বিষাদময় নিষাদ পর্ব-৩+৪

0
2860

#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০৩ + ০৪
জাহান আরা

ভোরের মিষ্টি বাতাস এসে চন্দ্রকে ছুঁয়ে যায়।বাতাসের ঝাপটায় খানিকটা কেঁপে উঠে চন্দ্র।
নিষাদ ঘুম থেকে উঠেছে অনেক আগেই,নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ এক্সারসাইজ করে,প্লাংক করে দীর্ঘ সময় নিয়ে।
ঘামে জবজবে হয়ে যায় নিষাদের পুরো শরীর,আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে নিষাদের মুখে।
আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে কিছুক্ষণ,তার প্রেমে কতো মেয়ে পাগল অথচ সে কি-না প্রেমে পড়লো এক পিচ্চি মেয়ের,যে মেয়ে কি-না তার ঘোর বিরোধী।

চন্দ্রর পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে নিষাদ,তারপর মুগ্ধ হয়ে তাকায় চন্দ্রর দিকে,চন্দ্রর চোখের পাতা হালকা কেঁপে উঠছে।
চন্দ্র কি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে?
নিষাদের ইচ্ছে করছে চন্দ্রর গালে হাত রাখতে,কপালে একটা চুমু খেতে,কিন্তু পারছে না।
কে জানে এই মেয়ে জেগে গেলে হয়তো লঙ্কা কান্ড লাগাবে।
একটা মেয়েকে এতো ভয় পাচ্ছে ভাবতেই নিষাদের হাসি পায়।
সারারাত মেয়েটা এতো নড়াচড়া করেছে যে নিষাদ নিজেই ঘুমাতে পারে নি।
স্থির হয়ে ঘুমাতে পারে নি মেয়েটা,সারা বিছানা দাপিয়ে বেড়িয়েছে,একটা বিছানা এই মেয়ের একাই লাগে।
নিষাদ ভেবে পাচ্ছে না ভবিষ্যতে বাচ্চাকাচ্চা হলে তারাসহ এক বিছানায় কিভাবে ঘুমাবে চন্দ্রকে নিয়ে।
কল্পনায় নিষাদ দেখতে পায় বাচ্চাদের কোলে নিয়ে নিষাদ বিছানার একপাশে বসে আছে,বাচ্চারা তার কোলে ঘুমুচ্ছে,আর চন্দ্র সারা বিছানায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
রাতে একচোট হাসে নিষাদ এসব ভেবেই।

চন্দ্র ঘুম থেকে উঠে সকাল ৮টায়,আড়মোড়া ভেঙে আয়নায় চোখ পড়তেই চমকে নিজের দিকে তাকায়,এখনো বিয়ের ভারী লেহেঙ্গা তার পরনে,মেকাপ,গহনা সব পরেই সে শুয়ে ছিলো।মুখের এই ভারী মেকাপ সে এখন তুলবে কি দিয়ে?
এখানে নারিকেল তেল পেলেও তো হতো,ড্রেসিং টেবিলের উপর নারিকেল তেল নেই ভালো করে খুঁজে দেখে চন্দ্র।

মাথায় হাত দিয়ে দেখে চুল সব ঝট পাকিয়ে গেছে।নিজেকে ভালো করে দেখে চন্দ্র,রাতে কি নিষাদ তাকে ছুঁয়েছে?
নিজের উপর নিজের রাগ হয় চন্দ্রর,ছ্যাবলার মতো সারারাত ঘুমিয়েছে,জেগে থাকবে বলেও জেগে থাকতে পারে নি।
নিজেকে নিজে ধিক্কার জানায়,”ছি চন্দ্র!
তোকে দিয়ে কিছু হবে না,আজীবন তুই এরকম হেরে যাবি।”

ওয়াশরুমে গিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়াতেই চন্দ্র অবাক হয়,বেসিনের সামনে মেকাপ রিমুভার রাখা আছে।শুধু মেকাপ রিমুভার না,চন্দ্রর নিত্যদিন ব্যবহার করা সবকিছু রাখা আছে,চন্দ্রর পছন্দের টুথপেষ্ট টুথব্রাশ ও বাদ যায় নি।
মুচকি হাসি ফুটে উঠে চন্দ্রর মুখে,এই লোকটা যে গুছানো তা আগে থেকেই জানে চন্দ্র,কিন্তু এতোটা কেয়ারিং তা জানা ছিলো না।
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে চন্দ্র মুখের মেকাপ তোলে,তারপর ফেইসওয়াশ দিয়ে মুখে ধোয়।

কেমন ফ্রেশ লাগছে নিজেকে,ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আরেকটা চমক পায়,টেবিলের উপর সকালে নাশতা,ড্রেসিং টেবিলের উপর সাজ সরাঞ্জম রাখা,একটু আগেও এখানে এসব ছিলো না।
চন্দ্র বুঝতে পারে সে যখন ওয়াশরুমে ছিলো তখন কেউ এসব রেখে গেছে এখানে।
মুখে ক্রিম লাগিয়ে চন্দ্র চুলের দিকে হাত দেয়,এবার সব চুল ছিঁড়ে ফেলতে হবে।

দরজায় নক হতেই চন্দ্র তাকায় সেদিকে,একটা ফর্সা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে,চন্দ্র তাকাতেই মিষ্টি হেসে বলে,”আসবো ম্যাডাম?”

ম্যাডাম!
তাকে কেউ ম্যাডাম বলে ডাকছে!
চন্দ্র কিছুটা অবাক হয়,অবাকের বিষয় টা নিজের মধ্যে চেপে রেখে মেয়েটাকে আসতে বলে।

“আপনি ৫মিনিট চোখ বন্ধ করে বসুন ম্যাডাম,আমি আপনার চুলের সব জট ছাড়িয়ে দিচ্ছি ৫ মিনিটে। ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দ্র,এই লোক অতিমাত্রায় যত্নশীল,চন্দ্রর সব খবর তার নখদর্পনে।
চুলে জট পাকালে যে চন্দ্র সব ছিঁড়ে ফেলে,কেটে ফেলে তাও জানে এই লোক।
হতাশ হয়ে চন্দ্র চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে।

দ্রুত হাতে মেয়েটা চুলে হাত লাগায়,চুল থেকে সব পার্লার ক্লিপ খুলে ফেলে,তারপর আস্তে আস্তে চুলের সব জট ছাড়িয়ে চুল বেঁধে দেয়।
চন্দ্র বেশ অবাক হয়।
মেয়েটা খুব পটু এই কাজে,চন্দ্র জিজ্ঞেস করে,”আপনি এতো দ্রুত কিভাবে পারলেন?”

মুচকি হেসে মেয়েটা জবাব দেয়,”আমার নিজের পার্লার আছে ৪টা ম্যাডাম,হাজার হাজার মেয়েকে আমি কাজ শিখিয়েছি।”

চন্দ্র আরো অবাক হয়,তারপর বলে,”আপনি এখানে কেনো তাহলে?”

“আপনার বর চেয়েছে বলে।”
মেয়েটা উদাস হয়ে যায় এইটুকু বলে।রহস্যের গন্ধ পায় চন্দ্র।ডাল মে কুছ কালা হে!

মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,”ওনাকে আপনি খুব ভালোবাসেন না-কি? ”

মেয়েটার মুখ মুহুর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে যায়,হাত থেকে চিরুনি পড়ে যায়।আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে মেয়েটা দ্রুত বের হয়ে যায় চন্দ্রর রুম থেকে।
হাসি পায় চন্দ্রর,ভীষণ হাসি পায়। হাহা করে হেসে উঠে।
ড্রেস চেঞ্জ করে নিতেই চন্দ্রর ফোন বেজে উঠে। হাবিব ভাই কল দিয়েছে,নিষাদের বিরুদ্ধে একটা সভার আয়োজন করেছে চন্দ্রদের দল থেকে,১০টায় সভা শুরু চন্দ্রকে সময় মতো উপস্থিত থাকতে বলে হাবিব।
হাবিব নিষাদের বিরোধী দলের সভাপতি।

চন্দ্র মনে মনে ভাষন দেয়ার প্রস্তুতি নেয়,নিষাদকে জব্দ করার এক সুযোগ পাওয়া গেছে,তা কিছুতেই মিস করা যাবে না এবার।
একটা মেরুন রঙের শাড়ি পরে নেয় চন্দ্র,ঠোঁটে একটু হালকা লিপস্টিক, ১০টা বাজার ১০ মিনিট আগে বের হয়ে যায় রুম থেকে।
পুরো বাসা যেনো জনমানবহীন,কোথাও কারো কোনো টু শব্দ শোনা যাচ্ছে না। চন্দ্র বুঝতে পারে না এটা বাসা নাকি মৃত্যুপুরী,এতো নিস্তব্ধ হবে কেনো!
হিল জুটোর খটাখট শব্দ তুলে চন্দ্র সিড়ি বেয়ে নিচে নামে,নিষাদ একপাশে সোফায় বসে আছে,নিষাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চন্দ্র বের হয়ে যায় বাসা থেকে।

সভায় গিয়ে চন্দ্র খানিকটা হতাশ হয়,প্রায় সব চেয়ারই ফাঁকা,১৫-২০ জনের বেশি মানুষ নেই সভায়,তাও এরা চন্দ্রদের দলের কর্মী।
দলের অন্যান্যরা একে একে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে,হাততালি দেয়ার মানুষ ও নেই এখানে।
কেমন পরাজিত মনে হয় চন্দ্রর নিজেকে।

চন্দ্রকে অবাক করে দিয়ে ৫ মিনিট পরেই আস্তে আস্তে মানুষ আসতে থাকে,চমকে উঠে চন্দ্র,কয়েকজন সাংবাদিক ও এসেছে।
মন খুশি হয়ে যায় চন্দ্রর,এবার উপযুক্ত শিক্ষা হবে নিষাদের বাচ্চার।
খুব বাজে একটা গালি দেয় নিষাদকে চন্দ্র মনে মনে।

স্টেজে চন্দ্রর ডাক পড়তেই চন্দ্র উঠে দাঁড়ায়,তারপর স্টেজে উঠে যায়।
মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সভার সবার দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠে চন্দ্র,সভার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে নিষাদ।
বুঝতে পারে চন্দ্র কেনো এখানে এতো লোকজন এলো আর এতো সাংবাদিক।
ঘেমে উঠে চন্দ্র,পার্স থেকে টিস্যু নিয়ে মুখ মোছে,তারপর নিচের দিকে ছুঁড়ে ফেলে টিস্যু।

সাদা সুতি একটা পাঞ্জাবি নিষাদের পরনে,মুখে ছোট-বড় খোঁচাখোঁচা দাড়ি,লাল ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছে যেনো পান খেয়ে এসেছে সে।যদিও চন্দ্র জানে নিষাদের ঠোঁট এরকমই।
লম্বা চুলগুলো কপাল ছাড়িয়ে চোখ ঢেকে দিচ্ছে,মাথা নাড়া দিয়ে নিষাদ চুল সরিয়ে দেয়,বুকের ভিতর হঠাৎ করেই কেঁপে উঠে চন্দ্রর।
এই ছেলেকে আজ এতো বেশি সুন্দর লাগছে কেনো!
ওই যে পকেট থেকে টিস্যু নিয়ে আলতো হাতে কপালের নাকের ঘাম মুছছে নিষাদ,তারপর হেটে গিয়ে চন্দ্রর সামনে স্টেজের নিচে দাঁড়ায়,চন্দ্রর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া টিস্যু টা ও তুলে নিয়ে ময়লা ফেলার ঝুড়িতে টিস্যু ২টা ফেলে আসে।

ছোট একটা কাজ,অথচ পুরো জনসভার সব মানুষ সোল্লাসে ফেটে পড়ে,হাততালি তে মুখরিত হয়ে যায় জনসভা।
মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায় চন্দ্রর,নিষাদ হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলে।

চন্দ্র রাগে,জিদে নিষাদের নামে নিন্দা করা শুরু করে।মুহুর্তেই ভুলে যায় এই লোকটা তার স্বামী,গতকাল থেকে তার সব সুখ দুঃখের সাথী এই লোক।
“আপনারা যাকে পরম শ্রদ্ধেয় মনে করেন,সেই নিষাদ হাসনাত চৌধুরী কি এতোটা সম্মানের যোগ্য?
গতকাল সে জোর করে আমাকে বিয়ে করেছে শুধুমাত্র তার বিরোধিতা যাতে না করতে পারি আমি,তারজন্য। ”

চন্দ্রর কথার মাঝখানে সভায় আবার গুঞ্জন উঠে,কয়েকজন উঠে দাঁড়ায়,নিষাদ হাত তুলে সবাইকে বসতে বলে।
চন্দ্রকে ইশারা দিয়ে মাইক্রোফোনে বলে,”ক্যারি অন ডিয়ার।”

মেজাজ আরো বেশি খারাপ হয় চন্দ্রর,মনে যা আসে তাই বলতে থাকে।
চন্দ্রর বক্তব্য শেষ হতেই নিষাদ সবার আগে হাততালি দিয়ে উঠে,নিষাদের সাথেসাথে জনসভার সবাই হাততালি দিয়ে উঠে।

সভা থেকে বের হওয়ার মুখে চন্দ্র নিষাদ মুখোমুখি হলো,সাথেসাথে চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো সাংবাদিকরা।
একজন প্রশ্ন করে বসলো,”স্যার,আপনার বিরুদ্ধে এই জনসভা,তারপরও আপনি জনসভায় যোগ দিলেন কেনো?”

নিষাদ চন্দ্রর হাত চেপে ধরে শক্ত করে,তারপর বলে,”প্রথম কথা ও আমার স্ত্রী,ওর ভালোমন্দ খেয়াল রাখার দায়িত্ব পুরোপুরি আমার,আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের আগে আমার ব্যক্তিগত জীবন,আমার দাম্পত্য জীবন।সেখান থেকে আমার প্রথম দায়িত্ব চন্দ্রকে নিরাপত্তা দেওয়া।
চন্দ্র কোথায় এলো,কেনো এলো তা পরের ব্যাপার।ও আমার সমালোচনা করতে এসেছে,তাতে আমার একটুও সমস্যা নাই।”
এটুকু বলেই নিষাদ চন্দ্রর হাত ধরে নিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে দিয়ে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো।
তারপর বের হয়ে গেলো গাড়ি নিয়ে।

চন্দ্র খানিকটা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো নিষাদের দিকে।
মানে কি হলো এটা তাই বুঝতে পারছে না চন্দ্র,এই লোক কিভাবে এরকম চুপ হয়ে সব শুনে গেলো!

ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকে চন্দ্র,পুরো নিউজফিডে নিষাদের ভিডিও,চন্দ্রর ফেলে দেওয়া টিস্যু নিষাদ তুলে নিয়ে ঝুড়িতে ফেলে এসেছে,আর শেষ মুহূর্তে বলা নিষাদের কথাগুলো কেউ যেনো এক করে ভিডিও বানিয়ে আপলোড করেছে ফেসবুকে,ক্যাপশন দেওয়া,”নেতা হিসেবে তুমি যেমন শ্রেষ্ঠ,তেমনি স্বামী হিসেবেও তুমি শ্রেষ্ঠ”
চন্দ্রর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।
মাত্র ১০ মিনিটে ১মিলিয়ন ভিউ হয়ে গেছে,শেয়ার হয়েছে অসংখ্য।
প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে নিষাদ,নিষাদের মহানুভবতা,নিষাদের ভালোবাসা।

হিতে বিপরীত হয়ে গেছে চন্দ্র বুঝতে পারতেই রাগে ক্ষোভে চিৎকার করে উঠে চন্দ্র।হেরে গেছে সে আবার।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছে চন্দ্রর।
একের পর এক সবাই আপলোড করছে ভিডিও টা,মেয়েদের ক্যাপশন দেখে চন্দ্রর কেমন যেনো হিংসা হতে থাকে,প্রায় সব মেয়ের ক্যাপশন এটাই যে,”এরকম একটা কেয়ারিং জামাই চাই”

রাগে মাথা গরম হয়ে যায় চন্দ্রর,সোজা হয়ে বসে গাড়িতে।নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেও পারছে না চন্দ্র,মাথার ভিতর যেনো আগুন জ্বলছে।

হঠাৎ করেই নিষাদ গাড়ি ব্রেক করে,তারপর নেমে গিয়ে একটা দোকান থেকে একটা ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে এসে চন্দ্রর দিকে বাড়িয়ে ধরে দৃঢ়স্বরে বলে,”নেমে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দাও,মাথায় খানিকটা দাও,তাহলে শরীর একটু ভালো লাগবে।”

নিষাদ হয়তো কথাটা চন্দ্রর ভালোর জন্যই বলেছে,কিন্তু চন্দ্র বিষয় টা সহজভাবে নিতে পারলো না।
ভীষণ অপমানিত বোধ হলো চন্দ্রর।
ইচ্ছে করছে একটা ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিতে নিষাদের,তবুও নিজেকে সামলায় চন্দ্র।
গাড়ির এসির ঠান্ডা বাতাস ও চন্দ্রর বুকের ভিতর টা ঠান্ডা করতে পারছে না কিছুতে।
হতাশায় ভরে যায় চন্দ্রর মন,মুহূর্তেই ইচ্ছে করে চন্দ্রর,নিষাদ কে খুন করে ফেলার।
মনে হচ্ছে এর সবই ভং,লোক দেখানো,মিথ্যে,অভিনয়।

নিষাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রর দিকে,একমাত্র এই একটা মেয়ে তাকে সেকেন্ডে সেকেন্ডে অভিশাপ দেয় নিষাদ জানে,চন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে নিষাদ,”তুমি যেমন সেকেন্ডে সেকেন্ডে আমাকে বলো ঘৃণা করি,ঠিক তেমনি প্রতি ন্যানো সেকেন্ডে আমি তোমাকে বলি ভালোবাসি চন্দ্রাবতী! ”

চমকে উঠে চন্দ্র নিষাদের কথা শুনে।
চন্দ্রাবতী!
অনিক!!
মুহুর্তেই চুরমার হয়ে গেলো যেনো চন্দ্র,প্রবলভাবে কেঁপে উঠলো,সেই কাঁপুনি বদলে গেলো কান্নায়,আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে চন্দ্র,অনিক তাকে ধোঁকা দিয়েছে!
চন্দ্রাবতী!এই নামে তো অনিকের ডাকার কথা ছিলো,আজ অনিক কই,কাকে ডাকছে ভালোবেসে অনিক!
গুঙিয়ে বলে উঠে চন্দ্র,”আমার অনিক,অনিইইইইক।”

নিষাদ চমকে উঠে,চন্দ্র এতোটা ভালোবাসে কাউকে ভাবনাতে ছিলো না নিষাদের,চন্দ্রকে কখনো এরকম আবেগময়ী মনে হয় নি,এই মেয়েটার মনে ও এতো প্রেম!
এতো ভালোবাসা!

চলবে…???

#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০৪
জাহান আরা

চন্দ্রর মুখ থমথমে হয়ে আছে,বুকের ভিতর ব্যথার প্রলয় নৃত্য। বারবার অনিককে মনে পড়ছে চন্দ্রর,আজ যদি অনিক থাকতো!
অনিক নিশ্চয় এখন তার বউয়ের কাছে।
চন্দ্রর মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়,অনিক কেনো শেষ সময়ে বিয়ে করতে এলো না,কেনো বর সেজে কাল নিষাদ গিয়েছে বিয়ে করতে?
তবে কি অনিক আর নিষাদ একে অপরকে চেনে?
এটা অনিকের আর নিষাদের ষড়যন্ত্র ছিলো?

ভাবনাটা মাথায় আসতেই চন্দ্রর রাগ আরো বেড়ে যায়।বিছানায় শুয়ে থাকা এই মানুষটাকে এখনই চন্দ্রর বালিশ চাপা দিয়ে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে।
হাবিব টেক্সট করে চন্দ্রকে,”চন্দ্র ভেঙে পড়ো না,নিষাদের একটা ব্যবস্থা আমরা করবোই।”

চন্দ্র রিপ্লে দেয়,”আমার খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে হাবিব ভাই ওকে।”
তারপর ফোন ছুঁড়ে মারে সোফার উপর।

বাহিরে আমের বোলের সুবাস পাওয়া যাচ্ছে,জানালা দিয়ে তাকায় চন্দ্র,জানালার পাশের একটা আম গাছ,আমের গুটি বড় হচ্ছে সবে মাত্র।
চকিতে মনে পড়ে চন্দ্রর সেই শৈশবের কথা,ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে,কালবৈশাখী ঝড়ে আম কুড়ানোর কথা।
বাতাসে গাছ ভেঙে পড়তো,সেই ঝড়েই ছুটে যেতো চন্দ্র আম কুড়াতে।
কতোদিন হয়ে গেছে সেই স্মৃতির,তবুও মনে পড়ে চন্দ্রর।বিছানায় গিয়ে শোয় চন্দ্র,নিষাদ অন্যপাশ ফিরে শুয়ে আছে,এক নজর নিষাদের দিকে তাকায় চন্দ্র।

বুকের ভিতর থেকে উথলে উঠে একরাশ হতাশা।
জীবন বারবার তাকে ধোঁকা দিচ্ছে,নিজের বলতে তার কেউ নেই।
নিষাদকে মৃদু ধাক্কা দিতেই নিষাদ ঘুরে তাকায় চন্দ্রর দিকে,তারপর জিজ্ঞেস করে,”কিছু বলবে?”

চন্দ্রর নিজেকে কেমন অসহায় মনে হয়,কেউ নেই তার,এই একটা মানুষ,যার হওয়ার কথা ছিলো চন্দ্রর সবচেয়ে আপন,সেই মানুষ টা চন্দ্রর সবচেয়ে বড় শত্রু।

চন্দ্রর ফর্সা মুখে বিষাদের ছায়া,কেমন ব্যথার চাপ মুখে।নিষাদের বুকের ভিতর ভাঙ্গন শুরু হয়। ইচ্ছে করে ভালোবাসার জোয়ারে ভাসিয়ে দিতে এই অপূর্ব মেয়েটিকে।

“আপনি অনিককে কিভাবে চেনেন সত্যি করে বলেন।”

অবাক হয় নিষাদ।
“অনিক?
কোন অনিক?
কে অনিক?”

“ভান করবেন না একদম,আমি জানি আপনি অনিককে চেনেন,না চিনলে আপনি কেনো কাল বিয়ের আসরে হাজির হলেন?
আমার তো অনিকের সাথে বিয়ে হবার কথা ছিলো।”

“হ্যাঁ তা ছিলো হয়তো,আমি জানি না,আমি শুনলাম তোমার বিয়েতে বর আসে নি,একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাবে তা কিভাবে হয় বলো,তাই তোমাকে লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে বিয়ে করেছি,তুমি কি ভেবেছো তোমাকে বিয়ে করতে আমি রাজী ছিলাম না-কি?
হু,কতো মেয়ে ঘুরে এই নিষাদের পেছনে,তোমার মতো দজ্জাল একটা মেয়েকে বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে।”

“কি বললেন আপনি?”

“আয়নায় নিজেকে দেখেছো তুমি?
মুখ ভর্তি তিল,নাক বোঁচা,চোখের কোলে কালি,এটা একটা চেহারা হলো না-কি?
তোমার হাত দেখো আর আমার হাত দেখো,তুমি নিজেই বলো এবার,কে বেশি ফর্সা?
আমি আরো সুন্দরী বউ ডিজার্ভ করি বুঝলা।”

অপমানে চন্দ্রর চোখে জল চলে এলো,নিষাদ একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রর অশ্রু টলটল চোখের দিকে,নিষাদ কিভাবে বুঝাবে,চন্দ্রর এই বোঁচা নাক,মুখের তিল,চোখের নিচের কালি,এইসব নিষাদের কতো চেনা,কতো প্রিয়!
কিভাবে বুঝাবে জল টলমল চোখে চন্দ্রকে ক্লিওপেট্রার চাইতে সুন্দরী লাগে!
নিষাদের ভিতর তোলপাড় শুরু হয় যে।

চন্দ্র কিছু না বলে শুয়ে পড়লো।রাগে মাথায় আগুন জ্বলছে।নিষাদ ও পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে,মনে পড়ে যায় প্রথম দিন চন্দ্রকে দেখার কথা।

মিটিং শেষ করে কলেজ থেকে বের হয়েছে নিষাদ,চন্দ্র তখন তড়িঘড়ি করে ছুটছে ক্যাম্পাসের দিকে।প্রথম দেখায় ভালো লেগে যায়।পায়ের স্যান্ডেল খুলে যায় দৌড়াতে গিয়ে,নিষাদ বাইকে বসে খেয়াল করে মেয়েটা একপায়ের স্যান্ডেল ফেলেই চলে গেছে।

চন্দ্রর ফেলে যাওয়া স্যান্ডেল টা নিষাদ তুলে এনেছে সবার অজান্তে।আজও তো আছে সেটা নিষাদের আলমারিতে প্যাকেটে মোড়ানো।
কখনো চন্দ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নি নিষাদ ভালোবাসার কথা বলতে,আড়ালে থেকে খেয়াল রেখেছে চন্দ্রর।
এই খেয়াল রাখতে গিয়েই ভুল বুঝাবুঝি হয়ে যায়।

শোয়া থেকে উঠে বসে নিষাদ,এতোদিনে তার একটা কথা মাথায় এসেছে।
চন্দ্রর তো ফেইল করার কথা ছিলো না,তবে চন্দ্র কেনো ফেইল করলো এক্সামে?
কিছু একটা তো হয়েছে,কিন্তু কি হয়েছে?

শুরু থেকে ভাবতে থাকে নিষাদ।

চন্দ্রর ইন্টার এক্সাম শুরু হওয়ার পর নিষাদ প্রতিদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে চন্দ্রকে দেখে আসতো।রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় এক্সাম টাইমে ও ভিতরে যেতে পারতো নিষাদ।তার উপর স্বয়ং হাসনাত সাহেব ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট।

সেদিন ও তেমন নিষাদ হলের বাহিরে দিয়ে যাচ্ছিলো,চন্দ্রর সামনে সিট ছিলো তুসির।তুসি ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য হল থেকে বের হয়,নিষাদের সাথে দেখা হয়ে যায় তখন।
তুসির সাথে নিষাদের পরিচয় ছিলো আগে থেকেই,তুসির থেকেই নিষাদ চন্দ্রর খোঁজ খবর নিতো।

চন্দ্রর এক্সামের কথা জিজ্ঞেস করতেই তুসি জানায় চন্দ্রর এক্সাম আজ খুব খারাপ হবে,চন্দ্রর কোনো প্রশ্ন কমন পড়ে নি আজ,চন্দ্র লিখা বন্ধ করে বসে আছে,কান্না করছে,প্রশ্ন অনেক কঠিন হয়েছে।

শুনে নিষাদের মন খারাপ হয়ে যায়।সেবার সত্যিই প্রশ্ন হার্ড হয়েছে অনেক,নিষাদ প্রশ্ন ম্যানেজ করে নিয়ে সব লিখে হলে সেবার প্রথম নকল পাঠায়।
ইংরেজিতে অনার্স করছে নিষাদ,কলেজের ফার্স্ট বয় হওয়ায় খুব দ্রুতই সব সলভ করতে পারে।

কিন্তু তবু কেনো চন্দ্র ফেইল করলো?

নিষাদের দেওয়া উত্তর থেকে সবাই পরীক্ষা দিয়ে ভালো মার্ক পেয়েছে শুধু চন্দ্র ছাড়া।তবে কি কেউ হলে সেদিন গুটিবাজি করেছে?

কপালের রগ রাগে দপদপ করছে নিষাদের,কেউ নিষাদের অজান্তে একটা কূটচাল চেলেছে নিষাদ এতোদিনে ও বুঝতে পারে নি সেটা।
বাকি রাত আর ঘুমাতে পারে না নিষাদ,মাথায় চিন্তা ঘুরছে।
চন্দ্রর ভালো করতে গিয়ে খারাপ করে ফেলেছে নিষাদ,কে করেছে এরকম তা জানতে হবে নিষাদকে।

চন্দ্রর ঘুম আজ দ্রুতই ভেঙে যায়,চোখ মেলে দেখে নিষাদ ইয়োগা করছে।ঘাম চুইয়ে পড়ছে নিষাদের শরীর থেকে,খালি গায়ে বুকের সব লোম দেখা যাচ্ছে।
ফর্সা বুকে ঘন কালো লোম চন্দ্রর মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
অনিকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে,অনিকের বুকে মুখ গুঁজবার কথা ছিলো চন্দ্রর।
এখন নিশ্চয় অনিকের বউ অনিকের বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে!
মানতে পারছে না চন্দ্র।

কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে তার?
কার জন্য কষ্ট হচ্ছে?
যে কি-না বিয়ের দিন পালিয়েছে তার জন্য?
না ভাববে না তাকে আর চন্দ্র।

চোখ মুছে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।

চলবে???

(বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন,রিচেক দিই নি।ব্যস্ত থাকায় গতকাল লিখতে পারি নি আজও ছোট পর্ব দিয়েছি।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে