আনকোরা কাহিনী পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
48

#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট

দুলাভাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ভাইয়া তার দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বললো, ” কি লাভ পেলেন দুলাভাই? অন্যায় কাজে কি কোন শান্তি আছে? বরং আমায় বোনের জীবনটা উলোটপালোট হয়ে যাবে।”

দুলাভাই কিছু বললেন না। শরিফও মাথা নিচু করে আছে। ভাইয়া আমায় বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। নিজেও আমার পিছন পিছন বেরিয়ে এলো। এখন যা হবার তা কোর্টে হবে। পুলিশের হাতে তেমন কিছু নেই। বড় আপা কি এসব সহ্য করতে পারবে? ভাবতেও ভয় লাগছে।

” রাতুল, আইসক্রিম খাবি?”

” না, ইচ্ছে করছে না। বড় আপার কথা ভাবছি। আপা নিজেকে সামলাতে পারবে তো?”

” আপা খুব শক্ত মেয়ে। যে কোন পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার শক্তি তার আছে। চিন্তা করিস না। ”

” একটা কথা বলো তো। শরিফ সকালবেলা ভাবীকে কল দিলো কেন?”

” রাতে ওর মোবাইল দিয়ে শরিফকে কল দিয়েছিলাম। রিসিভ করেনি। মেয়েদের কন্ঠ শুনলে অনেক পুরুষ গলে যায়। এমনি খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য কল দিয়েছিলাম। দুলাভাই কি করছে না করছে। তখনও শরিফকে সন্দেহ করিনি। তাছাড়া তোর ভাবী তো খুব সুন্দরী। শরিফে মতো চরিত্রবান ছেলে সুন্দরী মেয়ে দেখলে গলে যায়। ”

” কিছু বুঝলাম না। ”

” কিছু বুঝতে হবে না। চল, হাসপাতালে যাবো। ”

” তুমি যাও। আমার একটু কাজ আছে। একজনের সাথে দেখা করতে হবে। ”

” কার সাথে? বান্ধবী নাকি?”

” না। আমার কোন বান্ধবী নেই। ”

” দেখি আপা সুস্থ হোক। তোর বিয়ে দিতে হবে। অনেক বড় হয়ে গেছিস। ”

ভাইয়া বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগছে না। এই ছেলে কি আমায়ও সন্দেহ করছে নাকি? নতুন গোয়েন্দাদের মাথায় নানা রকমের ভূত ঘোরে। যে কাউকে সন্দেহ করে বসে।ভাইয়াকে বিদায় দিয়ে থানায় ঢুকলাম। শরিফর কাছে গিয়ে বললাম,” শরিফ, একটা সত্যি কথা বলবে?”

” কি কথা? তুমি আবার ফিরে এলে কেন? সবই তো শুনলে। আর কিছু বাকি নেই।”

” আমার লাল শার্ট তুমি কোথায় পেলে? সত্যি কথা বলো।”

” তোমার ভাবীর কাছ থেকে নিয়েছিলাম। ”

” কিভাবে? ভাবী তোমায় আমার জামা কেন দেবে?”

” এতো কথা তোমায় বলবো কেন? ”

” পুলিশকে তো বলবে, দাঁড়াও ওদের ডাক দিচ্ছি। ”

” হাতি কাঁদায় পড়তে তেলাপোকাও লা’থি মা’রে। একটা শার্টের জন্যই তো তোমাদের বাড়িতে গেছিলাম। কিন্তু কার কাছে চাইবো বুঝতে পারছিলাম না। অবশ্য চু’রি করা যেত। কিন্তু তুমি তো মুরগির মতো ঘরে বসে থাকো। চু’রি করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তাই নিজের জামায় ইচ্ছে করে পানি ঢেলে দিয়ে তোমার ভাবীর কাছে একটা জামা চাইলাম। সে আমাকে ওই জামাটা এনে দিয়ে বললো,” এটা রাতুলের জামা। আমার কাছে ছিলো। দেওয়া হয়নি। এটা পরো। রাতুল কিছু বলবে না। ”

জামার ব্যাপারে ভাবীকে সন্দেহ করছিলাম। এখন আর সেই সন্দেহ নেই। হাসপাতালে যেতে হবে, ভাইয়া বোধহয় এতক্ষণে চলে গেছে।
ভেবেছিলাম ভাইয়া চলে গেছে কিন্তু না। ভাইয়া রাস্তার ওপাশে একটা দোকানে বসে চা খাচ্ছে। এই গরমে কেউ চা খায় নাকি!

সবকিছু জানার পর বড় আপা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শান্ত গলায় বললো, ” ওদের কেমন শা’স্তি হবে? ফাঁ’সি হওয়ার সম্ভাবনা আছে? ”

ভাইয়া বললো, ” না আপা। ফাঁ’সি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে যথাসম্ভব জোরালো শা’স্তি আবেদন করবো। ”

” ফাঁ’সি হলেই ভালো হতো। এদের মতো মানুষের জন্য বিধবা মেয়েরা শান্তিতে থাকতে পারে না। তিনুর মায়ের কথাটা একটু ভাব।”

“আপা, তুমি কষ্ট পাচ্ছো না?”

” না ভাই। পাচ্ছি না। বরং শান্তি লাগছে। মুক্তির শান্তি। ”

আপা কথা এতটুকুও মিথ্যে নয়। আপার চোখ-মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হয়তো কোন আশা খুঁজে পেয়েছে।
আপার সুস্থ হতে মাসখানেক লাগলো। তবুও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না। দুলাভাইয়ের কোন সুরাহা হয়নি। কে’সের তারিখ পিছিয়ে যাচ্ছে। আদালত রায় দিচ্ছে না। ওরা খুব নামকরা উকিল ঠিক করেছে। সে ওদের বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। মানুষ টাকার কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেয়! ভালো-মন্দ হিসাব করে না।

বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম। এমন সময় বড় আপা এসে আমায় ডেকে তুললো। আদুরে গলায় বললো, ” আমার সাথে একটু যাবি। বেশিক্ষণের কাজ না। ঘন্টাখানেক লাগবে। ”

” কোথায় যাবে? তুমি তো এখনও সুস্থ হওনি।”

” ও বাড়িতে যাবো। কিন্তু জিনিস আনতে হবে। ”

বড় আপা খুব জেদি। একবার কিছু বললে না করা পর্যন্ত শান্ত হয় না। তাই তাকে না করার সুযোগ হলো না। নীল শার্টটা গায়ে ঝুলিয়ে আপার সাথে গেলাম। ও বাড়িতে গিয়ে আপা কারো সাথে কথা বললো না। সোজা নিজের ঘরে ঢুকে সোনার গহনাগাঁটি ব্যাগ ভরতে লাগলো। আপা শাশুড়ি তেড়ে এসে তীক্ষ্ণ গলায় বললো, ” এসব নিচ্ছিস কেন? এসব কি তোর বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিস?”

” হ্যাঁ। এগুলোর বেশিরভাগ জিনিস আমি বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। শুধুমাত্র এগুলো নয়। আপনার বসার ঘরে পাতানো সুন্দর সোফাটা আমার বাবার দেওয়া। রান্নাঘরের গ্যাসের চুলা থেকে বেশিরভাগ জিনিস আমি বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। আজ তো শুধু গহনা নিয়ে যাচ্ছি। দু’দিন পর এসে এগুলোও নিয়ে যাবো। এছাড়া তিন লাখ টাকা রেডি রাখবেন। আপনার ছেলেকে ব্যবসার জন্য এনে দিয়েছিলাম। ”

আপার শাশুড়ি খানিকটা দমে গেলো। স্বর নিচু করে বললো, ” মাইয়া গো জীবনে স্বামীই সব। ঝগড়া সংসারের বাতির মতো। সবকিছু ভুইলা তুমি এ বাড়িতে চলে আসো। আমরা তো তোমায় ভালোবাসি। ”

” না, আপনারা আমায় ভালোবাসেন না৷ একটা সন্তান হওয়া নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছেন। কত কবিরাজ ওঝার কাছে নিয়ে গেছেন। অথচ সমস্যার আপনার ছেলের। যাইহোক পুরনো কথা তুলতে চাই না। সত্যি কথা কি জানেন, কাঁচা লোহা বেশি পিটালে অ’স্ত্র হয়ে যায়। পরেরবার থেকে সাবধানে থাকবেন। আসি। ”

আপা আর কোন কথা বললো না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। আমি অবাক হয়ে আপাকে দেখছি। মানুষটা কতটা বদলে গেছে। এই আপা একসময় শশুরবাড়ির জন্য পাগল ছিলো। প্রতি রোজায় ইফতার, দুই ঈদে জামাকাপড়। কোন কিছু বাদ যেতো না। বাবা মা’রা যাওয়ার পর থেকে ভাইয়া সবকিছু দিয়ে এসেছে। মানুষ কত বদলে যায়।

” কাল একটু থানায় যাবি? কাজ আছে।”

” দুলাভাইয়ের সাথে দেখা করবে? ”

” তালাকনামা চাইবো। ”

বহুদিন বাদে আপা খুব সুন্দর করে সেজেছে। পরনে হালকা গোলাপি শাড়ি, খোঁপায় বেলি ফুলের মালা, দুটো কাঁচা গোলাপ বসানো। আপা একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে। চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া কোন মেয়েকে এতো সুন্দর দেখায় জানা ছিলো না। বাড়িতে ভালো-মন্দ রান্না হচ্ছে। কোন অনুষ্ঠান আছে নাকি কে জানে। ভাবী আমায় আড়ালে ডেকে নিয়ে বললো, ” আজ বড় আপাকে দেখতে আসবে। তুমি ভালো কিছু পরে নাও। বাজারের গিয়ে মিষ্টি নিয়ে এসো। ”

” আপার বিয়ে ঠিক করলো কে? তাছাড়া পাত্র কে?”

” তোমায় ভাইয়ের কলিগ। মিরাজ সাহেব। লোকটা বেশ ভালো। প্রথম বউ মা’রা গেছে। কোন ছেলে-মেয়ে নেই। এখানেই বাসা ভাড়া করে থাকে। ”

” আপা রাজি?”

” হুম। যারা কষ্ট দেয় তাদের জন্য অপেক্ষা করতে নেই। ফিরে যাওয়াটাও বোকামি। যাইহোক।”

মিরাজ সাহেব আসলেই বেশ ভালো মানুষ। হাসিখুশি। সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আপার দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে, পরক্ষণে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। আগের দুলাভাই মাস চারেক আগে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছিলো। সে সময় আপা একটুও কাঁদেনি। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলো। জীবন কত বিচিত্রময়! মানুষ কতশত স্বপ্ন দেখে কিন্তু তার বেশিরভাগ বাস্তবে ধরা দেয় না৷ আপা ওই খারাপ মানুষটাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালেবেসেছে। জীবনের সবকিছু উজাড় করে তার সাথে সুখী হতে চেয়েছে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। আচ্ছা আপার জীবনটা কি অন্য রকম হতে পারতো না? হয়তো পারতো, নয়তো পারতো না।

কোন এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় আপার সাথে মিরাজ ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলো। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। এ বাড়িতে ওদের বাসর হবে। ছোট আপা অকারণে ছোটাছুটি করছে। তার বয়স বেশ অনেকটা কমে গেছে। বৃষ্টির মধ্যে আমায় দোকানে পাঠালো। ফুল আনতে হবে। বাসরঘর ফুল ছাড়া মানায় না। কাগজের ফুল হলে হবে না। কাঁচা ফুল আনতে হবে। ফুল খুঁজে পেতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হলো। বৃষ্টিতে ফুলের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। অবশেষে কাক ভেজা অবস্থায় বাড়ি ফিরলাম। ছোট আপা দৌড়ে এসে বললো, ” ফুল এনেছিস? এতো দেরি করলি কেন? রাত শেষ হলে ঘর সাজাবো নাকি? ”

” এনেছি৷ ”

ছোট আপা আমার হাত থেকে ফুলের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো। আমার দিকে ফিরে তাকানোর সময় হলো না তার। সকলে বসার ঘরে গল্প করছে৷ ভাবী কারণে অকারণে হাসছে৷ মা’য়ের চোখের কোণে অশ্রু টলটল করছে। বারবার আঁচলে চোখ মুছছে। শুধুমাত্র ছোট আপা এখানে নেই৷ সে ঘর সাজাচ্ছে। কি এমন ঘর সাজাচ্ছে দেখতে সেদিকে উঁকি দিলাম। ছোট দুলাভাই আমায় দেখে বেশ লজ্জা পেলো। তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ছোট আপা স্বাভাবিক গলায় বললো, ” সাজানো শেষ। দেখ তো কেমন হয়েছে। ”

ঘরটা সত্যিই খুব সুন্দর করে সাজানো। বিছানায় আকাশী রঙের চাদর। তাতে সাদা আর লাল ফুলের কাজ। পাশের টেবিলে ফুলদানি ভর্তি গোলাপ ফুল। খাটের কোনায় রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে। ঘরের চারকোণায় চারটে ঘিয়ের প্রদীপ। আবছা আলোয় ঘরটা একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে। কে বলছে অপ্রকাশিত ঘটনায় জীবন থেমে যায়? জীবন তো কখনও থামে না। নদীর মতে বয়ে চলে। পাহাড় জঙ্গল ছাড়িয়ে সাগরের খোঁজে। সাগরটাই বুঝি সব সুখের নীড়!

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে