করেছে সে। পড়াশোনা নিয়ে ভিশন সিরিয়াস সে।সব কিছু কম্প্রমাইজ করলেও পড়াশোনা নিয়ে কোন কম্প্রমাইজ নেই। বাদবাকি সব কিছু ভুলে পড়াশোনায় মগ্ন হয়ে বসে থাকে এতো দিন।

অপরদিকে,
ইমা ফ্রিজস হয়ে বসে আছে।তার বুঝতে বাকি নেই মহিন ই ছিল এটা। ভাবতেই শরীর শিহরিত হচ্ছে। তখন রিহাব হৈ হুল্লোড় করতে করতে এসে বললো,
— ইমু তুই চলে গেলে তোর সব কিছু আমার হয়ে যাবে। কি মজা কি মজা! এমনকি তোর মোবাইল টা পর্যন্ত আমার হয়ে যাবে। আমি মোবাইল দিয়ে সাপিপ খানের গান দেখমু।

ইমা বিরক্ত ভরা কন্ঠে বললো,
— কতো বার বলবো,সাপিপ নয় সাকিব হবে।আর তোকে না বলেছি ঐসব গান টান শুনবি না।শুনিস না কেন আমার কথা?

রিহাব বিছানায় ধপাস করে শুয়ে বললো,
— আমার গান অনেক ভাল্লাগে তুই জানিস না? তুই তো বাড়িতে গান শুনতেই দিস না।তুই যখন চলে যাবি তখন আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান শুনতে পারুম বলে আনন্দের কোন শেষ থাকবো না।

ইমা কোমরে হাত রেখে বললো,
— আমি কোথাও যাচ্ছি নাকি আমিই জানি না আর তুই কিনা ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে দিলি?তোর দুষ্টুমি আনন্দে বালি! আমি কোথাও যাচ্ছি না মাথায় ঢুকিয়ে নে গর্দভ কোথাকার।

রিহাব এবার সিরিয়াস হয়ে বললো,
— আমি যে শুনলাম তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিয়ের কথা ক‌ইলো।
— তুই কি বড়দের কথাবার্তা আড়িপেতে শুনিস? বেয়াদব ছেলে কোথাকার ঘড়িতে কয়টা বাজে দেখেছিস?যা স্কুলে যা। তুই যে এভাবে ক্লাসের মাঝে বাড়িতে চলে আসিস তোকে স্যার ম্যামরা কিছু বলে না?
— বুঝতে হব্বে আমি কে? রিহাব খান!
— তবে রে…

এক ছুটে পালায় রিহাব। সাকিব খানের মতো সেও নিজেকে রিহাব খান বলে দাবি করে হা হা। এবার দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র সে। বাড়ির পাশে স্কুল বলে একটু পর পর ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চলে আসে। আর সাহারার থেকে টাকা চেয়ে নেয়। পড়াশোনার কোন খবর নেই তার সারাদিন শুধু দুষ্টামি করে বেড়ানো তার কাজ।
.
.
ইব্রাহিম খলিল মেয়েকে ডেকে পাঠান তার রুমে।ইমা গেলে বলেন,
— ছেলেটার বাবা কল করেছিলেন!

ইমা উৎসুক হয়ে তাকায় বাবার দিকে,তারা কি বলেছেন তা জানার কৌতূহল নিয়ে। ইব্রাহিম খলিল বলেন,
— তিনি বললেন, এতো দূর থেকে আসতে সময়ের ব্যাপার। সবাই নিজ নিজ কর্মস্থলে নিয়োজিত।তাই একটা ভালো দিন তারিখ ঠিক করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে তারা। তারিখটা তাঁরাই ঠিক করবে কারণ মহিনের হাসপাতাল থেকে ছুটির জন্য এক সপ্তাহ আগে থেকে দরখাস্ত করতে হবে। এখন আমাদের মতামত জানাতে বললেন। তুই কি বলিস মা?

সাহারা খাতুন বলে উঠলো,
— গরুর থেইকা জিজ্ঞাসা ক‌ইরা কি ঘাস দিমু? তুমি অরে জিজ্ঞাসা করো কেন?মেয়ে জামাইদের ক‌ইয়া তাদের জানায় দাও।

সাহারার কথায় খুব বিরক্ত হলেন ইব্রাহিম খলিল। তাই বললেন,
— আহ্ তুমি চুপ করে থাকো। বেশি কথা বলো কেন?মেয়ে সারাজীবন সংসার করবো। এখন মেয়ের মতামত না শুনে আমি তাদের বলি কি করে?
— হ আমি তো বেশি কথাই ক‌ই। তোমাগো কাছে আমার কোন মূল্য নাই। আমি কি তোমার মেয়ের খারাপ চাই?চাই না তো তাইলে আমাকে এমনে দূর ছাই করার মানে কি? আমি থাকতাম না তোমার সংসারে। আমি তো তোমাগো ভালো চাই না তাইলে থাকুম কেন?

সাহারা মনের সব কথা গলগল করে বলে দিয়ে বাহিরে বের হয়ে গেলেন। এতে ইমার খুব কষ্ট হয়।ইমা মাঝে মাঝে তার মাকে একদম চিনতে পারে না। খুব অপরিচিত মনে হয়।এই সামান্য ব্যাপারে এতো উত্তেজিত হ‌ওয়ার কোন মানে হয়? কোন বিষয় সহজ ভাবে নিতে পারেন না তিনি।এই এক সমস্যা তার।ইমা বাবা কে বললো,
— আব্বু তোমরা যেমন ভালো মনে করবে তেমনি করো। আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না।

তারপর নিজের রুমে চলে আসে ইমা।
তার বুক ফেটে কান্না আসছে,ভিশন কষ্ট হচ্ছে । তার পরিবার কে ছেড়ে অতো দূর থাকতে হবে ভেবেই বুকটা হাহাকারের প্রতিধ্বনি তুলছে অবিরাম। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজন।সব নতুনের ভিড়ে মেনে নিয়ে মানিয়ে নিতে পারবে তো সে? সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করে মন জয় করতে পারবে সে? তার ভুল ত্রুটি গুল শুধরে দিয়ে সুন্দর করে শিখিয়ে দিবে তো তারা?
এত সব ভেবে মনে ভয় জাগে ইমার।
.
.
বিয়ের দিন শুক্রবার ধার্য করা হয়েছে। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে।পারা-প্রতিবেশিতে আত্মীয় স্বজনে বাড়ি মুখরিত হয়ে উঠেছে।
ইমা তার বান্ধবীদের ও নিমন্ত্রণ করেছে। তার মধ্যে কয়েকজন এসেছে।
ইমা’র বান্ধবী রিতা বললো,
— আমি শুনেছি রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে বিয়েতে খরচ যত কম, সেই বিয়েতে বরকত তত বেশি।’ এই হাদিস কতটুকু সঠিক? আর বিয়ের অনুষ্ঠানে খরচ সম্পর্কে রাসূল (সা.) কী বলেছেন?

এর উত্তরে ইমা বললো,
— আসলে বিয়েতে খরচ অতিরিক্ত করা বা বড় ধরনের আড়ম্বর করা, মানে অপচয় করে অন্য রকম একটা অবস্থা তৈরি করা, এটি আল্লাহর রাসূল (সা.) সুন্নাহর পরিপন্থী। আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর দেখানো পথ এবং নির্দেশনা পরিপন্থী; বরং রাসূল (সা.) যেটা বলেছেন সেটা হচ্ছে, সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে হচ্ছে সেটি, যেখানে খরচ কম হয়ে থাকে।

কম খরচ বলতে মূলত এখানে যেটা বোঝানো হয়েছে সেটা হলো, একজন ব্যক্তির সামর্থ্য রয়েছে, সে সামর্থ্য অনুযায়ী লোকদের আপ্যায়ন করবে বা মেহমানদারি করবে। এটাই হচ্ছে কম খরচ। কিন্তু কম খরচ বলতে এটা বোঝায় না যে একেবারেই খরচ না করা, যেটাকে কৃপণতা বলা হয়ে থাকে। মানে লোকদের খাওয়ালেন না, আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দিলেন না, বিয়ে হয়েছে জানালেন না, তাহলে এটা সৌন্দর্যের পরিপন্থী। কিন্তু বিয়ের মধ্যে সৌন্দর্যকে এবং বিয়ের কথা প্রচার-প্রকাশ করাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আবার এ ক্ষেত্রে সামাজিক সংস্কৃতির বিষয়ও আছে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তির অনেক সামর্থ্য আছে। তিনি অপচয় না করার ব্যাখ্যাতে গিয়ে এক কেজি ভালো খেজুর কিনে মসজিদে গিয়ে বিয়ে পড়িয়ে ফেললেন। এটা কম খরচ নয়, এটা কৃপণতা। এর চেয়ে তিনি যদি বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁর আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গরিবদের দাওয়াত করে সুন্দরভাবে খাওয়ান এবং অপচয় না করেন, সেটাই উত্তম হবে।
.
.
যথাসময়ে বরযাত্রী উপস্থিত হলো।
তাঁরা এসেই মেয়ের সাজগোজের সমস্ত জিনিসপত্র দেয়। তারপর ইমার বোনেরা আর মামিরা মিলে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। সাজানো হলে বরযাত্রী দের সাথে আসা মেয়েরা ইমাকে দেখতে যায়।আর ছেলেদের ছেলেদের ইমার রুমে যাওয়া নিষেধ তা মহিন কড়া নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে।তার অর্ধাঙ্গিনীর পর্দার সু- রক্ষার ব্যবস্থা তো তাকেই করতে হবে নাকি।যার কারণে এতো গুলো দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল সে। এখন তো অন্য পুরুষদের সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না কখনোই।

মহিনের ছোট বোন মোহনা ইমাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
— আমি তোমার দুই মাত্র ননদিনী বুঝলে ভাবীমুনি?

তার প্রতি উত্তরে মিষ্টি হাসে ইমা। বিয়ের বেনারসী প্লাস ভারি মেকআপ এ ইমার সুন্দর্যৌ দ্বিগুন হতে তিন গুণ ছড়িয়ে পড়েছে।ভারি মিষ্টি লাগছে মা শা আল্লাহ।মহিন দেখলে হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।

মোহনার খুব পছন্দ হয়েছে তার ভাইয়ের বউ কে। মনে মনে বলে, ভাইয়ার পছন্দ আছে বলতেই হবে। না হয় খুলনা থেকে এই সুদূর জেলা চাঁদপুরে চলে আসে বিয়ে করতে! তার রহস্য উন্মোচন এবার ঠাহর করতে পারলো মোহনা।
.
অতঃপর,
কাজী যখন কবুল বলতে বললেন তখন মাথা নিচু করে বসে রইল ইমা।দশ মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ কবুল বলার কোন খবর নেই। সবাই রিতিমত নির্বাক হয়ে যায়। একেকজন বলতে শুরু করলো,ইমা বোন বলে দে সবাই অপেক্ষা করছে।
এদিকে ইমার বুক ফেটে কান্না আসছে ভিশন। কিছুতেই মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না!এ এক যন্ত্রনা ।যে বা যারা এই মুহূর্ত অতিক্রম করেছে একমাত্র তারাই জানে মুহূর্তটা কতটা যন্ত্রনার হয়।
মহিনের বড় বোন মিলি গিয়ে মহিন কে বললো,
— যে মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছিস সেই মেয়ে আদৌও বিয়েতে রাজি আছে তো?

এই মুহূর্তে এসে বড় বোনের এমন ধারা কথা শুনে ঘটনার কিছুই ঠাহর করতে পারে না মহিন। তখন জিজ্ঞাসা করলো আপু তুমি এমন কেন বলছো আমি বুঝতে পারছি না কিছুই!প্লিজ ক্লিয়ার করে বলবে কি হয়েছে?

মিলি চোখ মুখে কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো,
— মেয়ে তো এখনো অবধি কবুল বলছে না। কাজী সাহেব সেই কখন থেকে বলে যাচ্ছেন অথচ কবুল বলার কোন নাম গন্ধ নেই।এ কেমন মেয়ে বিয়ে করতে চলে এসেছিস তুই? মেয়ের সম্পর্কে ঠিক মত খবর নিয়েছিস তো? আবার অন্য কোথাও সম্পর্কে জড়িত…

সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করার পূর্বেই মহিন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দাঁড়িয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য ইমার রুমে যাওয়া!
যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাবে তখন সবার আলহামদুলিল্লাহ প্রতিধ্বনি শুনতে পায় মহিন। এবং অন্যান্য দের কথায় বুঝতে পারে ইমা কবুল বলেছে। তখন পুনরায় এসে বসে পরে।
তারপর ছেলের কে বলা হলে সে দুই মিনিটের মাথায় কবুল বলে দেয়। তারপর সবাই মোনাজাত ধরে দো’আর মাধ্যমে বিয়ে সম্পূর্ণ হয় আলহামদুলিল্লাহ।

অতো দূর থেকে আসায় বরযাত্রীদের আজকের রাতটা থেকে যাওয়ার জন্য বলা হয়। কিন্তু তারা এতো মানুষ নিয়ে থাকাটা ঝামেলা হবে ভেবে থাকবে না বললো।তাই ইব্রাহিম খলিল আর জোর করলেন না।যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

আসার সময় বরের গাড়িতে অন্যরা আসলেও যাওয়ার সময় মহিন নির্দেশ দিল সে আর তার বউ শুধু এক গাড়িতে যাবে। বাকিরা অন্য গাড়িতে। সেরকম ভাবেই র‌ওনা হলো সামনে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে আর পিছনে মহিন আর ইমা বসেছে।
ত্রিশ মিনিটের উপর পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ ইমার কান্না থামাথামির নাম নেই।তাই মহিন আলতো হাতে ইমার ডান হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে….

#চলবে… ইনশা আল্লাহ ‌।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে