বিষাদময় নিষাদ পর্ব-০৬

0
1716

#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০৬
জাহান আরা

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে চন্দ্র নিষাদ আজ দেরি করছে সেকথা। স্বভাবত নিষাদ এতো দেরি করে না,আজ কেনো করছে?
বিষয়টা তেমন পাত্তা না দিয়ে চন্দ্র ঘুমানোর চেষ্টা করে।
তন্দ্রাভাব আসতেই চন্দ্র স্বপ্ন দেখে তার নাকের নাকফুল কোথায় যেনো খুলে পড়ে গেছে।
লাফিয়ে উঠে বসে চন্দ্র,বুক ধড়পড় করছে তার,নিশ্বাস আটকে আসছে তার।

কেনো এমন স্বপ্ন দেখলো সে?
বুকের ভিতর কিসের অজানা ঝড়?
কেনো এতো কাঁপছে সে!

নিষাদ কে কল দেয়,নিষাদের ফোন অফ পাচ্ছে।
ঘেমে উঠে চন্দ্র,কি অলুক্ষুনে স্বপ্ন দেখলো সে এটা!

সিএনজি নিয়ে বাসায় ফিরছে কাসেম,মাঝরাস্তায় একটা গাড়ি আড়াআড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বিরক্ত হয় কাসেম।আজ তার তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার কথা,কয়েকবার হর্ণ দেয় কাসেম।
সামনের গাড়ির কোনো নড়চড় নেই দেখে সিএনজি থেকে বের হয়ে যায় কাসেম।
গাড়ির দরজা টান দিতেই খুলে যায়।

চমকে উঠে কাসেম রক্তাক্ত নিষাদকে দেখে।হাতে একটা প্যাকেট জড়িয়ে ধরে কাৎ হয়ে শুয়ে আছে সিটের উপর নিষাদ।
নিষাদ কাসেমের একজন প্রিয় মানুষ,নিষাদই বন্ধ করেছে তাদের স্টেশনে চাঁদা দেয়ার রীতি,আগে কোনো নেতা এই কাজ করে নি,উল্টো চাঁদার সিংহভাগ তাদের পকেটে যেতো।
পাঁজাকোলা করে কাসেম নিষাদকে বের করে আনে গাড়ি থেকে,তারপর নিজের সিএনজি তে তুলে নিয়ে যায় হাসপাতালের দিকে।
মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে থাকে কাসেম।
নিষাদের এই অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
দুনিয়ায় ভালো মানুষের শত্রুর অভাব হয় না কাসেম জানে,কিন্তু তাই বলে কাউকে এভাবে খুনের চেষ্টা করবে?

ফুল স্পিড তুলে ঝড়ের বেগে হাসপাতালে আসে কাসেম,তারপর নিয়ে যাওয়া হয় নিষাদকে ওটির দিকে।
হাসপাতালে নিতেই খবর ছড়িয়ে যায় চারদিকে,হাসনাত সাহেবের ফোন বেজে উঠে।

হাসনাত সাহেব শুয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছেন,ফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করেন।
চুপ করে দুঃসংবাদ শুনে ফোন কেটে দেন।

উপরে উঠে চন্দ্রর দরজা নক করে,নিষাদ এসেছে ভেবে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয় চন্দ্র।
হাসনাত সাহেব চন্দ্রর দিকে তাকান,চন্দ্রর মুখে তিনি অজানা শঙ্কার ছায়া দেখতে পান।

হাসনাত সাহেব কে দেখে চন্দ্র কিছুটা অবাক হয়,সেই সাথে বুকের ভিতর মুচড়ে উঠে চন্দ্রর।
হাসনাত সাহেব কেনো এখানে?
তবে কি খারাপ কিছু হয়েছে?

চন্দ্র জিজ্ঞেস করার আগেই হাসনাত সাহেব বলেন,”তুমি কি আমার সাথে হাসপাতালে যাবে?
নিষাদের উপর প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে।”

মুহুর্তেই চন্দ্রর চেহারা বিমর্ষ হয়ে যায়।
এজন্যই কি সে এই স্বপ্ন দেখেছে?
কাঁপাকাঁপা গলায় বলে,”যাবো বাবা”

ভিতরে ঢুকে একটা পাতলা শাল জড়িয়ে নেয় চন্দ্র শাড়ির উপর দিয়ে,তারপর নেমে আসে হাসনাত সাহেবের সাথে।

মনোয়ারা বেগম শুয়ে পড়েছেন সন্ধ্যা বেলায় ঘুমের ঔষধ খেয়ে,তার ইনসোমনিয়া আছে।
হাসনাত সাহেব আর ডাকলেন না তাই তাকে।

নিজের গাড়ি বের করেন নিজেই,ড্রাইভার কে রেখে নিজেই ড্রাইভিং সিটে বসেন।পাশে বসে চন্দ্র।
তারপর ছুটে যায় গাড়ি হাসপাতালের দিকে।

চন্দ্রর বুক কাঁপছে দুরুদুরু করে,নিষাদের যদি কিছু হয়ে যায়!
কে করেছে নিষাদের উপর হামলা?
কেনো করেছে?

হাসপাতালে পৌঁছায় হাসনাত সাহেব আর চন্দ্র ৩০ মিনিট পরে।
ওটির সামনে যেতেই চমকে উঠে চন্দ্র,বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে হাজারখানেক মানুষ।
এতো মানুষ কোথা থেকে এলো এই অল্প সময়ে!
আবার ও চন্দ্র বুঝতে পারে নিষাদের জনপ্রিয়তা।

চন্দ্রকে দেখে কয়েকজন চেয়ার খালি করে দিয়ে বলে,”বসেন ভাবী।”

চন্দ্র তাকায় তাদের মুখের দিকে।কেমন যেনো লজ্জা করছে চন্দ্রর,এই ছেলেগুলো জানে সে যে নিষাদের বিরোধী অথচ কতো সম্মান করছে তাকে তারা।
সে তো এতো সম্মানের যোগ্য না।

কাসেম চন্দ্রকে দেখে এগিয়ে আসে,তারপর প্যাকেট টা চন্দ্রর হাতে দিয়ে বলে,”ম্যাডাম,এই প্যাকেট টা নিষাদ ভাইয়ের হাতের মুঠোয় ছিলো,খুব শক্ত করে মুঠোয় ধরে রেখেছিলেন নিষাদ ভাই এই প্যাকেট টা,মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো জিনিষ আছে এতে,আপনি দেখে নেন ম্যাডাম।”

হাত বাড়িয়ে প্যাকেট নেয় চন্দ্র,তারপর আস্তে করে খোলে প্যাকেটের মুখ।
তারপর আবারও চমকে উঠে,প্যাকেটের ভিতর ৫টা পাউডার।
নিজের অজান্তেই চন্দ্রর চোখে পানি চলে আসে।

ওটির দরজা খুলে ডাক্তার বের হয়ে আসে।চাইলেও এগিয়ে যেতে পারে না চন্দ্র ডাক্তারের কাছে,নিষাদের দলের ছেলেগুলো ঘিরে ধরেছে ডাক্তার কে।

তবু চন্দ্র শুনতে পায়, জ্ঞান ফেরে নি এখনো নিষাদের,অপারেশন করতে রক্ত লাগবে।
বি নেগেটিভ রক্ত দিতে হবে,অনেকক্ষণ ধরে রক্তক্ষরণ হওয়ায় নিষাদের দেহে এখন রক্তের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে।

চন্দ্র বলার চেষ্টা করে তার নিজের ও বি নেগেটিভ রক্ত কিন্তু বলার আগেই দেখে ১০-১২ জন রেডি হয়ে একসারিতে দাঁড়িয়ে গেছে,তাদের রক্ত বি নেগেটিভ।

————-

বাসায় পৌঁছাবার পর থেকে তুসি রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে।
কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তুসি নিষাদ চন্দ্রর হয়ে গেছে।
নিজের উপর রাগ হয় খুব তুসির,কেনো কখনো নিষাদকে সরাসরি বলে নি ভালোবাসার কথা!
কেনো বলে নি সে নিষাদকে পাগলের মতো ভালোবাসে!
আজ যে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
নিষাদ আজ অন্য কারো হয়ে গেছে।

বিছানার উপর থেকে নিজের ফোন নেয়,তারপর ফেসবুকে যায়।
নিষাদকে আজকে সোজা বলে দিবে সব তুসি,কবে থেকে সে নিষাদকে ভালোবাসে,কেনো এরকম করেছে,সব বলবে।

ফেসবুকে ঢুকেই তুসি চমকে যায়,নিষাদকে নিয়ে হাজারটা পোস্ট।
ভয়ে কুঁকড়ে যায় তুসি।
নিষাদের কি হয়েছে!

বুক ফেটে কান্না আসে তুসির,কি হয়ে গেলো এসব!
নিষাদের উপর জমে থাকা রাগ হঠাৎ করেই ব্যথায় রূপ নেয়।
তুসির না হোক,তবু নিষাদ বেঁচে থাকুক,তুসি তো কখনো চায় নি নিষাদের মৃত্যু হোক।
তবে কেনো এরকম হলো!

বের হয়ে যায় রুমের দরজা খুলে,বাহিরে গিয়ে বাবার রুমের দরজায় নক করে।কাঁদতে কাঁদতে যতোটুকু পারে বাবাকে বুঝিয়ে বলে তুসি।
তুসির বাবা তোজাম্মেল হায়দার মেয়ের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে তুসিকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
তার এই মেয়েটা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ তিনি জানেন।

বাহিরে বের হতেই সিএনজি পেয়ে যান,বাবা মেয়ে সিএনজি তে উঠে বসেন।

ওটির সামনে এসে তুসি চন্দ্রকে দেখতে পায়।
এই কয়দিনেই চন্দ্রকে কেমন যেনো বড় বড় লাগছে তুসির কাছে,হাতে সোনার বালা,নাকে নাকফুল,চোখে চশমা,গায়ে একটা শাল,পরনে শাড়ি,মাথায় এলোমেলো চুল।
তুসির ভীষণ কান্না পায়।আজ এভাবে এখানে তো তুসির থাকার কথা ছিলো,নিষাদের বউ হয়ে,তবে কেনো চন্দ্র!
হঠাৎ করেই তুসির মনে হয়,আল্লাহ কখনো ভুল বিচার করে নি,নিজের বান্ধবীর সাথে তুসি প্রতারণা করেছে নিজের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য,এজন্যই আল্লাহ তার ভাগ্যে নিষাদকে রাখে নি।

নিজেকে আজ ভীষণ ছোট মনে হয় তুসির।
এগিয়ে গিয়ে চন্দ্রর হাত ধরে।
অনেকক্ষণ ধরে চন্দ্র চুপ করে বসে আছে,হঠাৎ তুসিকে দেখতে পেয়ে কেমন চমকে উঠে।
চন্দ্র কিছু বলার আগেই তুসি কেঁদে উঠে ঝরঝর করে।

চন্দ্র কিছু বুঝতে পারে না কি হয়েছে তুসির।
কান্না থামিয়ে তুসি চন্দ্রর পায়ের কাছে বসে পড়ে,তারপর পা জড়িয়ে ধরে বলে,”আমাকে ক্ষমা করে দে রে চন্দ্র,আমি অনেক বড় ভুল করেছি।”

চন্দ্র কিছুই বুঝতে পারে না তুসির এরকম ব্যবহার করার মানে।
তুসির হাত ধরে তুলে নেয় চন্দ্র,তারপর জিজ্ঞেস করে চন্দ্র,”কি হয়েছে তোর?”

মাথানিচু করে তুসি জানায় সব।

চন্দ্রর ভয়ার্ত চেহারা বদলে যায় বিস্ময়ে।কি বলছে এসব তুসি?
তবে কিসের এতো বিরোধিতা তার নিষাদের সাথে?
কিসের এতো ভুল বুঝাবুঝি ছিলো তার নিষাদের সাথে!
কেনো চন্দ্র বুঝে নি আগে!
কেনো নিষাদের কথা বিশ্বাস করে নি কখনো!

মনে পড়ে যায় চন্দ্রর অনেক দিন আগের কথা।
রেজাল্টের পর চন্দ্র নিষাদের উপর খুব রেগে ছিলো।
কলেজে সেদিন নিষাদের একটা সভা ছিলো ছেলেদের নিয়ে।
রাগে অন্ধ হয়ে চন্দ্র বড় একটা ইটের ঢেলা তুলে নিয়েছে।তারপর কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে মারে নিষাদকে লক্ষ করে,নিষাদ দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলো,সোজা গিয়ে ঢেলা নিষাদের কপালে লাগে,নিষাদ কপালে হাত চেপে ধরে চন্দ্রর দিকে তাকায়।
সেদিনও নিষাদের মুখে কোনো রাগের আভাস দেখে নি চন্দ্র,ছেলেরা সবাই লাফিয়ে উঠেছিলো,নিষাদ সবাইকে শান্ত হয়ে বসতে বলে।
রুমাল দিয়ে কপাল বেঁধে নেয়।নিষাদের কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত দেখে চন্দ্র হেসেছে সেদিন খুব।

তুসির দিকে তাকাতে ও ঘৃণা করছে চন্দ্রর,কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায় চন্দ্র।
হঠাৎ করেই ভীড়ের মধ্যে দেখতে পায় একটা চেনা মুখ।
অনিক!

এগিয়ে গিয়ে অনিকের কলার চেপে ধরে চন্দ্র,তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”বিশ্বাসঘাতক!!!”

হতভম্ব হয়ে অনিক তাকায় চন্দ্রর দিকে,তারপর চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,”ভুল করছেন ভাবী আপনি,আমি অনিক না,আমি সুমন,অনিক তো নিষাদ ভাইয়ের আরেক নাম,আপনি আমাকে না,ভালোবেসেছেন নিষাদ ভাইকে,আমি তো শুধু ২ বার অনিক সেজে অভিনয় করেছি আপনার সাথে দেখা করতে গিয়ে।”

চন্দ্রর মনে হয় যেনো পুরো পৃথিবী ঘুরছে।
কি হচ্ছে এসব আজ!
কি শুনছে এসব সে!
ধপ করে পড়ে যায় চন্দ্র মাথা ঘুরে।

চলবে???

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে