বৃষ্টি শেষে রোদ পর্ব-১০+১১

0
466

#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ১০)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

সাজ সকালে মুখে পানি পড়তেই ঘুম ভাঙলো রিদের। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে সামনে গ্লাস হাতে দাড়ানো আরশির দিকে তাকাতেই দেখে হাসছে সে। এই সকাল সকাল ঘুমের মাঝে পানি ঢালার মতো বিরক্তিকর আর কিছু আছে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না। তবুও এই বিরক্তিকর কাজটা করে সে নির্লজ্জের মতো হাসছে।

এবার বিরক্তির সাথে চেহারায় রাগান্বিত ভাব রেখে আরশির এক হাত চেপে ধরে রিদ। আচমকাই এভাবে ধরায় পালাতে চেয়েও ব্যর্থ হলো আরশি। রিদ উঠে দাড়িয়ে অন্য হাতে মুখে লেগে থাকা পানি গুলো মুছে বলে,
“এটা কি ছিল?”
আরশি এখনও মুখে হাসি ধরে রেখে বলে,
“ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।”
রিদ চেহারায় রাগান্বিত ছাপ রেখে আবারও স্বাভাবিক গলায় বলে,
“এতো আলগা পিরিত তো আমি দেখাতে বলিনি।”
“আপনি কেন বলবেন, আমি কি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম?”

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল রিদ। অতঃপর শান্ত গলায় বলে,
“এখন আর ভয় পাস না আমাকে?”
আরশি দু’দিকে ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালো। রিদ কিছু একটা বোঝার ভঙ্গিতে উপর-নিচে হালকা মাথা নাড়িয়ে ‘আচ্ছা’ বলে আরশির দুই হাত একজায়গায় করলো। আরশির দু’হাত রিদ এক হাত দিয়ে জোড়ে চেপে ধরে হাটা শুরু করে ওয়াশ রুমের দিকে। আরশি উহ্ সূচক শুব্দ করে নিজেকে ছাড়াতে চেয়েও ব্যর্থ হলো। এবার একটু ভয় পেলো এটা ভেবে এই লোক কেন আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাচ্ছে?

ওয়াশরুমে ঢুকে দেখে অর্ধেক পানি ভর্তি একটা বালতি রাখা আছে। রিদ ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“বাহ্ সব দেখি রেডি করাই আছে।”
আরশি এবার ব্যাপার টা বুঝতে পেরে ক্ষনিকটা কান্নার ভান ধরে বলে,
“স্যরি স্যরি স্যরি ভাইয়া, আর জীবনেও এমন কিছু করবো না। এই প্রমিস করছি।”

রিদ এবার তার হাত ছেড়ে এক পাশে দাড় করিয়ে বলে,
“কান ধরে দশ বার উটবস কর।”
ওয়াশ রুমে আশেপাশে কারো দেখে ফেলার ভয় নেই। তাই আরশি বাধ্য মেয়ের মতো কান ধরে উটবস করতে শুরু করলো। নয় পার হয়ে দশবার হতেই রিদ চুপচাপ বালতির পুরো পানিটাই ঢেলে দিল আরশির গায়ে। শারা শরির ভিজে গেলে যেন বোকা বনে গেলো আরশি। অবাক ভঙ্গিতে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে অতঃপর বলে,
“কান ধরার শাস্তি দিয়েছেন কান ধরেছি। তাবুও ভিজিয়ে দিলেন?”
রিদ এবার গাল টেনে একটা হাসি দিয়ে বলে,
“এটা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ স্কয়ার। কেউ আমাকে একটু ভালোবাসা দিলে আমি তাকে বহুগুণ ভালোবাসা ফিরিয়ে দিই। হিহিহি।”

বলেই চুপচাপ বেড়িয়ে গেলো রিদ। রাগে শরির রি রি করলেও কিছু বলতে পারছে না আরশি। নিজের দিকে তাকাতেই যেন এবার কাঁন্না পাচ্ছে খুব।

আরশির মা টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছেন। রিদ তার কাজে হেল্প করছে আর ফুপি-ভাতিজার দুখের-সুখের আলাপ করছে।
এর মাঝে এই সাজ সকালে আরশিকে ভেজা অবস্থায় দেখে ক্ষনিকটা চমকালো তার মা। কারণ জানতে চাইলে আরশি পরপর কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে যেন বেলুনের মতো ফুলছে। কিছুক্ষণ ফোঁস ফোঁস করে অতঃপর ক্ষনিকটা কাদু ভাব নিয়ে বলে,
“তোমার ভাইয়ের ছেলে করেছে এ কাজ। বিনা দোষে এই সাজ সকালে কাক ভেজা করে দিয়েছে আমায়।”

পূনরায় কাজে মন দিল তার মা। স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“বিনা বাতাসে তো আর গাছের পাতা নড়ে না।”
“আমি কিছু করিনি।”
“তুমি কত ধোয়া তুলসীপাতা, সেটা তো রিদের ভেজা টি-শার্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”

মায়ের কথা আরশি কিছুটা হতাশ হয় আরশি। মা হয়েও ভাইয়ের ছেলের পক্ষ নিয়ে নিজের মেয়ের বিরোদ্ধে রায় দিচ্ছে? দেশ থেকে ন্যায় বিচার উঠে যাচ্ছে দিন দিন।

“””””””””””””””””””””””””””

সকালে সবার নাস্তা শেষে যার যার ব্যস্ততায় উঠে চলে গেলেও এখনো টেবিলে নাস্তা নিয়ে বসে আছে ফারুক। একটু একটু করে খাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে খাবার টা শেষ করতে চাইছে না আজ।

সবাই উঠে চলে গেলে রুহির দিকে চেয়ে ফারুক বলে,
“ভাবি, এখানে বসো। তোমার সাথে কথা আছে একটু।”
রুহি কৌতুহল নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে বলে,
“হুম ভাইয়া বলুন।”
ফারুক ক্ষনিকটা মৃদু হেসে বলে,
“প্রথমত আমাকে তুমি বা তুই করে বললেই আমি বেশি খুশি হবো। কারণ বয়সেও আমি আপনার ছোট। আর দ্বিতীয়’ত স্যরি।”

রুহি কিছুটা কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু স্যরি কেন?”
“ঐ দিনের ঘটনার জন্য। বিশ্বাস করুন ভাবি আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। আরশি হোচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার সময় শুধু সেভ করেছিলাম এটুকুই। আর হুট করে রিদ ভাই এসে হয়তো ভুল বুঝে এমন একটা সিকুয়েশন ক্রিয়েট করে ফেলেছে। বিষয়টা পুরোটাই একটা মিস আন্ডারস্টেনিং।”

হুট করে ঐ টপিক উটায় রুহি কিচুটা বিব্রত হয়ে বলে,
“দেখো, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি মনে করি ওসব নিয়ে আর না ভাবাটাই ভালো হবে।”
ফারুক পূনরায় বলে,
“যদিও আমার মনে হয় আমি কোনো ভুল করিনি। তবুও ভাবি, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমার মনে হয় আমার ক্ষমা চেয়ে আত্মিয়তার সম্পর্কটা সুন্দর রাখা উচিৎ। আমি জানি, রিদ ভাই আমার সাথে কথা বলতে চাইবে না। তবুও ভাবি আপনি তার সাথে আমার একটু কথা বলিয়ে দিবেন? আমি যাষ্ট ক্ষমা চাইবো আর কিছু না।”
প্রতি উত্তরে কিছুক্ষন চুপ থেকে রুহি বলে,
“আচ্ছা, দেখি কি করা যায়।”

“””””””””””””””””””””””””””””””

বেলকনিতে গিয়ে দাড়ালে বাইরে রিদের গাড়ি দাড় করানো দেখে চমকালো আরশি। সকালে গিয়েছিল, এখন আবার হুট করে আসার কারন কি?
বুঝতে না পেরে বেলকনি থেকে রুমে ফিরে আসে সে। তখনি রিদ রুমে প্রবেশ করে ক্ষনিকটা তাড়া দেখিয়ে বলে,
“রেডি হয়ে নে, বাইরে যাবো।”
“কেন?”
“গেলেই দেখবি।”
“আম্মু,,,,,,,”
“ফুপিকে বলেছি আমি। এখন যা বলছি চুপচাপ তাই কর। আমি কিছুক্ষণ ওয়েট করছি, দশ মিনিটের মাঝে রেডি হয়ে বাইরে আয়।”
বলেই বেরিয়ে গেলো রিদ। জানার কৌতুহল থাকলেও প্রশ্ন করার সুজুগ পেলো না আরশি।

রেডি হতে প্রায় পনেরো মিনিট সময় লাগলো তার। তাড়াহুড়ো করলেও পাঁচ মিনিট লেট। যাই হোক, এর জন্য কিছু শুনতে হয়নি তাকে। আরশি রেডি হয়ে বের হলে রিদ ফুপিকে ডেকে বলে,
“আমরা যাচ্ছি ফুপি।”
ফুপি তাদের কাছে এসে বলে,
“আচ্ছা, ওর বাবা ফেরার আগেই তারাতাড়ি ফিরে আসিস বাবা। নাহলে আবার রেগে যেতে পারে।”

রিদ অন্য দিকে তাকিয়ে নিজের মাঝে বিড়বিড় করে বলে, ‘বউ নিয়ে বাইরে গেলে শশুরের এতো সমস্যা কিসের?’
পাশ থেকে আরশির মা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কিছু বললি?”
রিদ ক্ষনিকটা মৃদু হেসে বলে,
“না ফুপি তেমন কিছু না। তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো।”
“আচ্ছা, ফি আমানিল্লাহ।”

“”””””””””””””””””””””””””””””””

ছাঁদের মাঝে একটা খোলা রেস্টুরেন্টে বসে আছে দুজন। আরশি কৌতুহল নিয়ে রিদের দিকে চেয়ে বলে,
“আমরা এখানে কার জন্য অপেক্ষা করছি।”
“রুহির জন্য।”
রিদ শান্ত গলায় কথাটা বললেও অনেকটাই অবাক হয় আরশি। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“রুহি আপু! হটাৎ এই জায়গায়!”
“হুম। বলল, বিয়ের দিন যাইনি তাই আজ যেন তোকে নিয়ে তার সাথে দেখা করি।”

কিছুটা নার্ভাস হয়ে গেলো আরশি। রুহি আপুর সাথে নিশ্চই দুলাভাইও আসবে। এতকিছুর পর ভাইয়ার সামনে দাড়াতে হবে, ভাবতেই কেমন যেন লাগছে তার। যেন এমনটা জানলে রিদের সাথে আসা দুরে থাক, বাসা থেকেই বের হতো না সে।
ভাবতে ভাবতেই রুহি আপু উপস্থিত হয় সেখানে। নার্ভাস হওয়া চেহারা এবার অবাক হওয়ায় রুপ নিল। রুহিকে দেখে খুশি হলেও পাশে ফারুককে দেখে অনেকটা অবাক হলো রিদ নিজেও।

রুহি সামনে আসতেই উঠে দাড়িয়ে গেলো রিদ। এক পলক ফারুক-কে দেখে নিয়ে শান্ত গলায় রুহির দিকে চেয়ে বলে,
“ও তোর সাথে কেন?”
শান্ত ভাবে প্রশ্ন করলেও রিদের রাগ বুঝতে সময় লাগলো না রুহির। এবার আরেকটু কাছে গিয়ে রিদের এক হাত ধরে বলে,
“দেখ, ভুল বুঝিস না ভাই। ফারুক তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তাই সে এসেছে তোদের কাছে তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে।”

রিদ পূনরায় শান্ত ভাবে বলে,
“এটা কি শুধুই একটা ভুল ছিল?”
রুহি পূনরায় তাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে,
“দেখ যা হওয়ার হয়ে গেছে। ভুলে যা ওসব। ভুল বড়ো হলেও ক্ষমা করা মহৎ গুন।”
এর মাঝে ফারুকও পাশ থেকে বলে,
“আ’ম রিয়েলি স্যরি রিদ ভাই। ফান করতে গিয়ে আমার এমনটা করা ঠিক হয়নি। আমি আমাজ কাজের জন্য লজ্জিত। ছোট ভাই মনে করে ক্ষমা করে দিন, প্লিজ।”

রিদ কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। ফারুক এবার আরশির দিকে চেয়ে দু হাত জোর করে বলে,
“আপু সত্যি আমি সেদিন মজা করতে গিয়ে এমনটা হয়ে গেছে। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। ভাই হিসেবে ক্ষমা করে দিন। আমি আপনাদের সবার কাছেই ক্ষমা পার্থী।”

দুজনের কাছে ক্ষমা চেয়ে সবটা স্বাভাবিক করে নিল ফারুক। ফারুকের মাঝে অপরাধবোধের ছাপ দেখে আর কিছু বলতে পারলো না রিদও। রিদকে ক্ষমা করতে দেখে এবার আরশিও ক্ষমার দৃষ্টিতে তাকালো। মানুষ মাত্রই ভুল। আর ক্ষমা করাটাও মহৎ গুন।

একসাথে বসলো চারজন। ফারুক অনেকটা হাস্যজ্জল মুখে ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার দিল। যেন আজ খুব খুশির দিন তার। বিকেলটা চারজন একসাথে উপভোগ করে বিদায় নিল তারা। ফারুক হাসি মুখে রিদের সাথে হ্যান্ডসেক করে কোলাকুলি করে নিল। অতঃপর আরশির দিকে চেয়েও নমনীয় ভাবে বিদায় দিল ফারুক।

বিদায় নিয়ে আরশির হাত ধরে গাড়িতে উঠে বসলো রিদ। জানালা দিয়ে হাত নারিয়ে পূনরায় বিদায় জানিয়ে ছুটলো আরশিদের বাড়ির উদ্দেশ্য। আরশিকে পৌছে দিতে হবে তাড়াতাড়ি।

রুহি গাড়িতে উঠে বসলো। ফারুক গাড়ির পাশে দাড়িয়ে এক পলক তাকালো রিদের গাড়ির দিকে। কিছুটা মুচকি হেসে নিজের মাঝে বিড়বিড় করে বলে,
“সব কিছু এতটুকুতেই শেষ নয়। আর না আমিও একটুকুতে হার মেনে নেওয়ার মানুষ। নিজেকে ছোট করেছি মাত্রই আত্মিয়তার সম্পর্ক টা সুন্দর রাখতে। আমার আঘাতের স্বাদ ঠিকই উপভোগ করতে হবে দুজনকে। অপেক্ষাটা শুধু সঠিক সময়ের।”

To be continue……………

#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ১১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

আজ শুক্রবার। প্রতি সাপ্তাহের নিয়ম অনুযায়ী অগন্তুকের চিরেকুট রেখে যাওয়ার তিন রাতের মাঝে আজ শেষ রাত। তাই অগন্তুক কে জানতে রাত জাগা পাখির মতো বেলকনিতে দৃষ্টিতে রেখে বসে আছে আরশি। গত দু’দিন ধরে পাহারা দিয়েও কোনো সু-ফল পায়নি। বৃহস্পতিবার সকালে বেলকনিতে কোনো চিরেকুট ছিল না, আজ শুক্রবারেও ছিল না। তার মানে শনিবার সকালে চিরেকুট পাওয়া যাবে এতে শতভাগ নিশ্চিত সে।

ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে রাত ৩ টা। ঘুমে চোখ দু,টো জ্বলছে তার। অলরেডি দু’বার চোখে পানি ছিটিয়েছে। তবুও জেদ ধরে বসে আছে। আজ এই লুকোনো চিরেকুটের মালিককে হাতেনাতে ধরতে হবে তার।

চোখ কচলে চুপচাপ বেলকনির দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো সে। না, বেলকনি পুরোই ফাঁকা। বাইরেও কারো সাড়াশব্দ নেই। হতাশ হয়ে দুলতে দুলতে আবারও রুমে এসে বসলো সে। দেখতে দেখতে প্রায় ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো। ঘুমে মাথা ব্যাথা করছে তার। হেলান দেওয়ার জন্য একটা বালিশ পেছনে রেখে চোখ বুঁজে বসে আছে সে। ধরেই নিল, আজও অগন্তুক আসবে না। চোখের পাতা বন্ধ হতেই যেন রাজ্যের সব ঘুম এসে আঁকড়ে ধরেছে তাকে।

মায়ের ডাক শুনে চোখ মেলে তাকায় সে। তখন সকাল আট টা। এর আগেও নাকি তিনবার ডেকে গেছে মা। ঘুম না হওয়ায় চোখ দুটো এখনো জ্বলছে। ঘুমকাতুর ক্লান্ত শরিরে বিছানা থেকে নেমে দুলতে দুলতে বেলকনির কাছে এসে দাড়ালো। ভালো করে তাকাতেই যেন সব ঘুম উড়ে গেলো মুহুর্তেই। আজ চিরেকুটের সাথে একটা গোলাপও রাখা।

বিরক্তিতে যেন এবার নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে আরশির। তবুও চুপচাপ কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে খুললো সেটা।

‘রাত জাগা পাখি,
একজন ঘুমকাতুরে রমনীর জন্য এমন সম্মোধন একদমই বেমানান। তবুও আজ এই সম্মোধনেই লিখতে ইচ্ছে হলো খুব। কাগজে ফুটিয়ে তোলা এই লুকোনো ভালোবাসার অংশ টুকু তোমার আড়ালে রাখতে চেয়ে গত তিন রাত বাইরে বসে অপেক্ষায় জেগে জেগে হাজারো মশার কামড় খাওয়ার অনুভূতিটা তীব্র প্রশান্তিতে রুপ নেয় তখনই, যখন ভাবি আমার প্রিয় মানুষটাও আমার অপেক্ষায় তিনটি রাত নির্ঘুম কাটিয়েছিল।’

আর কিছুই লিখা ছিল না কাগজে। তবুও আজকের চিরেকুট সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে আরশিকে। তার কারণ, অগন্তুক কিভাবে বুঝতে পারলো সে তার অপেক্ষায় জেগে ছিল? আর এটাই বা জানলো কিভাবে সে ঘুম পাগল মেয়ে? তিনি কি সত্যিই খুব পরিচিত কেউ? লুকিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করা মানুষটা আরশি যাকে সব সময় সন্দেহ করে সত্যিই সে নয়তো? উফ, হয়তো আরেকটু জেগে থাকতে পারলেই হাতেনাতে ধরা যেত তাকে।

“””””””””””””””””””””””””””””

কেটে গেলো আরো কিছু দিন। তিন দিন পর রিদের ফ্লাইট। যার জন্য বাড়িতে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে রুদ্র চৌধুরী। আত্মিয়-স্বজন সবাইকে ফোনে দাওয়াত দিলেও কি মনে করে ফুপিদের দাওয়াত দিতে তাদের বাসায় চলে গেলো রিদ।

দরজা খুলে ভাইয়ের ছেলেকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠে ফুপির। রিদ ভেতরে আসতে আসতে মৃদু হাসি রেখে বলে,
“তোমাদের আবার বিরক্ত করতে চলে এলাম ফুপি।”
ফুপি কিছুটা হেসে বলে,
“এক চ’র খাবি উল্টাপাল্টা কথা বললে। ফুফির বাসায় আসবি না তো কোথায় যাবি হুম?”
কিছুটা হাসলো রিদ। হাটতে হাটতে নিজের মাঝে বিড়বিড় করে বলে,
‘একদম ঠিক বলেছো ফুপি। আমার জানটাই তো এই বাড়িতে পড়ে আছে। না এসে থাকি কিভাবে?’

ফুপি কিছুটা ভ্রু কুচকে বলে,
“কি সব বিড়বিড় করিস?”
রিদ ফুপির দিকে চেয়ে বলে,
“বলছি, ফুপি তো মায়ের মতোই। তো ছেলে মায়ের কাছে আসবে না তো কোথায় যাবে?”

একটা প্রশান্তির নিশ্বাস নিল ফুপি। তিনি দুই মেয়ের মা হলেও কোনো ছেলে সন্তান নেই তার। সত্যিই রিদকে দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় এটাই তার ছেলে। রিদ একটা প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে বলে,
“আঙ্কেল তো এখনো ফিরেনি মনে হয়?”
ফুপি তার কাছে এগিয়ে এসে প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বলে,
“আসার সময় হয়েছে, চলে আসবে একটু পর। আর এগুলো কি?”
ফুপি প্যাকেটের ভেতর আইসক্রিম ও চকলেট এর বক্স গুলো দেখে প্রশ্ন করলে রিদ স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“ওগুলো আরশির জন্য। ওর পছন্দের খাবার।”

ফুপি এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে রিদের দিকে চেয়ে বলে,
“খাবার না ছাঁই। তোকে এসব আনতে নিষেধ করেছি না? দুদিন পরপর এসব এনে ফ্রিজ ভর্তি করে রাখিস। আর এই হাবিজাবি খেয়ে ভাত একদমই খেতে চায় না ফাজিলটা।”
ক্ষনিকটা মুচকি হাসলো রিদ। মুখে হাসি ধরে রেখে বলে,
“কোথায় সে?”
“তার রুমেই পড়ছে।”

আরশির রুমের দিকে এগিয়ে গেলো রিদ। হটাৎ রিদকে দেখে একটু হলেও চমকাবে আরশি। ভেতরে প্রবেশ করতেই যেন মাথায় বাজ পড়ল তার। আহত হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে আরশি। কপালে লেগে থাকা লাল তরল পদার্থ দেখেই যেন বুকটা ধুক করে উঠলো তার। রিদ ছুটে তার কাছে গিয়ে ফ্লোরে বসে মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল। চোখে মুখে অস্থিরতার ছাপ। রিদকে দেখে আরশি খুব আহত গলায় বলে,
“এসেছেন? আমি ভেবেছিলাম ম’রার আগে আর আপনার মুখটা দেখা হবে না।”
রিদ উত্তেজিত গলায় বলে,
“কি সব উল্টাপাল্টা বকছিস? আর এসব কিভাবে হলো?”

আরশি আবারও আহত আহত গলায় বলে,
“বাতরুমে পা পিছলে,,,,,”
রিদ উত্তেজিত ভাবে তাকে উঠাতে গেলে আরশি তার হাত ধরে থামিয়ে বলে,
“একটা সত্যি কথা বলবেন?”
“কি কথা।”
“আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার আগে আমি একটা কথা জানতে চাই। এটাই আমার শেষ ইচ্ছা। আপনার মুখ থেকে একবার শুনতে চাই। সত্যি করে বলুন, আপনি কি আমায় ভালোবাসেন?”

এতোক্ষন উত্তেজিত হয়ে থাকলেও এবার শান্ত হয়ে গেলো রিদ। কপালের দিকে ভালো করে তাকাতেই এবার প্রচুর রাগ হলো তার। কপালে আঙুল ছুঁইয়ে অতঃপর নাকের কাছে এনে বুঝতে পারে এটা রক্ত না।

চোর ধরা খাওয়ার মতো চোখ বুঁজে নিল আরশি। এমন ফাজলামির শাস্তি স্বরুপ পাক্কা দশ মিনিট কান ধরে এক পায়ে দাড়িয়ে থাকতে হলো তাকে। এবার নিজের৷ প্রতি প্রচুর রাগ হচ্ছে তার। ইশ কেন যে টিভিতে দেখে এভাবে ভালোবাসা কথা বের করতে গেলাম? শেষে এসে ভালোবাসায় প্রকাশের বিপরীতে কান ধরে দাড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ওফ অসহ্য।

“”””””””””””””””””””””””””””””””””

কেটে গেলো আরো দু’দিন। আজ বিকেলেই বাসায় ফিরে আসে রোহান। আগামি কাল সকালে রিদ বেড়িয়ে যাবে বাসা থেকে। আজ রাতে সবাইকে দাওয়াত দেওয়ায় মেহমানরাও আসতে শুরু করেছে দেখে তারাতাড়িই বাসায় ফিরলো রোহান।

হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল। বাসায় প্রবেশ করতেই রুমকিকে দেখে ডেকে বলে,
“এই বাতি লেবু ধর। এগুলো তোর জন্য।”
বাতি লেবু বলায় কিছুটা রাগ হলেও ফুল দেখে আপাতত সেই রাগ চলে গেলো রুমকির। দেখে কম করে হলেও একশো টা ফুল আছে এখানে। দু’হাতে ফুল গুলো নিয়ে রোহানের দিকে চেয়ে বলে,
“এগুলো আমার জন্য? আপনি এনেছেন, রিয়েলি! সূর্য কোন দিকে উঠলো আজ?”

রোহান টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে বলে,
“আসার সময় দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলে ফুল গুলো নিয়ে মন খারাপ করে দাড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলে বলে, আজ বিক্রি করতে পারেনি। তার প্রতি মায়া হলো তাই সব গুলোই নিয়ে নিলাম। ভাবলাম ফেলে দিয়ে কি করবো, তোর তো আবার গোলাপ খুব পছন্দ। তাই নিয়ে এলাম।”

রুমকি কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“আপনাকে কে বললো আমার গোলাপ পছন্দ?”
“পছন্দ না হলে কি সেদিন রুহির বরের বিয়ের গাড়ি থেকে গোলাপ চুরি করতি?”

বলেই একটু ভাব নিয়ে চুপচাপ চলে গেলো রোহান। ফুল হাতে অবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে রুমকি। জানতে ইচ্ছে হচ্ছে সেদিন লুকিয়ে ফুল চুরির বিষয়টা রোহান ভাই কিভাবে জানলো?

“””””””””””””””””””””””””””””””””

রাতে খাওয়া শেষে রিদকে বিদায় ও শুভ কামনা জানিয়ে মেহমানরা চলে গেলো একে একে। বিষন্ন মনে মনে ছাদে দাড়িয়ে ছিল রিদ। বিদায়ের সময়টা ঘনিয়ে আসতেই যেন বুকটা ভাড়ি হয়ে উঠছে তার। তাই তো মন খারাপ প্রকাশ না পেতে সবার থেকে আড়ালে এসে দাড়িয়ে আছে। এর মাঝে তার সামনে এসে দাড়ালো আরশি। আজ একদমই হাস্যজ্জল বা চটপটে ভাবটা নেই। বিষণ্ন মনে মাথা নিচু করা।

রিদের এবার খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে হলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,
“পিচ্চিটা মন খারাপ করে আছে কেন?”
আরশি মাথা তুলে স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“আপনাকে শুভ কামনা জানাতে এসেছি। দোয়া করি সব সময় খুব ভালো থাকুন। স্বপ্ন পূরণ করে তাড়াতাড়ি সহি সালামতে ফিরে আসুন আমার,,,, মানে আমাদের সবার কাছে।”

বিষণ্নতার মাঝেও কিছুটা মুচকি হাসলো রিদ। আরশির দু’গালে হাত রেখে নমনীয় গলায় বলে,
“ইন’শা আল্লাহ্।”
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল আরশি। অতঃপর হুট করে বলে,
“আমার খুব ভয় হচ্ছে।”
রিদ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কেন?”
আরশি আবারও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে,
“আমি শুনেছি ইংল্যান্ডে নাকি চারপাশে সব সাদা চমরার মেয়েরা ঘুরে বেড়ায়। যদি আপনি তাদের ধোঁকায় পড়ে,,,,,,”

বাকিটুকু বলার আগেই রিদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“লাইফে যদি নির্দিষ্ট কেউ থাকে, যাকে দেখে অনুভব করা যায় আমার নিজের একটা ভালোবাসার মানুষ আছে। তাহলে দুনিয়ার সব সুন্দর্য এক করে সামনে এনে দিলেও ভালোবাসার মানুষটাই সবার উর্ধে থাকে। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আমার স্বপ্নের স্বপ্নচারিনীর চেয়ে অন্য সবই আমার কাছে মূল্যহীন। সেই মানুষটাই আমার একমাত্র মুগ্ধতা।”

নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ রিদের দিকে চেয়ে রইল আরশি। অনেক্ষন আটকে রাখা কাঁন্নাটা যেন আর ধরে রাখতে পারলো না সে। হুট করেই রিদকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে সে। কাঁদু স্বরে হিচকি তুলে বলে,
“খুব মিস করবো আপনাকে।”

বুকটা কেঁপে উঠলো রিদের। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথাটা যেন বহুগুন বেড়ে গেলো মুহুর্তেই। এই বয়সে আরশি এতটা আবেগি হয়ে যাবে তা হয়তো ধারণারও বাইরে ছিল। এখনো জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলছে মেয়েটা। এটা কি সত্যিই ভালোবাসা নাকি এই বয়সের আবেগ?

To be continue……………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে