প্রণয় কাব্য পর্ব-১৭

0
556

#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৭.
‘বিয়েটা কেন আটকাতে চাচ্ছ পুতুল?’

পুতুল সাগরের দিকে তাকালো। লোকটার চোখে বেদনার ছাপ। পুতুল নির্মল চেয়ে বললো,

‘কারণটা আপনাকে জানাতে পারব না আমি। তবে এটা ভিষণ জরুরি। ধরে নিন আমার বাঁচা মরার প্রশ্ন এটা। বিয়েটা হয়ে গেলে আমি হয়তো আমাকেই হারিয়ে ফেলব।’

সাগর দূর আকাশে তাকালো। চারদিকে আধার ঘনিয়ে আসছে। বাড়ি ফিরতে হবে। সাগর ঘুরে দাঁড়ালো। সামনের দিকে পা বাড়িয়ে পুতুলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘বেয়াইন চলেন। আপনাকে এগিয়ে দেই।’

পুতুল ও আর কথা বাড়ালো না। সাগরের পিছনে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে লাগলো। তার নিজেকে হালকা লাগছে। সাগর বুঝমান লোক। সে নিশ্চই বুঝবে। এই মুহূর্তে তার তিহনকে ভিষণ মনে পড়ছে। মনে পড়ছে গত রাতের দুষ্ট মিষ্টি মুহূর্তগুলো। পুতুলের মন উতলা হয়। ছটফট করে ওঠে মন। অনুভব হলো সে ভালোবেসে ফেলেছে তিহানকে। এই ভালোবাসা ভয়ংকর। এই যে তার মন কেমন করছে! এই মন কেমন করার কোনো নাম নেই। এমন অজানা নামের অনেক অনুভূতিদের সাথেই সাক্ষাত ঘটেছে পুতুলের। কিছু অনুভূতি সে সামলে নিতে পারলেও কিছু অনুভূতি বড্ড অবাধ্য। এক দন্ড শান্তি দিচ্ছে না তাকে!

___________

সাগরের সাথে বিয়েটা ভেঙে গেছে পুতুলের।‌ বিয়েটা সাগরের পক্ষ থেকেই ক্যানসেল করা হয়েছে। সেদিন বাড়িতে ফিরেই সে জানিয়েছে এমন বাচ্চা একটা মেয়েকে সে বিয়ে করতে পারবে না। নাজরিন অবশ্য ছেলেকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। পুতুল মেয়েটাকে তার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। ছেলের ও তো পছন্দ ছিল। হুট করে কি হলো? সেদিন রাতে সাগর না খেয়ের দরজা বন্ধ করে রুমে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। যাকে চেয়েছে তাকে না পাওয়ার বেদনা তাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। পরদিন সকালে খাবার টেবিলে নাজরিন আবারো বিয়ের বিষয়টা তুললে সাগর রেগে যায়।

‘বিয়ের জন্য ম্যাচিউর মেয়ে দেখ মা। এমন বাচ্চা মেয়ে আমি চাই না! সুন্দরী হতে না কেবল আমাকে বুঝবে এমন মেয়ে হলেই চলবে। এ ব্যাপারে আর কোনো কথা শুনতে চাই না।’

আর কোনো কথা হয়নি। সবাই সহজেই মেনে নিয়েছিল। সেদিনি শিউলিকে কল করে জানানো হয়েছে। শিউলির একটু খারাপ লাগলেও সে হাসি মুখেই মেনে নিয়েছিল। প্রতিবেশীদের বিয়ের ব্যাপারে জানানো হয়েছিল না। নয়তো এতক্ষণে পুরো গ্রাম পুতুলের বিয়ে না হওয়ার কথা যেনে যেত।

তিহানের সাথে পুতুলের যোগাযোগটা কমে এসেছে। পুতুল রোজ রাতেই মোবাইল হাতে অপেক্ষা করে কিন্তু প্রতিরাতে কাঙ্খিত মানুষটির কথা শোনার সৌভাগ্য তার হয়না। পুতুলের মন খারাপ হয় ভিষণ কিন্তু যখন তিহানের ক্লান্তি ভরা কন্ঠ শোনে তখন আর অভিযোগ করা হয়ে ওঠে না। মন খারাপ গুলো চিন্তায় রূপ নেয়। পুতুলের এমন কান্ডে তিহান হাসে। এইতো কিছুদিন আগের কথা। তিহান যখন কল করল তখন কেবল রাত একটা। পুতুল ঘুমিয়ে ছিল। কলের শব্দ পেয়েই লাফিয়ে উঠেছিল। তিহানের বড্ড জ্বর এসেছে। শীতের মধ্যে এসি চালিয়ে রাখার দরুণ জ্বর এসেছে। একথা শুনে সে কি কান্না মেয়েটার! পাক্কা এক ঘন্টা সময় লেগেছে পুতুলকে শান্ত করতে। বর্তমানে পুতুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখছে। আজ তিহান আসবে। দীর্ঘ পাঁচ মাস পর তাদের দেখা হতে চলছে। পুতুলের মন খুব ফুরফুরে। সকাল থেকে সে এটা ওটা বানাচ্ছে। এই যেমন ক্ষীর পুলি বানিয়েছে, গুড় দিয়ে তেলের পিঠা বানিয়েছে। এগুলো তিহানের জন্য। শিউলি অবাক চোখে কেবল মেয়ের কান্ড দেখছে। একসময় না পেরে চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

‘কতবার বলছি মাতার কাপুড় ফালাই রাস্তা দিয়া না হাঁটতে। দিন দুপুরে এমন হাঁটতে না করছি। বাতাস লাগবো কত্তবার বলছি। আমার কতা হুনে নায়। অবস্থাডা দেখছো এহন!’

পুতুল মায়ের কথাড় ছোট ছোট চোখ করে তাকালো। মেকি হেসে বললো,

‘চিন্তা করো না মা। আমাকে ধরার মতো ভুল জ্বিনেরা করবে না। ওদের ও তো প্রাণের মায়া আছে তাইনা?’

শিউলি চোখ গরম দিল। গলা নিচু করে বললো,

‘ফের এরম কতা না হুনি। দিনদিন বুদ্দি গ্যান হাঁটুর নিচে নামতাছে।’

পুতুল শুনলো বলে মনে হলো না। সে পরিপাটি হয়ে তৈরি হয়ে একটা বাটিতে কয়েকটা তেলের পিঠা নিয়ে নিলো। মাথায় সুন্দর করে ওড়না সেট করে নিয়ে বের হলো। শিউলি উঠান ঝাঁট দিতে দাতে বললো,

‘কোথায় যাওয়া হইতাছে এমন বেলা কইরে?’

পুতুল ঘড়ি দেখলো। এগারোটার বেশি বেজে গেছে। দ্রুত পা বাড়িয়ে বলল,

‘পারুলকে এই পিঠাগুলি দিয়ে আসি। যাব আর আসবো। দেরী করবো না বেশি।’
____________

মার্চ মাসের প্রায় শেষ। কাঠ ফাটা রোদ মাঠে ঘাটে। পুতুল এবার নাইনে উঠেছে। বিজ্ঞান বিভাগে সে। বিভাগ সিলেকশন নিয়ে খুব দোটানায় ছিল সে। তিহান তাকে ভরসা দেয়। পড়াশোনার ব্যাপারে তিহান তাকে নাইনটি পার্সেন্ট হেল্প করবে। বাকি টেন পার্সেন্ট পুতুলের নিজের উপর। পারুল মানবিক বিভাগে আছে। পড়াশোনার প্রতি তার মন উরু উরু। এভাবে আর যাই হোক সে কলেজ অবদি যেতে পারবে বলে পুতুলের মনে হয়না। পুতুল এ নিয়ে কিছু বললেই বলে,

‘জীবনটা ছোট বুঝলি! পড়াশোনার জন্যই যদি দিনের অর্ধেক সময় ব্যায় করি এত সুন্দর প্রকৃতিকে কখন উপভোগ করব?’

পুতুল হাল ছেড়ে দিয়েছে। একে দিয়ে পড়াশোনা সত্যিই হবে না। বেশ কিছুদিন হলো সুজনের সাথে পারুলের অন্যরকম সম্পর্ক লক্ষ্য করছে পুতুল। রোজ স্কুল শেষে সুজনের পারুলের জন্য অপেক্ষা করা! নদীর ওপারে বেড়াতে যাওয়া। স্কুল ফাঁকি দিয়ে ফুচকা খেতে যাওয়া এগুলো কোনো কিছুই পুতুলের চোখের অগচরে নয়। তবে পারুলকে এ ব্যাপারে বললে সে পুরোপুরি ভাবে ইগনোর করে। পুতুল আর আগ্রহ দেখায়নি। আগ্রহ না দেখালে পারুল নিজ থেকেই এসে তাকে সব জানাবে। অযথা সময় নষ্ট করে কি লাভ?
পারুলদের বাড়ি পুতুলদের থেকে কিছুটা দূরে। পারুলের মা তাকে পছন্দ করেন না বলেই ওদের বাসায় তেমন একটা যাওয়া হয়না পুতুলের। প্রায় ছয় মাস বা তারও বেশি হয়েছে সে শেষবার পারুলের বাড়িতে এসেছিল। পুতুল কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই বাড়ির ভেতর ঢুকল। পারুলের মা ঘরের সামনেই টুল পেতে বসেছিল। পুতুল সুন্দর করে সালাম দিলো। পারুলের মা উত্তর নিলেও কেমন চোখ করে যেন তাকালো। পুতুল তাতে পাত্তা দিলো না। এ পৃথিবীতে সবাই তোমাকে পছন্দ করবে এমন না। কিছু লোক তোমায় অপছন্দ করবে এটাই স্বাভাবিক।

‘পারুল‌ কোথায় চাচি?’

‘আছে ঘরেই। তুমি পুতুল না?’

‘হ্যা চাচি।’

পারুলের মা মাথা ঝাঁকালো। পুতুল বুঝলো না এখন তার কিছু বলা উচিত নাকি ভেতরে যাওয়া উচিত! তাকে এই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে বাঁচাতেই আগমন ঘটলো পারুলের। সে পুতুলের কন্ঠ শুনেই বের হয়েছে। পুতুলকে দেখেই দারুণ উচ্ছাসে লাফিয়ে উঠলো। পুতুলকে আর পারুলের মায়ের মুখামুখি হতে হয়নি। তাদের গল।প চললো প্রায় একটা পর্যন্ত। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন কত বছর পর একে‌ অপরকে দেখেছে।

____________

পুতুলের সাথে তিহানের দেখা হলো বিকেলে। সাথে পারুল ও ছিল। পারুলের সাথে ঘুরতে বের হবে বলেই বের হওয়া বাড়ি থেকে। তিহানের হাথে সুজনকে দেখে পুতুল মুচকি হাসলো। পুতুলের চোখ আটকালো তিহানের দিকে। এতদিন বাদে তিহানকে দেখে তার শ্বাস রোধ হয়ে এলো যেন। চোখ দুটো জ্বলছে। পুতুল ঠোঁট কামড়ে ধরলো। যাকে দেখার জন্য মন এত উতলা ছিল আজ তাকে দেখতে পেয়ে যেন সর্বাঙ্গ জমে গিয়েছে। পুতুল একচুল নড়ার শক্তি পেলো না। লোকটা আরো সুন্দর হয়ে গেছে। গায়ে সাদা রঙের পাতলা শার্ট। যার উপরের দুটো বাকন খোলা। পুতুল কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। এই লোককি এখানে নিজের বডি দেখাতে এসেছে?
তিহান অপলক তাকিয়ে। পুতুলকে আগের তুলনায় কিছুটা বড় লাগছে। একটু মোটাও হয়েছে হয়তো। তিহান পুতুলকে উদ্দেশ্য করে সুজনকে বললো,

‘তোর মনে হয়না এবার আমার বিয়েটা করে ফেলা উচিত? বয়স তো কম হলো না!’

চলবে……..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে