মাতাল হাওয়া পর্ব-৮+৯

0
216

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব- ৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

লিখনের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে ৯ টা বেজে গেল আজ। বাসায় ফিরার সময় দুই কেজি ওজনের একটা বয়লার মুরগী নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে। ভাইকে এই অসময়ে মুরগী সমেত বাড়ি ফিরতে দেখে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-কিরে অসময়ে মুরগী কেন?

-তোমার হাতের চিকেন বিরিয়ানী খাইতে মন চাচ্ছে আপা। তাই নিয়ে আসলাম।

-তুই টাকা কই পাইলি?

-বৃষ্টির আম্মু বেতন দিয়ে দিছে।

-তাও তুই আনতে গেলি কেন? আমাকে ফোন দিয়ে বলতি আমি আসার সময় নিয়ে আসতাম। এতক্ষণে রান্নাও হয়ে যাইতো তাহলে।

-তোমাকে পাইলে না বলবো?

-মানে!

-মানে তোমার ফোন! বন্ধ ছিল কল দিয়ে পাই নাই।

-ওহ! সারাদিন কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কখন ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে বলতে পারি না।

-চার্জ শেষ হয়ে গেছে না বইলা বলো তোমার ফোনের চার্জ থাকে না। কতদিন ধরে বলতেছি এই নষ্ট ফোনটারে বাদ দিয়ে একটা নতুন ফোন কিনো।

-দরকার হইলে কিনবো। এখন এটাই ভালো চলতেছে।

-চলতেছে না তুমি জোর করে চালাইতেছো আপা। এই মাসে অন্তত একটা ফোন কিনো। এক মাস নাহয় আমরা একটু কম খাইলাম।

-তুই যা তো গিয়ে ফ্রেশ হ। গোসল কর গিয়ে।

-এখন তো আমাকে ভাগাবাই দরকারী কথা বলতেছি যে।

-হইছে বুঝছি তো।

লিখন চলে যেতে নিয়ে থেমে গিয়ে আরও বলে,

-আপা তোমার কষ্ট না হইলে আজকেই বিরিয়ানি রান্না কইরো। আর আলু দিও বেশি করে।

-আচ্ছা, রানতেছি।

লিখনটা এমনই। প্রতিদিন তিনবেলা তাকে বিরিয়ানি দিলে তার চাইতে খুশি কেউ হবে না। এনড্রয়েডের নামে একটা একদমই নরমাল মোবাইল চালায় চিত্রলেখা। তাও চার বছরের অধিক সময় হয়ে গেছে সে মোবাইল ফোনটা ব্যবহার করছে। মাঝে একবার ব্যাটারি বদলে নিয়েছিল। আট/দশ হাজার টাকা দামের একটা ফোন কতদিনই বা সার্ভিস দিবে! আরও আগেই বদলে নেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চিত্রলেখা কখনই নিজের প্রয়োজনগুলোকে প্রায়োরেটি দেয়নি। তাই কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। তবে চিত্রলেখা চাইলেই দু/তিন ‘মাস কিছু টাকা সাইড করেই একটা মোটামোটি ভালো ব্রান্ডের ও দামের ফোন কিনতে পারে। কিন্তু নিজের প্রয়োজনে সে তা করবে না।

বিরিয়ানী দমে বসিয়ে রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে চিত্রলেখা। ড্রইং রুমে নারগিস বেগম সহ বাকিরা সবাই মিলে টেলিভিশন দেখতে ব্যস্ত। চিত্রলেখাকে এগিয়ে আসতে দেখে নারগিস বেগম বলেন,

-আয় মা আমার সাথে বোস।

চিত্রলেখা এগিয়ে গিয়ে খালার পাশে বসতেই তিনি মেয়ের মুখ নিজের আঁচল দিয়ে মুছে দিয়ে বলেন,

-ঘরে বাইরে এত কাজ করলে তো অসুস্থ হয়ে যাবি মা।

-হবো না খালা। আর মাঝেমধ্যে একটু অসুস্থ হইলেও দোষ নাই। কিন্তু তুমি তো জানোই আমি সহজে অসুস্থ হই না।

নারগিস বেগম আরও কিছু বলতেন কিন্তু তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে লিখন চিত্রলেখাকে জিজ্ঞেস করে,

-আপা আজকে কি তোমার মামুনের ভাইয়ের সাথে দেখা হইছিল নাকি?

চিত্রলেখা জবাব দেয়ার আগে নারগিস বেগম জিজ্ঞেস করেন,

-কেন! মামুন আবার কি করলো?

-বাসায় আসার সময় দেখা হইছিল বলল আপার কথা। কি বলছে আপা মামুন ভাই তোমারে?

-ঐ পুরান প্যাঁচালই। নতুন কিছু না।

-বিয়ের কথা?

-হুম।

-তবে আপা একটা কথা কিন্তু সত্যি মামুন ভাই সত্যি সত্যি তোমারে অনেক ভালোবাসে। মামুন ভাই কেবল লেখাপড়াটাই কম করছে তোমার থেকে এছাড়া মানুষ হিসেবে কিন্তু অনেক ভালো।

-তুই হঠাৎ আজ মামুনের প্যাঁচাল শুরু করলি কেন? মতলব কি তোর?

-তুমি চাইলে মামুন ভাইয়ের প্রস্তাবের কথা ভাবতে পারো।

-আর কোনো গান নাই তোদের?

লিখনকে সমর্থন করে নারগিস বেগম বলেন,

-মামুনের মাও তোরে অনেক পছন্দ করে।

-খালা এখন তুমিও শুরু হয়ে যাইও না। আমার অনেক ক্লান্ত লাগতেছে, বিরিয়ানি দমে আছে ওদের খাইতে দিয়ে দিও। আমি গেলাম, ঘুমাবো।

-ঘুমাবো মানে? তুই খাবি না?

-আমার খুদা নাই খালা।

-খালি পেটে ঘুমাবি?

-এই পৃথিবীতে আমি একা না খালা। খোঁজ নিয়ে দেখো গিয়ে হাজার হাজার মানুষ খালি পেটে ঘুমাচ্ছে।

আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চিত্রলেখা নিজের ঘরে চলে যায় বিশ্রাম করতে। সারাদিন অফিসের পর বাসায় এসে একগাধা কাজের পর ভীষণ ক্লান্ত সে।

—————————————————————————–

রওনক আগেরদিন রাতে বেরিয়ে গিয়ে অনেক দেরিতে বাসায় ফিরেছিল। রাতে আর কারো সঙ্গে তার দেখা হয়নি। আজ সকাল সকাল ডাইনিং টেবিলে আসতেই রওনক দেখে সবাই থাকলেও দিলারা জামান নেই। জাহানারা রওনকে চা ঢেলে দিতে থাকলে সে জিজ্ঞেস করে,

-মা কই খালা?

-আপা তো তার ঘরে।

-নাস্তা করবে না?

-ডাকতে গিয়েছিলাম কিন্তু দরজা খুললেন না৷ রাতে তুমি চলে যাওয়ার পর নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে বসেছেন। এখনো বের হয়ে আসেননি।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রওনক বলে,

-থাক খালা, মাকে আপাতত ঘাটার দরকার নেই। একা থাকুক মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে।

জাহানারা এই বাড়িতে অনেক বছর ধরে আছেন। রওনক উনার হাতেই বড় হয়েছে। এই বাড়ির সবকিছুর দেখাশুনা জাহানারাই করেন। মূলত দিলারা জামানের দূর সম্পর্কের বোন হয়। যার নিজের বলতে কেউ নেই এই পৃথিবীতে। অল্প বয়সে স্বামী মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করেননি। কোনো সন্তানও নেই। নিঃসঙ্গ জাহানারাকে দিলারা জামান নিয়ে এসেছেন নিজের কাছে। তখন থেকে তিনি এই বাড়িতেই থাকেন। রওনক উনার কাছেই মানুষ হয়েছে। রওনকের বাবাও নিজের বোনের মতোই আদর করতেই জাহানারাকে। রাদিন, তানিয়াও যথেষ্ট সম্মান কারে উনাকে, ভালোওবাসে।
তানিয়া রওনককে জিজ্ঞেস করে,

-বাই দ্যা ওয়ে রাতে কোথায় গিয়েছিলে রওনক?

-বলেই তো গিয়েছিলাম ভাবী ফ্রেন্ডের সাথে প্ল্যান ছিল।

-আগে তো শুনিনি, সাবা আর ওর বাবা-মাকে দেখে সাডেনলি প্ল্যান হয়ে গেল।

এই বিষয়ে আর কথা বাড়ায় না রওনক। প্রয়োজনের বাইরে কথা বলতে সে এমনিও পছন্দ করে না। নাস্তা শেষ করে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।

প্রতিদিনের মতো আজও সময় মতো অফিসে চলে এসেছে চিত্রলেখা। ডেস্কে বসে নিজের প্রায় বন্ধ হয়ে যাই যাই করতে থাকা ফোনটা চার্জে লাগাতে ব্যস্ত হয়। তখনই অফিসে প্রবেশ করে রওনক। নিজের কেবিনে প্রবেশ করতে নিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় সে। পেছন ঘুরে তাকায় চিত্রলেখার দিকে। ডেস্কের নিচের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় তার দেখা জুতটাই আজ চিত্রলেখার পায়ে। তা দেখে রওনকের চোয়াল জুড়ে সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটলো যেন। চিত্রলেখা তখনও রওনককে দেখতে পায়নি। পেছন ফিরে ছিল বলে দেখতে পায়নি। মোবাইল চার্জে লাগিয়ে পেছন ঘুরতেই সে দেখতে পায় রওনক দাঁড়িয়ে আছে তার কেবিনের দরজার ঠিক সামনে। আচমকা রওনককে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। সালাম দিয়ে বলে,

-আজ লাবিব সাহেবের আসতে দেরি হবে।

-জানি।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রওনক আরও বলে,

-একটু পরে একটা মিটিং আছে আমার। এক কাপ চা খেয়ে বের হবো। লাবিবের আসতে দেরি হবে তাই তুমি চলো আমার সঙ্গে।

-আমি! (অবাক হয় চিত্রলেখা)

-হ্যাঁ তুমি। এনি প্রবলেম?

-না, মানে আসলে আমার গেটআপ মিটিংয়ে যাওয়ার মতো কিনা তাই…

রওনক দু কদম এগিয়ে এসে একবার চিত্রলেখাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে,

-ঠিকই তো আছে।

-আসলে…

-ইউ আর লুকিং ফাই। এক কাপ চা প্লিজ তারপর বের হবো আমরা।

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা আর কিছু বলে না। রওনকও আর না দাঁড়িয়ে নিজের কেবিনে চলে যায়। চিত্রলেখা আরেকবার নিজেকে দেখে নেয়। তার পরনে আহামরি কিছু নয়। প্রতিদিন যেমন সাধারণ পরিধানে আসে আজও তাই। হাতের কাজ করা থ্রি-পিস পরনে। বেশি চিন্তা ভাবনা না করে এগিয়ে গিয়ে চা বানায় রওনকের জন্য।

দশটার দিকে ওরা বেরিয়ে পরে মিটিংয়ের জন্য। লিফটের কাছে আসতেই চিত্রলেখা বলে,

-আপনি লিফটে চলে যান আমি সিড়ি দিয়ে আসছি।

-কেনো?

-না মানে এমনি।

-তুমি লিফট রেখে সিড়ি দিয়ে নামবে তাও নয় তলা থেকে?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা।

-সমস্যা কোথায়?

-কোনো সমস্যা নেই।

-অবশ্যই সমস্যা আছে। স্বাভাবিক মানুষ এমনটা করবে বলে আমার মনে হয় না।

-না মানে আসলে…

চিত্রলেখা নিজের কথা শেষ করতে পারে না। তখনই নিচ থেকে লিফট চলে এসেছে। রওনক আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আচমকাই চিত্রলেখার একটা হাত ধরে তাকে টেনে সঙ্গে নিয়ে লিফটে উঠে পড়ে। চিত্রলেখা আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। লিফট নিচে যেতে শুরু করলে চুপচাপ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কতক্ষণে সে লিফট থেকে বের হবে সেই অপেক্ষা। চিত্রলেখার কোনো কিছুতেই কোনো ধরনের সমস্যা নেই কেবল মাত্র দুটো বিষয় ছাড়া। তন্মধ্যে একটা হচ্ছে বন্ধ জায়গার ফবিয়া। বন্ধ জায়গায় এক মিনিটও থাকতে পারে না সে। বলে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। চিত্রলেখার হয়েছে একই দশা। সে মনে মনে ভাবছে কতক্ষণে লিফন নিচে নেমে দরজা খুলবে আর তখনই দু’ ফ্লোর নামতে না নামতেই আচমকা লিফটটা থেমে যায়। হয়ত কারেন্ট চলে গেছে। অফিস বিল্ডিংয়ে জেনারেটর আছে যেকোনো মুহূর্তেই লিফট আবার চলতে শুরু করবে। কিন্তু আচমকা লিফট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘাবড়ে যায় চিত্রলেখা। ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কি হলো?

-ভয় পাওয়ার কিছু নেই। হয়ত ইলিকট্রিসিটি চলে গেছে এক্ষুনি জেনারেটর অন হয়ে যাবে। ইটস ওকে।

রওনক ইটস ওকে বললেও চিত্রলেখা শান্ত হতে পারে না। অন্ধকারে মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। তাড়াহুড়ো করে নিজের ব্যাগ থেকে ফোন বের করে চিত্রলেখা লাইট অন করতে। এখনো জেনারেটর অন হয়নি। তাড়াহুড়োয় চিত্রলেখার হাত থেকে ফোনটা পরে যায়। অন্ধকারে সে হাতড়েও ফোনটা খুঁজে পায় না। রওনক নিজের ফোন বের করে লাইন জ্বালাতেই দেখতে পায় চিত্রলেখা নিচে বসে তার ফোন খুঁজছে। কিন্তু ফোনটার অলরেডি ব্যাক সাইড খুলে ব্যাটারি বেরিয়ে গেছে। সে লাগানোর চেষ্টা করলে রওনক বলে,

-আমাকে দাও আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।

চিত্রলেখা উঠে দাঁড়ালে রওনক তার দিকে লাইট দিতেই খেয়াল করে এরই মধ্যে চিত্রলেখা ঘেমে গেছে অনেকখানি। এমনকি সে খানিকটা কাঁপছেও। চিত্রলেখার এমন অবস্থা দেখে ব্যস্ত কন্ঠে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-আর ইউ অলরাইট?

-এখনো লাইট আসছে না কেন? কাউকে বলবেন লিফটটা খুলতে।

রওনক টের পায় চিত্রলেখার নিঃশ্বাস নিতে হয়ত কষ্ট হচ্ছে। তাই জিজ্ঞেস করে,

-তুমি ঠিক আছো তো? তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?

-কাউকে বলুন প্লিজ দরজাটা খুলতে আমি শ্বাস নিতে পারছি না। দরজাটা খুলতে বলুন প্লিজ। দরজাটা…

চিত্রলেখা কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই পেছন দিকে ঢলে পরতে নেয়। কিন্তু পরে যাওয়ার আগেই রওনক তাকে ধরে ফেলে। চিত্রলেখার খুলে যাওয়া ফোনটা পকেটে রেখে তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। তখনই জেনারেটর অন হয়ে লিফট চলে শুরু করে। লিফটটা নিচে নামতেই রওনক চিত্রলেখাকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। লিফট এসে পার্কিং-এ থেমেছে। বেহুঁশ চিত্রলেখাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে রওনক। ড্রাইভারকে বলে স্কয়ার হসপিটালে যেতে। তখনও জ্ঞান নেই চিত্রলেখার। সে শান্ত হয়ে রওনকের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। রওনক চিত্রলেখাকে সিট শুইয়ে দেয় না। পরম যত্নে তার মাথাটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চিত্রলেখার জ্ঞান ফিরলো প্রায় দুই ঘন্টা পর। জ্ঞান ফিরে চোখ মেলতে একটি আভিজাত্য হাসপাতালের দামী কেবিনের বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করে যারপরনাই বিচলিত হলো সে। তৎক্ষনাৎ মনে করার চেষ্টা করলো সে এখানে কীভাবে এসেছে! মস্তিষ্কের উপর চাপ প্রয়োগ করলে খানিকটা অস্বস্তি হলো বটে কিন্তু তৎক্ষনাৎ মনেও পড়ে গেল লিফটে জ্ঞান হারিয়েছিল সে। চোখের সামনে ঘটঘুটে অন্ধকার ছেয়ে গেল, শরীর ছেড়ে দিয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পরছিল সে। তৎক্ষনাৎই একটা হাত জড়িয়ে ধরেছিল তাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে। তারপর আর কিছু মনে নেই। কেবল মনে পড়ছে তার সঙ্গে সিইও স্যার ছিল। কেবিনের চারদিকে একবার চোখ বুলালো চিত্রলেখা কিন্তু এখানে কোথাও মানুষটা নেই। তাহলে সে এখানে কীভাবে এলো? কে নিয়ে এলো তাকে? জ্ঞান হারানোর পর কি হয়েছিল তার সাথে? কিছু মনে পড়ে না চিত্রলেখার। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত প্রেসার দেয়ার ফলে মাথা ব্যথা করতে আরম্ভ করলো যেন। দপদপ করে সেই ব্যথা বাড়ছে টের পেয়ে আপাতত অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনা বাদ দিতে চায়৷ কিন্তু চাইলেই কি এমন চিন্তা ভাবনা বাদ দেয়া যায়! অন্যরা পারলেও চিত্রলেখা পারে না। সে আরও বেশি তাগাদা অনুভব করে জানার কি হয়েছে তার সাথে জ্ঞান হারানোর পর। কিন্তু এখানে তার প্রশ্নের উত্তর করবে এমন কেউ নেই। নিরুপায় হয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই শুয়ে থাকে চিত্রলেখা। চাইলেও উঠতে পারছে না কারণ তার হাতে ড্রিপ লাগানো, সেলাই চলছে। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে দরজার দিকে তাকায় যদি কেউ আসে। কিন্তু কে আসবে? ভাবতে ভাবতেই চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে কেবিনের দরজাটা খুলে গেল। দরজা ঠেলে একজন নার্স ভেতরে চলে এলো। ফস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। এখন হয়ত কিছু জানা যাবে। নার্স এগিয়ে এসে চিত্রলেখার জ্ঞান ফিরেছে দেখে জিজ্ঞেস করে,

-এখন কেমন লাগছে আপনার?

হালকা করে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। নার্স ড্রিপটা চেক করে দিয়ে বলে,

-বিশ্রাম করুক ঠিক হয়ে যাবেন।

নার্সটা চলে যেতে নিলে চিত্রলেখা বলে,

-একটু শুনবেন?

থেমে গিয়ে ফিরে এসে নার্স জিজ্ঞেস করে,

-কিছু লাগবে আপনার?

-আমি এখানে কীভাবে এসেছি? কে নিয়ে এসেছে আমাকে?

-সেটা তো আমি বলতে পারছি না।

-কী হয়েছে আমার?

-কেমন গুরুতর কিছু নয়। পাসআইট করেছিলেন। আপনার সম্ভবত কোনো ফোবিয়া আছে বা প্যানিক এ্যাটাক হয়েছে।

-বন্ধ করে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। লিফট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

-সেজন্যই আনা হয়েছে আপনাকে। বিশ্রাম করলেই সেরে যাবেন। চিন্তার কোনো কারণ নেই।

-আপনি কি একটু কষ্ট করে আমাকে জানাবেন কে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে?

-ঠিক আছে, আপনি বিশ্রাম করুন আমি খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি। এই মুহূর্তে আর স্ট্রেস নিবেন না আবার প্যানিক এ্যাটাক হতে পারে।

নার্স বেরিয়ে যায়। চিত্রলেখা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে এই আশায় কখন নার্সটা ফিরে এসে তাকে জানাবে এখানে তাকে কে নিয়ে এসেছে? আজ তো ঐ সময় লাবিব অফিসে ছিল না। তা-না হলে চিত্রলেখা নিঃসন্দেহে ধরে নিতো লাবিবই তাকে নিয়েছে। অফিসে একমাত্র লাবিবের সাথেই তার সখ্যতা আছে। এছাড়া অন্যদের সাথে পরিচয় থাকলেও তেমন কোনো সখ্যতা নেই। কাজের বাহিরে কখনো কারো সঙ্গে তেমন কোনো সখ্যতা গড়ে ওঠেনি তার। চিত্রলেখার মাথার ভেতর রওনক নামটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে এই মুহূর্তে। কোনোভাবে কি মানুষটা তাকে এখানে নিয়ে এসেছে? কিন্তু এমন হওয়ার সম্ভাবনা কম। তার জরুরী মিটিং আছে। সে নিশ্চয়ই নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে তার মতো সাধারণ একজন কর্মচারীর জন্য সময়ের অপচয় করবেন না। নিশ্চয়ই অফিসের কাউকে দিয়েই পাঠিয়েছেন হবে হয়ত। বাসায় খবর দেয়া হয়েছে? বেডের পাশে থাকা টেলিবে একবার তাকায় চিত্রলেখা। নিজের ফোনটা খুঁজে আনমনে। মনে মনে ভাবে, ফোনটা কোথায় আমার? চিন্তা করতেই মনে পড়ে যায় তার ফোনটা তো লিফটে পড়ে গিয়েছিল। সেটা তুলতেই বসেছিল সে। তারপর সেটা কোথায় গেল? এদিক সেদিক তাকায় চিত্রলেখা নিজের ফোন খুঁজতে কিন্তু দেখা মিলে না। তখনই আবার কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে একটু আগে আসা সেই নার্সটাই। চিত্রলেখার কাছাকাছি এগিয়ে এসে নার্সটা কিছু বলার আগে সে নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-আমার ফোনটা কোথায় দেখেছেন? খুঁজে পাচ্ছি না।

-আমরা আপনার সাথে কোনো ফোন পাইনি।

-আমার ব্যাগ! ব্যাগে আছে হয়ত ফোনটা।

-আপনাকে যখন আনা হয়েছিল তখন আপনার সঙ্গে কোনো ব্যাগ ছিল বলে মনে হয় না।

তবু বেডের পাশে থাকা কেবিনেটের ড্রয়ারে একবার দেখে। দেখে নার্স জানায়,

-নেই, থাকলে এখানেই থাকতো। এখানে নেই মানে আওনার সঙ্গে ছিল না।

গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয় চিত্রলেখা। তার ব্যাগ, ফোন সব কোথায় গেল? নিশ্চয়ই এর উত্তর মিলবে যদি জানা যায় তাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে সেটা জানা যায় তো। যে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে তার কাছেই হয়ত আছে ব্যাগ আর ফোন। এই মুহূর্তে জানা খুব প্রয়োজন মানুষটা কে। কে তাকে নিজ দায়িত্বে এখানে নিয়ে এলো! অদ্ভুত এক বুলভলাইয়াতে ডুবে আছে চিত্রলেখা। এর থেকে নিস্তার প্রয়োজন তার।

-মিস্টার জামান আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। পেপার্সে আপনার গার্ডিয়ানের জায়গায় উনার নামই লেখা দেখলাম।

নার্সের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে চিত্রলেখার। চোখ ঘুরিয়ে নার্সের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়া কন্ঠে বলে,

-মিস্টার জামান!

-জি, রওনক জামান।

-আমার গার্ডিয়ান!

-জি, আপনার এডমিশন পেপার্সে এমনটাই লেখা দেখলাম।

কয়েক মুহূর্ত ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা নার্সের মুখের দিকে। তা দেখে নার্সটা বলে,

-আপনি বিশ্রাম করুন।

নার্সটা বেরিয়ের যাওয়ার উদ্যোগ নিলে চিত্রলেখা বলে,

-আমার তো এখন জ্ঞান ফিরে এসেছে। আমি বাসায় যেতে চাই।

-আপনাকে ছেড়ে দেয়া হবে কিন্তু আগে আপনার গার্ডিয়ান আসুক তারপর।

-আমার তো কোনো গার্ডিয়ান নেই। আমি নিজেই আমার গার্ডিয়ান।

-তাহলে যে আপনাকে এখানে ভর্তি করিয়েছে সে! সে কি হয় আপনার?

এক মুহূর্ত নার্সের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। ভাবলেশহীন সেই চাহনী। তারপর শান্ত সুরে বলে,

-কেউ হয় না উনি আমার।

নার্সটা কি বুঝলো বা কি ভাবলো কে জানে! এগিয়ে এসে চিত্রলেখার মাথায় মৃদু হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-হাসপাতালের তো কিছু নিয়ম আছে। পেশেন্ট বললেই আমরা তাকে ছেড়ে দিতে পারি না। তাও দেয়া যেত যদি আপনি নিজে এসে ভর্তি হতেন, তাহলে। কিন্তু আপনাকে তো আরেকজন ভর্তি করিয়েছে। আমাদের জন্য সেই আপনার গার্ডিয়ান। তাই তার অনুমতি ছাড়া আমরা আপনাকে ছাড়তে পারবো না। আপনি বিশ্রাম করুন। উনি চলে আসবেন। তারপর ডাক্তার চেকাপ করে দেখবেন। যদি মনে করেন আপনাকে রাখার প্রয়োজন নেই তাহলে ছেড়ে দিবে।

নার্সের সব কথা চিত্রলেখার মাথায় ঢুকলো না। তার মস্তিষ্ক কেবল ক্যাচ করলো একটা কথা। ❝উনি চলে আসবেন।❞ নার্স যে উনি বলতে রওনক জানামকে বুঝিয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার। নার্সের কথা টেনে ধরেই সে বলল,

-উনি আসবেন বলেছেন?

-জি, বলে গেছেন জলদিই চলে আসবেন। আমরা যেন আপনার খেয়াল রাখি।

আবারও কোনো গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয় চিত্রলেখা। তার মস্তিষ্ক জুড়ে একটাই কথা। রওনক জানাম নামক মানুষটা যে কিনা এত বড় কোম্পানির সিইও সে তাকে নিজে এসে এখানে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। আবার যাবার সময় বলেও গেছে সে আবার আসবে। কেন আসবে? তাকে দেখতে? কিন্তু কেন? অন্য কাউকে না দিয়ে সে নিজে কেন তাকে হাসপাতালে নিয়ে এলো? এসব কেন এর উত্তর নেই চিত্রলেখার কাছে তারপরেও মস্তিষ্ক প্রশ্নের জাল বুনেই যাচ্ছে একের পর এক।

রওনক কেবল চিত্রলেখাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েই চলে যায়নি। বরং পাক্কা চল্লিশ মিনিট তার মাথার কাছটাতেই বসেছিল। সেই বসে থাকার দরুন জ্ঞান হারিয়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকা চিত্রলেখার একটা হাতও ধরেছিল সে কয়েক মুহূর্তের জন্য। যা হয়ত তার উচিত হয়নি। তবু ধরেছিল সে। মিটিংটা ক্যান্সেল করার কোনো উপায় ছিল না। বিদেশি ডেলিটেকের সাথে মিটিং আজ না হলে আবার লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী মিটিংয়ের ডেট পেতে। তাই দেরি করে হলেও তাকে যেতে হয়েছে। যদিও মিটিং টা বেলা বারো টায় ছিল। ইচ্ছা করেই সে চিত্রলেখাকে নিয়ে আগে ভাগেই বেরিয়ে গিয়েছিল। অথচ নিচে নামার আগেই অসুস্থ হয়ে গেল মেয়েটা। চিত্রলেখা বলেও ছিল লিফটে না উঠে সিড়ি বেয়ে নামবে কিন্তু সে কোনো কথা না শুনেই তাকে লিফটে তুলে নিলো। দেখতে গেলে তার জন্যই মেয়েটা এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকা চিত্রলেখার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল রওনক। চোখ ফেরাতে পারেনি সে। এমন মুখোশ্রী থেকে চোখ ফেরানোটাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এমনি চিত্রলেখাকে দেখতে তার মনে হয় মেয়েটা এক পৃথিবী কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে নিজের কাঁধে। অসুস্থ হয়ে সেই মুখটা যেন আরও মলিন হয়ে গেছে। অব্যক্ত, বলতে না পারা হাজার টা কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে এই মুখে যা স্পষ্ট না হলেও আবছা আবছা দেখতে পারছে রওনক। বুঝতে না পারলেও খানিকটা অনুভব করতে পারছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে