প্রণয় কাব্য পর্ব-১৮

0
770

#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৮.
মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলছে দুজোড়া প্রেম পায়রা। পুতুল নিরবে তিহানের পাশ ঘেঁষে হাঁটছে। তারা বাজার রেখে অনেকটা দূরে চলে এসেছে। আশপাশে ফসলি চমি আর বিল ছাড়া কোনো বসত বাড়ি নজরে আসছে না। এদিকটায় পুতুলের কখনো আসা হয়নি।

‘কিছু বল পুতুল। তোর নিরবতা আমার সহ্য হচ্ছে না।’

হঠাৎ এহেন কথায় সরু চোখে তাকালো পুতুল। ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘আপনি কেন নিরব?’

তিহান প্রগাঢ় চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,

‘তোর সাহস বেড়েছে বড্ড। কথার পিঠে কথা বলতে শিখে গেছিস দেখছি!’

পুতুল মুচকি হেসে জবাব দিলো,

‘বাড়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?’

তিহান মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো। একদম স্বাভাবিক। পরক্ষণে দুষ্ট হেসে বললো,
‘এটাও তো স্বাভাবিক এতদিন বাদে তোর নিজস্ব পুরুষকে দেখে তাকে সাদরে জড়িয়ে ধরা! সেই অতি সাধারণ কাজটা কেন করছিস না?’

পুতুল বড় বড় চোখ করে তাকালো। নরম কিন্তু বেশ জোরেই বললো,

‘অসভ্য লোক!’

‘এই অসভ্য লোকটা আরো অসভ্য হতে চায়! এজন্য দ্রুত বিয়ে করে ফেলা দরকার!’

তিহানের কথায় পুতুল নাক চোখ কুঁচকে তাকালো। লজ্জা পেলেও নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বললো,

‘আপনি দিনদিন দুষ্টভাষি হচ্ছেন তিহান!’

উত্তরে তিহান অমায়িক হাসলো। পুতুল অগোছালো হলো। লোকটার হাসি এত সুন্দর কেন?
.
.
এরপরের কাহিনীগুলো খুব অগোছালো ভাবেই ঘটলো। পরপর কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল পুতুলের জীবনে। এইতো আজ সকালের কথা বাহিরে সোরগোল এ তার ঘুম ভাঙে। কোনোরকম বিছানা ছেড়ে বাহিরে আসতেই নজরে পড়লো আশপাশের প্রায় অনেক মানুষ ভীর করেছে। শিউলিকে দেখা গেলো ঘরের এক কোণে ঘাপটি বসে থাকতে। পুতুল বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলো। মায়ের পাশে বসে তাকে শান্ত করে ঘটনা কি বোঝার চেষ্টা করলো। পাশ থেকে ফুলির মা বলে উঠলো,

‘তর বাপ আইছে পুতুল। তর দায়িত্ব নিবার চায়!’

বাপ নামক লোকটার কথা শুনতেই যেন মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। পরিবারের সদস্যগুলোর বেদনা আর কষ্টের কথা ভেবে নাক মুখ কুঁচকে নিলো সে। চোখে জলরাশি ভীর জমিয়েছে। শিউলি মেয়েকে আটকাতে চাইল কিন্তু পাড়ল না। বড় বড় পা ফেলে ভিড় ঠেলে উঠানে নেমে দাড়ালো পুতুল। মাঝ বয়সী ফিটফাট একজন লোক চেয়ার পেতে বসা। পাশেই পরিচিত আরো কিছু মুখ দেখা গেলো। তার সাথে দেখা গেলো আট কি নয় বছরের একটা ছেলেকেও। যে পুতুলকে দেখা মাত্রই তার বাবাকে ডেকে বলছে,
‘এইটাই কি ছোট আপু?’

লোকটা এতক্ষণে পুতুলের দিকে তাকালো। প্রথম তাকানোতেই তার চোখ থেমে গেলো। মেয়েটা একদম শিউলির মতো হয়েছে।

‘এখানে কেন এসেছেন?’

ঝাঁঝালো কন্ঠে নড়েচড়ে বসলো লোকটা। মুচকি হাসলো সে। নরম গলায় বললো,

‘তুমি তোমার ময়ের অন্যরূপ পুতুল! তোমার মায়েও কথার ঝাঁঝ ও ঠিক তোমার মতো।’

পুতুল দাঁতে দাঁত পিষে বললো,

‘আমার মায়ের ব্যাপারে কিছু আমি আপনার থেকে জানতে চাচ্ছি না। আমার মাকে আমি জানি। শুধু অজানা আমার হতভাগা বাবাকে যে আমার মায়ের মতো একজনকে পায়ে ঠেলে পালিয়ে গেছিল!’

পুতুলের এহেন কথায় লোকটা হয়তো কিছুটা লজ্জা পেলো। আশপাশের লোকেরা নিরবে মজা নিতে লাগলো। কতেকে মুখ চেপে হাসছেও! পুতুলের রাগ বাড়লো। চিৎকার করে বলে উঠল,

‘আপনারা এখানে কি করছেন? সিনেমা দেখতে এসেছেন? এই মুহূর্তে এখান থেকে সকলে বের হয়ে যাবেন!’

চাপা গুঞ্জনের সাথে সাথে সকলে প্রস্থান করতে শুরু করলো। পুতুল সেদিকে নজর দিলো না। শিউলি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বচ্চা ছেলেটা পুতুলকে ভয় পাচ্ছে। বাবার পেছনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত চোখে পুতুলকে দেখছে।

‘শান্ত হও পুতুল! আমরা নিরবে বসে কথা বলি?’

পুতুল বড় করে শ্বাস নিলো। ধরে আসা গলায় অনুনয় করে বললো,

‘আমি সত্যিই আপনার সাথে কথা বলতে চাই না! চলে যান প্লিজ! আর কখনো আমাদের জীবনে আসার চেষ্টা করবেন না। আমরা ভালো আছি। এতটুকু শান্তি তো আমরা চাইতে পারি!’

লোকটার চোখ ছলছল করে উঠলো। এতদিন বাদে তার ছোট্ট মেয়েটাকে এভাবে দেখে কলিজা মুচরে উঠলো। যেই মেয়েটা বাবা বলতে পাগল ছিল আজ সে সেই বাবার কাছে শান্তি ভিক্ষা চাইছে! একজন বাবার কাছে এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে?
লোকটা অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বললো,

‘তোমাদের নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা শেষ হলো শিউলি! তোমায় দেখার জন্য পুতুলের মতো এক বাঘিনী মেয়ে আছে! এমন একটা মেয়ে থাকতে আর কিসের ভয়?’

পুতুল অশ্রু সিক্ত নয়নে তার বাবার পানে তাকিয়ে রইল। কতদিন বাদে বাবা নামক ব্যক্তিটাকে দেখছে সে! একসময় প্রতি বেলায় সে বাবা ফিরে আসার প্রার্থনা করতো। আর আজ যখন আসলো সে নিজ হাতে তাকে ছুড়ে ফেলে দিল! বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠলো। এমনটাই কেন হতে হলো? আর পাঁচটা স্বাভাবিক পরিবারের মতো তার পরিবারটা কেন গোছানো নয়?

‘তোমাকেতো বলাই হয়নি পুতুল। এটা তোমার ছোট ভাই। ওর খুব ইচ্ছা ছিল ওর বোনদের সাথে দেখা করার। আজ নিয়ে এলাম তাই।’

লোকটা মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। ছেলেটা বাবার হাত ধরে ভয়ার্ত চোখে পুতুলকে দেখছে।

‘ভালো থেক মা! তুমি না চাইলে আমি আর কখনো তোমাদের জীবনে আমার ছায়াও ফেলব না। চিন্তা করো না। নিজের আর মায়ের খেয়াল রেখো। আসছি!’

লোকটা বেড়িয়ে গেল। রেখে গেলো এক বুক যন্ত্রণা। পুরোনো ক্ষত থেকে যেন নতুন করে রক্ত ঝড়তে‌ শুরু করছে। শিউলি আঁচলে মুখ ঢেকে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। পুতুল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে কাঁদার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। এতদিন বাদে কেন সে এলো? না এলেই তো হতো। তারা তো ভালোই ছিল!

____________

পুতুলের বাবার হঠাৎ করে আগমনের কথাটাও দিনের মাঝেই পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। এসব কথা বাতাসের আগে ছড়ায়। বিকেলের দিকে চিন্তিত মুখে পারুল এসে হাজির হলো। পুতুল তখন তার রুমের খাটে চুপটি করে বসে। পারুল এসেছে বুঝেও কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না সে। পারুল এক হাতে পুতুলকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,

‘সব ঠিক হয়ে যাবে রে। মন খারাপ করিস না। তুই এমন করলে কাকির কি হবে?’

পুতুল শুনলো কিনা বোঝা গেলো না। পারুল কিছু সময় পুতেলের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে রইলো। কিছু সময় অতিবাহিত হলে সে হাতের মুঠোয় থাকা ফোন হাতে কাউকে কল করে পুতুলের কানের কাছে ধরলো।

‘পুতুল!’

তীহানের কন্ঠ কানে আসতেই পুতুলের চোখে পানি জমতে শুরু করলো। তিহান আবারো বললো,

‘কথা বল পাখি! আমার কষ্ট হচ্ছে।’

পুতুলের ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ কানে আসতেই তিহান মুচকি হাসলো। শুধালো,

‘জীবনের কিছু খারাপ অধ্যায় থাকে পুতুল। এসব কিছুকে সামনে এগিয়ে চলাটাই আমাদের কাজ। সামনে এগিয়ে যেতে হলে এমন ছোট বড় অনেক অতীত সামনে আসবে তাই বলে নিজেকে গুটিয়ে নিলে চলবে?’

‘লোকটা কেন এলো তিহান? তাকেতো আমরা চাইনা!’

‘আর কখনো আসবে না সে পুতুল। তোর অনিচ্ছায় কেউ তোর জীবনে আসতে পারবে না। আমি দিব না!’

পারুল পুতুলকে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে শিউলির রুমে গেল। বিছানায় শুয়ে আছে শিউলি। পারুলের মায়া হলো ভিষণ। এত শক্ত মহিলাটাও আজ কেমন ভেঙে পড়েছে! পাথরেরও বুঝি দুর্বলতা আছে!
তিহানের সাথে কথা বলার পর পুতুল কিছুটা স্বাভাবিক। বাড়িতে রান্না হয়নি। দুপুর থেকে তারা না খেয়ে। ক্ষুদায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। মানসিক কষৃটের জন্য পেট তো আর থেমে থাকবে না! নিয়ম করে তার খাদ্য তার চাই! পুতুল বিছানা ছেড়ে নামতেই বাহির থেকে সুজনের কন্ঠ ভেসে এলো। পারুল অপেক্ষা না করে সেদিকে ছুট লাগালো। পুতুল আর সেদিকে গেল না। মায়ের রুমে একবার উঁকি দিয়ে দেখে এলো। শিউলি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। পুতুল আলতো হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তার আপন বলতে এই মা-ই আছে। এই মায়ের কষ্ট কিভাবে সে সহ্য করবে?

চলবে………

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে