বিষাদময় নিষাদ পর্ব-১+২

0
6227

#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০১+০২
জাহান আরা

কবুল বলার ঠিক পরমুহূর্তেই বাহিরে শোরগোল উঠলো পাত্র বদল হয়ে গেছে। যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে এই সেই ছেলে না।
চন্দ্রর মুখের হাসি নিমিষেই বিষাদে রূপ নেয়,কাঁপা কাঁপা হাতে পার্স থেকে ফোন বের করে,” দ্যা গেম ইজ ওভার,আই হ্যাভ ওন”

মেসেজটি দেখেই “না” বলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে মূর্ছা যায় চন্দ্র মুহুর্তেই।

মূর্ছা যেতে যেতে চন্দ্র শুনতে পায় বাহিরে আম গাছে কোকিলের কুহুতান শোনা যাচ্ছে,যেনো চন্দ্রের অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে কোকিল সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে।কোকিলের কুহুতানে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ছে যেনো।
কোকিলটা এতো বেশি আনন্দিত কেনো?
ভাটফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ ভেসে আসছে বহুদূর থেকে,এই ইট-পাথরের রাজ্যে ভাটফুল আসবে কোথাথেকে?
ভাটফুল তো ফেলে এসেছে গ্রামের বাড়িতে।ফেলে এসেছে এক আনন্দিত শৈশব,সেই শৈশব অল্পকিছু দিনের যদিও,তবুও সেটা কেমন জ্বলজ্বল করছে স্মৃতির পাতায়।
ভাটফুলের ঘ্রাণ আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়,চন্দ্র প্রবেশ করে যেনো এক হিমশীতল ঘরে,যেনো যুগের পর যুগ কেউ পরম যত্নে বরফ পুড়িয়ে পুড়িয়ে এই ঘরকে আরো শীতল করে তুলেছে।
কি সব ভাবছে চন্দ্র এসব?
বরফ কি পোড়ানো যায়?
এরকম অসংলগ্ন চিন্তাভাবনা কেনো জড় হচ্ছে মাথায় তার,সে কি মরে যাচ্ছে না-কি?
চন্দ্রর হাত পা সব ঠান্ডায় জমে আসাড় হয়ে গেছে।
আস্তে আস্তে চারদিক নিরব হয়ে যায়।

এয়ারকন্ডিশানারের শীতল হাওয়া বইছে রুমে,তারপরেও চন্দ্রর নানী হাতপাখা দিয়ে চন্দ্রকে বাতাস করছে,রাহেলা ছুটে গিয়ে তেল পানি নিয়ে এসেছে চন্দ্রর মাথায় দেয়ার জন্য।
চন্দ্রর খালা নাজনীন বেগম লাফিয়ে উঠলেন রাহেলার হাতে তেল পানি দেখে।
“তোর আক্কেল দিয়ে কি শরবত বানিয়ে খেয়ে নিয়েছিস না-কি রাহেলা?
মেয়েটা এতো সুন্দর করে সেজেগুজে এসেছে পার্লার থেকে,তুই কি-না ওর মাথায় সরিষার তেল দিতে এসেছিস,বলি ওর সাজগোজের কি অবস্থা হবে এখন,চুলের শেপ নষ্ট হয়ে যাবে যে এই সহজ বিষয় টা কি তোর মোটামাথায় ঢুকে না?”

“খালাম্মা,এইডা আপনে কি কইলেন?
আমি কি ২ লম্বরি তেল আনছি আপার লাইগা?
এই তেল আমাগো গেরামের সফুরা বুড়ির পড়া তেল,এককোষ তেল মাতাত দিলেই দেখবেন চন্দ্র আপা শোয়া থাইকা উইঠ্যা খারাইয়া যাইবো,এই রাহেলা অরজিনাল জিনিস ব্যবহার করে,গরিপ অইতে পারি কিন্তু রুচি নিচু না, বুইঝলেন খালাম্মা?”

নাজনীন বেগমের দুই চোখ বড় বড় হয়ে গেছে,তিনি বসা থেকে উঠে দাড়ালেন,ঝগড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মনে মনে।
চন্দ্রর নানী আনোয়ারা বেগম অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে উঠে দাঁড়ালেন,তারপর রাহেলা কে বললেন,”রাহেলা,তেল নিয়ে যা এখান থেকে,তোর কোনো তেলতুল দিতে হবে না যা,শুধু পানি আন তুই।”

“মিনারেল ওয়াটার আনবি বুঝলি?”
নাজনীন বেগম মনে করিয়ে দেয় আবার।

রাহেলার ইচ্ছে ছিলো নাজনীন বেগমের সাথে আরো একদফা ঝগড়া করতে,কিন্তু এখন চন্দ্র আপার শরীর অসুস্থ তাই রাহেলা আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়,এই বাসায় এই একটা মানুষ আছে যাকে রাহেলা অসম্ভব ভালোবাসে,শ্রদ্ধা করে।
নাজনীন বেগম রাহেলার দুই চোখের বিষ,সুযোগ পেলেই এই মহিলা ক্যাটক্যাট করে কথা শোনায় বাসার সব মানুষকে,চন্দ্র আপার মতো একটা পরীর মতো মেয়েরেও ছাড় দেয় না।
রাহেলার ইচ্ছে করে মাঝেমাঝে সফুরা বুড়ির একটা পালা জ্বিন নাজনীন বেগমের উপর ছাইড়া দিয়া তামাশা দেখতে।

রাহেলা পানি নিয়ে আসতেই নাজনীন বেগম জিজ্ঞেস করে,”মিনারেল ওয়াটার এনেছিস তো?”

“না,ডিস্টিল ওয়াটার আনছি।”

নাজনীন বেগম আরো রেগে যায়,বিরসবদনে রাহেলা জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকায়,বাহিরে পাশের বিল্ডিংয়ের বাথরুমের পাইপ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
খুব একটা আকর্ষণীয় দৃশ্য না এটা,তবুও রাহেলা গভীর মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
বাথরুমের একটা পাইপে ছিদ্র হয়েছে,ঝিরঝির করে পানি পড়ছে সেখান থেকে,সেই পানি সাদা দেয়ালে পড়তে পড়তে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে সাদা দেয়াল।

মুখে পানিই ছিটকা দিতেই চন্দ্রর জ্ঞান ফিরে আসে। হতভম্ব হয়ে তাকায় চন্দ্র উপস্থিত সবার দিকে।
নানী,খালা,চাচী আরো অনেক মেহমান উপস্থিত রুমে,এক মুহূর্ত লাগে চন্দ্রর মনে করতে সবকিছু।

“চন্দ্র রে,কি জামাই পাইলি রে তুই,সোনার টুকরা জামাই,একেবারে রাজকুমার যেনো বুঝলি,আমি তো পাত্রবদলের কথা শুনে কোমরে আঁচল গুঁজে গেছি ছাঁদে ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে,মামাবাড়ির আবদার নাকি যে ওরা পাত্র বদল করে দিবে,গিয়ে তো দেখি জামাই বাবাজী যেনো রাজকুমার,কি সুন্দর লম্বা লম্বা সিল্কি চুল,তোর আর জামাইয়ের দেখিস শ্যাম্পু কন্ডিশনার নিয়ে ঝগড়া হবে খুব।
হিরের টুকরো একটা ছেলে,যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছিলো সে তো একটা আলকাতরার ড্রাম ছিলো।আর তোর শ্বশুরের কথা কি বলবো,বুড়ো বয়সেও এতো স্মার্ট!
এবার তোদের ২জনকে খুব মানাবে বুঝলি।একদম হিরের খনি পেয়েছিস তুই রে চন্দ্র”

চন্দ্র হতাশ হয়ে তাকায় বাহিরের দিকে,দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে চন্দ্র কান্না রুখতে। ভিতরটা রাগে,ক্ষোভে ফেটে পড়ছে যেনো।হেরে গেলো সে!

কোকিলের কুহুতান আবারও শোনা যাচ্ছে।হঠাৎ করেই চন্দ্রর মনে হলো কোকিলের কুহুকুহুর চাইতে কাকের কা কা শব্দ আরো বেশি শ্রুতিমধুর।
মানে হয় কোনো এরকম উদ্ভট ভাবনার?
চন্দ্র বুঝতে পারে না।

——————-

হাসনাত সাহেব বসে আছে একটা চেয়ারে,হাতে কোল্ড ড্রিংকসের বোতল।এক চুমুক দিচ্ছেন আর চারপাশে তাকিয়ে দেখছেন,তিনি বেশ উত্তেজনা অনুভব করছেন ব্যাপার টা তে,একসময় তার ও ইচ্ছে ছিলো এভাবে বিয়ে করার,মনোয়ারা কে তুলে নিয়ে যাওয়ার,কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস,মনোয়ারার বাসায় প্রস্তাব দিতেই তারা মেনে নিলো,হাসনাত সাহেব আর পারলেন না এরকম কিছু করতে।
এখন ছেলের বিয়েতে সেই আনন্দ উপভোগ করছেন।
মনে মনে নিজেকে বার কয়েক বাহবা দিলেন তিনি।
কি ছেলে জন্ম দিয়েছেন দেখতে হবে না,এরকম সাহস আজকের দিনে কয়জন দেখাতে পারে?
জেলার রাজনৈতিক দলের সভাপতি হয়ে তার ছেলে কি সাহসের কাজটাই না করলো!
মনোয়ারা বেগম কে ভিডিও কল দিলেন হাসনাত সাহেব,মনোয়ারা বেগম রিসিভ করতেই হাসনাত সাহেব একগাল হেসে বলে উঠেন,”বুঝলে মনু,জীবনে আজকে একটা একসাইটিং কাজ করতে এসেছি বাপ-বেটা মিলে,আরেকজনের বউ চুরি করে নিয়ে আসছি নিষাদের জন্য,বুঝতে পারছো না তুমি কি থ্রিলিং ব্যাপারস্যাপার,তুমি বাসায় সব রেডি করো,বাসর সাজানোর ব্যবস্থা করো।”

মনোয়ারা বেগম বিরক্তিতে ব্রু কুঞ্চিত করে বলেন,”তোমাকে নিষেধ করেছি না আমাকে মনু বলে ডাকবে না যেখানে সেখানে?
বিয়ে করেছে আমার ছেলে,তুমি এতো খুশি কেনো?”

“আরে মনু,তুমি বুঝতে পারছো না কি পরিমাণ খুশি আমি আজ,এখানে এসে বউমার এক খালা কে দেখেছি,মহিলা দেখতে খুবই সুইট,আর ব্যবহার তো আরো অমায়িক,আমাকে কি সুন্দর করে বেয়াই সাহেব বলে পান বানিয়ে দিলো।”

মুহূর্তেই মনোয়ারা বেগমের ফর্সা গাল লাল হয়ে উঠলো,নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
হাসনাত সাহেব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন,এই তেজস্বিনী চেহারায় প্রেমে তিনি হাজার বার পড়েছেন,আজীবন পড়তে চান।
মনোয়ারা বেগম খট করে কল কেটে দিলেন।

হাসনাত সাহেব আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলেন।
বয়স বাড়লেও মনের বয়স বাড়ে না,সেখানে সে আজীবন যৌবনের অধিকারী,বুড়ো বয়সেও কোনো স্ত্রী স্বামীর ভাগ দিতে পারে না,স্বামীর মুখে পরনারীর কথা সহ্য করতে পারে না।
ভালোবাসা বিষয় টা কি অদ্ভুত!
ভাবতেই ভালো লাগছে হাসনাত সাহেবের।এতো সুখী কেনো তিনি!

সোফায় আরাম করে বসে আছে নিষাদ,হাঁটুতে পাগড়ি রাখা।নেভী ব্লু শেরওয়ানীতে নিষাদকে লাগছে রাজকুমারের মতো।একমাথা সিল্কি চুল নিষাদের যেকোনো মেয়ের জন্য ঈর্ষাজনক।
আপাতত বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে নিষাদ,কপাল বেয়ে নাকে নেমে এসেছে রেশমের মতো কোমল চুলগুলো।

ভিতরে জয়ের আনন্দ,প্রাণখুলে হাসতে ইচ্ছে করছে নিষাদের,কিন্তু হাসছে না নিষাদ।আজ সে জিতে গেছে,নিষাদ এতোটা আনন্দ পায় নি কখনো আজ যতোটা পাচ্ছে।
নিষাদ কে কেউই কিছু বলছে না,সবাই কেমন শ্রদ্ধার চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে।
বিশেষ করে নিষাদের শ্বশুর রশিদ সাহেব কেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বারবার তাকাচ্ছে নিষাদের দিকে,বারবার স্যার স্যার বলছে।
রশিদ সাহেব আবার এসে নিষাদের পাশে দাঁড়ালো,বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করে,”স্যার কিছু লাগবে আপনার?”

নিষাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়,তারপর রশিদ সাহেবের দুইহাত চেপে ধরে বলে,”বাবা,আমাকে স্যার স্যার বলে কেনো লজ্জা দিচ্ছেন বলেন তো?
আমি আপনার মেয়ের জামাই,আপনার সন্তানের মতো,আমাকে আপনি নাম ধরে বলবেন,স্যার বলে ডেকে আমাকে লজ্জা দিবেন না প্লিজ।”

রশিদ সাহেব কিছুটা ইতস্তত করে বলেন,”আপনি এতো বড় একজন মানুষ,একজন রাজনীতিবিদ,ভবিষ্যতে আপনি আরো বড় পর্যায়ে যাবেন জেলার সভাপতি থেকে,আমার মতো ছাপোষা মানুষের মুখে আপনার নাম মানায় না।”

“আপনি আমার নাম ধরে না বললে আমি যে শান্তি পাবো না বাবা,আমার মনে হবে আপনি আমাকে মেনে নিতে পারেন নি বাবা,অন্য মানুষের কাছে আমি রাজনীতিবিদ হতে পারি,আপনার কাছে আপনার সন্তান হতে চাই আমি।”

গর্বে রশিদ সাহেবের বুক ভরে যায়,এরকম ভদ্র,নম্র,বিনয়ী আজকাল দেখা যায় না,যেখানে রাজনীতির সাথে জড়িত সবার চরিত্র কলুষিত সেখানে নিষাদ এক ভরসার নাম রশিদ সাহেবের কাছে,নিজের ছেলেকেও তিনি বলতেন সবসময়,মানুষ হলে নিষাদের মতো হও,যেমন মেধাবী তেমন দয়াবান।
সেই ছেলেটি আজ তার মেয়ের জামাই,কতোবড় পাওয়া এটা তার ভাবতেই আনন্দ লাগে।

ভয় ও হয় আবার রশিদ সাহেবের। চন্দ্র নিষাদের বিরোধী দল সাপোর্ট করে। সবসময় নিষাদের বিরুদ্ধে থাকে,কেমন যেনো একরোখা মেয়েটা,সবসময় নিষাদের দোষ খুঁজে বেড়ায়,নিষাদ চন্দ্রর সম্পর্ক সাপেনেউলে,এদের সংসার কি টিকবে?
নিষাদ যদি ভিতরের কোনো কোন্দল মেটানোর জন্য অথবা চন্দ্রকে শাস্তি দেয়ার জন্য বিয়ে করে তাহলে কি হবে?

করুণ চোখে তাকায় রশিদ সাহেব নিষাদের দিকে।নিষাদ রশিদ সাহেবের চোখের ভাষা বুঝতে পারে। ২হাত ধরে টেনে নেয় প্যান্ডেলের অন্যপাশে।
তারপর বলে,”আমি জানি আপনি হয়তো ভাবছেন আমি নিজের রাজনৈতিক পথ পরিস্কার রাখতে,চন্দ্রর মুখ আটকাতে ওকে বিয়ে করেছি,বাকীজীবন আপনার মেয়েকে অত্যাচার করবো তার কৃতকর্মের জন্য,আপনি ভুল বুঝবেন না আমাকে বাবা,এরকম কিছুই হবে না।
এটা শুধু মাত্র একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো,চন্দ্রকে আমি কখনোই কোনোকিছুতে নিষেধ করবো না,ও চাইলে আগামীকাল থেকেই আমার বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করতে পারে,আমি ওর ব্যক্তিগত জীবনে কখনো হস্তক্ষেপ করবো না।”

চলবে,

#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০২
জাহান আরা

চন্দ্র বিছানার একপাশে বসে আছে কাঠ হয়ে,নিষাদ ল্যাপটপে কাজ করছে।
নিষাদের রুমের দিকে ভালো করে তাকায় চন্দ্র,রুমের কোথাও কোনো অগোছালো নেই,কেমন সাজানো গোছানো শান্ত পরিবেশ।পুরো রুম গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো,সব সাদা গোলাপ।
বাহিরে কোকিল ডাকছে অনবরত,মেজাজ খারাপ হয়ে যায় চন্দ্রর,এই হতচ্ছাড়া কোকিল মজা নেয় তার দুরবস্থা দেখে।

খোলা জানালা দিয়ে দখিনা বাতাস আসছে,কি শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। এই রাতটা চন্দ্রর একটা গুরুত্বপূর্ণ রাত হওয়ার কথা ছিলো অথচ চন্দ্র বসে আছে একপাশে আর নিষাদ অন্যপাশে।

ব্যাগ থেকে নিজের ফোন বের করে নেয় চন্দ্র,তারপর অনিককে কল দেয়,ভিতরের আগুন নেভে নি চন্দ্রর এখনো।আজ তার আর অনিকের বিয়ে হতো,চন্দ্র অনিকের কাছে থাকতো,তার ৪মাসের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতো,অথচ কিছুই হয় নি।
কপালের রগ দপদপ করছে রাগে,জিদে।
এই একটা লোক তাকে সবকিছুতে টেক্কা দিয়ে যায়।সে ছাড়া সবার কাছে নিষাদ মহাপুরুষ যেনো।

অনিকের ফোন অফ।
চন্দ্র ফেসবুকে লগ ইন করে,অনিককে একটিভ পায়,সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় অনিকের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ম্যারিড দেওয়া দেখে।
মানে কি এসবের!
অনিক বিয়ে করেছে?
বুকের ভিতর প্রলয় নৃত্য শুরু হয়,চন্দ্র বুক চেপে ধরে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে।
কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না চন্দ্রর,অনিক তাকে এতো বেশি ভালোবাসতো অথচ সেই অনিক কি-না বিয়ে করে নিয়েছে!
দ্রুত টেক্সট করে চন্দ্র অনিককে,”কেনো এরকম করেছো অনিক?”

সাথেসাথে রিপ্লে আসে অনিকের আইডি থেকে,”কেমন করেছি?”

“আমার ভালোবাসার সাথে বেঈমানী করেছো,বিয়ের কথা ছিলো আমাদের আজকে,অথচ তুমি আসো নি,আমার বিয়ে হয়েছে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি তার সাথে,কেনো এরকম নাটক করলে তুমি?
অন্তত তুমি তো জানতে আমি তোমাকে কতো ভালোবাসি অনিক।”

“তোমার ভালোবাসার মূল্য দিতেই আজ তোমার বিয়ে নিষাদের সাথে হয়েছে চন্দ্র,তুমি আসলে কাকে ভালোবাসো তাই বুঝোনি।”

“তোমাকে আমি খুন করে ফেলবো অনিক শুধু একবার সামনে পাই তোমায়।”

“চেষ্টা করে দেখতে পারো।আসছি এখন,আজ আমি ও বিয়ে করেছি,বাসর আজ আমারও।”

“একটা প্রশ্ন শুধু।”

“বলো?”

“তুমি কি আমাকে ভালোবাসো নি কখনো অনিক?
এই ৪মাসের সম্পর্কে আমার জন্য তোমার একটুও দয়া হয় নি?”

“আমার এখন গুছিয়ে বলার মতো সময় নেই চন্দ্র,একদিন সময় করে সব বলবো কেনো এরকম হলো,আজ থাকুক,গুড নাইট।”

চন্দ্র কিছু বলার আগেই অনিক চন্দ্রকে ব্লক দিয়ে দিলো।মুহুর্তেই পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেলো চন্দ্রর।অনিক তাকে ধোঁকা দিয়েছে!
বুকের ভিতর একটা চিনচিনে ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না চন্দ্র যাকে ভালোবেসেছে সে এভাবে প্রতারণা করতে পারে তার সাথে।

চন্দ্রর মনে পড়ে যায় অনিকের কথা,ফেসবুকে কেমন হুট করে ওদের পরিচয় হয়,তারপর প্রেম।
একটা চ্যাট গ্রুপ থেকে অনিকের সাথে চন্দ্রর পরিচয় হয়,গ্রুপে সবচেয়ে বেশি কথা বলতো চন্দ্র,আর সবচেয়ে কম কথা বলতো অনিক।
গ্রুপ কলে অনিক একদিন ও কথা বলে নি সামান্য হায়,হ্যালো,হু,হা ছাড়া।
চন্দ্রর মনে পড়ে চন্দ্রর বকবকানি শুনতে শুনতে সবাই কল থেকে চলে যেতো,শুধুমাত্র মনোযোগী শ্রোতা হয়ে সব শুনতো অনিক।
বেশিরভাগ কথাই চন্দ্রর অপ্রয়োজনীয়,উদ্ভট,তাও অনিক শুনতো সব।
এই চুপচাপ থাকা ছেলেটাকে চন্দ্রর ভালো লাগতে শুরু করে,চন্দ্র নিজেই অনিকের প্রেমে পড়ে যায়।
অনিককে দেখার ও দরকার মনে করে না।

হুট করেই একদিন গ্রুপকলে সবার সামনে প্রপোজ করে বসে অনিককে চন্দ্র,সেদিন অনিক ভীষণ গম্ভীর হয়ে যায়,তারপর থমথমে গলায় বলে,”তোমার এরকম হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া উচিৎ হয় নি চন্দ্রাবতী,বিশেষ করে আমাকে এখনো দেখোই নি তুমি,আমাকে আগে দেখো একবার। ”

সেদিনই অনিক তার ছবি পাঠায় চন্দ্রকে, ছিপছিপে গড়নের শ্যামলা ছেলেটি।চন্দ্র ভালো করে দেখেও না অনিককে,সে তো অনিকের চেহারার প্রেমে পড়ে নি,অনিকের ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছে।
একমাত্র অনিকই পারতো চন্দ্রকে প্রয়োজন অনুযায়ী শাসন করতে,আবার মিষ্টি করে কথা বলতে।
আকুল হয়ে প্রেম নিবেদন করে চন্দ্র অনিককে,সেদিন নিজের কাছে নিজেকেই অচেনা মনে হয়েছে চন্দ্রর,একটা ছেলেকে সে এভাবে চাইছে কেনো তা ভেবে ও অবাক হয়েছে চন্দ্র।
ফিরিয়ে দেয় নি অনিক সেদিন চন্দ্রকে,দেখা হতো খুব কম,৪মাসে ২বার দেখা করেছে দুজন।
হাজার ও স্বপ্ন দেখেছে চন্দ্র অনিককে নিয়ে,সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে অনিক শেষ সময়ে এসে হাত তুলে নিয়েছে সম্পর্ক থেকে।
কাকে বিশ্বাস করবে দুনিয়াতে?
সবাই তো ধোঁকা দেয়।

মাথায় যেনো আগুন জ্বলে উঠে চন্দ্রর,বিছানায় উঠে দাঁড়িয়ে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে সব ফুল,নিষাদ তাকিয়ে থাকে চন্দ্রর দিকে।
চিৎকার করে কাঁদতে থাকে চন্দ্র,”সব মিথ্যে,সব ছলনা” চিৎকার করে বলতে থাকে চন্দ্র।
বুকের ভিতর ভীষণ জ্বালাপোড়া শুরু হয় চন্দ্রর,গতরাতে ও যেই ছেলেটা সারারাত তার সাথে চ্যাটিং করেছে,সেই ছেলেটা আজ অন্যকারো সাথে ব্যস্ত মধুর সময় কাটাতে,রোমাঞ্চ করতে।
বুকে ব্যথা শুরু হয় চন্দ্রর,ঠোঁট কামড়ে ব্যথা চাপা দেয়ার মিথ্যা চেষ্টা করে চন্দ্র।
ব্যাগ হাতড়ে দেখে স্প্রে টা রেখে এসেছে।

নিষাদের দিকে তাকায়,নিষাদ ফোন মুখের উপর নিয়ে বসে আছে।চন্দ্রর মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা বুঝি বুক ছিঁড়ে বের হয়ে আসবে,কি কষ্ট হচ্ছে তার কাকে বলবে?
এই অমানুষটা তার দিকে তাকানোর প্রয়োজন ও মনে করছে না একবার।বুকের ব্যথায় যে চন্দ্রর প্রাণ বেরর হয়ে যাওয়ার উপক্রম তাও দেখছে না এই পাষণ্ড লোক!
চন্দ্র ও ঠিক করে রাখে কিছুতেই নিষাদকে বলবে না,তাতে প্রাণ যায় তো যাক।

ফোনের ব্যাক ক্যামেরা অন করে নিষাদ চন্দ্রকে দেখছে,চন্দ্র দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে আছে,কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
বড় করে শ্বাস নিচ্ছে চন্দ্র,নিষাদ প্যান্টের পকেট থেকে স্প্রে বের করে,তারপর ছুঁড়ে মারে বিছানায়।
তারপর আবার ক্যামেরা দিয়ে চন্দ্রকে দেখে,সরাসরি চন্দ্রর দিকে তাকাতে নিষাদের কেমন যেনো বিব্র‍ত লাগছে।
এই মেয়েটা অল্প একটু চাপ নিলেই কেমন অসুস্থ হয়ে যায় তা নিষাদের চাইতে ভালো কে জানে?

জিহবার নিচে স্প্রে করে চন্দ্র চুপ করে বসে থাকে,আস্তে আস্তে বুকের ব্যথাটা কমে আসে,চন্দ্র স্থির হয়ে বসে।তারপর আবার ফোন বের করে,নিষাদকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেও ফোন টিপে।

হেরে যাওয়ার ব্যর্থতা চন্দ্রকে কেমন নিশ্চুপ করে দেয়।

নিষাদ এসে চন্দ্রর পাশে বসে।একটা বালিশ কোলে তুলে নিয়ে চন্দ্রকে বলে,”চন্দ্র,আমার প্রতি তোমার এতো ক্ষোভ কেনো?
আমি হাজারবার বলেছি তোমাকে,তুমি যা ভেবেছো তা আমি করি নি,তবু এরকম অহেতুক রাগ পুষে রেখে কি লাভ?
আমার বিরোধী দলে যোগদান করেছো তুমি তুচ্ছ একটা কারণে,বিষয়টা খুবই ছেলেমানুষীর হয়ে গেছে না চন্দ্র?”

চন্দ্রর চোখ বড়বড় হয়ে উঠে,দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,”তোর জন্য আমার এক্সাম খারাপ হয়েছে,আর তুই আমাকে বলছিস তুচ্ছ বিষয় এটা?
আমি ইন্টার এক্সামে ফেইল করেছি তোর কারণে,আর এখন আসছিস তুই আমার কাঁটা ঘায়ে লবণের ছিটা দিতে?”

নিষাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,তারপর বিড়বিড় করে বলে,”এখনো বাচ্চা রয়ে গেছো তুমি,একদিন বুঝবে ঠিকই।”

তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।

চন্দ্র বাকি রাত কাটায় জেগে থেকে,নিষাদকে সে একটুও বিশ্বাস করে না,যেকোনো সময় নিষাদ স্বামীর অধিকার দেখানোর চেষ্টা করতে পারে,এই ভয়ে চন্দ্র ঘুমাতে পারে না আর।
বারবার মনে পড়ছে চন্দ্রর অনিকের কথা,অনিক এখন কি করছে?
নতুন বউয়ের শরীরের ভাজে ভাজে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছে কি?
অন্যকারো চুলের ঘ্রাণে মাতাল হচ্ছে অনিক?
অন্যকারো ঠোঁটের সুধা পান করছে অনিক?
অনিক কিভাবে পারলো তাকে এভাবে ধোঁকা দিতে?

ভাবতেই চন্দ্রর চোখ জ্বালা করে,খামচে ধরে নিজের মাথার চুল,তারপর উপুড় হয়ে কাঁদতে থাকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে।
একটা কালবৈশাখী তার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে।

চলবে….???

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে