বিষাদময় নিষাদ পর্ব-০৫

0
1924

#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০৫
জাহান আরা

ভোরের আলো এখনো ফুটতে শুরু করে নি।পাখিরা জেগে গেছে,কলকাকলীতে মুখরিত পরিবেশ।
শিমুল গাছে যেনো আগুন লেগেছে,রক্তলাল শিমুল ফুল ফুটে আছে গাছে।
থোকায় থোকায় শিমুল ফুল যেনো হাসছে প্রাণ খুলে।
গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে তুসি ১ সপ্তাহ আগে,গ্রামের সবই ভালো লাগে তুসির শুধু মাত্র নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ছাড়া।
ফোনে নেটওয়ার্ক প্রায় নেই বললেই চলে।৭ দিন ধরে তুসি বিচ্ছিন্ন সবার থেকে,তবুও এনজয় করছে তুসি গ্রামের বাড়িতে খুব।
বাড়ি থেকে বের হয়েছে তুসি ভোর বেলায়,১০টার টিকেট কেটেছে তুসির বাবা,তাই আবার ঘুরেফিরে গ্রামটা দেখে নিচ্ছে তুসি।

————

ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসেছে চন্দ্র,গতরাতে নিষাদের করা অপমানের জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারনে,খানিকক্ষণ চন্দ্র রূপচর্চা করেছে আজ।যদিও ভীষণ লজ্জা লেগেছিলো তার,কিন্তু বুকের ভিতর তীরের মতো লেগেছে নিষাদের দেওয়া খোঁচা।
বিছানা থেকে উঠে গিয়ে মুখে সানস্ক্রিন লাগায় চন্দ্র,পিছন থেকে আপনমনে নিষাদ বলে, “আল্লাহ যারে সুন্দর বানায় তার ঘষামাজা করা লাগে না,আমার মতো সুন্দর হয় সে।”

চন্দ্র বুঝতে পারে নিষাদ তাকেই বলেছে কথাটা,এক মুহূর্ত থেমে যায় চন্দ্র।তারপর ঘুরে দাঁড়ায় নিষাদের দিকে।
পাউডারের কৌটা নিয়ে নিষাদের দিকে এগিয়ে যায়,নিষাদের বুকের সাথে ঘেঁষে দাঁড়ায় তারপর।
হার্টবিট বেড়ে যায় নিষাদের, চন্দ্র এতো কাছে আসায়,হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে নিষাদ।
চন্দ্রকে ফিসফিস করে বলে,”সরে দাঁড়াও চন্দ্র,ভুল হয়ে যাবে আমার।”

ব্রু কুঁচকে চন্দ্র জিজ্ঞেস করে,”কিসের ভুল?”

জবাব দেয় না নিষাদ,চন্দ্র আর তার মাঝে শরীরের কোনো দূরত্ব নেই,কিন্তু মনের দূরত্ব হাজার হাজার মাইল।
চাইলেই নিষাদ চন্দ্রকে ছুঁতে পারে,চাইলেই চন্দ্রর চোখ,মুখ,নাক,চোখ,ঠোঁট,বুক সব ছুঁতে পারে,কিন্তু চাইলেই চন্দ্রর বুকের বা পাশের সেই হৃদয় টা ছুঁতে পারে না। যতোদিন সেই হৃদয়ে ঠাঁই না হয় ততোদিন চন্দ্রর এসবের কোনো মূল্য নেই।

হাত থেকে পাউডারের কৌটা নিয়ে নিষাদের মাথায় ঢেলে দেয় চন্দ্র,তারপর গটগট করে হেটে বের হয়ে যায় রুম থেকে।
হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে নিষাদ।
তারপর হেসে উঠে হাহা করে।

————–

বাড়ি ফিরে নাশতা সেরে রেডি হয় সবাই,বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে ফোন বের করে তুসি।এই ৭দিন ধরে ফোন সে ধরে নি বললেই চলে,ডাটা অন করে মেসেঞ্জারে ঢুকে।
ঠিক তখনই নিষাদের কল পায়,বুকের ভিতর ছলাৎ করে উঠে এক অজানা শিহরণ।কিছুটা ভয়,কিছুটা উত্তেজনা।

কল রিসিভ করে সালাম দেয় তুসি,কুশলাদির পর নিষাদ জিজ্ঞেস করে,”তুসি,অনেকদিন পর আমার আজকে একটা কথা মনে পড়েছে,ইয়োগা করার সময় আমি চোখ বন্ধ করে ভেবেছি বিষয় টা নিয়ে,যেটুকু কনফিউশান ছিলো তুই এখন সেটা ক্লিয়ার করে দিবি।”

চমকে যায় তুসি।
কিসের কথা বলছে নিষাদ ভাই?
নিজেকে শান্ত রেখে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে নিষাদ ভাই?”

“চন্দ্রর পরীক্ষা খারাপ হলো কেনো তুসি?”

ছোট একটা প্রশ্ন,কিন্তু তুসির কলিজা কেঁপে উঠলো শুনে,গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেলো।
গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তুসির,নিজেকে কেমন অসহায় মনে হচ্ছে।
অনেক কষ্টে তুসি জবাব দিলো,”চন্দ্র সেদিন আপনার দেওয়া নকল নেয় নি,তাই….”

“তুসি,সত্যিটা কি তুই বলবি নাকি আমি চন্দ্রর থেকে জেনে নিবো?”

ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যায় তুসির মেরুদণ্ড দিয়ে।নিজেকে খুব বড় অপরাধী মনে হয় তুসির।
নিষাদের কঠোর কথার সামনে মিথ্যা বলার সাহস পায় না।মিনমিন করে জবাব দেয়,”আমি ভুল করে ফেলেছি নিষাদ ভাই।”

“কেনো করলি এরকম?”

কি জবাব দিবে তুসি এই প্রশ্নের?
জবাব দিতে হলে যে তাকে ফিরে যেতে হবে সেই ক্লাস ৮এ,যেদিন থেকে নিষাদকে তার ভালো লাগে।
নিষাদের প্রতিটি সভা,মিছিলে তুসি হাজির হয়েছে শুধুমাত্র নিষাদকে দেখার জন্য।
অথচ নিষাদ কখনো বুঝতেই পারে নি।
উল্টো তুসির কাছেই চন্দ্রর খবর নিতো,চন্দ্রর জন্য উপহার পাঠাতো।
কেনো সহ্য করবে তুসি?
ভালোবাসার মানুষের মুখে অন্যকারো কথা শোনার কষ্ট নিষাদ কিভাবে বুঝবে!
পাপ হয়েছে তাতে?
হোক পাপ!
ভালোবাসার জন্য মহাপাপ করতেও তুসি পিছপা হবে না।সবসময় চন্দ্রর কাছে হেরে এসেছে তুসি,ভালোবাসার ক্ষেত্রেও।
তাই সবসময় চন্দ্রর কাছে নিষাদের দুর্নাম করেছে।নিষাদ চন্দ্রর জন্য অসংখ্য গিফট দিয়েছে,অনায়াসে সব নিজের কাছে রেখে দিয়েছে তুসি।
এসব শুধু তার।

তুসির নিরবতা লক্ষ করে নিষাদ বলে,”ভুল করেছিস তুসি,অনেক বড় ভুল,তবে জেনে রাখ,নিষাদ অবুঝ না,তুই যা চেয়েছিস তা কখনোই পাবি না,চন্দ্রকে আমি বিয়ে করেছি।”

কল কেটে দেয় নিষাদ,মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় তুসি।
কি শুনলো সে এটা?
নিষাদ বিয়ে করেছে?
তাও চন্দ্রকে?

মাথা ঝিমঝিম করে উঠে তুসির,নিষাদ অন্যকারো হয়ে গেছে!
বুকের ভিতর থেকে জলোচ্ছ্বাসের মতো কান্না বের হয়ে আসে,চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে তুসি।

——————

নিষাদ বের হয়ে এসেছে বাসা থেকে সেই সকালে,চন্দ্র ড্রয়িং রুমে বসে আছে। এই বাড়িতে তার একটুও সময় কাটছে না,চায়ের কাপ হাতে হাসনাত সাহেব এসে সোফায় বসে।
অনেক ভেবে চিন্তে চন্দ্র আস্তে করে বলে,”বাবা,একটা কথা বলার ছিলো।”

হাসনাত সাহেব মুখ তুলে তাকালেন চন্দ্রর দিকে,তারপর জিজ্ঞেস করলেন,”কি কথা বলো?”

“আমি এখানে থাকতে চাচ্ছি না।”

সোজা হয়ে বসলেন হাসনাত সাহেব,তারপর জিজ্ঞেস করলেন,”কেনো?”

“আমার অসুবিধা হচ্ছে। ”

“কি অসুবিধা বলো?
নিষাদ কি তোমাকে তোমার দলীয় কোনো কাজে নিষেধ করেছে?
আমাকে বলো আমি এখনই মেরে ওর পিঠের ছাল তুলে নিবো,আমি নিজে ওর বিরুদ্ধে সভার ব্যবস্থা করবো ও যদি তোমার রাজনীতির পথে বাঁধা হয়।”

হতাশ হয়ে চন্দ্র বলে,”না বাবা,আমি পড়াশোনা করবো,এখানে আমার পড়াশোনা হচ্ছে না।”

“পড়াশোনা হচ্ছে না মানে?
নিষাদ কি তোমার বইখাতা নিয়ে টানাটানি করে না-কি?
বলো,আমি তাইলে আজই ওর বিরুদ্ধে সভার ব্যবস্থা করবো।পেয়েছে কি ও,তোমার বইখাতা নিয়ে টানাটানি,ইয়ার্কি নাকি হ্যাঁ! ”

চন্দ্র বুঝতে পারে এই মানুষের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই,হাল ছেড়ে দিয়ে বলে,”না বাবা,তা লাগবে না,আমি যাবো না কোথাও।”
চন্দ্র উঠে চলে যায় নিজের রুমের দিকে,মুচকি হাসি ফুটে উঠে হাসনাত সাহেবের মুখে।
তার ছেলের এতো সাধনার ভালোবাসা,তিনি কিভাবে যেতে অনুমতি দিবেন বাড়ি থেকে?

নিষাদের সভা শেষ হয় রাতের ৯টায়,শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে নিষাদের।
গাড়ি দাঁড় করায় একটা কসমেটিকস শপের সামনে,সকালে চন্দ্র সব পাউডার ঢেলে দিয়েছে নিষাদের গায়ে,পাউডার নিতে হবে চন্দ্রর জন্য।
চন্দ্র কোন ব্রান্ডের পাউডার ব্যবহার করে?

জানা নেই নিষাদের সেটা,দোকান থেকে ৫ রকমের ৫টা পাউডার কিনে নেয় নিষাদ,একটা তো হবেই।

গাড়িতে উঠে বসতেই নিষাদের কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো,কিছু একটা যেনো ঠিক নেই।
কি হয়েছে?
মন কু ডাকছে কেনো?
বুঝতে পারছে না নিষাদ,নিজের অবচেতন মন কিছু একটা বলতে চায় যেনো।
কিছু না ভেবে গাড়ি স্টার্ট দেয় নিষাদ,ঘটনা ঘটে বাসার কাছাকাছি আসতেই।
পিছন থেকে কেউ একজন অতর্কিত হামলা করে নিষাদের উপর।একহাতে নিষাদের মুখ চেপে ধরে,অন্য হাতে পেটে চাকু ঢুকিয়ে দেয় কেউ।
ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে ৩বার পেটে চাকু ঢুকায়,কাঁপা কাঁপা হাতে নিষাদ পিছনে হাত নিয়ে হামলাকারীর চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেয়।
মাগো করে চিৎকার করে উঠে কেউ,তারপর ছেড়ে দেয় নিষাদকে,লাফিয়ে নামে গাড়ি থেকে।
নিষাদ গাড়ি থেকে নেমে ধরার আগেই পিছনে এসে একটা গাড়ি থামে,তারপর হামলাকারীকে টান দিয়ে গাড়িতে তুলে নেয় নিষাদ ধরার আগেই।
দ্রুত ঘুরে চলে যায় গাড়ি।

নিষাদের পুরো শরীর ভিজে যাচ্ছে রক্তে,মাথা ঝিমঝিম করছে,শরীর কাঁপছে।
কাকে বলবে নিষাদ?
টলতে টলতে গাড়িতে উঠে নিষাদ,মৃত্যু তার খুব সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
গাড়ি ঘুরিয়ে হাসপাতালের দিকে নেয় নিষাদ,চোখ বন্ধ হয়ে আসছে নিষাদের,বারবার চন্দ্রর মুখ ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
শেষ বার কি নিষাদ চন্দ্রকে দেখতে পাবে না?

হাত কাঁপছে নিষাদের,চোখ বন্ধ হয়ে আসছে,মনে মনে তওবা করে, কালেমা তাইয়্যেবাহ পাঠ করে নিষাদ।
মাঝরাস্তায় আড়াআড়িভাবে গাড়ি থেমে যায় নিষাদের।চন্দ্রর জন্য নেওয়া পাউডারের প্যাকেট শক্ত করে মুঠোয় ধরে,কেউ যেনো তাকে গভীর অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে।আস্তে আস্তে সব অন্ধকার হয়ে যায় নিষাদের।

চন্দ্র জানতে ও পারে না ভাগ্য তাকে নিয়ে কোন খেলা খেলতে যাচ্ছে!

চলবে….???

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে