মাতাল হাওয়া পর্ব-৭৪+৭৫+৭৬

0
285

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

বোর্ড পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেও নিয়মিত লিখনের কাছে পড়তে আসছে বৃষ্টি। তার লক্ষ ঢাকা ইউনিভার্সিটি। বাসা থেকে যদিও বলা হয়েছে সে চাইলে যেকোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারে। মেয়েকে পড়ানোর ক্ষমতা বৃষ্টির বাবা মুস্তফা সাহেবের আছে। কিন্তু বৃষ্টি একেবারেই হেলায় ফেলে দেয়ার মতো ছাত্রী নয়। সে তার মেধা যোগে পড়ালেখা করতে চায়। তাছাড়া লিখনের এখানে অনেক বড় একটা ভূমিকা আছে। লিখনের পথেই হাটতে চায় সে। তাই বৃষ্টিরও স্বপ্ন একদিন সে নিজেও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করবে। সেজন্য সবসময় মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখাও করেছে। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছে। উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টও আশা করছে ভালো হবে। তাই মনোযোগ দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। নিজের দিক থেকে কোনোরকম ত্রুটি রাখছে না কোনোধরনের।

বিগত পাঁচ মাস ধরে বাসায়ই ছোট্ট করে কোচিং সেন্টারের মতো করে ছাত্র পড়াচ্ছে লিখন। অনেক বেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়াচ্ছে তেমনটাও নয়। সামনে তার নিজের পরীক্ষা সেই প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। সর্বসাকুল্যে ৫ টা ব্যাচ পড়ায় সে তাও প্রতিদিন ২ কি ৩ টা ব্যাচ থাকে। এভাবে মিলিয়েই ৭ দিনে ৫ টা ব্যাচ কাভার দেয়। তবে বৃষ্টির এই আইডিয়াটা যথেষ্ট উপকারে দিয়েছে। এখন আর পড়ানোর জন্য বাইরে যেতে হয় না তাকে। ঘন্টা ধরে ১ জনকে ২ ঘন্টাও পড়াতে হয় না। এত অল্প সময়ে যে এতগুলো ছাত্র-ছাত্রী পড়াচ্ছে এর পেছনের অবদানটা বৃষ্টির বেশি। ওর সার্কেলের এমন কেউ বাকি নেই যে লিখনের কাছে পড়ে না। নিজের বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে ক্লাসমেট এমন কাউকে বাদ রাখেনি বৃষ্টি। সবাইকে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে। এছাড়া এলাকায় আগে থেকেই তার একটা সুনাম ছিল। অনেকে তার কাছে ছেলেমেয়ে পড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে পড়াতে পারেনি লিখন। তাদের সবার সাথে যোগাযোগ করে বাসায় পড়ানোর বিষয়টা জানিয়েছে সে। অনেকেই তার কাছে পড়তে পাঠিয়েছে নিজ নিজ ছেলেমেয়েদের। বৃষ্টির ভাই নাঈমের ক্লাসের কয়েকজনও পড়ছে তার কাছে।

চিত্রলেখা বিয়ে করে চলে যাবার পর এসে ক’দিন থেকে গিয়েছিল। তারপর থেকে চারু খালার সঙ্গে তার ঘরেই থাকছে। প্রথমে লিখন বারান্দায় চেয়ার টেবিল দিয়ে পড়াবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু চারুর একার জন্য একটা ঘর লাগে না। তাই ও খালার সঙ্গে তার ঘরেই থাকছে। ছোটবেলা থেকেই চারুর রাতে একা ঘুমানোর অভ্যাস নেই। চিত্রলেখা চলে যাবার পর বেশ কিছুদিন একলা ঘুমালেও প্রায় রাতেই ঘুম ভেঙে গেলে পরে খালার কাছে তার ঘরে চলে যেতো। তারপর নারগিস বেগমই একদিন বলেছিল চারুকে উনার সঙ্গে থাকতে। চারু খালার ঘরে সিফট হয়ে যাওয়ার পর একটা ঘর ফেলে রাখার মানে হয় না। যদিও নারগিস বেগম বলেছিলেন চয়ন বড় হচ্ছে, লিখন তো বড় হয়ে গেছেই। ওরা দুই ভাই যেনো দুই ঘরে থাকে। এখন ওদের প্রাইভেসির দরকার আছে। লিখন আপত্তি না করলেও চয়ন বলেছিল ভাইয়ের সাথে এক ঘরে থাকতে তার আপত্তি নেই যতদিন না লিখনের বিয়ে হচ্ছে। দুইজন দুই ঘরে থাকার চাইতে লিখনকে চয়নই বলেছিল ঔ ঘরটা যেনো সে ছাত্র পড়ানোর জন্য গুছিয়ে নেয়। লিখন নিজেও ভেবে দেখেছে চয়ন ঠান্ডা ধরনের ছেলে। চুপচাপ টেবিলে বসে পড়লে টেরও পাওয়া যায় না সে যে ঘরে আছে। সেজন্যই চয়নের সাথে এক ঘরে থাকতে তারও সমস্যা হয় না। সবদিক বিচার বিবেচনা করে ঐ ঘরটাতেই এখন ছাত্র পড়ায় লিখন। আপাতত লাগছে না পরেরটা পরে দেখা যাবে। এমনিও লিখনের বিয়ে করতে অনেক দেরি আছে।

গত দুই সপ্তাহের পড়ার উপর আজ বৃষ্টির একটা পরীক্ষা ছিল। তাই জলদি পড়া শেষ হয়ে গেছে তার। যেদিন যেদিন তার পড়া থাকে। পড়ার পর খানিকক্ষণ চারুর সঙ্গে আড্ডা চলে তার। পড়ার জন্য এবাড়ি বৃষ্টির আসা যাওয়া বাড়ার ফলে চারুর সঙ্গে গভীর সখ্যতা হয়েছে বৃষ্টির। আগে ভালো সম্পর্ক থাকলেও সম্পর্ক এতখানি গভীর ছিল না দু’জনার। কিন্তু আজকাল দু’জনকে মানিকজোড় বলা যায়। তবে বিগত ক’দিন তেমন একটা কথা হয়নি দু’জনার। চারু ব্যস্ত আছে বা মাথা ধরেছে বলে এড়িয়ে গেছে বৃষ্টিকে। কিন্তু কিছু একটা যে ঠিকঠাক নেই তা ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছে বৃষ্টি। কিন্তু জানার জন্য চাপাচাপি করেনি চারুকে। দু’জনের সম্পর্ক এখন এমন যে জিজ্ঞেস না করলেও একজন আরেকজনকে ঠিকই মনের কথা জানাবে। কিন্তু মাঝে সাতদিন পেরিয়ে গেছে তাই আর ধৈর্য্য রাখতে পারছে না বৃষ্টি। চারুর কি হয়েছে তাকে সেটা জানতেই হবে। কোনো কারণে চারুটা ভালো নেই বৃষ্টির মন বলছে। আর চারুর মন খারাপ থাকলে বৃষ্টির নিজেরও ভালো লাগে না।

পরীক্ষার শীট জমা দিয়ে সোজা চারুর ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে বৃষ্টি। দরজাটা ভেজানো ছিল। মৃদু ধাক্কা দিতেই দরজাটা ভেতর দিকে হাট হয়ে খুলে যায়। বৃষ্টি যতখানি চারুকে চিনে অসময়ে ঘুমানোর অভ্যাস তার নেই। তাই এই অবেলায় ঘরের বাতি নিভিয়ে চারুকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে দেখে অবাক না হয়ে পারে না সে। বিরক্ত না করে বেরিয়ে আসবে ভাবতেই টের পায় কাঁথার নিচে লুকিয়ে চারু সম্ভবত কাঁদছে। তাই বেরিয়ে না এসে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দেয় সে। এগিয়ে এসে চারুর মাথার কাছে বসে বৃষ্টি। এখনো কোনো কথা বলেনি সে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চুপ হয়ে গেছে চারু। নড়াচড়াও করছে না আর। কিছু না বলেই বৃষ্টি নিজেও চারুর পাশে শুয়ে পড়েছে। কাঁথাটা টেনে নিয়ে চলে যায় কাঁথার নিচে চারুর কাছাকাছি। ঘুমিয়ে থাকার ভান করেই শুয়ে আছে চারু। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বৃষ্টি বলে,

-আমি জানি তুই জেগে আছিস চারু।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে তোর? এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? কথা বলতেছিস না কেন কয়দিন ধরে আমার সাথে? আমার কোনো কথায় কি কষ্ট পাইছিস?

জবাব দেয় না চারু। বৃষ্টি নিজেই বলে,

-আমাকে বলবি না তোর কি হইছে? আমি না তোর সই লাগি?

নিঃশব্দে কেঁদেই চলেছে চারু। মুখে কোনো শব্দ নেই তার। বৃষ্টি জানে কীভাবে চারুর মুখ দিয়ে কথা বের করতে হয়।

-আপা থাকলে আপাকে কি বলতি না তোর কি হইছে? আমাকে বল। দেখবি আমি সমাধান করে দিবো।

এবারে ধরা গলায় চারু বলে,

-তোমরা কেউ কিছু করতে পারবা না।

-তুই কাঁনতেছিস কেন? কেউ কি তোর মনে কষ্ট দিছে? কি হইছে আমাকে বল না চারু।

-কিছু হয় নাই আমার।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা চিন্তা ভাবনা করে বৃষ্টি। ভেবে জিজ্ঞেস করে,

-তুই কি কাউকে পছন্দ করিস চারু? কাউকে ভালোবাসিস? সে কি তোরে কষ্ট দিছে? মন ভাঙছে তোর?

বৃষ্টির এই প্রশ্নের জবাব দেয় না চারু। কি জবাব দিবে? ও তো নিজেই জানে না মামুনকে সে ভালোবাসে কিনা। চারু শুধু জানে মানুষটার জন্য তার ভেতরটা ভীষণ পোড়ে। মানুষটার বিয়োগে তার ভেতরটা পুড়ে ছাড়খার হয়। মানুষটাকে একবার দেখার জন্য গলা-বুক শুখিয়ে চৌচির হয়ে যায়। মানুষটার অনুপস্থিতিতে তার মনের জমিনে চৈত্রের খড়া পড়ে। ভেতরে ভাঙচুর হয়। কিন্তু ভালোবাসে কিনা সেটা তো চারু জানে না। তাছাড়া সে ভালোবাসলেই কি আর না বাসলেই কি! মামুন ভাই তো এখনো তার মায়াকেই ভালোবাসে। আর চারু তো মায়া না। কখনো মায়া হতেও পারবে না, হতে চায়ও না। তাই মামুন ভাইও কখনো তাকে ভালোবাসবে না। তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। এসব ভাবতেই চারুর বুক ভেঙে, চোখ গলে কান্নার বন্যা নামে। বৃষ্টি পাশ ফিরে চারুকে বুকে জড়িয়ে নেয়। মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দেয়। তার বুকে মাথা রেখে আরও বেশি কান্নায় ভেঙে পড়ে চারু। কাঁদতে কাঁদতেই চারু নিচু কন্ঠে বলে,

-মামুন ভাই আমাকে ভালোবাসে না কেন বৃষ্টি আপু?

-মামুন ভাই!

-তুমি এই কথা কাউকে বইলো না বৃষ্টি আপু। তোমাকে লিখন ভাইয়ের কসম। কাউকে মামুন ভাইয়ের কথা বইলো না।

বৃষ্টি আর কিছু বলতে পারে না। সে চারুর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। কাউকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবাসার পরেও মানুষটা যদি আপনার ভালোবাসা বুঝতেই না পারে, আপনার ভেতরকার দহন টের না পায় তখন ঠিক কতখানি পুড়ে সেটা বৃষ্টি খুব ভালো করেই জানে। আর কথা বলে না সে। বড় করে দু’বার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কেবল।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

কফির কাপে চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে বাইরের দিকে তাকান দিলারা জামান। ধানমন্ডির একটি রুফটপ রেস্টুরেন্টে বসে আছেন তিনি। আজ সাবার সঙ্গে সকালের নাস্তা করার পরিকল্পনা করে বাইরে এসেছেন। কিন্তু সাবা এখনো এসে পৌঁছায়নি তাই অপেক্ষা করতে এক কাপ কফি অর্ডার করে নিয়েছেন। এখানে এসেই সাবাকে কল করে জানিয়েছেন তিনি পৌঁছে গেছেন। সাবা জানিয়েছে সে পথেই আছে। তার বাসা এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়।

দিলারা জামানের কফি শেষ হওয়ার আগেই এসে পৌঁছায় সাবা। ঠিক উনার মুখোমুখি অন্যপাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,

-সরি আন্টি আপনাকে ওয়েট করতে হলো।

-ইটস ওকে ডিয়ার।

ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলে সাবা দিলারা জামানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-ইউ হ্যাব টু হেল্প মি আন্টি। আপনার হেল্প ছাড়া আমি এই ব্যাটেলটা জিততে পারব না। এন্ড ইউ নো এনি হাউ আই হ্যাব টু উইন দিজ ব্যাটল। আমার রওনককে চাই-ই চাই।

-কাম ডাউন মাই ডিয়ার। তোমাকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। এবারে যা করার আমি করব। এতদিন আমি কিছুই বলিনি। ভেবেছি সময় দিলে হয়ত আমার ছেলেটা নিজে থেকেই বুঝতে পারবে। বাট আনফরচুনেটলি আই ওয়াজ রঙ। তাই এখন যা করার আমিই করব। খুব জলদি ঐ মেয়েটাকে আমি আমার রওনকের জীবন থেকে সরিয়ে দিবো। তারপর তোমাকে আমার রওনকের বউ করে নিয়ে যাবো। এন্ড আই প্রমিজ ইউ দ্যাট।

-থ্যাংকিউ সো মাচ আন্টি।

-ওহ কাম অন মাই ডিয়ার।

তানিয়া সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। এই মাসেই তার ফ্লাইট, সে নিউইয়র্ক চলে যাচ্ছে। কবে ফিরবে তা সে নিজেও এখনো জানে না। লাস্ট ফাইলটা সিগনেচার করে তার এসিস্ট্যান্টকে হ্যান্ডওভার করে হাসি মুখে তানিয়া বলে,

-ডান, এরপর জামান গ্রুপের সঙ্গে আমার আর কোনো লেনদেন নেই।

-ভুল বললে ভাবী।

তানিয়ার কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে রওনক বলে কথাটা। তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকায় তানিয়া। এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি অন্যপাশের চেয়ারে বসে রওনক।

-বুঝলাম না।

-সহজ হিসেব ভাবী। তুমি এখন থেকে জামান গ্রুপের ইমপ্লই নও তবে শেয়ার হোল্ডার তো আছোই।

গেল মাসেই তানিয়া ও রাদিনের ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখনো একই বাড়িতে থাকছে তারা যদিও দু’জন দুই ঘরে। তানিয়া চাইলেই অন্যকোথাও থাকতে পারত বাচ্চাদের নিয়ে কিন্তু রওনক অনুরোধ করায় ওবাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে। শেষ কয়টা দিন তানিয়া এখানেই থাকুক চেয়েছে রওনক। ওদের ডিভোর্সের সময় রওনকের প্রেসারেই বাধ্য হয়ে রাদিনকে তার শেয়ারের অর্ধেকটা তানিয়ার নামে লিখে দিতে হয়েছে। যদিও তানিয়া নিতে চায়নি কিন্তু রওনকের সঙ্গে পেরে ওঠাটা সহজ বিষয় নয়। জামান গ্রুপে রাদিন ১০ পার্সেন্ট শেয়ারের মালিক। যেখান থেকে ৫ পার্সেন্ট এখন তানিয়ার। তাই এদিক থেকে সে এখনো জামান গ্রুপের একজন। রওনক পুরোপুরি তানিয়াকে হারাতে চায় না। মীম, মিশকাতের মা হিসেবে এই পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকলেও রওনক তাকে চিনে। একবার চলে যেতে পারলে তানিয়া আর পেছন ফিরে তাকাবে না। সেজন্যই কোম্পানির শেয়ার দিয়ে তাকে খানিকটা বেঁধে রাখার চেষ্টা। যদিও রওনক কখনই তানিয়াকে ফিরে আসার জন্য জোর করবে না তবুও সে চায় তানিয়া সারাজীবন জামান গ্রুপের, জামান পরিবারের একজন হয়ে থাকুক। রওনকের এত এত সাফল্যের পেছনে যারা দিনরাত এক করে শ্রম দিয়েছে তানিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। তার ক্ষমতায় থাকলে রওনক আরও অনেক বেশি করত কিন্তু তানিয়া নিবে না। চরমভাবে ঠকে যাবার পর শিখেছে তাই তানিয়া যে তার আত্মসম্মান বিসর্জন দিবে না সেটা সবচাইতে ভালো জানে রওনক।

তানিয়ার কেবিন থেকে ফিরে এসে নিজের কেবিনে ঢোকার আগে সামান্য দাঁড়ায় রওনক। তাকে দেখে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় লাবিব। একমুহূর্ত লাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রওনক বলে,

-ভেতরে আসো।

লাবিবকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে নিজের কেবিনে চলে যায় রওনক। সময় বিলম্ব না করে লাবিব তার ডেস্কের উপর থাকা প্যাড নিয়ে বসের কেবিনে প্রবেশ করে। রওনকের টেবিলের কাছাকাছি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

-কি করতে কবে?

-বসো।

-জি!

-সিট ডাউন লাবিব।

লাবিবের হাতে থাকা প্যাডটা সে টেবিলের উপর রেখে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। রওনকের হাবভাব অন্যরকম লাগছে তার কাছে এইমুহূর্তে। খানিকক্ষণ লাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ইজ এভরিথিং অলরাইট?

-বুঝলাম না স্যার!

-আমি তোমার কথা জিজ্ঞেস করছি লাবিব। আর ইউ অলরাইট?

-এবসিলিউটলি স্যার৷ আমার কি হবে?

-তুমি আমার পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট লাবিব। অনেকটা বন্ধুর মতো। প্রতিদিনের একটা সিংহভাগ সময় তুমি আমার সঙ্গে থাকো। আমি তোমার মুখ দেখলে বলতে পারি তুমি কেমন আছো। লাস্ট কয়দিন ধরে দেখছি তুমি তোমার মধ্যে নেই। ব্যাক্তি লাবিব এখানে উপস্থিত থাকলেও তোমার মন-মস্তিষ্ক অন্যকোথাও থাকে। কখনো কোনো কাজে ভুল না করা মানুষটা একটা সিঙ্গেল কাজ ঠিকঠাক করতে পারছে না। এরপরেও বলবে তুমি ঠিক আছো?

-আই এম এক্সট্রিমলি সরি স্যার। তবে আপনি একদম ভাববেন না। এরপর আর কোনো ভুল হবে না। আই প্রমিজ ইউ, মন দিয়ে কাজ করব।

-লাবিব! আমি কাজের কথা বলছি না। আমি তোমার কথা বলছি। তোমার কথা ভাবছি। আর ইউ ওকে? তুমি ভালো নেই। আই এম ওয়ারিড এবাউট ইউ। ইউ নো, ইউ আর ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট ফর মি। লাইক এ ব্রাদার, লাইক এ ফ্রেন্ড। সামওয়ান, হুম আই ক্যান রিলে। আই ক্যান ট্রাস্ট।

-আই এম সরি স্যার। আমি আমার পার্সোনাল প্রবলেমের জন্য অফিসের কাজ নষ্ট করেছি। আপনাকে টেনশন দিচ্ছি। কিন্তু আর এমন হবে না। আই এসর ইউ দ্যাট।

রওনক তৎক্ষনাৎই কিছু বলে না। একমুহূর্ত সময় নেয়। হাতের কাছে টেবিলের উপর থাকা চিত্রলেখা ও তার একটা এফর সাইজ ফটোফ্রেম হাতে নেয়। খানিকক্ষণ চিত্রলেখাকে দেখে নিয়ে ফ্রেমটা পূর্বের জায়গায় নামিয়ে রাখে। আবার লাবিবের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমি যে পজিশনে আছি, এই পজিশনটা যে আমার জন্য কতখানি বিপদজনক তা তুমি খুব ভালো করে জানো লাবিব। নিজের জীবন, সব সম্পর্ক, সব কিছু হাতে রেখে এই পজিশনটায় বসে আছি আমি। আমার জায়গা থেকে আমি আমার মা-ভাইকেও পুরোপুরি ভরসা করতে পারি না। তবে একদমই কাউকে ভরসা করতে পারি না তেমনও নয়। হাতে গোণা যে কয়জন মানুষকে আমি বিশ্বাস করি, যাদের উপর আমি ভরসা রাখতে পারে তন্মধ্যে তুমি অন্যতম লাবিব। তবে তোমাকেও যে না জেনেই ভরসা করি তাও নয়। তোমাকে পুরোপুরি ভরসা করার আগে অনেকদিক বিচার বিবেচনা করতে হয়েছে আমাকে। সবসময় সতর্ক থাকতে হয়েছে৷ তোমার ইন এন্ড এভ্রি মুভ সম্পর্কে জানি আমি। তোমার ফ্যামিলি লাইফ, ফ্রেন্ডসার্কেল, সোশ্যাল লাইফ এমনকি পার্সোনাল লাইফও। কাউকে ভালোবাসাটা ভুল নয়, অন্যায় নয় লাবিব। সমস্যা হচ্ছে অনেকসময় আমরা ভুল সময় নয়ত ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলি। আসলে ভালোবাসা বা ভালোবাসার মানুষ কোনোটাই ভুল নয়। সিচুয়েশন অনেকসময় আমাদের সঙ্গ দেয় না। কিন্তু একবার চেষ্টা না করে হাল ছেড়ে দেয়ার পক্ষে আমি নই৷ আমি যদি সেকেন্ড চান্স ডিজার্ভ করি তাহলে ঐ মানুষটাও আরেকটা চান্স ডিজার্ভ করে। সম্ভব না জেনেও ভালোবাসতে পেরেছো চলে যাবার আগে তাকে সেটা জানাবে না?

-আ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার। আপনি কি বলছেন?

-আমি সব জানি লাবিব। তুমি নিজে আমাকে জানিয়েছো কাউকে ভালোবাসো। তাকে জানাবে বলেছিলে কিন্তু জানাওনি। কেনো জানাওনি জানি না৷ কিন্তু আমার মনে হয় এখন অন্তত ভাবী চলে যাবার আগে তোমার মনের কথা তাকে জানানো উচিত।

-স স্যার আমি…

-ইটস ওকে লাবিব। আই রিয়েলি ডোন্ট হ্যাভ এনি প্রবলেম। আমি শুধু চাই ঐ মানুষটার জীবনেও এমন একজন আসুক যে তাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসবে। অন্তত নিজের ভালো লাগার কথাটা তাকে জানাও। তুমি তার জন্য কি ফিল করো এতটুকু জানার রাইট তার আছে। হয়ত এরপর কখনো সুযোগ নাও পেতে পারো। তাই সুযোগ থাকতে একবার বলেই দেখো কি হয়।

লাবিব বুঝতে পারে না কি জবাব দিবে। রওনক নিজেই আরও বলে,

-আমি কি বললাম একবার ভেবে দেখো। তবে মনে রেখো তোমার হাতে সময় বেশি নেই। জলদি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার মতে পরে আফসোস করার চাইতে এখনই একটা স্টেপ নেয়া হয়ত ভালো হবে। যাই হোক অন্তত তোমার আফসোস থাকবে না সুযোগ পেয়েও তাকে জানাওনি। একবার বলেই দেখো লাবিব।

রওনকের সামনে কিছু বলতে পারে না লাবিব। গলা দিয়ে আর কথাই বের হয় না তার। ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসে আছে সে। মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে তার। বুঝতে পারছে না তার আসলে কি করা উচিত৷ রওনকের এডভাইস মতো সত্যি সত্যি তানিয়াকে মনের কথা জানাবে সে? এই কাজটা করা কি উচিত হবে? এইমুহূর্তে উচিত অনুচিত ভাবতে পারছে না। এটাও সত্যি তানিয়া চলে যাবার পর হয়ত সত্যি সত্যি আর সুযোগ পাবে না সে। আর হয়ত কোনোদিন তাদের দেখা হবে না। এটাই হয়ত তার শেষ ও একমাত্র সুযোগ।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

সেদিনের পর আর মামুনের সঙ্গে দেখা হয়নি চারুর। হয়তো এদিকে আসেনি সে। বা এসে থাকলেও চারুকে এড়িয়ে চলেছে। চারুর এখন একটাই চেষ্টা মামুনের কথা চিন্তা করা। কিন্তু মানুষের ধর্ম হচ্ছে তাকে যেটা করতে না করা হবে সেটাই সে বেশি করে। চারু যত মামুনের কথা না ভাবার চেষ্টা করে ততই বেশি যেনো মামুনের ভাবনারা তার মস্তিষ্কের দখল নিয়ে বসে থাকে। সমস্ত দিন লেখাপড়া, হাজার রকম কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেও কাজ হয় না। ঘুরে ফিরে মামুন নামক ভাবনারা ঠিকই চারুর মস্তিষ্কের পথ খুঁজে নেয়। একমাত্র বৃষ্টি জানে চারুর মনের অবস্থা। অন্যরা সবাই হাসিখুশি চারুকে দেখে কিন্তুর তার ভেতরকার দুঃখটা কেবল বৃষ্টি টের পায়। তাই তো সুযোগ পেলেই চারু বৃষ্টিকে খানিকক্ষণের জন্য জড়িয়ে ধরে মন হালকা করার চেষ্টা করে। বৃষ্টি নিজেই একই রোগে আক্রান্ত আরেকজন কি সান্তনা দিবে সে! তবু চেষ্টা করে চারুকে সঙ্গ দেয়ার।

ইদানিং ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের ব্যস্ততায় দিন কাটছে রওনকের। চিত্রলেখাকে সময় দেয়া তো দূরের কথা ঠিকঠাক নিঃশ্বাস নেয়ার সময়টাও পাচ্ছে না সে। হাজার ব্যস্ত থাকলেও তার মস্তিষ্কের ভেতর সারাক্ষণ চিত্রলেখাই থাকে। কথা বলার সময় পাচ্ছে না সে বউয়ের সঙ্গে কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছে কোনো কারণে চিত্রলেখা চিন্তিত। হয়তো তাকে কিছু বলতে চায় কোনো কারণে পারছে না। বেশ কিছুদিন ধরেই রওনকের ফিরতে রাত হয়। যতক্ষণে সে বাসায় ফিরে ততক্ষণে অন্যরা খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ে। সবাই শুয়ে পড়লেও চিত্রলেখা ঠিকই রওনকের অপেক্ষায় বসে থাকে। সে না ফিরা পর্যন্ত তার জন্য না খেয়ে বসে থাকে। তবে রওনক লক্ষ করেছে চিত্রলেখা লাস্ট ক’দিন ধরে ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করছে না। এমনকি রাতে ঠিকঠাক ঘুমাচ্ছেও না। হঠাৎ হঠাৎ রাতে ঘুম ভাঙলে প্রায়ই দেখে চিত্রলেখা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দু’রাত আগেরই কথা। বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠলে দেখে চিত্রলেখা তার পাশে নেই। না দেখেও বলতে পারবে তার প্রিয়তমা কোথায় আছে। বাথরুমের কাজ সেরে আর বিছানার দিকে আগায় না রওনক। বিছানা রেখে বারান্দার দিকে আগায় সে। কিন্তু বারান্দায় এসে সামান্য অবাক হয়। ইদানিং রাতে ঘুম ভাঙলে পরে চিত্রলেখাকে বারান্দাতেই পাওয়া যায়। কিন্তু আজ সে বারন্দায় নেই। চিত্রলেখা কোথায় আছে দেখার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। নিচে কিচেনে যাবার আগে ভাবে উপরের ফ্লোরেই আরেকটা জায়গা আছে যেখানে চিত্রলেখা থাকতে পারে। সেদিকেই আগায় সে। দোতলার ঝুল বারান্দার দিকে আগায় সে। বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়েই ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে সে চিত্রলেখাকে দেখতে পেয়ে। এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে প্রিয়তমাকে জড়িয়ে ধরে রওনক। মাথার পেছন দিকে নাক ঘষে, কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়ে বলে,

-এখানে কি করছো?

-ঘুম আসছিল না।

-তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?

-উঁহু

-তাহলে!

চিত্রলেখা কিছু বলে না। রওনক নিজেই বলে,

-ইদানিং দেখছি ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করছো না, ঠিক মতো ঘুমাচ্ছো না। আমি এপেয়ন্টমেন্ট নিয়ে দেই কাল ডাক্তার দেখিয়ে আসো?

-ডাক্তার দেখাতে হবে না, আমার কিছু হয়নি।

-আমার স্বস্তির জন্যই নাহয় দেখিয়ে আসো।

-আপনার ব্যস্ততা কমলে না হয় যাবো।

-কাল…

-প্লিজ।

রওনক আর জোর করে না। সে নিজেও বুঝতে পারছে তার চন্দ্রলেখা হয়তো শারীরিকভাবে অসুস্থ নয়। তার অসুস্থতাটা সম্ভবত মন-মস্তিষ্কের। খুব সম্ভবত কিছু নিয়ে চিন্তিত সে। রওনককে বলতে চাইছে না বা বলতে পারছে না। এক্ষুনি জোর করে না রওনক। আরেকটু সময় দেয় চিত্রলেখাকে নিজের ভেতরকার সংশয় কাটিয়ে ওঠার। যেনো সে নিজে থেকেই নিজের সমস্যার কথা জানাতে পারে। রওনক নিজেও আর কিছু বলে না। তার বুকের উপর নিজেকে ছেড়ে দেয় চিত্রলেখা। হয়তো শান্তি খোঁজার চেষ্টা করে। এই বারান্দাতেই একটা সিঙ্গেল দিভান রাখা আছে। এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখাকে বুকে নিয়েই দিভাবটাতে শুয়ে পড়ে রওনক। চিত্রলেখা বাধা দেয়ার চেষ্টা করে বলে,

-চলুন রুমে যাই।

-উঁহু, বাকি রাতটা এখানেই থাকি। একসাথে ভোর দেখবো। চাঁদ আমাদের দেখে জ্বলুক।

রওনকের মুখ চেপে ধরে চিত্রলেখা বলে,

-ইশ! আপনার মুখে কিচ্ছু আটকায় না তাই না?

নিজের মুখের উপর থেকে বউয়ের হাত সরিয়ে নিয়ে রওনক বলে,

-আমার বউ, আমি যা খুশি করব তাতে কার কি?

লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যায় চিত্রলেখার তৎক্ষণাৎ। হাত বাড়িয়ে লজ্জায় মাখোমাখো হওয়া মুখটা নিজের কাছাকাছি নিয়ে চিত্রলেখাকে কিছু বুঝার সুযোগ না দিয়ে ঠোঁট জোড়ার দখল নেয় সে। চিত্রলেখা জানে বাধা দিয়ে লাভ হবে না। বরং সে নিজেও তাল মেলায় রওনকের তালে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে