মাতাল হাওয়া পর্ব-৭৭+৭৮+৭৯

0
268

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)
বিঃদ্রঃ সামনে রোমান্টিক অংশ আছে। নিজ দায়িত্বে পড়বেন।

আচমকা ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে চিত্রলেখা। নিজেকে ধাতস্থ করতে বড় বড় করে কয়েকবার নিঃশ্বাস নেয়। খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। স্বপ্নে দেখেছে তার পরনে একটা সাদা শাড়ি। রঙহীন ধবধবে সাদা একটা শাড়ি পরে ড্রইং রুমের ফ্লোরে বসে আছে। তাকে দেখতে বিধ্বস্ত লাগছে। ঠিক তার সামনেই একটা লাশ রাখা। লাশের মুখ দেখা যাচ্ছে না তাই নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে পারছে না লাশটা কার। কাফনের কাপড় টেনে লাশের মুখ ডেকে রাখা রয়েছে। তবে চিত্রলেখার মন তাকে জানান দেয় লাশটা এমন কারো যে তার ভীষণ আপন। আর এই বাড়িতে একমাত্র রওনকই একজন যে একান্তই চিত্রলেখার, একান্তই তার ব্যাক্তিগত আপন মানুষ, নিজের মানুষ। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার কারণ কি বুঝতে পারছে না। বুকের ভেতর দুড়ুমদাড়ুম শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বিছানার বা’পাশে তাকায় সে। কিন্তু বিছানার ওদিকটা খালি পড়ে আছে। তার একান্তই ব্যাক্তিগত মানুষটা তার পাশে নেই। গত দু’দিন ধরে বাসায় আসছে না রওনক। কাজের ভীষণ ব্যস্ততা তার। কাজের চাপে খাওয়া দাওয়াটাও ঠিকঠাক করার সময় পাচ্ছে না সে। বাড়ি না ফেরা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই চিত্রলেখার। রওনকের দায়িত্ব, কাজের চাপ সম্পর্কে যথেষ্ট আইডিয়া আছে তার। আর এইসব ব্যস্ততা যে সাময়িক সেটাও খুব ভালো করে জানে। তবে এটাও সত্যি রওনককে সে প্রতিমুহূর্ত বাড়াবাড়ি রকমের মিস করে। এমনভাবে মানুষটা তার সাথে জড়িয়ে যাবে তা চিত্রলেখা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। রওনককে ছাড়া একমুহূর্ত সময় থাকার কথা ভাবতে পারে না সে। অথচ আমরা যা না চাই আমাদের তাই করতে হয়। হাত বাড়িয়ে কপালের কাছে এসে থাকা চুলোগুলো ঠিক করে নিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। অন্যপাশে ঘুরে গিয়ে খানিকটা পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। আগের জায়গায় ফিরে গিয়ে মোবাইল ফোনটা হাতে নেয়। সন্ধ্যায় এসএমএস করে রওনক জানিয়েছিল আজ রাতেও সে বাসায় ফিরতে পারবে না। রিপ্লাইতে চিত্রলেখা লিখে দিয়েছিল অন্তত সময় মতো খাবারটা খেয়ে নিতে। একটু যেন ঘুমিয়েও নেয় সে। এরপর তখন আর রওনকের পক্ষ থেকে কোনো জবাব পায়নি সে। ফোনটা তুলে হাতে নিতেই দেখে রওনকের নম্বর থেকে নতুন এসএমএস এসে রয়েছে। নোটিফিকেশন দেখে ততক্ষণাৎই হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশ করে। রওনক লিখে পাঠিয়েছে, “ Sweet dreams BOW, I miss you badly. Wanna k i s s you desperately.” চিত্রলেখার চোয়াল জুড়ে একটা হাসি ফুটে ওঠে। মোবাইলের স্ক্রিনেই সময় দেখে নেয় সে। রাত আড়াইটা বাজে। মোবাইলের স্ক্রিনে থাকা দু’জনের ছবিটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বাথরুমে চলে যায়। বাথরুম সেরে বের হবার সময় ড্রেসিং রুমের দরজাটা খুলতেই চিত্রলেখার বাড়ন্ত কদম থমকে যায়। শরীর জুড়ে হিমশীতল শিহরণ খেলতে শুরু করে। নিজেকে হালকা লাগতে লাগে। মনে হয় যেন শরীরের সমস্ত ভার হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তার। নিজেকে পালকের মতো ওজনহীন লাগতে লাগে। রওনকের কামনায় ভারী হয়ে থাকা দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়তেই চিত্রলেখার অঙ্গে অঙ্গে বিদ্যুৎ চলাচল শুরু হয়ে যায় যেন। অদৃশ্য এক চুম্বক তাকে বিছানার পায়ের কাছের কার্নিশ ঘেষে বসে থাকা পুরুষটার দিকে টানতে লাগে। বেডরুমের দুই দরজার আলাদা চাবি আছে রওনকের কাছে। বাইরের দরজা লক করলেও চিত্রলেখা ইচ্ছা করেই ভেতরের দরজাটা লক করেনি। যদি মাঝরাতে মানুষটা তার কাছে আসে। যদি হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখে মানুষটা তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে রেখেছে। যদি কাঙ্ক্ষিত মানুষটার হাত জোড়া তাকে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে নেয়। এমন অনেকগুলো যদির কথা ভেবেই ভেতরের দরজার লকটা সে লাগায়নি। বাইরের দরজার নবের লকটা লাগালেও ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগায়নি। চিত্রলেখার মন তাকে জানিয়েছে হয়ত মাঝরাতে, শেষরাতে বা ভোরের দিকে সে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় মানুষটা ঠিক ফিরে আসবে তার কাছে। তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে বলে। তার ভাবনাকে সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে সত্যি সত্যি রওনক এসেছে। লজ্জায় চিত্রলেখার চোয়াল সামান্য লাল হলেও, অহেতুক লজ্জা পেয়ে আসন্ন মুহূর্ত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে একদম মন সায় দেয় না চিত্রলেখার। বরং আবেদনের এই জোয়ারে তাল মিলিয়ে ভেসে যেতে মন চাইছে তার। চিত্রলেখার শরীর জুড়ে এই চাওয়া তীব্র থেকে তীব্র হতে লাগে। তাই নিজেকে আটকে না রেখে ড্রেসিংয়ের দরজাটা পেছন দিক থেকে হাত বাড়িয়ে টেনে দিয়ে সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে পা বাড়ায় সে। চিত্রলেখার আচমকা কি হয়েছে সে নিজেও বলতে পারবে না। রওনককে পুরোপুরি চমকে দিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের বুকের কাছে থাকা ওড়নাটা একপাশে ফেলে দিয়ে তার কোলের উপর উঠে বসে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারে না রওনক। তার মনে হচ্ছে সবটাই বুঝি তার কল্পনা। অন্যথায় বিয়ের এতদিন পরেও কাছে আসতে লজ্জা পাওয়া তার বউটা নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছে এ যেন কল্পানার বাইরে। রওনককে কিছু বুঝার সু্যোগ না দিয়ে তার ওষ্ঠ জোড়ার দখল নেয় চিত্রলেখা। নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দেয় তার জীবনের একমাত্র পুরুষটার হাতে। তার যেভাবে ইচ্ছা হয় তাকে আদরে আদরে ভারিয়ে দিক। এই মুহূর্তে রওনকের আদর ছাড়া আর কিচ্ছু চাই না চিত্রলেখার। কোনোদিন কোনোকিছুর আশা না করা, স্বপ্ন না দেখা, আকাঙ্ক্ষা না রাখা চিত্রলেখা যেন নে শা য় মেতেছে। রওনক নামক পুরুষটা চিত্রলেখার নে শা য় পরিণত হয়েছে। এই মানুষটার স্পর্শে নিজেকে মাতাল মাতাল লাগে তার। সর্বক্ষণ এই মাতাল হাওয়া’য় ভেসে বেড়াতে ইচ্ছা করে কেবল। সারাক্ষণ ইচ্ছা হয় মানুষটার স্পর্শ তার শরীরজুড়ে মাখামাখি হয়ে থাকুক।

দীর্ঘ সময় একে-অপরের একান্ত গোপন অঙ্গে ডুবে থাকার পর চিত্রলেখাকে নিজের উন্মুক্ত বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে রওনক। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকে দু’জনে। প্রিয়তমার উন্মুক্ত পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নীরবতা ভেঙ্গে রওনক বলে,

-আই ওয়াজ রিয়্যালি সারপ্রাইজড।

মুখে কিছু বলে না চিত্রলেখা। রওনকের বুকের উপর মাথা রেখে কেবল মুখ তুলে তার মুখের দিকে তাকায়। রওনক নিজেই বলে,

-তুমি এভাবে কখনো নিজে থেকে এগিয়ে আসবে, আমাকে আদর করবে; কখনো ভাবিনি।

বলেই চিত্রলেখার কপালে একটা চুমু খায় সে।

-থ্যাংকিউ মাই লাভ।

রওনকের কথা শুনে সামান্য হাসে চিত্রলেখা কিন্তু তার সেই হাসি যেন চোখ পর্যন্ত পৌঁছে না। জানতে, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে রওনকের কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করে না সে। নিজেকে আটকে রাখে আপাতত। শত ব্যস্ত থাকলেও চিত্রলেখা কখন কি করছে না করছে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি আছে তার। কোনো কারণে যে তার চন্দ্রলেখা বিচলিত সেটাও জানে। জোর করে চেপে ধরলে হয়ত এক্ষুনি সব বলে দিবে কিন্তু সে ইচ্ছা করেই চেপে ধরছে না। চিত্রলেখার জন্য একটা সারপ্রাইজ পরিকল্পনা করে রেখেছে সে। এই সপ্তাহেই তার সব ব্যস্ততাদের ইতি ঘটবে। হাতের কাজগুলো শেষ করেই লাবিবকে সব দায়িত্ব দিয়ে প্রিয়তমাকে নিয়ে দিন পাঁচেকের জন্য দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে সব কোলাহল, ব্যস্ততাদের থেকে অনেক দূরে। যেখানে তাদের কেউ বিরক্ত করতে পারবে না। সারাক্ষণ সে তার চন্দ্রলেখায় ডুবে থাকতে পারবে। তখন জানতে চাইবে কি হয়েছে তার প্রিয়তমার। এমন কি তাকে সারাক্ষণ বিচলিত রাখছে। সেটা যাই হোক চুটকি বাজিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করে দিবে সে, তা যত বড় সমস্যাই হোক না কেন। চন্দ্রলেখার জন্য সে সব করতে রাজি, সব করতে পারে। আর মাত্র কয়েকটা দিন কেবল।

কোচিং শেষে বাড়ি ফেরার পথে মামুনকে দেখে আচমকাই থমকে দাঁড়ায় চারু। অনেক অনেক দিন পর তাদের দেখা। মামুনকে দেখেই চারুর বুকের ভেতর ঝড়ো বাতাস বইতে আরম্ভ করে। যেকোনো সময় বৃষ্টি হয়ে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নামতে শুরু করবে। তবু মানুষটার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। সেদিনের ঘটনার পর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছে সে। মামুনের কথা ভাবতে চায় না তবু বারবার মামুন নামক ভাবনারা চারুর মস্তিষ্কে ফিরে এসেছে। ঠিক ফিরে আসেনি; চারুর মস্তিষ্ক ছেড়ে যায়নি বলা যায়। সামান্য অবসর পেলেই মামুন নামক ভাবনা হানা দিয়েছে চারুর মন ও মস্তিষ্কে। তাই তো নিজেকে ঠিক রাখতে লেখাপড়ায় মন দিয়েছে সে। আবার দেখা হবার সবরকম আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিল চারু। এভাবে আবার মানুষটা তার সামনে এসে দাঁড়াবে ভাবতেই পারেনি।

হাসি হাসি মুখ করে মামুন জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছো চারু?

-ভালো।

ছোট্ট করে জবাব দেয় চারু। এর বেশি কিছু বলতে পারে না। গলা ধরে আসছে তার। বেশি কথা বললে এক্ষুনি গলা ভার করে চোখ গলে কান্না নামতে শুরু করবে। এভাবে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে তাও মামুনের সামনে কাঁদতে চায় না সে। এমনিতেও মামুনকে সে তার চোখের পানি দেখাতে চায় না। চারু টের পায় মামুনের ঠোঁটের কোনায় লেপ্টে থাকা সামান্য হাসি দেখে তার দুনিয়া ভাংচুর হয়ে কান্না নামতে চাইছে। এমনিতেই চোখ ভার হতে শুরু করেছে। মামুন টের পাবার আগেই নিজের দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে নেয় সে। কিছুতেই মামুনকে সে তার চোখের পানি দেখাবে না। চারু চুপ করে থাকায় মামুন নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-আমি কেমন আছি জানতে চাইবে না?

মাথা ঝাঁকায় চারু। ডানে-বামে মাথা ঝাঁকিয়ে না করে। তা দেখে মামুন আরও জিজ্ঞেস করে,

-আমার উপর রাগ বুঝি?

এবারে ডানে-বামে মাথা ঝাঁকায় চারু। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মামুন বলে,

-আমি চলে যাচ্ছি চারু। এরপর হয়ত আমার আর ফিরা হবে না। এবারে একেবারের জন্যই যাচ্ছি। তাই ভাবলাম যাবার আগে তোমার সাথে দেখা করে যাই।

মামুনের কথা শুনে অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে মুখ তুলে তার দিকে তাকায় চারু। মামুনের মুখের হাসি আগের চাইতে সামান্য প্রশস্ত হয়। তবে মামুনের ঠোঁট হাসলেও চোখ হাসে না। বরং ওই চোখে আফসোস দেখা যায়। চারুর দৃষ্টির অবাক হওয়া মামুনের দৃষ্টি এড়ায় না। কিন্তু চারুর মুখে-ঠোঁটে কোনো কথা নেই। মামুন নিজেই বলে,

-দেখবে একদিন তোমার জীবনেও এমন কেউ আসবে যে শুধু তোমার হয়েই থাকবে, তোমাকেই ভালোবাসবে।

-আমার তো এমন কাউকে চাই না মামুন ভাই। আমার শুধু আপনাকে চাই, আপনাকেই লাগবে।

কথাটা মুখ ফুটে বলতে চায়নি চারু। কিন্তু সবসময় তো আমাদের চাওয়া, না চাওয়াতে সবকিছু হয় না। চারু না চাইতেও তার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে। বেরিয়ে যাওয়া কথা তো আর ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই তাই চারুও আর সেই চেষ্টা করে না। মামুনের চোখে চোখ রাখে সে। সামান্য হেসে মামুন বলে,

-তুমি তো জানোই আমি মায়াকে…

মামুন তার মুখের কথা শেষ করতে পারে না। চারু বলে,

-আপা কোনোদিন আপনাকে ভালোবাসেনি মামুন ভাই।

-আমি জানি মায়া কোনোদিন আমাকে ভালোবাসেনি। কিন্তু আমি তো তাকে ভালোবেসেছি। আমরা কাকে ভালোবাসবো আর কাকে ভালোবাসাবো না এটা যার যার চয়েজ, বুঝলে। আমি মায়াকে ভালোবাসি এটা যেমন আমার চয়েজ তেমনি মায়া আমাকে ভালোবাসে না ওটা মায়ার চয়েজ।

“আর আমি আপনাকে ভালোবাসি, এটা আমার চয়েজ মামুন ভাই।” কথাটা মনে মনে বলে চারু। মামুন নিজের মতো বলতে থাকে,
-আমি যাকে ভালোবাসি, সে ভালো আছে এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আমি ভালোবাসি বলে তারও আমাকে ভালোবাসতে হবে ভালোবাসায় এমন কোনো শর্ত নাই। শর্ত দিয়ে ভালোবাসা হয় না চারু। তুমি ছোট মানুষ তাই এতকিছু বুঝবা না। ভালো লাগাকে ভালোবাসা মনে করতেছো।

মামুনের কথায় মাথা ঝাঁকায় চারু। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতেই বলে,

-উঁহু, ভালো লাগা আর ভালোবাসার পার্থক্য আমি বুঝি মামুন ভাই। বরং আপনি নিজেই জানেন না আসলে কোনটা ভালো লাগা আর কোনটা ভালোবাসা। আপাকে আপনি কোনোদিন ভালোবাসেন নাই। শুরু থেকেই আপাকে আপনার ভালো লাগতো। সেই ভালো লাগাকেই ভালোবাসা মনে করছেন, আদৌতে আপনি আপাকে ভালোবাসেন না। কখনো বাসেন নাই।

চারুর কথা শুনে খানিকটা তব্ধার মতো খায় মামুন। তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে হিমশিমও খায় সে। তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে চারু আরও বলে,

-আপনার কি আপার জন্য ম রে যাইতে মন চায় মামুন ভাই? এই যে আপাকে বিয়ে করবেন বলে রাতদিন এক করে স্বপ্ন দেখলেন অথচ আচমকাই একদিন আরেকজনের সাথে আপার বিয়ে হয়ে গেল। আপা এখন আরেকজনের বউ, কয়দিন পর বাচ্চার মাও হবে। এসব ভাবলে কি আপনার ম রে যাইতে মন চায় না?

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মামুন বলে,

-ম রে যাওয়া এত সহজ না চারু। যে কথা বলা যত সহজ, সে কাজ করা ততটাই কঠিন ও অসম্ভব।

-আপনি ভুল বললেন মামুন ভাই। ম রে যাওয়া মোটেও কঠিন কিছু না। আমি এক্ষুনি আপনাকে সেটা প্রমাণ করে দেখাইতে পারব।

বলেই চারু একমুহূর্ত দাঁড়ায় না। পেছন দিকে ঘুরে মেইন রোডের দিকে হাঁটা ধরে। খানিকক্ষণ আগেই যে পথ ধরে এসেছিল, সেদিকেই আগায়। চারুর আচমকা কান্ডে কয়েকমুহূর্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রয় মামুন। চারু খানিকটা এগিয়ে যাবার পর মামুনের হদিশ হয় সে আসলে কি করতে যাচ্ছে। বুঝতে পেরে আর মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে না সে। দ্রুত সামনের দিকে কদম বাড়ায়। চারু মেইন রোডের কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা করে ফেলার আগেই পেছন থেকে তার হাত ধরে আটকে ফেলে মামুন। আতঙ্কে তার বুকের ভেতরটা ধুপধাপ করছে। ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-কি পাগলামি করতেছো চারু তুমি?

মামুনের চোখে চোখ রেখে চারু বলে,

-আপনি আমাকে ভালোবাসেন না, কোনোদিন বাসবেনও না ভাবলেই আমার ম রে যাইতে মন চায় মামুন ভাই।

-কি যা তা বলতেছো এগুলা তুমি চারু?

-আপনি আমাকে বিয়ে করবেন মামুন ভাই?

চারুর আচমকা প্রশ্ন শুনে এবারে পুরোপুরি তব্ধা বনে গেছে বেচারা। শেষবারের মতো হোক আর যাই হোক, চারুর সাথে দেখা করতে আসা একদম উচিত হয়নি তার। আগেরবার দেখা হবার পর সে বুঝতে পেরে গিয়েছিল চারু তাকে পছন্দ করে এমনকি বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ করে। কিন্তু সে মনেপ্রানে তার মায়াকেই চেয়েছে সবসময়। এই জীবনে মায়া ছাড়া অন্য কাউকে জায়গা দেয়ার কথা ভাবতেই পারে না। সেখানে চারু তো প্রশ্নই আসে না। তবুও মনে হয়েছিল একেবারে শিফট করে যাবার আগে শেষবারের মতো চারুর সাথে দেখা করা উচিত। কিন্তু এমন কিছু হবে জানলে ভুলেও দেখা করতে আসতো না সে। যেমন চুপচাপ বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছিল এক রাতের অন্ধকারে, তেমন চুপচাপ আরেক রাতের আঁধারেই চলে যেতো সে চিরচেনা এই শহর ছেড়ে। সেটাই হয়ত ঠিক হতো। নিজেকে সামলে নিয়ে মামুন বলে,

-তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে চারু।

-আপনি আমাকে বিয়ে না করলে আমি এক্ষুনি গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পরব বলে দিচ্ছি।

যা বলেছে তা করে দেখাতে মামুনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে চারু। এতে মামুনের হাতের বাধন আরও শক্ত হয়। চারুকে টেনে ধরে সে কাছাকাছি। আচমকা কি হয় তার কে জানে! চারু মামুন দু’জনেই কিছু বুঝে ওঠার আগে কষে এক থাপ্পড় লাগায় মামুন চারুকে। আচমকা থাপ্পড় খেয়ে যেন নড়তেও ভুলে গেছে চারু। মুখে কোনো রা করে না সে। কেবল নিঃশব্দে দু’চোখ গলে গাল বেয়ে পানি ঝড়তে লাগে। হঠাৎ এমন কাজ কেনো করলো মামুন নিজেও জানে না। নিজের উপরেই এখন বিরক্ত সে। চারুর হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের চুলে হাত চালায়। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

-বাড়ি যাও চারু। পাগলামী বাদ দিয়ে, বাড়ি যাও।

মুখে কিছু বলে না চারু। কেবল মাথায় ঝাঁকায়। আরেকটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

-প্লিজ চারু বাড়ি যাও। আমারে এমন কঠিন পরীক্ষায় ফালাইও না, তোমার দোহাই লাগে।

-আপনি আমাকে বিয়ে না করলে আজকে নাহয় অন্যদিন, একদিন ঠিকই আমি ম রে যাব মামুন ভাই।

মামুনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে চারু। পেছনে মামুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনের ভেতর ভয় জাগে তার। যদি সত্যি সত্যি চারু কিছু একটা করে ফেলে!

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করে বাড়িতে প্রবেশ করে চারু। কিন্তু চোখের পানি যেনো থামতেই চায় না তার। চারুকে ওমনভাবে মাথা নিচু করে ঘরে ডুকতে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল নারগসি বেগমের কিছু একটা ঠিক নেই। মেয়ের পেছন পেছন ঘরে এলে দেখতে পান এই অবেলায় কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সে। চারু শব্দ না করলেও ওর শরীরের ফোঁপানি নারগিস বেগমের দৃষ্টি এড়ায়নি। ডাকতে চেয়েও চারুকে ডাকেন না তিনি। চিন্তিত ভঙ্গিতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। আচমকা কি হলো সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না। ঘর থেকে বের হবার মুখেই খালার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় চয়নের। খালার কপালে চিন্তার ছাপ দেখে ব্যস্ত হয় জানতে চায়,

-কি হইছে খালা?

কি বলবেন বুঝে পায় না নারগিস বেগম। চয়নকে বলা ঠিক হবে কিনা সেটাও বুঝতে পারছেন না। লিখন, চয়ন দু’জনই তাদের দুই বোনের সব বিষয়ে ভীষণ পাগলাটে ধরনের। জানতে পারলেই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু আড়াল করতেও নারগিস বেগমের মন সায় দিচ্ছে না। তাছাড়া চারুর কি হয়েছে সেটাই তিনি ঠিকঠাক জানেন না। সংকোচ করেও চারুর কথাটা চয়নকে বলেন। সবকিছু শুনে চয়ন খালাকে আশস্ত করে বলে,

-তুমি চিন্তা করো না খালা আমি দেখতেছি। আপাতত ওরে কিছুক্ষণ নিজের মতো থাকতে দাও। আমি বাড়ি ফিরে কথা বলবো। কি হয়েছে আমি দেখতেছি তুমি টেনশন কইরো না।

ব্যস্ত হয়ে এয়ারপোর্টের এদিক থেকে সেদিক দৌড়াচ্ছে লাবিব। টেনশন ও চিন্তায় বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে তার। ইতোমধ্যে কপাল ঘামতে শুরু করেছে লাবিবের। ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিজের চুলে হাত চালায় সে। একবার এদিক তাকায়, আরেকবার অন্যদিকে যদি কাঙ্ক্ষিত মানুষটার দেখা মিলে; এই আশায়। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। খুব বেশি একটা দেরি হয়নি তার তবুও মনের গহীনে একটা সংকা রয়েই যায় হয়ত মানুষটা চলে গেছে। শেষবারের মতো তাদের দেখা হবে না। এই জীবনে হয়ত সে আর নিজের মনের কথা বলার সুযোগটা পাবে না। মনের ভেতর সুপ্ত যে আশা নিয়ে এসেছিল সে তা নিরাশায় রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে লাবিবের। পরাজয়টা স্বীকার করেই নিয়েছে সে। এছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই তার কছে।

-লাবিব!

আচমকা নিজের নাম শুনে পেছন ঘুরে তাকায়। তানিয়াকে দেখতে পেয়েই ফস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। তানিয়া বুঝতে পারে না কি করা বা বলা উচিত তার এই মুহূর্তে। ওয়েটিং এরিয়াতে বসে নিজের ফ্লাইটের সময় হবার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। এতক্ষণে তার প্লেনে থাকার কথা ছিল কিন্ত আসার পরে জানতে পারে তার নির্ধারিত সময় থেকে এক ঘন্টা ডিলে হয়ে গেছে ফ্লাইট টা। অন্যথায় এইমুহূর্তে তানিয়া এখানে থাকতো না। কিছুক্ষণ আগেই তার ফোনে রওনক কল দিয়েছিল। আসার আগেই রওনকের সাথে দেখা হয়েছে তার। তাই এইসময় রওনকের নম্বর থেকে কল পেয়ে খানিকটা অবাকই হয় সে। ইচ্ছা করেই কাউকে সঙ্গে নিয়ে এয়ারপোর্টে আসেনি তানিয়া। বিশেষ করে মীম ও মিশকাতকে না আনার জন্যই কাউকে আনেনি সে। ওরা এয়ারপোর্ট এলে কিছুতে ছেলে-মেয়েকে রেখে যেতে পারতো না সে। ওদের দু’জনের জন্মের পর কখনো ওদের রেখে একদিনের জন্যও কোথাও থাকেনি সে। তানিয়ার মনে আছে কোম্পানির একটা জরুরী কাজে একবার তাকে তিনদিনের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিল। তখন মীম, মিশকাতের বয়স মাত্র ১৫ মাস চলে। রওনক তাকে বলেছিল তার যাবার প্রয়োজন নেই। তার বদলে হয় সে নয় অন্যকেউ একজন চলে যাবে। কিন্তু তানিয়া চায়নি নিজের কাজটা অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে। এছাড়া অনেকেই বলেছিল বাচ্চা হবার পর তানিয়া আর আগের মতো কাজ করতে পারবেন না। তানিয়া কখনো চায়নি এই কথাটা সত্যি হোক। তাই ১৫ মাসের মীম, মিশকাতকে নিয়েই চট্টগ্রাম গিয়ে কাজ সেরে এসেছিল সে। মীম, মিশকাতের পরীক্ষা শেষ হলেই রওনক নিজে গিয়ে ওদের তানিয়ার কাছে দিয়ে আসবে কিছুদিনের জন্য।

রওনকের কল রিসিভ করে ফোন কানে তুলেই তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-এনিথিং রঙ?

-থ্যাং গড তোমাকে পাওয়া গেল।

-কি হয়েছে বলো তো?

-তোমায় শেষবারের মতো দেখা করে কিছু বলার জন্য কেউ একজন হন্য হয়ে এয়ারপোর্টের এই মাথা থেকে সেই মাথা দৌড়াচ্ছে। কাইন্ডলি তাকে একটু দেখা দেও।

-কার কথা বলছো বলো তো।

-একটু আশেপাশে দেখলেই বুঝবে। আমি নাম বলছি না। তুমি একটু দেখো। তাকে দেখলেই বুঝতে পারবে। আর শুনো…

-শুনছি বলো।

-কি বলতে চায় একটু মন দিয়ে শুনো প্লিজ।

-ঠিক আছে।

তানিয়ার হ্যান্ড পার্সে থাকা পানির বোতলটা লাবিবের দিকে এগিয়ে দেয়। একমুহূর্ত সময় বিলম্ব না করে তানিয়ার হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খায় সে। বোতলটা ফিরিয়ে দিতেই তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-তুমি এখানে!

-বলছি, বলতেই এসেছি।

-আমি শুনছি।

একমুহূর্ত সময় নিয়ে লাবিব বলে,

-আমি আপনাকে ভালোবাসি।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

তানিয়া চলে যাচ্ছে, তার যাবার পথের দিকে তাকিয়ে আছে লাবিব। বুকের ভেতরটা অদ্ভূত এক না পাওয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও ভালো লাগছে তার। শুরু থেকেই সে জানে এমন একজনকে সে তার মনের আসনে বসিয়েছে যাকে হয়ত কখনো সে পাবে না। এই মানুষটাকে কখনোই নিজের করে ছুয়ে দেয়া তো দূরের কথা পাওয়া হবে না জেনেও ভালোবেসেছে। ভালোবাসা এমনই; ভালো ক্ষতির হিসেব করে ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি যার উপর আমাদের কোনো জোর নেই। চাইলেই যেমন কাউকে আমরা ভালোবাসতে পারি না, তেমনি যাকে একবার ভালোবেসে ফেলি তাকে চাইলেই এই হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায় না। মানুষটা আমার না হলেও দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যুগ যুগ, অনন্তকাল মানুষটা এই পোড়া মনের কোনো এক গহীন কোনে ঠিক ঘাপটি মেরে থাকে আজীবন। তানিয়া নামক এই নারী হয়ত এইজীবনে কখনো লাবিবের ব্যাক্তিগত নারী হবে না তবে বেঁচে থাকতে কোনোদিন সে তাকে ভুলবে না। অন্যকোনো নারীতে হয়ত ওতখানি আসক্ত হতেও পারবে না সে কখনো। তবু আফসোস নেই লাবিবের। বুকের ভেতরটা বিসন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও মুখে তার তৃপ্তির হাসি। অন্তত যাকে ভালোবাসে তাকে জানাতে তো পেরেছে ভালোবাসার কথাই এই বা কম কি! “আমি যাকে ভালোবেসেছি সে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। তোমার ভালোবাসা আমি পুঁজি করে রাখবো, জানবো অন্তত কেউ আমায় ভালোবেসেছে।“ তানিয়ার বলে যাওয়া এইকথাটা সবসময় মনে থাকবে লাবিবের।

পেছন থেকে একদম এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ায় রওনক। হাত বাড়িয়ে লাবিবের কাঁধে হাত রাখে। সামনের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই লাবিব বলে,

-থ্যাংকিউ স্যার।

রওনকের নিজের ঠোঁটের কোণেও সামান্য হাসি পরিলক্ষিত হয়।

-মনে হয় না আমি থ্যাংক্স পাবার মতো কিছু করেছি।

-আপনি না থাকলে তো আমি মানুষটাকেই পেতাম না। আর না নিজের মনের কথা জানাতে পারতাম।

রওনক নিজের মুখে স্বীকার না করলেও লাবিব জানে তানিয়াকে খুজে পাবার পেছনে অবশ্যই তার হাত আছে। অন্যথায় এই সময় তার এখানে থাকার কথা নয়।

অনেকক্ষণ আগেই তানিয়া লাবিবের চোখের আড়াল হয়ে গেছে। তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে ছিল সে। এবারে দৃষ্টি সরিয়ে এনে পাশ ফিরে রওনকের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমার জানা মতে আপনার এখন মিটিং এ থাকার কথা। মিটিং ফেলে এখানে কেনো?

-লাক ফেবার করলে যা হয় আর কি। যাবার পথেই ফোন এলো মিনিং টা ক্যান্সেল হয়েছে। ব্যস আমি সুযোগটা লুফে নিলাম। আমার দু’জন খুব কাছের মানুষের জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা মুহূর্ত আর আমি সেই মুহূর্তের সাক্ষী হবো না সেটা কি হয় নাকি?

দু’জনেই একমুহূর্ত নিঃশব্দ হেসে নিয়ে রওনক আরও বলে,

-চলো অফিস যাই। লাঞ্চের পর মিটিং আছে আরেকটা এটার পর আর আমাকে পাবে না। কোনো জরুরী কাজ থাকলে এখনি জানাও আজ অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে আর পাবে না আমাকে আগেই বলে দিচ্ছি।

-ওকে বস।

রওনক যে প্রজেক্টটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল্ সেটা কমপ্লিট হয়েছে। আজ থেকে তার কাজের ভার সামান্য কমেছে যদিও কখনোই তার কাজের প্রেসার কম থাকে না। এত বড় একটা গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক তো সে এমনি এমনি হয়নি। তাই আবার কাজের চাপ বেড়ে যাবার আগেই চিত্রলেখাকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও যাবার পরিকল্পনা সেরে ফেলেছে সে। আজ রাতের ফ্লাইটেই তার চন্দ্রলেখাকে নিয়ে ব্যাংকক যাচ্ছে রওনক দিন পাঁচেকের জন্য। এতদিন কাজের চাপে বউকে সে ঠিকটাক সময় দিতে পারেনি। এছাড়াও সে ভুলে যায়নি তার চন্দ্রলেখা কোনো কারণে চিন্তিত, সেটাও জানতে হবে তাকে। তাই অফিসের সমস্ত দায়িত্ব লাবিবকে বুঝিয়ে দিয়ে প্রিয়তমাকে নিয়ে হারিয়ে যাবে কিছুদিনের জন্য। এখন একটাই তাড়া তার দ্রুত অফিসের কাজ সেরে বাসায় ফিরে যাওয়া। গিয়েই চন্দ্রলেখাকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে সে। ভাবতেই অস্থিরতা বাড়ছে তার।

প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে তানিয়া। এমন কিছু একদমই আশা করেনি সে। মানুষের জীবন তার নিজেস্ব পরিকল্পনায় চলে যায় বরং সম্পূর্ণটা বিধাতার পূর্ব পরিকল্পিত। তানিয়া চোখ বন্ধ করতেই তার চোখের পাতায় ভেসে ওঠে লাবিবের বলা কথাগুলো।

-আমি আপনাকে ভালোবাসি।

আচমকা লাবিবের মুখে এমন কথা শুনে অবাক না হয়ে পারে না সে। এতদিনের কর্ম জীবনে বেশ অনেকবার লাবিবের সাথে কাজ করা হয়েছে তার কিন্তু এখনো মনে হয়নি ছেলেটা অশুভ দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে খুব ভালো ভাবেই নিজের অনুভূতিদের আড়াল করে রেখেছিল। আচমকা লাবিবের কথা শুনে কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না।

-লাবিব… আমি…

কি বলবে শব্দ খুঁজে পেতে হিমশিম খায় তানিয়া। তাকে থামিয়ে দিয়ে লাবিব নিজেই বলে,

-আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমি আপনাকে ভালোবাসি এটা আমার দায়। আপনাকে আমি কোনো দায় দিচ্ছি না। আপনার পক্ষ থেকে আমি কখনো কোনো ধরনের ইঙ্গিত পাইনি, ওভাবে হয়ত কখনো আপনি আমাকে লক্ষই করেননি কিন্তু আমি করেছি। আমার দৃষ্টিতে আপনি সবসময় বিশেষ সম্মানের। নিজের অজান্তেই আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি টের পাবার আগেই। যতক্ষণে টের পেলাম ততক্ষণে আমার আর ফিরে আসার রাস্তা খোলা নেই। আপনি একটু বলছি না আপনাকে আমার ভালোবাসা গ্রহণ করতে হবে। আমি শুধু চাই আপনি জানুন কেউ একজন আপনাকে ভালোবাসে, অসম্ভব ভালোবাসে। আপনি আমার হবেন না জেনেও আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি জেনেন আমি আপনাকে ভালোবাসি এতটুকু স্বীকৃতিই যথেষ্ট আমার এই জীবন কাটিয়ে দেবার জন্য। আমি শুরু থেকেই জানি আপনাকে নিজের করে পাবার মতো সৌভাগ্য আমার নেই। এই সত্যিটা অনেক আগেই মেনে নিয়েছি আমি। আমি শুধু চাই আমার ভালোবাসার মানুষটা ভালো থাকুক; যেখানেই থাকুক, যার সাথেই থাকুক শুধু ভালো থাকুক, অনেক সুখে থাকুক। আপনার মুখের হাসিই যথেষ্ট আমার ভালো থাকার জন্য।

লাবিবের বলা কথাগুলো সুনে তানিয়া কথা বলার খৈ হারিয়ে ফেলেছিল। খানিক চুপ করে লাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে পরে তানিয়া বলে,

-আমি যাকে ভালোবেসেছি সে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। তোমার ভালোবাসা আমি পুঁজি করে রাখবো, জানবো অন্তত কেউ আমায় ভালোবেসেছে।

একমুহূর্ত চুপ করে থাকার পর তানিয়া বলে,

-আসি ভালো থেকো, নিজের খেয়াল রেখো।

-আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন প্লিজ।

আর কিছু না বলে নিজ গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায় তানিয়া। নিজেকে আর ভালোবাসার অযোগ্য মনে হচ্ছে না তার। কেউ আমায় যত্ন করে ভালোবাসছে এ যেনো পরম অনুভূতি। খালি হাতে নয় ভালোবাসা নামক স্বর্গীয় অনুভূতি হৃদয়ে পুঁজি করে যাচ্ছে সে। হয়ত কোনোদিন লাবিবকে তার ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসতে পারবে না সে কিন্তু সারাজীবন লাবিবের এই ভালোবাসাকে সম্মান জানাবে সে, লাবিবের এই ভালোবাসা পুঁজি করে রাখবে।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ব্রেকিং নিউজ চলছে। সব ক’টা চ্যানেলে একই নিউজ। বাংলাদেশের নামকরা ব্যবসায়ী, জামান গ্রুপের কর্ণধার রওনক জামান আজ বিকেলে অফিস থেকে নিজ বাসায় ফিরে যাবার সময় গুরুতর এক্সিডেন্ট করে বর্তমানে ঢাকার এ্যাপলো হসপিটালে ভর্তি আছেন। তার বর্তমান অবস্থা কি সেটা এখনো জানা যায়নি। তার পরিবারের সদস্যরা খবর পাওয়া মাত্রই হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছেন কিন্তু রিপোর্টদের সাথে এখন পর্যন্ত কেউ সাক্ষাৎ করেনি তাই ভেতরকার পরিস্থিতি এখনো সবার অজানা। জানা গেছে এক্সিডেন্টের সময় ঘটনাস্থানেই ড্রাইভারের মৃ ত্যু ঘটেছে। রওনক জামানকে যখন হাসপাতালে আনা হয়ছে তখনও তার নিঃশ্বাস চলছিল কিন্তু পর্বরতী অবস্থা এখনো সবার অজানা। রিপোর্টটাররা জামান পরিবারের সদস্য বিশেষ করে রওনক জামানের স্ত্রী চিত্রলেখা জামানের সাথে দেখা করতে চাইলে রওনক জামানের এ্যাসিস্ট্যান্ট জানিয়েছেন এইমুহূর্তে পরিবারের সদস্যরা কেউই কথা বলার মতো পরিস্থিতে নেই। সময়মতো মিডিয়াকে সকল আপডেট দেয়া হবে। যে ডাক্তাররা রওনক জামানের চিকিৎসা করছেন উনারাও কেউ রিপোর্টারদের এইমুহূর্তে কোনোরকম সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে গোপন সূত্রে দুটো তথ্য জানা গেছে। এক, রওনক জামান হাসপাতালে আসার পথেই মা রা গেছেন তাই এখন পর্যন্ত মিডিয়াকে কিছু জানানো হচ্ছে না। দুই, রওনক জামানকে যেকোনো মুহূর্তে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে। অধৈর্য হয়ে সবাই অপেক্ষা করছে কখন ভেতর থেকে খবর আসবে। এরই মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে রওনক জামানের অবর্তমানে এত বড় ব্যবসা কে দেখবে? কেউ বলছে তার বড় ভাই রাদিন জামান, কেউ বলছে তানিয়া জামান যিনি রাদিন জামানের প্রাক্তন স্ত্রী এবং জামান গ্রুপের একজন শেয়ার হোল্ডার। আবার কেউ কেউ বলছে রওনক জামানের স্ত্রী চিত্রলেখা জামান হয়ত কোম্পানির হাল ধরবে। এই সবই গুঞ্জন, সঠিক তথ্য এখনো জানা যায়নি।

বিকেল বেলায় অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে রওনকের গাড়ির ব্রেক ফেইল করে এক্সিডেন্ট হয়। তৎক্ষণাৎই দুটো পল্টি খেয়েছে গাড়িটা। ঘটনাস্থানে ড্রাইভারের মৃ ত্যু হলেও রওনককে পাওয়া গেছে র ক্তে মাখামাখি হয়ে অজ্ঞান অবস্থায়, তখনো তার নিঃশ্বাস চলছিল। হাসপাতালে আনার সঙ্গে সঙ্গে একটি মেজর অপারেশন হয়েছে তার। অপারেশনের পর তাকে রাখা হয়েছে আইসিউতে। ইতোমধ্যে অপারেশনের পর ৩ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত রওনকের জ্ঞান ফিরেনি। আইসিউর বাইরের করিডোরেই বসে আছেন দিলারা জামান, জাহানারা ও লাবিব। অবশ্য একমুহূর্ত বসার সময় নেই লাবিবের। সে ফোন কল এ্যাটেন্ড করতে ব্যস্ত। চারিদিক তাকেই সামাল দিতে হচ্ছে। খবর পেয়ে লিখন ছুটে এসেছে নিজের বোনকে সামাল দিতে। লিখনের সঙ্গে নারগিস বেগমও আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু লিখন নিয়ে আসেনি। বলে এসেছে সে পরিস্থিতি বুঝে জানাবে। সাবারাও সবাই এসেছে খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই। সবগুলো মানুষের মধ্যে একমাত্র অনুপস্থিত রয়েছে চিত্রলেখা; যাকে এই সময় রওনকের সব চাইতে বেশি প্রয়োজন। লিখন আসার পর থেকে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত। কাকে জিজ্ঞেস করবে সে চিত্রলেখার কথা। কম করে হলেও ১০ থেকে ১৫ বার চিত্রলেখাকে ফোন করেছে সে কিন্তু বোনের ফোনটা বারবার বন্ধ আসছে। পরিবারের উপস্থিতিতে ভালোবাসার মানুষের সাথে কথা বলতে পারছে না রিপা। কিন্তু লিখনের কপালে চিন্তার ছাপ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না তার এই চিন্তার কারণ কি। একই কারণে সে নিজেও চিন্তিত। রওনকের এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ঘন্টা পাঁচেক আগে। প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেল রিপোর্ট করছে অথচ চিত্রলেখার কোনো হদিশ নেই এটা আসলেই চিন্তা করার জন্য যথেষ্ট। কথা বলতে পারছে না দেখে রিপা লিখনের নম্বরের এসএমএস পাঠায়। যেখানে লেখা, “জাহানারা আন্টি জানিয়েছেন আপা নাকি সকাল বেলায় বাসা থেকে বেরিয়েছে। তুমি কি জানো সে কোথায় আছে?” রিপার পাঠানো এসএমএস টার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে লিখন, বুঝতে পারছে না কি জবাব দিবে সে। সকাল বেলায় বেরিয়ে কোথায় গেছে তার বোন? এখনো কি রওনকের এক্সিডেন্টের খবর পায়নি সে? নানারকম ভাবনা এসে ভর করছে লিখনের মস্তিষ্কের ভেতর যার কোনোটারই জাবাব নেই তার কাছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে